1 September 2018

শিক্ষা প্রসঙ্গঃ নৈতিক শিক্ষা, কর্মমুখী কারিগরি শিক্ষা এবং শিক্ষাগ্রহণের উপায়


বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা অতিক্রম করছে এক ভয়াবহ ক্রান্তিলগ্ন। একদিকে দেশে বাড়ছে শিক্ষার হার, আরেকদিকে শিক্ষিত সমাজ ভুলে যাচ্ছে শিক্ষার উদ্দেশ্য। শিক্ষার হারের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে শিক্ষিত বেকার এবং প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি। প্রচলিত শিক্ষায় নৈতিক শিক্ষা এবং কর্মমুখী কারিগরি শিক্ষার অভাব এর প্রধান কারণ। নৈতিক শিক্ষার অভাব থাকলে মানুষ যতই শিক্ষার সার্টিফিকেট পাক না কেন দেশ পিছিয়েই থাকবে। কর্মমুখী কারিগরি শিক্ষা না থাকলে শিক্ষিত লোকেরা কেবল চাকরি করতে চাইবে। নিজেরা কিছু করার মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখার পরিকল্পনা বা ঝুঁকি কোনোটাই তারা নেয়ার জন্য প্রস্তুত থাকবে না। আর এরসাথে যুক্ত করতে হবে সাংস্কৃতিক শিক্ষা। মানুষের শুভসত্তাগুলো চর্চার মাধ্যমে শিক্ষা পাবে তার পূর্নাঙ্গতা, দেশ পাবে সংস্কৃতিবান প্রজন্ম।

নৈতিক শিক্ষা

নৈতিক শিক্ষা একজন মানুষকে মানুষ করে তোলার ভিত্তিস্বরূপএকটি শিশুর শিক্ষার্জন শুরু হয় মায়ের পেটের ভেতরেই। শিশুর শিক্ষার স্বার্থে মায়ের যেমন সুস্থ-স্বাভাবিক থাকা জরুরি তেমনি মায়ের শিক্ষার্জন করাও জরুরি। মা এসময় অনাগত শিশুর জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে পারেন। তিনি এসময় কিছু পড়তে পারেন, গান শুনতে পারেন, ছবি আঁকতে পারেন, অংক করতে পারেন ইত্যাদি। শিশুর জন্মের পর থেকে ৫ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুর জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়। এসময় একজন শিশুর মস্তিষ্কের ৯০% গঠনের কাজ সম্পন্ন হয়। এসময় শিশুকে নৈতিক শিক্ষা দেয়ার প্রধান সময়। এসময় শিশু যে শিক্ষা পায় তা তার আগামী সারাজীবন চেতন বা অবচেতন মনে রয়ে যায়।

নৈতিক শিক্ষার মধ্যে অন্যতম হলো- ভালো আর মন্দের মধ্যে পার্থক্য করতে শেখানো। মা যেমন তার শিশুকে আগুন-পানি থেকে দূরে রাখেন, তেমনি তিনি চেষ্টা করবেন শিশুকে মিথ্যা বলা, চুরি করা, হিংসা করা ইত্যাদি অশুভ অভ্যাস থেকে দূরে রাখতে। সকল মানুষ সমান, মেয়ে বা নারীদের প্রতি সম্মান দেখানো, বড়দের সম্মান করা, ছোটোদের স্নেহ-আদর করা, কাজ বা শ্রমের ভিত্তিতে মানুষকে আলাদা না করা, সকল কাজের প্রতি সম্মান ইত্যাদি এসময় শেখানো উচিত। এসময় শিশুদের ধন্যবাদ দেয়া শেখানো উচিত। ধন্যবাদ দিলে কমে যায় না, বরং একটা শব্দের মাধ্যমে আপনি তার কাজ বা সেবাকে মূল্যায়ন করছেন। ভুল করলে তা স্বীকার করা এবং তার জন্য দুঃখিত বা অনুতপ্ত হওয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ নৈতিক শিক্ষা।

নিজের কাজগুলো নিজে করা, যেমন- নিজের বই নিজে গুছিয়ে রাখা, নিজের কাপড় নিজে গুছিয়ে রাখা, সংসারের কাজে মা-বাবা-ভাইবোনকে সাহায্য করা, নিজের জায়গা, নিজের ঘর পরিষ্কার রাখা নৈতিক শিক্ষার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। এসময় শিশুকে আবর্জনার বিষয়ে ধারণা দিতে হবে। কোনটা পচনশীল আবর্জনা, কোনটা অপচনশীল আবর্জনা, তাদের আলাদা করতে পারা, তাদের আলাদা পাত্রে ফেলা এবং কোনো ধরণের আবর্জনা রাস্তায়, বাসার বাইরে, জানালা দিয়ে যেখানে যায় সেখানে, বাসে-ট্রেনে-নৌকায়, পার্কে, যেখানে অন্য লোকেরা জমায়েত হয় সেখানে না ফেলা নৈতিক শিক্ষার অংশ। এসময় শিশুকে ছেলে এবং মেয়েদের শরীরের আলাদা হওয়ার বিষয়ে ধারণা দিতে হবে। ছেলে এবং মেয়ে উভয়ই মানুষ এবং সমান এই শিক্ষা দিতে হবে।

সমাজে যে কেবল ভালো অনুষঙ্গ আছে তা না। নৈতিক শিক্ষার মধ্যে খারাপ অনুষঙ্গ বিষয়েও ধারণা দিতে হবে। নিজের শরীরের ব্যক্তিগত জায়গা সম্পর্কে ধারণা দিতে হবে। এসবস্থানে যে কেউ অর্থাৎ যে কেউ হাত দেক না কেনো, সাথেসাথে চিৎকার দেয়া এবং সেই ঘটনা বাবা-মাকে জানানো শিশুর অবশ্যকর্তব্য।

কর্মমুখী কারিগরি শিক্ষা

কর্মমুখী কারিগরি শিক্ষা ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ নির্মানের মূলমন্ত্র। শিশুর প্রাথমিক স্তরের শিক্ষাগ্রহণ সম্পন্ন হলে তাকে কারিগরি বিষয়ে ধারণা দিতে হবে। বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। শিশুকে এসময় বিভিন্ন রকম শষ্য-সবজি, চাষাবাদ, বীজ, ঋতু-কাল সম্পর্কে ধারণা দিতে হবে। স্কুলে বা বাসায় পতিত জমি থাকলে সেখানে চাষ করে দেখাতে হবে কিভাবে চাষ করা হয়। প্রয়োজনে তাকে গ্রামে বা খামারে নিয়ে গিয়ে কৃষিপদ্ধতি দেখানো যেতে পারে।

বিভিন্নরকম ইলেকট্রিক এবং মেকানিকাল কাজ সম্পর্কে ধারণা দিতে হবে। ইঞ্জিন, বিদ্যুৎ, প্রাকৃতিক শক্তি ও জ্বালানী এবং প্রযুক্তি সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা দিতে হবে। যারা এসবকাজে আগ্রহী হবে তাদের জন্য ওয়ার্কশপের ব্যবস্থা করতে হবে। কাঠের কাজ এবং বিভিন্নরকম ক্রাফটের কাজ এসময় শেখাতে হবে। সেলাই শেখানোর জন্য স্কুলগুলোতে বিশেষ ক্লাসের ব্যবস্থা থাকতে হবে।

মাধ্যমিক স্তরে শিশু কর্মমুখী কারিগরি জ্ঞানার্জন শুরু করবে। স্কুলের খামার ও ওয়ার্কশপ থেকে তারা ট্রেনিং এবং প্রয়োজনীয় সমস্ত বিষয়গুলো পাবে। এসবই হবে সাধারণ শিক্ষাগ্রহণের পাশাপাশি। পাশাপাশি তারা যা উৎপাদন করবে সেগুলো বিক্রির ব্যবস্থা করবে স্কুল। বিক্রির টাকা পাবে শিক্ষার্থী। এতে করে শিক্ষাগ্রহণের সময়েই শিক্ষার্থী আত্মনির্ভরশীল হয়ে গড়ে উঠবে। পরবর্তীতে তার এই দক্ষতা আত্মকর্মসংস্থান তৈরীতে সাহায্য করবে। দেশের বেকারত্বের হার কমাতে এবং সর্বাবস্থায় দেশের অর্থনীতিতে অংশগ্রহন করতে কর্মমুখী কারিগরি শিক্ষার বিকল্প নাই।

কর্মমুখী কারিগরি শিক্ষা কেবল সুবিধাবঞ্চিত বা অর্থনৈতিকভাবে অস্বাবলম্বী পরিবারের শিশুদের জন্য নয়। কর্মমুখী কারিগরি শিক্ষা সবার জন্য। শিশুরা স্বাবলম্বী এবং আত্মনির্ভরশীল হলে পরিবার ও দেশের লাভ। দেশের অর্থনীতি বিকাশের অন্যতম সহায়ক শক্তি- কর্মমুখী কারিগরি শিক্ষা।

শিক্ষাগ্রহণের উপায়

-৫ বছর শিশুদের শিক্ষাগ্রহণের প্রাক-প্রাথমিক স্তরএরপরের ১০ বছর অর্থাৎ ৬-১৬ বছর প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাগ্রহণের স্তর এরপর ২ বছর উচ্চমাধ্যমিক স্তর এরপর শিশুরা উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য প্রস্তুত হয় এই হচ্ছে বাংলাদেশের সাধারণ শিক্ষা গ্রহণের স্তর

প্রাক-প্রাথমিক স্তরে শিশুরা সাধারণত বাসায় বা পরিবারের কাছে শিক্ষাগ্রহণ করে থাকে কিছু পরিমাণ কিন্ডারগার্টেন এবং ডেকেয়ার দেশে চালু থাকলেও তা অপ্রতুল এবং ব্যবস্থার কথা চিন্তা করলেতো বাংলাদেশের কিন্ডারগার্টেনগুলো নিজেরাই শিশুঅবস্থায় আছে প্রাক-প্রাথমিক স্তরের ব্যবস্থা হওয়া উচিত, খেলতে খেলতে শেখা এবং কিভাবে শিখতে হবে তা শেখা এসময় শিশুদের গাছ-পাখি-ফল-ফুল-প্রাণী-প্রতিবেশের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার উত্তম মুহুর্ত এস্তরে রোলনম্বরের নামে শিশুদের অসুস্থ প্রতিযোগিতার সম্মুখীন করিয়ে দেয়াটা একদম অনুচিত-অন্যায় বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে রোল নম্বর শুরু হতে পারে ১০ বছর বয়সে বা চতুর্থ শ্রেণী থেকে এস্তরে বাসায় এবং স্কুলে সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি নৈতিক শিক্ষা দিতে হবে।

এরপর প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে, শিশুরা জ্ঞানের মূল বিষয়গুলোর সাথে পরিচিত হতে শুরু করবে। তারা বিজ্ঞান, গণিত, সামাজিক বিজ্ঞান, বাংলা ভাষা, বাংলা সাহিত্য, বাংলাদেশ ও পৃথিবীর ইতিহাস, বাংলাদেশ ও পৃথিবীর সংস্কৃতি, প্রযুক্তি ও কারিগরি জ্ঞান, ২-৩ টি বিদেশী ভাষা শিখবে। এসময় তাদের নৈতিক শিক্ষার ট্রেনিং চলতে থাকবে। নৈতিক শিক্ষা শিশুরা তাদের জীবনে এবং আশপাশে প্রয়োগ করা শুরু করবে। পাশাপাশি তাদের সুনির্দিষ্ট কোন বিষয়ে আগ্রহ আছে কিনা তা ঠিক করবে। যার যে বিষয়ে আগ্রহ সে সেই বিষয়ে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করবে। কেউ গণিতে পারদর্শী হবে, কেউ বিজ্ঞানে মনোযোগ পাবে, কেউ গান বা বাজনায় আগ্রহী হবে, কেউ ছবি আঁকা বা অভিনয়ে নিজেকে খোঁজার চেষ্টা করবে।

মাধ্যমিক স্তরের শুরুতে বা শিশুর ১১-১২ বছর বয়সে কারিগরি জ্ঞান সম্পর্কে ধারণা দিতে হবে। এসময় তারা হাতেকলমে কারিগরি শিক্ষা গ্রহণের জন্য প্রস্তুত হবে। কারিগরি শিক্ষার মধ্যে উল্লেখ্য- কৃষি কাজ, কাঠের কাজ, মেকানিকাল বিভিন্ন কাজ, ইলেকট্রিক বিভিন্ন কাজ, বিভিন্ন রকম ক্রাফটের কাজ, সেলাই কাজ ইত্যাদি। প্রাথমিক কারিগরি ধারণা পাওয়ার পর যার যে বিষয়ে আগ্রহ এবং দক্ষতা তৈরী হবে, তাকে সেই বিষয়ে পারদর্শী করে তুলতে হবে। কারিগরি মাধ্যম থেকে কিছু পরিমাণ অর্থোপার্জনের রাস্তা মাধ্যমিক স্তরেই বের করতে হবে। এতে করে শিক্ষাগ্রহণকারীর উপর অর্থনৈতিক চাপ কমবে। শিশু উদ্যোগী হবে এবং নিজের কর্মসংস্থান তৈরীতে নিজেই সচেষ্ট হবে।

উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে গবেষণার পরিধি বিস্তৃত করতে হবে, মৌলিক গবেষণায় প্রণোদনা দিতে হবে। সাধারণ শিক্ষার সাথে নৈতিক এবং কারিগরি শিক্ষার সমন্বয় করার পর যে শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার স্তরে পৌঁছাবে, তাকে সঠিক দিকনির্দেশনা দেয়া গেলে দেশ এমন এক প্রজন্ম পাবে যে প্রজন্মের জন্য বাংলাদেশের ইতিহাস গর্বিত হবে।

17 August 2018

বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বিচ্যুতি অথবা বঙ্গবন্ধু হত্যার দায়




গতলেখায় আমরা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ নিয়ে কথা বলেছিলাম। আজকে বলতে চাই বঙ্গবন্ধুর নিজের আদর্শবিচ্যুতির কথা। বঙ্গবন্ধু নিজে যে আদর্শে পরিচালিত হয়েছিলেন ১৯৪০ থেকে ১৯৭১, সুদীর্ঘ ৩১ বছর; সেই আদর্শ তিনি নিজেই লঙ্ঘন করেন ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের চারটি মূল স্তম্ভ- অন্যায়ের সাথে আপোষহীনতা, সত্যবাদীতা, জনগণের স্বার্থে নিজেকে নিয়োজিত রাখা এবং সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন দেখা। ১৯৭২ সালে ক্ষমতাগ্রহণের পর এই চারটি মূলস্তম্ভ থেকে দূরে সরে যান বঙ্গবন্ধু। তিনি অন্যায়ের সাথে আপোষ করতে শুরু করেন। যে স্বপ্ন দেখে বাঙ্গালীরা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পরে সে স্বপ্ন হয়ে যায় অলীক কল্পনা। যে কাজগুলো দেশে ফিরেই করা দরকার ছিলো সেগুলো তিনি করেন নি।
দেশে ফিরেই একটি জাতীয় সরকার গঠন করে দেশকে একতাবদ্ধ করার প্রয়োজন ছিলো। এই প্রয়োজন তিনি এমন সময় উপলব্ধি করেন যখন সময় ফুরিয়ে এসেছে। দেশ স্বাধীন হলেও মানুষের মুক্তি দূর থেকে দূরে সরে যাচ্ছিলো। সমাজতন্ত্রের প্রশ্নে আওয়ামী লীগের অতিবিপ্লবী অংশটি বের হয়ে গিয়ে গঠন করে জাসদ (জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল)। জাসদ সেই সময় ত্রাসের রাজত্বকায়েম করে। জাসদকে মোকাবেলা করা আর নিজের ক্ষমতাকে পোক্ত করার জন্য তিনি গঠন করেন রক্ষীবাহিনী। এই জাসদ আর রক্ষীবাহিনীর মাঝখানে পরে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয় সাধারণ জনগণ। অথচ বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে বেশি ভাবা উচিত ছিলো জনগণের কথা।
যে সত্যবাদীতা বঙ্গবন্ধুর ৩০ বছরের রাজনৈতিক জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অর্জন ছিলো স্বাধীনতার পর তার জায়গা নিয়ে নেয় আত্মম্ভরিতা আর স্বেচ্ছাচার। এসময় তিনি মানুষ চিনতে ভুল করেন। তিনি কে দেশপ্রেমিক আর কে চাটুকার তার পার্থক্য করতে ব্যর্থ হন। তিনি কোনটা প্রশংসা আর কোনটা মোসাহেবী তা আলাদা করতে ব্যর্থ হন। এর দায় তাকে নিজের আর নিজের পরিবারের জীবন দিয়ে দিতে হয়েছে। মোসাহেবের দল বঙ্গবন্ধুর লাশের উপর দিয়ে গিয়ে ক্ষমতায় বসে আর বিবৃতি দেয়- ফেরাউনের পতন হয়েছে। মানুষ চিনতে ভুল না করলে দেশ আরো এগিয়ে যেতে পারতো।
১৯৭৩-৭৪ এই সালগুলোতে বেশকয়েকটা প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাংলাদেশকে মোকাবেলা করতে হয়। দেশে দেখা দেয় দুর্ভিক্ষ। একটি নতুন দেশের জন্য দুর্ভিক্ষ সামাল দেয়া খুব ভয়াবহ ব্যপার যদি সেই দেশে প্রবল দুর্নীতি উপস্থিত থাকে। যেই বঙ্গবন্ধু গ্রাম থেকে গ্রামে ঘুড়ে লোকেদের খোঁজখবর নিয়েছেন, সেই বঙ্গবন্ধু দুর্ভিক্ষের খবর জানতে নির্ভর করেন মোসাহেব আর দুর্নীতিবাজ রাজনৈতিকদের উপর।
স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু সোনার বাংলা গঠনের স্বপ্ন দেখা থেকেও দূরে সরে যান। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত বঙ্গবন্ধুকে এসময় চিহ্নিত করা হয়- স্বৈরতান্ত্রিক, কতিপয়তান্ত্রিক, একনায়কতান্ত্রিক, গোষ্ঠীতান্ত্রিক ইত্যাদি অভিধায়। তিনি একের পর এক ভুল সিদ্ধান্ত নিতে থাকেন এসময়। সেনাবাহিনীর ক্ষমতা কমিয়ে আনা, রক্ষীবাহিনীকে সেনাবাহিনীর সমমর্যাদায় বসানো, বিরোধীদের উপর দমন-পীড়ন, দেশপ্রেমিক নেতাদের চিনতে ব্যর্থ হওয়া, জনগণের চাহিদা বুঝতে না পারা এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতিকে মদদ দেয়া এসবই মূল কারণ।
অন্যায় ছাড়া কোনো সমাজ নাই। কিন্তু মানুষ অন্যায়ের বিচার চায়। বিচার না থাকা অথবা একেকজনের জন্য একেকরকম বিচার থাকাই বিচারহীনতা। বিচারের প্রশ্নে সেসময় বঙ্গবন্ধু পক্ষপাতদুষ্ট আচরন করেন। যে কারণে পরবর্তীতে সেনাবাহিনীতে বেশকিছু ‘বিপথগামী তরুণ’ তৈরী হয়। তরুণরা নিজেরা বিপথগামী হয়নি, তাদের বিপথগামী করা হয়েছে। তরুণদের বিপথগামী করার সমসংখ্যাক দায় বঙ্গবন্ধুরও।
তরুণদের রাগিয়ে দিয়ে যেকোনো কাজ উদ্ধার করা বেশ সহজ। এইসমস্ত ক্ষেপাটে তরুণেরা বিদেশী কিছু গোয়েন্দাসংস্থার উস্কানি পায়। মদদ পাওয়ার মতো সিনিয়র অফিসাররা এই ক্ষোভে আরো ঘি ঢেলে দেয়। ফলাফল বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুতে বঙ্গবন্ধুর নিজের যতোটুকু দায় ততোটুকু দায় বিপথগামী তরুণদের। এবং এই দায়ের আরেক হিস্যা বিদেশী স্বার্থবাদী কিছু বিচ্ছিন্ন লোক আর বিদেশী গোয়েন্দা সংস্থার।
যারা বিভিন্ন সময়ে বঙ্গবন্ধুর অকালমৃত্যু নিয়ে হীনমন্যতায় ভোগেন বা পুরো বাঙ্গালী জাতিকে বেঈমান বলে দোষারোপ করেন তাদের আরো বিস্তাড়িত ভেবে কথা বলার জন্য অনুরোধ করবো। ইতিহাস আপনার আবেগ দিয়ে চলে না। ইতিহাস কয়েকটা ঘটনা ছাড়া আর কিছুই না। এক ঘটনা, তার ফলশ্রুতিতে আরেক ঘটনা, এভাবেই ইতিহাস সামনের দিকে এগোয়।
ইতিহাস তার নিজের মতো আগাবে। পেছনে যা গিয়েছে তা গত হয়েছে। এখন আমাদের সময় সামনে তাকানোর। একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখা এখন কোনো অলীক কল্পনা নয়। যেদিন আমরা বিশ্বাস করতে শুরু করবো জাতি হিসেবে আমরা অনন্য, সেদিন থেকেই আমাদের উন্নতি শুরু হবে। সেদিন থেকেই আমরা নিজের গর্ব করে বলতে পারবো- আমরা বাঙ্গালী, আমরা বাংলাদেশী।

16 August 2018

বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বলতে আমরা কি বুঝি?

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (১৯২০-১৯৭৫)

বঙ্গবন্ধুর আদর্শ তার সারা জীবন। সারা জীবনে তার কর্মই তার আদর্শ। বঙ্গবন্ধু প্রথম জেলে যান চতুর্থ শ্রেনীর কর্মচারীদের অধিকার রক্ষায় করা একটি আন্দোলন থেকে। এই আন্দোলন করার কারণে তাকে জরিমানা করা হয়, তার ছাত্রত্বও বাতিল হয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধু জরিমানা দিতে অস্বীকৃতি জানান, কারন তিনি জানেন তিনি হকের পথে আছেন, তিনি সঠিক বিষয়ে আন্দোলন করছেন। জেল-জরিমানা-ছাত্রত্ব বাতিল তাকে টলাতে পারেনি, এই কারণেই তিনি আপোষহীন নেতা। অন্যায়ের সাথে কোনো আপোষ নাই, এমনকি যদি জেল হয়, জরিমানা হয়। এমনকি যদি ছাত্রত্বও বাতিল করা হয়। এটাই বঙ্গবন্ধুর আদর্শ। ১৯৪৮ সালে কেড়ে নেয়া ছাত্রত্ব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ফেরত দেয় ২০১০ সালে। ছাত্রত্ব চলে যাওয়ায় বঙ্গবন্ধু অসম্মানিত হন নাই, বরং অসম্মানিত হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, কারণ তারা ন্যায়ের পথে থাকতে পারে নাই।
রাজনীতিতে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন বঙ্গবন্ধুর গুরু। সোহরাওয়ার্দীর সাথে তিনি গ্রামবাংলা ঘুড়ে বেড়ান, জনগণকে সচেতন করেন। কোনো এক কারণে মতবিরোধ দেখা দিলে সোহরাওয়ার্দী বঙ্গবন্ধুকে ধমকের সুরে জিজ্ঞাসা করেন- 'তুমি কে?' বঙ্গবন্ধু উত্তর দেন- 'আমি যদি কিছু না হই, তাহলে আপনি কে?' বঙ্গবন্ধু সভাস্থল ত্যাগ করে চলে আসেন। এটাই বঙ্গবন্ধুর আদর্শ। নেতাকে সত্য বলতে পারার মতো সৎসাহস থাকাটাই বঙ্গবন্ধুর আদর্শ। এখনকার নেতারা ভুলে গেছেন কর্মীরা আছে বলেই তিনি নেতা। কর্মীরাও নিজেদের অবস্থান ভুলে গেছে। তারা মনে করে নেতাকে খুশি রাখতে পারলেই সব ঠিক। কিছু সাময়িক ব্যক্তিগত সুবিধার জন্য তারা বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে চুপ থাকেন, নেতার ভুল ধরিয়ে দেন না।
বঙ্গবন্ধুর জন্ম ১৯২০ সালে, প্রত্যক্ষ রাজনীতি শুরু করেন ১৯৪০ সালে, মৃত্যুবরন করেন ১৯৭৫ সালে। পাকিস্তান (১৯৪৭-১৯৭১) আমলের বেশিরভাগ সময় তিনি জেলে কাটান। জেলে যাওয়ার কারণগুলো হলো- চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের অধিকার আদায়ের আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন, স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন, দুর্ভিক্ষবিরোধী আন্দোলন, বাংলার স্বায়ত্তশাসনের জন্য আন্দোলন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন। এর কোনোটাই তার নিজের স্বার্থের জন্য নয়, জনগণের বৃহত্তর স্বার্থে আন্দোলন। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ এটাই। নিঃস্বার্থ ভাবে দেশের আর দেশের লোকেদের জন্য কাজ করে যাওয়াই বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, এর জন্য জীবনের অধিকাংশ সময় জেল খাটাও কোনো বিষয় না।
বঙ্গবন্ধু তার রাজনৈতিক জীবনের পুরোসময় স্বপ্ন দেখেছেন একটি সোনার বাংলার। সোনার বাংলা হবে, এই ভেবে তিনি মুসলিম লীগে যোগ দিয়েছিলেন। আবার মুসলিম লীগ থেকে আওয়ামী লীগ নিয়ে বের হয়ে এসেছিলেন। প্রথমে স্বায়ত্তশাসন চেয়েছিলেন, পরে পূর্ণ স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখতে থাকেন। এর সবই একটি সোনার বাংলায় তার দেশের লোকেরা থাকবে সেই স্বপ্নের প্রতিফলন। এটাই বঙ্গবন্ধুর আদর্শ। নির্দিষ্ট একটি স্বপ্নের দিকে নিরন্তর ছুটে চলাই বঙ্গবন্ধুর আদর্শ। বঙ্গবন্ধু যদি তার স্বাধীন বাংলার স্বপ্ন থেকে মাঝপথে বিচ্যুত হতেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা হয়তো আরো বিলম্বিত হতো। বঙ্গবন্ধু হয়তো যুদ্ধের মাঠে থেকে নেতৃত্ব দিতে পারেন নাই, কিন্তু জনগণকে একটা স্বাধীন দেশের স্বপ্ন ঠিকই দেখাতে পেরেছিলেন।
এখন আমরা স্বাধীন দেশ পেয়েছি। কিন্তু আমাদের মুক্তি আসে নাই। রাষ্ট্র হিসেবে আমরা এখনো সফল হতে পারি নাই। বঙ্গবন্ধুর দল বা তার উত্তরসূরিদের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ নিয়ে বোঝাপড়া না থাকা বা সেটা অনুশীলন না করা এখন একটা স্বাভাবিক বিষয়। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বলতে তারা কিছুই বুঝেনা, অথবা কেবল 'বঙ্গবন্ধুর আদর্শ' এই শব্দ ব্যবহার করাকে তারা ফ্যাশন মনে করে। অথচ বাংলাদেশের সোনার বাংলা হয়ে ওঠার সব উপাদান এখানেই মজুত আছে, অভাব কেবল সদিচ্ছার আর স্বপ্ন দেখার।

11 August 2018

আন্দোলন ও প্রতিপক্ষ

ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্য শুনলাম। আত্মঘাতী বক্তব্য। তারে কেউ বোঝাইছে নাকি এইরকম ভুলভাল সে নিজেই বুজছে আল্লাহ মালুম। নিরাপদ সড়কের মতো একটা যৌক্তিক আর নির্বিরোধী আন্দোলনকে তারা ঠেইলা সরকার বিরোধী আন্দোলনের দিকে নিয়া যাইতেছে, এইটা তারা বুঝতেছেনা। ছাত্রদের বোঝানোর দ্বায়িত্ব দেয়া হইছে কোমলমতি ছাত্রলীগের হাতে। এতো কোমল ছাত্রলীগ কি আন্দোলনকারী ছাত্রদের বুঝাইয়া ঘরে ফেরাবে নাকি মারামারি কইরা আরো বেশি পরিমাণ লোকরে এই আন্দোলনের সাথে ইনভল্ভ করবে, কি মনে হয় আপনার?
যে দেশে কোনো কিছুই ঠিক নাই সেই দেশে নিরাপদ রাস্তার জন্য আন্দোলন ও কি করা যাবে না? শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, ব্যাংকের রিজার্ভ সংকট, কয়লা-পাথর-সোনা সব জায়গায় ঘাপলা বাজায়া রাখছেন। যারাই টুকটাক বিরোধীতা করার চেষ্টা করছে তাদেরকেই বিএনপি-জামাত ট্যাগ দিতেছেন। সরকারের বিরোধীতা করলেই কি সে বিএনপি-জামাত। এছাড়া কি লোক নাই দেশে। বাংলাদেশের বেশিরভাগ লোকের সাথে সরকার বা বিএনপির কোনো সম্পর্ক নাই। তারা দুইবেলা খাবার চায়, নিরাপদে রাস্তায় চলাফেরা করতে চায়, বাইচা ঘরে ফিরতে চায়- যে ঘরে তার জন্য তার আপনজন অপেক্ষা কইরা আছে।
গতকাল(৪ঠা আগস্ট, ২০১৮) খুন-ধর্ষন হয় নাই বইলা যারা আন্দোলনের উপর ছাত্রলীগের আক্রমনকে জাস্টিফাই করতে চাচ্ছিলেন, এইটা কইরা তাদের কি উপকার হবে আমি জানিনা। আরে, নিরাপদ রাস্তাতো আপনার জন্যও দরকার। নাকী আপনি ছাত্রলীগ করেন বইলা আপনার এক্সিডেন্ট হবে না? আবার এমন না যে খুন-ধর্ষন হইলে তার বিচার হইতো দেশে। এর আগে তনুর ধর্ষনে আপনি কোন পক্ষে ছিলেন? তনুর ধর্ষনের বিচার হয় নাই। বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডের রায় দিল, এই আন্দোলনের ফাকে। যদিও এইটা লোকজনের চোখ এড়ায়া গেলো, কিন্তু আপনারা জানেন আপনারা অন্যায় করতেছেন।
বঙ্গবন্ধু নিয়া বড়বড় কথা বলেন আপনেরা। কই আপনাদের কাজেকামে তো বঙ্গবন্ধু প্রকাশ পায় না। নাকি আপনারা মুখেই চেতনার ব্যবসা করেন, মনোযোগ দিয়া কখনো পড়েন নাই। মারামারি বাদ দিয়া সময় নিয়া একটু পইড়া দেইখেন, বঙ্গবন্ধু কি বলছেন? বঙ্গবন্ধু আপনাদের ব্যাপারেও বলছেন, আপনাদের এখনকার সময় নিয়া তিনি ভবিষ্যৎবাণী কইরা গেছেন। জুলুম-নির্যাতন কইরা যে টিকা থাকা যায় না, এইটা আপনারা যখন বুঝবেন তখন দেরী হইয়া যাবে। আপনারা শুধুশুধু জনগণকে প্রতিপক্ষ বানাইয়েন না।
লোকেদের বিএনপির উপর ভরসা নাই বইলাই তারা আজ জনবিচ্ছিন্ন দলে পরিণত হইছে। সবচেয়ে বড় কথা স্বাধীনতাবিরোধী দল জামাতকে তারা এখনো ছাড়ে নাই। আর এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় চোর তারেক জিয়া এই দলের ভবিষ্যৎ কাণ্ডারি। এবং জনগণ এইটাও জানে যে বিএনপি দল হিসেবে জনগণের স্বার্থ রক্ষা না কইরা তাদের নেত্রীর বাড়িঘর নিয়া আন্দোলন করতে বেশি পছন্দ করে।
এমতাবস্থায়, জনগণকে আপনাদের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করাবেন না। যতটুকু গঠনমূলক পরিবর্তন করা যায় করুন। সৎ চিন্তা করুন। জনগণের পালস বোঝার চেষ্টা করুন। জনগণ নিরাপদ সড়ক চায়, নিরাপদ দেশ চায়, আইনের শাসন চায়, জুলুম-নির্যাতনের প্রতিরোধ চায়, জনগণ শান্তিতে থাকতে চায়।

10 August 2018

আন্দোলনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ভূমিকা

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মধ্যে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় ফেসবুক। এপ্রিল ২০১৮ এর হিসাব মতে বাংলাদেশে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ৩ কোটি ২০ লাখ। ব্যবহারকারীদের বিশাল একটা অংশের বয়স ১৫-৪০।
ইতিমধ্যে ফেসবুক বাংলাদেশের একটি বিকল্প সংবাদ মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। জাতীয় সংবাদ মাধ্যমগুলো (প্রিন্ট এবং অনলাইন) মিথ্যাচারিতা, স্বেচ্ছাচারিতা, সত্য খবর পরিবেশনে অনীহা এবং ভয়, সরকারী সেন্সর এবং পর্যাপ্ত জবাবদিহিতার অভাবে ফেসবুক হয়ে উঠছে বিকল্প সংবাদ মাধ্যম। তবে বড় প্লাটফর্ম হওয়ায় এইখানে গুজব ছড়ানোর যথেষ্ট সম্ভাবনা বিদ্যমান। ব্যবহারকারীদের খবর এবং গুজবের মধ্যে পার্থক্য করতে পারতে হবে এবং গুজব যেনো না ছড়ায় তার খেয়াল রাখতে হবে।
এছাড়া এখন ফেসবুক বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দলে পরিণত হয়েছে। একটি ভালো বিরোধী দলের অভাবে বাংলাদেশের সংসদ এবং রাজপথ যখন স্বেচ্ছাচারিতা আর স্বৈরাচারের উর্বর ময়দান, তখন ফেসবুকই লোকজনের ভরসার জায়গা। এইখানে লোকজন সমালোচনা করে, নিন্দা করে, একটা কাজ আরো কিভাবে ভালো হতে পারতো তার আলোচনা করে। বেফাঁস কিছু বললে হাসাহাসি করে, ট্রল করে। মত প্রকাশের স্বাধীনতা যখন কেড়ে নেয়া হচ্ছে তখন ফেসবুকই মত প্রকাশের প্লাটফর্ম হয়ে উঠছে। কিছু ৫৭ ধারাটারা আছে। তবে এগুলা এখন আর লোকে মানে না।
মতপ্রকাশের জায়গা হিসেবে ফেসবুক একটা খোলা মাঠের মতো। এইখানে সবাই যে যার মত দেন। এইখানে আপনি সচেতনতা তৈরী করতে পারেন। কোনো চলমান অন্যায়ের মধ্যে জনমত তৈরী করতে পারেন। আপনার পক্ষের-বিপক্ষের যুক্তি-তর্ক সাপেক্ষে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। এইখানে কে চুপ থেকে নিজের ধান্ধায় আছে তা বের করতে পারেন। এইখানে কে দলকানা, কে গোষ্ঠীস্বার্থে বিভোর, কে আধুনিক সুবিধাবাদী-রাজাকার তা চিহ্নিত করতে পারেন।
সৎ উদ্দেশ্যে কাজে লাগিয়ে আপনি ফেসবুক থেকেও ভালো আউটপুট বের করতে পারেন। নিজে সৎ আন্দোলনে যোগদান করুন, অপরকে যোগদান করতে উৎসাহিত করুন। আপনার অবস্থান পরিষ্কার করুন। কারা দলকানা এবং জনগণের শত্রু তাদের চিনে রাখুন।
সামনে বাংলাদেশের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। ভবিষ্যৎ গঠনের আন্দোলনে অংশগ্রহন করুন।

9 August 2018

শাহজাহান খানরা কেন কখনো ক্ষমতা ছাড়ে না?


পরিবহন খাত প্রতিদিন সোনার ডিম দেমা হাঁসের মতো একটা খাত। প্রতিদিন সোনার ডিম দেয় এরকম একটা হাঁসের মালিকানা কেউ ছেড়ে দেয় না। আমার সাথে একজন পরিবহন শ্রমিকের কথা হয়েছিলো এই বিষয়টা নিয়ে। তিনি চন্দ্রা থেকে চিটাগাং রোডের একটা বাসের কন্ট্রাক্টার। তার বাসের রুট- চন্দ্রা> বাইপাইল> সাভার> গাবতলী> ফার্মগেট> মৌচাক> শনির আখড়া> চিটাগাং রোড। সারাদিনে তাকে বেশ কয়েকটা স্টপেজে টাকা দেয়া লাগে। এর মধ্যে বাইপাইলে ৪০০ টাকা, গাবতলীতে ৪০০ টাকা, মৌচাকে ২৫০ টাকা, শনির আখড়ায় ৪০০ টাকা, মাতুয়াইলে ৪০০ টাকা দেয়া লাগে। প্রতিদিন এই বাসকে চান্দা দেয়া লাগে প্রায় ১৮৫০ টাকা (পুলিশের চান্দা আর কোম্পানির টিকেট চেকারদের ১০ টাকা বাদে)। বাসের রুট, টাইপ ইত্যাদির উপর নির্ভর করে সমস্ত বাসকেই চান্দা দেয়া লাগে প্রায় ১৫০০-৩০০০ টাকা। এই টাকাগুলা কই যায়?
এই টাকাগুলা লোকাল্গুন্ডাদের মাধ্যমে তোলা হয়। তারপর সেটা কোনো লোকাল এমপি বা নেতার পকেটে যায়। নেতার মধ্যে প্রধানত যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, ছাত্রলীগ, শ্রমিক লীগ (বা বিএনপির সময় পড়ুন দল), ওয়ার্ড কমিশনার উল্লেখযোগ্য। এই টাকার ফ্লো একদম নিচ থেকে শুরু করে একদম উপর পর্যন্ত প্রবাহমান। একটা সরল অংক- ধরেন ঢাকায় বাস চলে ১ লাখ, প্রতিদিনের চান্দা গড়ে ২,০০০ টাকা। তাইলে কতো টাকা হয়? ২০ কোটি টাকা। আমার কাছ থেকে হয়তো ১০ টাকা বেশি নিতেছে। কিন্তু দিনশেষে টাকাটা ২০ কোটি। এইটাকার ভাগ কে কে পায়? এই সিন্ডিকেটের পিছনে কে কে আছে? কারা এই চান্দার টাকার উচ্ছিষ্টভোগী?
বাসের এই টাকাটা কোথা থেকে আসে। আসে আমার –আপনার পকেট থেকেই। আমাকে-আপনাকে সিটিং এর নামে, বাসের ভাড়া বাড়ছে নামে এই টাকাটা দেয়া লাগে। এই টাকা না দিলে বাস রুটে চলতে পারবেনা। অথচ সেবার নামে কিচ্ছু বাড়ে নাই। একদম কিচ্ছু না। না ঢাকায় জ্যাম কমছে, না বাস স্টপেজ হইছে, না বাসে ফ্রি ওয়াইফাই বা এসি বা জ্যামে বসে পড়ার জন্য পত্রিকা! এমনকি সিটিং সার্ভিসের নামে সবচেয়ে বড় প্রতারনার জাল তৈরী করে রেখেছে ব্যবসায়ীরা। না হয় সিটিং, না দেয় সার্ভিস! কি বিচিত্র! আপনার পকেট থেকে প্রতিদিন ১০ টাকা বের হওয়া মানে মাসে ১০*৩০= ৩০০ টাকা আপনার সিস্টেম লস। আর এই সামান্য সিস্টেম লসের মাসিক আউটপুট ২০ কোটি*৩০= ৬০০ কোটি টাকা।
পরিবহন খাত থেকে হয়তো মাসে ৬০০ কোটি টাকা শাহজাহান খান ইনকাম করেন না। এর ১% ও যদি খান, তাহলে ৬ কোটি টাকা। কোন ব্যবসা মাসে আপনাকে ৬ কোটি টাকা দেবে? যাস্ট ফর নাথিং, একদম কিচ্ছু না করার জন্য এই টাকাটা দিচ্ছি আমরা। কাদের দিচ্ছি এই টাকাটা? যাদের আমাদের নিয়া কোনো চিন্তা নাই। যারা আমাদের নেতা হইয়া বইসা আছেন তাদের। যারা নিজেদের আর নিজের বৌ-বাচ্চা ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারে না তাদের।
এই প্রসেসের ভুক্তভোগী সাধারণ যাত্রীরা আর একই সাথে পরিবহন সেক্টরের শ্রমিকেরা। সাধারণ জনগণ মাঝেমাঝে ফেসবুকে নিজেদের মনের ভাব প্রকাশ করেন। কিন্তু শ্রমিকের পক্ষে বলার জন্য কেউ নাই। এমনকি তারা নিজেরাও না। তারা টাকা তুলে আর দিয়ে দেয়। ঐ কন্ট্রাক্টার আমাকে আক্ষেপ করে বলেছিলেন- ঐ খাচ্চর লোকগুলার লেইগা ট্যাকা তুলতে ভালো লাগে না মামা। কিন্তু কি করুম প্যাটের ধান্দা...
সবাই সবার ধান্ধায় আছে। সাধারণ জনগনের ধান্ধা হওয়া উচিত, আমরা আর এই সিস্টেম লসের অংশ হবো না। শ্রমিকের সাথে খারাপ ব্যবহার করা সমাধান না। এই সিস্টেমের মূলে আঘাত করতে হবে আমাদের। এই নৈরাজ্যের মূলে আঘাত করলেই দূর্নীতির একটা বৃহৎ খুঁটিতে টান পরবে, বিশ্বাস করেন। আমাদের সবাই দূর্নীতির কারনে দেশের প্রতি, রাষ্ট্রের প্রতি বীতশ্রদ্ধ। সবাই এটাকে নিয়তি বলে মেনে নিয়েছেন বা এটাই সিস্টেম হয়ে গেছে বলে মনে করেছেন। এখন সময় যুগ বদলের, এখন সময় নতুন দিনের। আমাদের বাচ্চারা আমাদের স্বপ্ন দেখাতে শেখাচ্ছে। আমাদের একটা নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখা এখন আর কোনো অপরাধ নয়।

18 May 2018

ফিলিস্তিনের জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের সবচেয়ে বড় শত্রু কে?




কয়েকদিন পরপর স্বাধীনতাকামী ফিলিস্তিনিরা মৃত্যুবরণ করে মিডিয়ার আলোচনায় আসে। আমরা সাধারণ জনগন হিসেবে কিছুদিন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সক্রিয় থাকি, তারপর বিবিধ ইস্যুতে আবার ব্যস্ত হয়ে যাই। ফিলিস্তিনিদের সংগ্রাম চলতেই থাকে। নিজের ভূমিতে বিদেশী মানুষ হয়ে থাকার যন্ত্রনা তারা নিজেরা ছাড়া আর কেউ জানেনা।

এই যন্ত্রনার প্রথম রূপরেখা প্রণয়ন করা হয় ১৯১৭ সালে, বেলফোর ঘোষণার মাধ্যমে। এরপর ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনিরা নিজেদের মাতৃভূমি হারিয়ে হয়ে যায় নিজের দেশে পরবাসী। তাদের জমিতে জোরপূর্বক প্রতিষ্ঠা করা হয় ‘ইসরাইল রাষ্ট্র’। ইসরাইল রাষ্ট্রের একের পর এক ভয়াবহ সিদ্ধান্তে রসদ জুগিয়ে এসেছে আমেরিকা। সে হিসেবে ফিলিস্তিনের জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের সবচেয়ে বড় শত্রু হওয়ার কথা আমেরিকার। কিন্তু আমেরিকা এতো বছর যাবৎ কিভাবে ইসরাইলের সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়ন করছে?

আমেরিকা-ইসরাইল গংদের প্রধান শক্তি মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর জ্ঞানার্জনের প্রতি অনিহা, প্রচণ্ড স্বার্থপরতা এবং বৃহৎ অনৈক্য। ইসরাইল যেখানে জ্ঞান-বিজ্ঞানে এগিয়ে যাচ্ছে, পরমানু বোমা তৈরী করছে, ন্যানোটেকনোলজিতে উন্নয়ন করছে; সেখানে মুসলিমদের মনোযোগের প্রধান কেন্দ্রবিন্দু আপনি শিয়া নাকি সুন্নি, আপনি হানাফি নাকি সালাফি, আপনি দাঁত ব্রাশ করেন নাকি মেসওয়াক ব্যবহার করেন। জ্ঞান-বিজ্ঞান বলতে আপনি বোঝেন প্রায় ১ হাজার বছর আগের ইবনে সিনা, আল কিন্দী, আল ফারাবী। এদের পর পৃথিবী আরো ১ হাজার বছর এগিয়ে গেছে। এইটা ইসরাইল জানে। ইসরাইল জানে আপনি কোন কোন বিষয়ে কনসার্ন! তাই তারা তাদের পরিকল্পনা ধীরে ধীরে বাস্তবায়নের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারছে।

সম্প্রতি আমেরিকা তাদের ইসরাইলি দূতাবাস জেরুজালেমে সরিয়ে নিয়েছে। এইটা মূলত ইসরাইল রাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের দাবী ‘ইসরাইলের রাজধানী জেরুজালেম’ এই ধারণার প্রতি সমর্থন। আমেরিকার দেখাদেখি ক্রমে আরো রাষ্ট্র এই মতের প্রতি সহানুভূতিশীল হবে। আমেরিকা যেভাবে ইসরাইলকে দিনের পর দিন ভরণপোষণ করে আসছে, এটা বিশ্বশান্তির জন্য মারাত্মক হুমকি।

ইসরাইলকে এই ভরনপোষণের গোঁড়ায় পানি ঢেলে এটাকে আরো সজীব আর প্রাণবন্ত করতে ভূমিকা পালন করছে বর্তমান সৌদী আরবের সরকার। সৌদী আরবের বর্তমান যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান সম্প্রতি ফিলিস্তিনি মুক্তি সংগ্রাম নিয়ে তার বোঝাপড়া ব্যক্ত করেছেন- ‘আলোচনার টেবিলে আসুন, শান্তি প্রস্তাব গ্রহণ করুন, তা না হলে অভিযোগ জানানো বন্ধ করে চুপ থাকুন।’ এই স্টেটমেন্টের মাধ্যমে তিনি আসলে ফিলিস্তিনের মুক্তি সংগ্রামকে কটাক্ষ করেছেন। সৌদী যুবরাজ না হলে তার এই বক্তব্যকে বেয়াদবি হিসেবে ধরে নেয়া যেতো। আলোচনার টেবিলে আসুন! কার সাথে আলোচনা? শান্তি প্রস্তাব গ্রহণ করুন! গাজায় ৬০ জন নিহত আর ৩,০০০ জন আহত ফিলিস্তিনির সংগ্রামের দাম শান্তি প্রস্তাব। কি কি শান্তির প্রস্তাব করতে পারে ইসরাইল আর আমেরিকা? আমরা কিছু ধারণা করি- ধারা ১, এখন থেকে ইসরাইলের রাজধানী জেরুজালেম। ধারা ২, এখন থেকে পশ্চিম তীর আর গাজাসহ পুরো ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডই ইসরাইল রাষ্ট্র। ধারা ৩, এখন থেকে সকল ফিলিস্তিনি ইসরাইলের ২য় শ্রেনীর নাগরিক। তা না হলে অভিযোগ জানানো বন্ধ করে চুপ থাকুন! আপনার কাছে কে অভিযোগ জানাতে গেছে? আপনি তো অনেক আগেই আপনার মস্তিষ্ক আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতির কাছে বন্ধক দিয়ে রেখেছেন। মধ্যপ্রাচ্যে আপনার মূল আগ্রহ- ইরানকে আটকাও, ইয়েমেনে সাধারণ মানুষ মারো, সিরিয়ায় আরো বেশিদিন গৃহযুদ্ধ চলুক আর সারা পৃথিবীতে কট্টরপন্থী ইসলাম ছড়িয়ে যাক। মুসলমানদের দুই পবিত্র শহরের খিদমতগার হয়েও আপনি জেরুজালেমকে ইসরাইলের হাতে তুলে দিতে পেছনে ফিরে তাকালেন না।

কেবল সৌদী আরব নয় পুরো মধ্যপ্রাচ্য ফিলিস্তিন প্রশ্নে কাঠগড়ায়। সিরিয়া আর ইরাক নাহয় যুদ্ধবিধ্বস্ত। জর্দান,  মিসর, তুরস্ক, আরব আমিরাত, কাতার!? অনেক অনেক বিষয়ে তারা মুসলিম বিশ্বের ত্রানকর্তা হিসেবে সামনে চলে আসে। অথচ নিজেদের মধ্যে প্রবল অবিশ্বাস। জর্দান মিসরকে সন্দেহ করে। মিসর কাতারকে সন্দেহ করে। সৌদী আরব আর কাতার একই মত অবলম্বন করেও দুইজন দুই জনের দিকে পিঠ দিয়ে আছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত ইয়েমেনে, আরব আমিরাত যতোটা আগ্রহ পায় তার কানা পরিমাণ আগ্রহও পায়না ফিলিস্তিনের মুক্তি সংগ্রামে। তুরস্কতো আরেক স্বাধীনতাকামী কুর্দিদের ঠেকাতে ঠেকাতে নিজেদের প্রেসিয়াস শক্তি ক্ষয় করে ফেলতেছে। এর সুযোগ নিতেছে ইসরাইল আর আমেরিকা। সুযোগ নিবেইনা বা কেন? এরা এইরকম একটা পরিস্থিতির জন্যই তো দীর্ঘদিন অপেক্ষা করে আছে। কেউ ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা বিষয়ে ন্যূনতম আওয়াজ করতে নারাজ। বাকী গরিব মুসলিম দেশগুলো যেমন- বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, মালি এরা দর্শকের মতো। একবার সৌদী আরবের দিকে তাকায়, আরেকবার তুরস্কের দিকে তাকায়। তাকায়া তাকায়া ভাবে কার দিকে গেলে অর্থনৈতিক সাহায্য বেশি পাওয়া যাবে।

ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার এইরকম এক সংকট মুহুর্তে আমাদের সকলের উচিত ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের পাশে দাঁড়ানো। এটা ফেসবুকের প্রোফাইল পিকচার চেঞ্জ করার মাধ্যমে করা যায় আবার নিজের নিজের জায়গায় প্রতিবাদ অব্যহত রেখেও করা যায়। এমনকি স্বাধীনতার পক্ষে লেখা একটা লাইনও স্বাধীনতা আন্দোলনকে ত্বরান্বিত করতে পারে। আপনার নাড়া দেয়া একটি মুহুর্ত একটি দিনকে প্রভাবিত করতে পারে। একটি দিন একটি মানুষকে প্রভাবিত করতে পারে। একটি মানুষ পুরো পৃথিবীকে প্রভাবিত করতে পারে। এই আন্দোলন থামার নয়। ফিলিস্তিনের পূর্ন স্বাধীনতা না আসা পর্যন্ত এই আন্দোলন চলবে।

11 February 2018

আজটেক প্রবেশিকা ১১ঃ উপনিবেশকাল ও বর্তমান উত্তরাধিকার

১১ উপনিবেশকাল বর্তমান উত্তরাধিকার
১৫২১ যিশুসনে স্পেন, ‘নতুন স্পেন’ নামে মধ্য আমেরিকা অঞ্চলে তার উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা করা শুরু করে। ক্রমে মধ্য আমেরিকা মহাদেশের প্রত্যেকটি অঞ্চল তাদের দখলে আসে। ১৮১০ যিশুসনে এই অঞ্চলে স্পেনের সাথে স্বাধীনতাকামীদের সংঘর্ষ শুরু হয়। দীর্ঘ সংঘর্ষের পর ১৮২৪ যিশুসনে পুরো মধ্য আমেরিকার স্প্যানিশ কলোনি ‘সংযুক্ত মেহিকো রাষ্ট্র’ নামে প্রজাতন্ত্র হিসেবে স্বাধীন হয়। মেহিকো স্বাধীন হলেও আজটেক জাতি এবং মধ্য আমেরিকার অন্যান্য আদিবাসী-ভূমিপুত্ররা স্বাধীন হয়নি, এমনকি নিজের ভাষায় কথা বলার জন্য দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হয়েছে তাদের।

১১. ঔপনিবেশিক শাসন
১৫২১-১৮২৪ যিশুসন পর্যন্ত আজটেকরা সরাসরি নতুন স্পেনের শাসনের যাতাকলে পিষ্ট হয়। এসময় তাদের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি পরিকল্পিত ভাবে ধ্বংস করা হয়। তাদের ভাষার উপর বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়। আজটেকদের স্কুলে পড়তে হলে স্প্যানিশ ভাষায় পরতে হতো। আজটেকরা প্রায় সবাই খ্রিস্টিয়ান ধর্মে দীক্ষিত হয়। এসময় বিয়ের মাধ্যমে স্প্যানিশদের সাথে আদিবাসী জাতিগুলো মিশ্রিত হতে থাকে। সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়ে আজটেকদের ভাষায়। আজটেক ভাষায় প্রচুর স্প্যানিশ শব্দ প্রবেশ করে। আজটেক লেখ্যরীতি পরিত্যাক্ত হয়।

তবে স্প্যানিশ সংস্কৃতিও আজটেক ও অন্যান্য আদিবাসী জাতি কর্তৃক প্রভাবিত হতে থাকে। স্প্যানিশ ভাষা, সংস্কৃতি, স্থাপত্যকলা আজটেকদের দিয়ে প্রভাবিত হয়। মিশ্র জাতি ‘মেস্টিযো’ মেহিকোতে প্রাধান্য বিস্তার করে।

১১. স্বাধীন মেহিকোতে আজটেক
১৮২৪ যিশুসনে মেহিকো স্বাধীন হলেও আজটেকরা স্বাধীন হয়নি। স্বাধীন মেহিকোতে নিজের ভাষায় পড়াশোনা করার অধিকার তাদের মেলেনি। এই অধিকার পাওয়ার জন্য তাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে, ২০০৩ যিশুসন পর্যন্ত। এর আগ পর্যন্ত স্প্যানিশ ছিলো একমাত্র মাধ্যম। এমনকি স্কুলে নিজেদের ভাষায় কথা না বলার বাধ্যবাধকতা ছিলো। দাপ্তরিক নথিপত্র, আইন-শালিশ, বইপত্র সবকিছুতেই ছিলো স্প্যানিশ ভাষার একক আধিপত্য। আদিবাসী ভাষাগুলোতে সাহিত্য রচনা নিরুৎসাহিত করা হতো।

১৮২০ যিশুসনে মেহিকোর প্রায় ৬০% লোক আদিবাসী ভাষাগুলোতে কথা বলতো। ২০০০ যিশুসনে সেই সংখ্যা সরকারী হিসাবমতে ৫.৪% এ এসে পৌছেছে। যদিও ১৯-২৩% নাগরিক নিজেদের আদিবাসী হিসেবে দাবী করে, কিন্তু ভাষা হিসেবে তারা ব্যবহার করে স্প্যানিশ। মেহিকোর আদিবাসী ভাষাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি লোক আজটেক জনগোষ্ঠীর, প্রায় ২০ লক্ষ। এরপর ইউকাতেক মায়া জনগোষ্ঠী প্রায় ৮ লক্ষ, মিহতেক জনগোষ্ঠী ৪.৫ লক্ষ এবং জাপোতেক জনগোষ্ঠী ৪ লক্ষ। মেহিকোতে স্প্যানিশদের সাথে অন্যান্য আদিবাসী জনগোষ্ঠীগুলোর মিশ্রনকে বিভিন্নভাবে শ্রেণীভুক্ত করা হয়েছে। যেমন, স্প্যানিশ + আদিবাসী = মেস্টিযো, স্প্যানিশ + মেস্টিযো = ক্যাস্টিযো, স্প্যানিশ + ক্যাস্টিযো = স্প্যানিশ ইত্যাদি।

মেহিকোর স্প্যানিশ সংস্কৃতির উপর আজটেক প্রভাব অনস্বীকার্য। অন্যান্য আদিবাসীদের তুলনায় আজটেকদের কাছ থেকে বেশি প্রভাবিত হয়েছে স্প্যানিশরা। মেহিকো শব্দটিই আজটেক। আজটেকরা নিজেদের পরিচয় দিতো ‘মেহিকো জাতি’ বলে। এমনকি মেহিকোর জাতীয় প্রতীকের ছবিটিও আজটেকদের ঐতিহ্য বহন করে। মেহিকোর জাতীয় প্রতীকটি তাদের জাতীয় পতাকাতেও উৎকীর্ন। সেখানে দেবতা হুইটসিলোপোশ্তলিকে (ঈগল রূপে) একটি সাপ মুখে করে নিয়ে একটা ক্যাকটাসের উপর বসে থাকতে দেখা যায়। ক্যাকটাস এখানে আজটেক সাম্রাজ্যের রাজধানী তেনোশতিতলানের প্রতীক। তেনোশতিতলানই আজকের মেহিকো রাষ্ট্রের রাজধানী মেহিকো সিটি।

১১. বর্তমান পরিস্থিতি
২০০৩ যিশুসনের পর আজটেকসহ বাদবাকী আদিবাসী ভাষাগুলো মেহিকোর জাতীয় ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। ফলে এখন থেকে স্কুল, আদালত এবং সরকারী দপ্তরে আজটেক ভাষা ব্যবহার করা যাবে। আজটেক ভাষা শিক্ষার জন্য আলাদা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তৈরী হচ্ছে। আজটেক ভাষায় সাহিত্য রচনার জন্য উৎসাহিত করা হচ্ছে। বর্তমান মেহিকোর তিনটি প্রদেশে আজটেকদের রাজনৈতিক অবস্থানও বেশ শক্তিশালী। এসব প্রদেশে আজটেকদের পরিমান হচ্ছে, পুয়েবলো ১৯%, গুয়েররেরো ১৭% এবং ভেরাক্রুজ ১৫%।

পরিশেষে, আজটেকরা একটি প্রাচীন সমৃদ্ধ সংস্কৃতির অংশীদার। বিশ্বসভ্যতায় এই সংস্কৃতির অবদান নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ। 

10 February 2018

আজটেক প্রবেশিকা ১০ঃ দৈনন্দিন জীবন

১০ দৈনন্দিন জীবন
আজটেকদের দৈনন্দিন জীবন ছিলো বৈচিত্রপূর্ণ। বিভিন্ন পেশার লোকেদের সমন্বয়ে আজটেক সমাজের জনজীবন ছিলো ঘটনাবহুল। আজটেক দৈনন্দিন জীবনে ধর্মের ব্যাপক প্রভাব ছিলো। আজটেক সমাজের প্রভাবশালী অভিজাত ও রাজপরিবারের সদস্যরা সাধারণ লোকেদের নাগালের বাইরে থাকলেও পুরোহিতরা ছিলেন সাধারণের প্রাত্যহিক জীবনের অংশ।

১০. পরিবারব্যবস্থা
আজটেকদের পরিবারব্যবস্থা ছিলো পুরুষতান্ত্রিক কিন্তু নারী এবং বৃদ্ধদের সম্মান করার প্রচলন ছিলো শিশুদের দেবতার আশীর্বাদ মনে করা হতো আজটেক সমাজে আজটেকরা পরিবারব্যবস্থাকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে করতো আজটেকদের পরিবার গঠনের জন্য প্রথমে পড়াশোনা শেষ করা লাগতো পড়াশোনা শেষ হবার পর পারিবারিক মতামত নিয়ে বিয়ে দেয়া হতো আজটেকদের বিয়েতে ঘটকের প্রচলন ছিলো সাধারণত দুই পরিবারের মধ্যে যোগাযোগ করিয়ে দিত ঘটক

বিয়ের জন্য প্রথমেই শিক্ষকের অনুমতি নেয়া লাগতো ছেলে এবং মেয়ে উভয়কেই তার পিতামাতা এবং শিক্ষকের অনুমতি নিয়ে বিয়ের জন্য প্রস্তুতি নিতে হতো বিয়ের জন্য সাধারণ বয়স ছিলো ছেলেদের ২০-২২, মেয়েদের ১৭-২০ বিয়েতে মেয়ে পক্ষের শিক্ষকরা ছেলে পক্ষের শিক্ষকদের হাতে একটা কুঠার তুলে দিতো ছেলে পক্ষের শিক্ষকরা তা গ্রহণ করলে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হতো বিয়েতে আত্মীয়রা একত্রিত হতো নাচ এবং গানের মাধ্যমে বর-কনেকে বরন করে নেয়া হতো বিয়ে পড়ানো হতো মন্দিরে, দেবতাদের সাক্ষী রেখে। বিয়েতে বরকে ভালো স্বামী হওয়ার ব্যাপারে এবং মেয়েকে স্বামীর উত্তম সহযোগী হওয়ার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি দিতে হতো।

সাধারণত আজটেক সমাজ একগামী বিয়েতে অভ্যস্ত ছিলো। তবে রাজপরিবারের সদস্য এবং অভিজাতরা বহুবিবাহ করতে পারতো। বহুবিবাহ আজটেক সমাজে ছিলো বিলাসিতা। পরিবারকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে, ব্যভিচারকে আজটেক সমাজে নিরুৎসাহিত করা হতো। ব্যভিচারের শাস্তি ছিলো মৃত্যুদণ্ড। আজটেক সমাজে একান্নবর্তী এবং একক দুই ধরনের পরিবারেরই অস্তিত্ব ছিলো। আজটেক সমাজে তালাকের ব্যবস্থা ছিলো। তালাকপ্রাপ্ত পুরুষ এবং মহিলা উভয়েই আবার বিয়ে করতে পারতো।

১০. শিক্ষা ব্যবস্থা
আজটেক শিক্ষাব্যবস্থায় দুই ধরনের স্কুলের অস্তিত্ব ছিলো। এক- কালমেকাক, এখানে সমস্ত যাজকীয় বিদ্যা, পঞ্জিকা, জোতির্বিদ্যা, ইতিহাস, গণিত, বিজ্ঞান, লোককথা, গান, নাচ, আইন এবং লেখা শেখানো হতো। আজটেক সমাজের সংস্কৃতি এবং নৈতিকতার শিক্ষাও এই স্কুলে দেয়া হতো। দুই-তেলপোশকাল্লি, এটা মূলত সামরিক স্কুল। এখানে যাজকীয় বিদ্যা বাদে বাকী সব কিছুর সাথে সামরিক শিক্ষা দেয়া হতো।

আজটেক সমাজে সমস্ত শিশুদের শিক্ষা বাধ্যতামূলক ছিলো। আজটেকরা মনে করতো শিশুদের শিক্ষাপ্রদান সামষ্টিক সামাজিক দায়িত্ব। তাই শিক্ষার ব্যাপারে কেবল পিতামাতার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত ছিলো না। আজটেক সমাজে একজন শিশুর জন্মের পরপর তাকে কোন স্কুলে দেয়া হবে তার সিদ্ধান্ত নেয়া হতো। প্রাথমিক শিক্ষা শুরু করার বয়স ছিলো ৩।

১০. খাদ্যাভ্যাস
আজটেকদের প্রধান খাদ্য ছিলো ভুট্টা। ভুট্টা থেকে উৎপাদিত হতো নানান জাতের খাবার। এছাড়া তাদের খাদ্যের তালিকায় ছিলো ম্যাগুই (আমেরিকান ঘৃতকুমারী)। ম্যাগুই থেকে আজটেকরা পোশাক নির্মানের সুতা এবং ‘অক্তলি’ নামক পানীয়ের জন্য রস সংগ্রহ করতো। অক্তলি এখনো মেহিকোতে পাওয়া যায়, তবে তাকে ডাকা হয় ‘পাল্কে’ নামে। ফল বা সবজি হিসেবে আজটেকরা গ্রহণ করতো- নোপাল ক্যাকটাস, কলা, টমেটো, মিষ্টি আলু, বিভিন্ন রকম মরিচ ইত্যাদি। প্রাণিজ খাবারের মধ্যে ছিলো বিভিন্ন রকম মাছ, হাঁস, সারসপাখি, তার্কি, হরিণ, খরগোশ, কুকুর এবং ইগুয়ানা (এক প্রকার গিরগিটি)। হাঁস এবং তার্কিকে ডিম এবং মাংসের জন্য গৃহে পালন করা হতো। সাধারণত দুইবেলা খাদ্যগ্রহন করতো আজটেকরা, সকালে এবং দুপুরে। রাতে খাবার এড়িয়ে চলতো অথবা খুব হালকা খাবার গ্রহণ করতো তারা।

১০. ক্রীড়া শরীরচর্চা
আজটেকদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ছিলো- ‘পাতোল্লি’। পাতোল্লি ৫২ গুটির খেলা। এই খেলা অনেকটা পাশা বা লুডুর মতো। চাররঙা পাথর ব্যবহার করে চারজন খেলোয়ার এটি খেলতে পারতো। পাতোল্লির মাধ্যমে জুয়া খেলতো আজটেকরা। আজটেকদের মধ্যে পাতোল্লি ছাড়াও বিভিন্ন রকম জুয়া এবং বাজির প্রচলন ছিলো। ছাত্র এবং যোদ্ধাদের জন্য বল খেলা বাধ্যতামূলক ছিলো। এছাড়া বিভিন্ন রকম শারীরিক কসরত, কুস্তি, লাঠি নিক্ষেপ, বর্শা নিক্ষেপ, গোলক নিক্ষেপ, দৌড় এবং সাতার খেলতো আজটেকরা।

১০. গান নাচ
আজটেকরা তাদের প্রার্থনা সুর করে গাইতো। প্রার্থনা ছাড়াও তাদের মধ্যে সুর করে কবিতা পাঠের প্রচলন ছিলো। আর একপ্রকার গান ছিলো, যাকে বলা হতো- ‘কান্তারে’ বা ভুতের গান। গানের সাথেসাথে নাচেরও প্রচলন ছিলো। ছাত্রদের জন্য প্রার্থনা এবং কবিতা সুর করে গাওয়া এবং তার সাথে নাচা বাধ্যতামূলক ছিলো। আজটেকদের বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে বাঁশি, ঝুনঝুনি, ড্রাম এবং শঙ্খের ব্যবহার ছিলো। তবে আজটেকদের বাঁশি, ঝুনঝুনি এবং ড্রাম ছিলো তাদের নিজস্ব ঐতিহ্য অনুযায়ী তৈরী।

১০. চিকিৎসা ব্যবস্থা
আজটেকদের মতে মানুষ অসুস্থ হতো তিন কারণে। অতিপ্রাকৃত, জাদুকরী এবং প্রাকৃতিক। আজটেকরা ধারণা করতো মানুষের কৃতকর্মের শাস্তি হিসেবে দেবতারা মানুষকে অসুস্থতা দিচ্ছেন। অসুস্থতা সারানোর জন্য আজটেক পুরোহিতরা অসুস্থ মানুষের উদ্দেশ্যে প্রার্থনা করতো। অসুস্থ মানুষ সুস্থতার জন্য দান করতো, উৎসর্গ করতো এবং পুরোহিতদের ভোজন করাতো। সুস্থতার জন্য আজটেকরা সাধারণত ভেষজ ঔষুধ গ্রহণ করতো। ভেষজ গুল্মের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হতো- ম্যাগুই। সাহাগুনের মতে আজটেকরা চিকিৎসায় প্রায় ১৪৯ রকম ভেষজ লতা-গুল্ম-শিকড় ব্যবহার করতো।

১০. অর্থনৈতিক ব্যবস্থা
আজটেকদের অর্থনীতি কৃষিনির্ভর ছিলো। খাদ্যদ্রব্যের সিংহভাগ নিজেরাই উৎপাদন করতো তারা। এছাড়া উদৃত্ত্ব খাদ্যদ্রব্য আশাপাশের নগররাষ্ট্রগুলোতে রপ্তানি করতো। আজটেকরা মুদ্রা হিসেবে ব্যবহার করতো ‘কোকোয়া বীজ’ এবং তামার কুঠারের পাত। কোকোয়া বীজ হচ্ছে চকোলেট তৈরীর মূল উপাদান। কোকোয়া বীজ শুকিয়ে তাকে বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করতো তারা। তখনকার বাজারমূল্য অনুযায়ী একটুকরা জ্বালানী কাঠের দাম ১ কোকোয়া, একটা তার্কির ডিম ২ কোকোয়া, একটা আস্ত তার্কি ২০ কোকোয়া, ভূমিহীন কৃষকদের একদিনের মজুরী ৪০ কোকোয়া ইত্যাদি। 

9 February 2018

আজটেক প্রবেশিকা ৯ঃ পঞ্জিকা ও জোতির্বিদ্যা

পঞ্জিকা জোতির্বিদ্যা
আজটেকরা জোতির্বিদ্যায় অগ্রসর জাতি ছিলো। তাদের নিজস্ব পঞ্জিকাও ছিলো। আজটেকদের পঞ্জিকা এবং জোতির্বিদ্যা ধর্ম এবং ধর্মীয় জীবনের সাথে জড়িত ছিলো। আজটেকদের কৃষি, উৎসব, দৈনন্দিন জীবন নির্ভর করতো পঞ্জিকার উপর। আজটেকরা পঞ্জিকা পাথরে খোদাই করে রাখতো। 

. পঞ্জিকা
আজটেক পঞ্জিকায় ১৮ মাসে এক বছর। প্রতি মাসে ২০ দিন। প্রতি মাসে ৪ সপ্তাহ এবং প্রতি সপ্তাহে ৫ দিন। বছরের ৩৬৫ দিনের মধ্যে বাকী ৫ দিন নেমোন্তেমি (অশুভ দিন)। এই পাঁচ দিন আজটেকরা কিছু না করার চেষ্টা করতো। প্রতি মাসেই আজটেকদের কোনো না কোনো উৎসব থাকতো। আজটেকদের ১৮ মাস হচ্ছে- ১। আত্‌লচাহুয়ালো (১৪ ফেব্রুয়ারি - ৫ মার্চ), ২। ত্‌লাকাহিপেহুয়ালিযত্‌লি (৬ মার্চ - ২৫ মার্চ), ৩। তোযোযতোন্তলি (২৬ মার্চ - ১৪ এপ্রিল), ৪। হুয়ে-তোযোযতোন্তলি (১৫ এপ্রিল – ৪ মে), ৫। তোহকাত্‌ল (৫ মে – ২৪ মে), ৬। এতজালকুয়ালিযত্‌লি (২৫ মে – ১৩ জুন), ৭। তেকুইলহুইতোন্তলি (১৪ জুন – ৩ জুলাই), ৮। হুয়ে-তেকুইলহুইত্‌ল (৪ জুলাই – ২৩ জুলাই), ৯। ত্‌লাহোশিমাকো (২৪ জুলাই – ১২ আগস্ট), ১০। হোকোত্‌ল-হুয়েতযি (১৩ আগস্ট – ১ সেপ্টেম্বর), ১১। ওশপানিযত্‌লি (২ সেপ্টেম্বর – ২১ সেপ্টেম্বর), ১২। তেওত্‌লেকো (২২ সেপ্টেম্বর – ১১ অক্টোবর), ১৩। তেপেইলহুইত্‌ল (১২ অক্টোবর – ৩১ অক্টোবর), ১৪। কুয়েশোল্লি (১ নভেম্বর – ২০ নভেম্বর), ১৫। পানকুয়েতযালিযত্‌লি (২১ নভেম্বর – ১০ ডিসেম্বর), ১৬। আতেমোযত্‌লি (১১ ডিসেম্বর – ৩০ ডিসেম্বর), ১৭। তিতিত্‌ল (৩১ ডিসেম্বর – ১৯ জানুয়ারি) এবং ১৮। ইযকাল্লি (২০ জানুয়ারি – ৮ ফেব্রুয়ারি)বাদবাকী ৯ - ১৩ ফেব্রুয়ারি নেমোন্তেমি। চার বছর পরপর পাঁচ দিনের জায়গায় ছয় দিন নেমোন্তেমি পালন করা হতো।
 
পাথরে খোদাইকৃত আজটেক পঞ্জিকা
. জোতির্বিদ্যা
আজটেকরা জোতির্বিদ্যা কাজে লাগাতো তাদের কৃষির ক্ষেত্রে। আজটেক জোতির্বিদ-পুরোহিতরা সূর্য-চন্দ্র-নক্ষত্রের নিখুঁত হিসাব রাখতেন। আগের প্রজন্মের গ্রহ-নক্ষত্রের হিসাব তারা পরবর্তী প্রজন্মকে দেখিয়ে দিয়ে যেতেন। আজটেকরা সূর্যগ্রহণ এবং চন্দ্রগ্রহণকে বিপর্যয় হিসাবে দেখতো। তাদের বিশ্বাস ছিলো এটা পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাওয়ার আলামত। আজটেক জোতির্বিদরা ঠিক কখন সূর্যগ্রহন বা চন্দ্রগ্রহন হবে তা বের করতে পারতেন। গ্রহণের সময় আজটেকরা এক জায়গায় সমবেত হয়ে ক্রন্দন করতেন এবং নিজেদের হাত-পায়ে দাগ কাটতেন। গ্রহণের সময় সবচেয়ে সাবধানে রাখা হতো প্রসূতি মায়েদের। আজটেকদের বিশ্বাস ছিলো গ্রহণ তাদের গর্ভের সন্তানকে নষ্ট করে ফেলবে। 

8 February 2018

আজটেক প্রবেশিকা ৮ঃ ভাষা ও সাহিত্য

ভাষা সাহিত্য
আজটেক ভাষা ছিলো খুবই সমৃদ্ধ। আজটেকদের ভাষার নাম ছিলো- ‘নাহুয়াত্‌ল’ নাহুয়াত্‌ল ‘উতো-আজতেকান’ ভাষাপরিবারের সদস্য। নাহুয়াত্‌ল এখনো জীবিত ভাষা। বর্তমান মেহিকো রাষ্ট্রে নাহুয়াত্‌ল দ্বিতীয় বৃহত্তম ভাষা, প্রথম স্প্যানিশ। নাহুয়াত্‌ল ভাষা সাহিত্যেও সমৃদ্ধ। বর্তমানে তেমন সাহিত্য রচিত না হলেও একসময় নাহুয়াত্‌ল প্রভাবশালী সাহিত্যের ভাষা ছিলো। এমনকি আশাপাশের জাতিগুলো তখন নাহুয়াত্‌ল ভাষা ব্যবহার করে সাহিত্য রচনা করতো। সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রেও আজটেকরা মনে করতো এটা বংশানুক্রমিক, অর্থাৎ সাহিত্যের গুণ পুত্র পায় তার পিতার কাছ থেকে।

. ভাষা
আজটেকদের ভাষা এখন স্প্যানিশ দ্বারা প্রভাবিত। তবে একইভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় নাহুয়াত্‌ল শব্দ আছে। সবচেয়ে বেশি নাহুয়াত্‌ল শব্দ প্রবেশ করেছে স্প্যানিশ ভাষায়। সেখান থেকে ইংরেজি ভাষায় এবং তারপর পৃথিবীর অন্যান্য ভাষায়। কমপক্ষে দুইটা নাহুয়াত্‌ল শব্দ আমরা বাংলা ভাষায় প্রায় প্রত্যেকদিন ব্যবহার করি। টমেটো এবং চকোলেট। টমেটো শব্দটার মূল নাহুয়াত্‌ল- ‘তোমাত্‌ল’ এবং চকোলেট এর মূল- ‘চকোলাত্‌ল’এছাড়া স্প্যানিশ এবং ইংরেজি ভাষা আরো বিভিন্ন শব্দের জন্য নাহুয়াত্‌ল ভাষার কাছে ঋণী।

নাহুয়াত্‌ল ভাষার অনেকগুলো উপভাষা রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য- ইশ্তমুশ, মেহিকানেরো, পিপিল, মিশোয়াকান, পোমারো, তেতেল্কিঙ্গো ইত্যাদি। দুইএকটা ব্যঞ্জনবর্ণ উচ্চারণে সামান্য তারতম্য ছাড়া উপভাষাগুলোতে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। এক উপভাষা ব্যবহারকারী অপরকে বুঝতে পারে এবং নিজেরা যোগাযোগ করতে পারে। আজটেক ভাষায় মৌলিক স্বরধ্বনি ছাড়াও রয়েছে ব্যঞ্জনধ্বনি। তবে আজটেকদের ব্যবহৃত নাহুয়াত্‌ল ভাষায় ব্যঞ্জনবর্ণের সংখ্যা ছিলো খুবই কম। বর্তমানে স্প্যানিশ বিভিন্ন উচ্চারন নাহুয়াত্‌ল ভাষায় প্রবেশ করেছে। আজটেকদের ব্যবহৃত নাহুয়াত্‌ল ব্যঞ্জনধ্বনিগুলো হলো- ম, , , , , ক্ব, ট্‌স, ত্‌ল, ত্‌শ,, , , হ এবং য়। শব্দের শেষ ‘হ’ অনুচ্চারিত থাকতো। ত্‌ল, ত্‌শ শব্দগুলো উচ্চারণের সময় অনুরণিত হতো। ‘স’ এর উচ্চারণ ক্ষেত্রবিশেষে ‘য’ এর মতো হতো।

আজটেকরা মূল শব্দের সাথে ‘ত্‌ল’ এবং ‘ত্‌লি’ উপসর্গ যুক্ত করতো। নাহুয়াত্‌ল ভাষায় সন্ধির উদাহরণও আছেযেমন- হোশিত্‌ল মানে ফুল এবং মিল্লি মানে মাঠ বা বাগান। ফুলের বাগান হবে হোশি(ত্‌ল)+মিল্লি বা হোশিমিল্লি। আজটেকরা একটা পুরো বাক্যও এক শব্দের মতো বলতো। যেমন- মিত্‌যমোত্‌যাতযাকুইলতিতিমানিযকু অর্থাৎ তারা তোমার পক্ষে যাবে, হয় বামে নয় ডানে।

. লেখনরীতি
আজটেকদের লেখনরীতি ছিলো চিত্রভিত্তিক। প্রতিটি শব্দের জন্য একটি চিত্র। অনেকসময় একই শব্দ বিভিন্ন চিত্রে বোঝানো হতো, আবার একই চিত্র দিয়ে বিভিন্ন শব্দ বোঝানো হতো। এই ধোঁয়াশার কারণে আজটেকদের লেখনরীতি যথেষ্ট দুর্বোধ্য। আজটেকদের সময়ে সবাই লিখতে পারতো না। লেখার ক্ষমতা কাউকে কাউকে দেয়া হতো। তবে সবাই পড়তে পারতো। এখন নাহুয়াত্‌ল ভাষা লেখা হয় স্প্যানিশ বা রোমান লিপি ব্যবহার করে।

. গণনারীতি
আজটেকদের গণনা ছিলো ২০ ভিত্তিক। হাতের ১০ আঙুল এবং পায়ের ১০ আঙুল, এই থেকে আজটেকদের ২০। আজটেকদের ১-৪ পর্যন্ত গণনা ছিলো সোজা, এরপরের গণনা একটু কঠিন। তবে পাঁচটা মূল শব্দের মাধ্যমে গণনাকে সহজ করা যেতো। মূলশব্দগুলো হলো- সেম বা সেন, মাতলাক্তলি, পহুয়াল্লি, যোন্তলি এবং সিকুইপিল্লি। আজটেকদের সংখ্যাগুলো নিচে দেয়া হলোঃ

সংখ্যা
নাহুয়াত্‌ল
সংখ্যা
নাহুয়াত্‌ল
সে
২১
সেম্পহুয়াল্লিয়নসে
ওমে
২৯
সেম্পহুয়াল্লিয়নশিসোনাহুই
ইয়েই
৩০
সেম্পহুয়াল্লিয়নমাতলাক্তলি
নাহুই
৩৯
সেম্পহুয়াল্লিয়নসাহতোল্লিয়ন্নাহুই
মাকুইল্লি
৪০
ওম্পহুয়াল্লি
সিচুয়াসে
৬০
ইয়েইপহুয়াল্লি
সিচোমে
৮০
নাউহপহুয়াল্লি
সিচুয়েই
১০০
মাকুইল্পহুয়ালতেত্‌ল
সিচোনাহুই
৪০০
সেন্তযোন্তলি
১০
মাতলাক্তলি
৪০১
সেন্তযোন্তলিয়নসে
১১
মাতলাক্তলিয়নসে
৪০৫
সেন্তযোন্তলিয়নমাকুইল্লি
১২
মাতলাক্তলিওমোমে
৫০০
সেন্তযোন্তলিইপানমাকুইল্পহুয়াল্লি
১৩
মাতলাক্তলিওমেই
৮০০
ওমযোন্তলি
১৪
মাতলাক্তলিওন্নাহুই
,২০০
ইয়েতযোন্তলি
১৫
সাহতোল্লি
,০০০
মাতলাক্তযোন্তলি
১৬
সাহতোল্লিয়নসে
,০০০
সেমসিকুইপিল্লি
১৭
সাহতোল্লিওমোমে
১৬,০০০
ওমসিকুইপিল্লি
১৮
সাহতোল্লিওমেই
২৪,০০০
ইয়েসিকুইপিল্লি
১৯
সাহতোল্লিওন্নাহুই
৮০,০০০
মাতলাকসিকুইপিল্লি
২০
সেম্পহুয়াল্লি
৩২,০০,০০০
সেন্তযোনসিকুইপিল্লি

টেবিলঃ আজটেক সংখ্যা।

সংখ্যাগুলো লেখায় প্রকাশ করার ক্ষেত্রে ১-৪ পর্যন্ত আজটেকরা ডট ব্যবহার করতো। ১- ১ ডট, ২- ২ ডট, ৩- ৩ ডট। পাঁচে যাওয়ার পর ব্যবহার করতো একটা বক্স বা বার। আবার ৬-৯ এর ক্ষেত্রে বার এর উপর একটা ডট, দুইটা ডট। এভাবে ১০ প্রকাশ করতো একটা বারের ভিতর আরেকটা বার। ২০ ব্যবহার করতে একটা পতাকা, ৪০ দুইটা পতাকা। ৪০০ এর জন্য একটা পাতা। ৮০০ এর জন্য দুইটা পাতা।

. সাহিত্য
আজটেকদের ছিলো সমৃদ্ধ সাহিত্য সাহিত্যের মধ্যে ছিলো কবিতা প্রাচীন আজটেক সাহিত্যধারায় কবিতাই ছিলো মুলস্রোত প্রার্থনা, স্তুতি, লোককথা এমনকি দার্শনিক চিন্তাভাবনা পর্যন্ত কবিতার মাধ্যমে প্রকাশ করা হতো দার্শনিক চিন্তাভাবনা যারা কবিতার মাধ্যমে প্রকাশ করতেন তাদের বলা হতো- কবি-দার্শনিক কবিতার ভাষা ছিলো সহজবোধ্য যেনো সাধারণ জনগন তা বুঝতে পারে কবিতার ভাষায় গল্প বলারও প্রচলন ছিলো আজটেক সমাজে

আজটেক সমাজের কিছু বিখ্যাত কবি এবং কবি-দার্শনিকের নাম পাওয়া যায় এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন- তেহকোকোর শাসক নেযাহুয়াল্কোয়োত্‌ল, তেনোশতিতলান এর  তোশিহুইতযিন, ত্‌লাতেলোল্কো এর তেমিলোতযিন, তেকামাশাল্কো এর যুবরাজ আয়োসুয়ান সুয়েতযপালিন, হুয়েহুতযিঙ্কো এর তেকায়েহুয়াতযিন, কবি-দার্শনিক সুয়াউহতেকোযত্‌লিকালের বিবর্তনে এবং স্প্যানিশ ঔপনিবেশিক শাসনের ফলে এখন বেশিরভাগ আজটেক কবিতাই হারিয়ে গেছে। কিছু কবিতা কেবল রয়ে গেছে আজটেকদের সমৃদ্ধ সাহিত্যের উদাহরণ হিসেবে।