22 January 2018

কিভাবে একটি বই পাঠকের কাছে পৌঁছায়?

প্রথমে লেখক কোনো সাদা পৃষ্ঠার কাছে গিয়ে বলেন- 'হও'। তারপর সেখানে লেখা হয়ে যায়। তারপর লেখাটা তিনি প্রকাশকের কাছে পাঠিয়ে দেন। প্রকাশক লেখাটাকে আবার বলেন- 'হও'। তারপর লেখাটা বাঁধাই হয়ে বই আকারে পাঠকের হাতে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়। বই তৈরীর ব্যাপারে এরকম মিথ বাজারে প্রচলিত আছে কিনা আমার জানা নাই, তবে এরকমটা অনেকে ভেবে থাকতে পারেন। আসলে একটি বই কিভাবে তৈরী হয়? কিভাবে একটা মৌলিক লেখা বই আকারে পাঠকের হাতে পৌঁছায়?

বই তৈরীর প্রধান উপাদান লেখা। লেখা লেখেন লেখক। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, ইতিহাস, দর্শন, বিজ্ঞান সবই প্রথমে লেখককে লেখতে হয়। লেখার জন্য লেখককে অনেকগুলো প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। তাকে বিষয়ভিত্তিক পড়তে হয়, চিন্তা করতে হয়। একজন লেখক প্রধানত একজন পাঠক। গবেষণাসংক্রান্ত লেখা তৈরীর জন্য কোনো কোনো লেখক নিজেদের চাকরী ছেড়ে দেন এমন নজিরও আছে। প্রচুর পাঠ, শ্রম, সময়, অর্থ ব্যায়ের পর একটা লেখা তৈরী হয়। লেখা তৈরী হওয়াটা বই বের হওয়ার একদম প্রাথমিক ধাপ।

লেখাটা তারপর যায় প্রকাশকের কাছে। প্রকাশকের কাছে যাওয়ার পর মূলত কাজ শুরু হয়। প্রকাশক লেখাটা নিজে পড়েন, কয়েকজনকে পড়ান। লেখাটা ছাপানোর উপযোগী হলে প্রকাশক তা ছাপানোর প্রস্তুতি নেন (কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া, সাধারণত প্রকাশকরা লেখা পড়েই ছাপান)। লেখাটার জন্য তখন একটা প্রচ্ছদ তৈরী হয়। প্রচ্ছদ করেন প্রচ্ছদকাররা। তারপর লেখাটা প্রেসে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়।

লেখাটা প্রেসে যাওয়ার জন্য 'পেইজ সেটাপ' দিতে হয়। লেখাটা কতো পৃষ্ঠার বই হবে, কেমন কাগজ হবে, বাঁধাই কেমন হবে এসব ঠিক করা হয়। লেখাটায় বানান ভুল আছে কিনা দেখা হয়, প্রাসঙ্গিক ছবি বসানো হয়, লেখাটাকে বইয়ের প্রতি পৃষ্ঠায় কিভাবে বসানো হবে তা ঠিক করা হয়।

পেইজ সেটাপ দেয়ার পর তা প্রেসে যায়। প্রেসে গেলে বইটা ছাপানোর জন্য কাগজ লাগে, কালি লাগে। প্রকাশকদের নিজের ছাপাখানা না থাকলে অন্যের ছাপাখানা থেকে ভাড়ায় ছাপাতে হয়। ছাপানোর পর বই যায় বাঁধাইয়ে। বাঁধাইখানায় বইটাকে বাঁধাই করা হয়। তার উপর প্রচ্ছদ চাপানো হয়। বইটা তখন পাঠকের হাতে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়।

প্রকাশকের এই সব কাজ করার জন্য একটা অফিস লাগে। অফিসের ভাড়া আছে, বিদ্যুৎ বিল আছে, প্রাত্যহিক কিছু খরচ আছে। অফিসে কয়েকজন লোক লাগে যারা পেইজ সেটাপ দিবে, ছাপাখানায় দৌড়াদৌড়ি করবে। বইটা রেডি হলে আবার অফিসে এনে রেখে দেবে। ছাপাখানায় আলাদা কারিগর লাগে, বাঁধাই করার জন্য আলাদা কারিগর লাগে। তাদের প্রত্যেককে বেতন দেয়া লাগে। প্রত্যেকটা জায়গায় আলাদা আলাদা খরচ আছে। এতোসব খরচের পর একটা একটা বই পাঠকের কাছে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়।

এতো শ্রম আর অর্থ ব্যয় করার পরও প্রকাশক জানেন না বইটা পাঠক পড়বে কিনা? পাঠক বইটা কিনবে কিনা? যারা মনে করেন একটা বই ফ্রিতে ফ্রিতে তৈরী হয়ে যায় তাদের প্রতি অনুরোধ জীবনে অন্তত একদিন বাংলাবাজার গিয়ে বসে বসে দেখবেন কিভাবে বই তৈরী করা হয়। বই আসলে একটি পন্যই। বইকে পন্য হিসেবে দেখুন, কিনে বই পড়ুন।

4 January 2018

বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার সংকটঃ আমরা কোথায় যেতে চাই?

বর্তমান বাংলাদেশে বহুমুখী শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলিত আছে। এবং এই বহুমুখী শিক্ষার শেষ কোথায় আমরা তা জানি না। আমাদের এই দেশে বাংলায় পড়ানো হয়, ইংরেজীতে পড়ানো হয়, আরবীতে পড়ানো হয়। বাংলা আর আরবীর ক্ষেত্রে আবার সরকারী ও বেসরকারী দুইটা ধারা। এতোসব শিক্ষার রাস্তা আসলেতো গিয়ে মিলার কথা জীবন সংগ্রামের সাথে। এই শিক্ষার গন্তব্য যে আসলে কোথায় তা কেউ জানে না। না ছাত্ররা, না শিক্ষকরা, না অভিভাবকরা, না সরকার।
বাকি সব সংকট বাদ দিলাম। যেমন- প্রশ্নপত্র ফাঁস, নকল, মেধা বাছাইয়ে দুর্নীতি, নজরদারীহীনতা ইত্যাদি। তারপরও আমরা জানিনা এই শিক্ষা আমাদের কোথায় নিয়ে যেতে চায়!? একটা বাঘ তার বাচ্চাকে জন্মের পর হরিণ শিকারের ট্রেনিং দিয়ে টিকে থাকতে শেখায়। একটা হরিণ তার বাচ্চাকে জন্মের পর বাঘের হাত থেকে বাঁচার ট্রেনিং দিয়ে টিকে থাকতে শেখায়। আমরা মানবজাতি আমাদের বাচ্চাদের কি শেখাতে চাই? কেনো শেখাতে চাই?
শিক্ষার প্রধানতম ভিত্তিঃ
শিক্ষার প্রধানতম ভিত্তি মানবজাতির জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে প্রবাহিত করা। যদি প্রত্যেক প্রকার অভিজ্ঞতা প্রত্যেক প্রজন্মের মানুষকে নতুন করে শিখতে হয়, এর চেয়ে ভয়াবহ আর কিছু হতে পারে না। পূর্ব প্রজন্মের মানুষ তাই তার পরের প্রজন্মকে নিজেদের ব্যবহার করা অভিজ্ঞতা শিক্ষার মাধ্যমে তুলে দিয়ে যায়। একজন মানবসন্তানকে তাই সবই শিখতে হয়। তার মহাকাশ বিজ্ঞান জানা লাগে, তার ইতিহাস জানা লাগে, গণিত, পদার্থ বিজ্ঞান, ভূগোল, অর্থনীতি, অনুজীববিজ্ঞান সবই জানা লাগে। তার বিমান চালানো শিখতে হয়, গাড়ি চালানো শিখতে হয়, রাস্তা পাড় হওয়াও শিখতে হয়। বড়দের সম্মান শিখতে হয়, ছোটদের আদর শিখতে হয়। তাকে নিজের কাজ নিজে করা শিখতে হয়, জায়গা মতো ময়লা ফেলা শিখতে হয়, উপকার পাওয়ার পর ধন্যবাদ দেয়া শিখতে হয়। তাকে সব শিখতে হয়।

শিক্ষার ব্যবহারঃ 
শিক্ষাটাকে মানুষ ব্যবহার করে জীবনধারণের উপায় হিসেবে। প্রথাগত শিক্ষা ব্যবহার করে মানুষ চাকুরি করে, ব্যবসা করে। চাকুরি আর ব্যবসার মূল লক্ষ্যই হচ্ছে জীবনধারণ। এটাই মানুষের শিক্ষা গ্রহনের মূল উদ্দেশ্য। এর পাশাপাশি শিক্ষা গ্রহনের আর একটা উদ্দেশ্য আছে। নতুন নতুন জ্ঞান উৎপাদন করে মানুষের জীবনধারণকে আরো সহজ ও উদ্দেশ্যপূর্ণ করে তোলা।

শিক্ষার সংকটঃ 
আমাদের দেশের শিক্ষার নানামূখী সংকট। আমাদের শিক্ষা কর্মমূখী না, আমাদের শিক্ষা দক্ষ জনশক্তি উৎপাদন করে না, আমাদের শিক্ষায় এথিক্স নাই, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় রমরমা নকল ও প্রশ্ন ফাঁস, আমাদের সিলেবাসের নির্দিষ্ট কোনো লক্ষ নাই, আমাদের সিলেবাস একমূখী না, আমাদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা মুখস্ত করতে বাধ্য করা হয়, যারা আমাদের শিক্ষা দিবে সে শিক্ষকদের যথাযথ ট্রেনিং নাই, ছাত্রদের উপর নানাবিধ শারীরিক ও মানসিক প্রেসার ইত্যাদি।

কেমন শিক্ষা দরকারঃ 
আমাদের এমন শিক্ষা দরকার যা একমুখী, কর্মমূখী এবং বিজ্ঞানমূখী। এই শিক্ষা আমাদের জীবনধারণের জন্য প্রয়োজন এমন ট্রেনিং দেবে। চাকুরি এবং ব্যবসায়ের পাশাপাশি নিজে কিছু করতে উদ্বুদ্ধ করবে। শুভ উদ্যোগকে স্বাগত জানাবে, উদ্যোক্তা তৈরী করবে। পরবর্তী প্রজন্মকে শিক্ষিত করতে শিক্ষকদের যথাযথ ট্রেনিং দেবে। জনশক্তি বিদেশে পাঠানোর আগে তাকে দক্ষ জনশক্তি হিসেবে ট্রেনিং দিয়ে তারপর পাঠাবে। সর্বোপরি মেধার বিকাশ ঘটাবে এবং মানবজাতির জ্ঞানকাণ্ড সম্প্রসারিত করতে সাহায্য করবে।

কিভাবে সংকট মোকাবেলা করবোঃ
সরকারী উদ্যোগঃ 
উপরে যতোগুলো কথা বললাম, তার প্রত্যেকটার সমাধান সম্ভব যদি সরকার উদ্যোগ নেয়, একথা আমরা সবাই জানি। কিন্তু আমাদের সরকার শিক্ষা নিয়ে কি ভাবে আমরা সবাই তা টের পাই। আমরা সবাই হতাশ আর হতাশা ঢাকার জন্য আমরা শিক্ষামন্ত্রীকে নিয়ে হাসিঠাট্টা করি। বৃহৎ পরিসরে সরকার উদ্যোগ নিলে সংকটের নিরসন খুব সম্ভব।

বেসরকারী উদ্যোগঃ 
কেবল সরকারকে দোষ না দিয়ে, ব্যক্তিগত বা সামস্টিক উদ্যোগে স্বল্প পরিসরে এই সংকট নিয়ে কাজ করা যায়। ব্যক্তিগত বা সামস্টিক উদ্যোগে পাঠচক্র বা আলোচনা চক্র করা যায়। এই পাঠচক্রে যার যে বিষয় পছন্দ সে বিষয় জানতে পারে, জানাতে পারে। পাঠচক্র কিছু হচ্ছে দেশে, আরো ব্যাপক পরিসরে হওয়া প্রয়োজন। পাশাপাশি পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। পাঠাগার ব্যক্তিগত হতে পারে, গ্রাম ভিত্তিক হতে পারে, স্কুল ভিত্তিক হতে পারে, এলাকা ভিত্তিক হতে পারে। এই পাঠচক্র আর পাঠাগারের মধ্য দিয়েই গড়ে উঠতে পারে একটি প্রজন্ম যেমনটা আমরা চাই।

[বেসরকারীভাবে সংকট মোকাবেলার আরো উপায় থাকতে পারে। সেগুলো নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে...]