৪
সমাজ
ও
সরকার
আজটেক সভ্যতা তার নিজস্ব
উপাদানে অনন্য ছিলো। আজটেক সভ্যতা যখন তার উৎকর্ষের শিখরে তখনই তা ধ্বংসপ্রাপ্ত
হয়। আজটেক সমাজ কাঠামোয় ছিলো সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা। সম্রাট ছিলেন সমস্ত
ক্ষমতার উৎস। সমাজে পুরোহিত ও অভিজাতরা প্রচণ্ড শক্তিশালী ছিলেন। এছাড়া
সমাজব্যবস্থায় সাধারন মানুষের অংশগ্রহণ ছিলো। আজটেক সমাজে দাসপ্রথা চালু ছিলো।
সমাজে বিভিন্ন রকম পেশাজীবীর অস্তিত্ব ছিলো, তবে যোদ্ধাদের আলাদা মর্যাদা
দেয়া হতো।
৪.১ সামাজিক শ্রেণীবিন্যাস
শ্রেণী
|
স্তর
|
|
সম্রাট
|
সম্রাটের সহকারী
|
|
অভিজাত
|
প্রধান পুরোহিতদ্বয়
|
|
উচ্চ-প্রভু
|
অভিজাত
|
|
|
ব্যবসায়ী
|
শিল্পী, সরকারী কর্মচারী, কৃষক
|
|
সাধারণ
|
ভূমিহীন কৃষক
|
|
সাধারণ নাগরিক
|
দাস
|
টেবিলঃ আজটেকদের সামাজিক শ্রেণীবিন্যাস।
আজটেক সামাজিক শ্রেণীবিন্যাসে আজটেকদের প্রধানত
দুইভাগে ভাগ করা হতো, অভিজাত
এবং সাধারন। অভিজাতদের মধ্যে আবার শ্রেণীভাগ করা হতো। আজটেক সমাজে সবার উপরে অবস্থান
সম্রাটের (ত্লাতোয়ানি)। সম্রাট সরাসরি দেবতা
হুইটসিলোপোশ্তলির প্রতিনিধি হিসেবে সাম্রাজ্য শাসন করতেন। তারপর থাকতেন একজন
চিহুয়াকোয়াত্ল (সহকারী)। তিনি
মূলত সম্রাটের প্রতিনিধি হিসেবে নিচের স্তরগুলোতে যোগাযোগ রক্ষা করতেন। সম্রাটের
অবর্তমানে তিনি সাময়িক শাসনকর্তা হতে পারতেন। তারপর থাকতেন কুয়েতজালকোয়াত্ল-তোতেক-ত্লামাকাজকুই
(দেবতা হুইটসিলোপোশ্তলির প্রধান পুরোহিত) এবং কুয়েতজালকোয়াত্ল-ত্লালক-ত্লামাকাজকুই
(দেবতা ত্লালকের প্রধান পুরোহিত)। এরা দুইজন সাম্রাজ্যের প্রধানতম পুরোহিত এবং একইসাথে প্রধান
বিচারকর্তা। এরপর থাকতেন ‘তেচুতলি’ বা উচ্চ-প্রভু এবং ‘পিল্লি’ বা অভিজাত।
জন্মসূত্রের মাধ্যমে এই ক্রম রক্ষা করা হতো। তবে সম্রাট চাইলে কাউকে উচ্চপদে বা
নিম্নপদে নিতে পারতেন।
আজটেক সমাজে সাধারন (মাচেহুয়ালতিন) কে কয়েকভাগে
ভাগ করা হতো। সাধারণদের মধ্যে উপরে অবস্থান করতেন ব্যবসায়ী (পোশ্তেকা), শিল্পী এবং সরকারী কর্মচারীরা। ব্যবসায়ীরা তাদের
অর্থনৈতিক প্রাচুর্যের কারনে কিছু বিশেষ সুবিধা পেত কিন্তু অভিজাতদের মতো সম্মান
পেতো না। শিল্পীরা সুবিধা পেত তাদের বিশেষ দক্ষতার কারনে। সরকারী কর্মচারীরাও
রাষ্ট্রীয় কিছু সুবিধা পেত। সবাই তাদের সুবিধামতো সাম্রাজ্যকে সেবা প্রদান করতো।
তারপরের স্তরে থাকতেন কৃষকেরা। কৃষকদের মধ্যে যাদের নিজস্ব ভূমি ছিলো তারা ভূমিহীন
কৃষকদের চেয়ে উপরে অবস্থান করতেন। এরপর অন্যান্য নাগরিক এবং দাসদের (ত্লাকোতিন)
অবস্থান ছিলো।
৪.২ আজটেক সম্রাট
আজটেক সমাজে আজটেক সম্রাটের অবস্থান সবার উপরে।
তাকে ডাকা হতো ত্লাতোয়ানি অর্থাৎ তিনি, যিনি বলেন। সম্রাটের পদ সাধারণত বংশানুক্রমিক। তবে সম্রাটদের প্রচুর
সন্তানাদি থাকায় যোগ্যতমদেরই সম্রাট পদের জন্য মনোনীত করা হতো। সম্রাটের বাকী
বংশধরেরা উচ্চ-প্রভু হিসেবে প্রচুর আরাম-আয়েশ ভোগ করতে পারতেন। সম্রাট হওয়ার জন্য
নিজেকে যোগ্য যোদ্ধা প্রমান করতে হতো। ভাবী-সম্রাটকে অবশ্যই কোনো সামরিক অভিযানে
অংশগ্রহণ করতে হতো। সেখানে তাকে জয়লাভ করতে হতো এবং সেখান থেকে যুদ্ধবন্দীদের দাস
হিসেবে ধরে নিয়ে আসতে হতো। যুদ্ধবন্দীদের সম্রাটের অভিষেকের সময় বলি দেয়া হতো।
এছাড়াও সম্রাটকে যাবতীয় যাজকীয় কার্যক্রম সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান রাখতে হতো। এছাড়া
তার অক্ষরজ্ঞান, ভাষাজ্ঞান এবং হিসাবজ্ঞান থাকা
আবশ্যক ছিলো। ১৩৭৫ থেকে ১৫২৫ পর্যন্ত আজটেক ইতিহাস শাসন করেছেন মোট ১১ জন সম্রাট।
সম্রাট
|
নামের অর্থ
|
শাসনকাল
|
আকামাপিশ্তলি
|
তীরের মুষ্ঠি
|
১৩৭৫-১৩৯৫
|
হুইটযিলিহুইত্ল
|
হামিং পাখির পালক
|
১৩৯৫-১৪১৭
|
চিমালপোপোকা
|
ধোয়াচ্ছন্ন ঢাল
|
১৪১৭-১৪২৭
|
ইজকোয়াত্ল
|
কাচের সাপ
|
১৪২৭-১৪৪০
|
মকতেজুমা ইলহুইশামিনা
|
দ্যুতীরন্দাজ ক্রুদ্ধপ্রভু
|
১৪৪০-১৪৬৯
|
আশায়াকাত্ল
|
জলমুখী
|
১৪৬৯-১৪৮১
|
তিযোসিকাতসিন
|
চুনাপাথরের পা
|
১৪৮১-১৪৮৬
|
আহুইটযোত্ল
|
জলজন্তু
|
১৪৮৬-১৫০২
|
মকতেজুমা হোসোয়োতযিন
|
ছোটো ক্রুদ্ধপ্রভু
|
১৫০২-১৫২০
|
সুইটলাহুয়াক
|
---
|
১৫২০
|
সুয়াউহতেমোক
|
বংশধর ঈগল
|
১৫২০-১৫২৫
|
টেবিলঃ আজটেক সম্রাটদের তালিকা।
৪.৩ পুরোহিত সমাজ
আজটেক সমাজ,
রাষ্ট্রব্যবস্থা এবং ধর্ম আলাদা বিষয় ছিলো না।
আজটেক সমাজে পুরোহিতদের বিশেষ গুরুত্ব ছিলো। সম্রাট ছিলেন পুরোহিতদের প্রধান।
সম্রাটের নিচেই ছিলেন, প্রধান
দুই পুরোহিত। তারা দুইজন একই মর্যাদার অধিকারী ছিলেন। তারা দুইজন তেনোশতিতলানের
প্রধান মন্দিরের পুরোহিতের দায়িত্ব পালন করতেন। একজন দেবতা হুইটসিলোপোশ্তলির
পুরোহিত, অপরজন দেবতা ত্লালকের পুরোহিত।
তারপর প্রত্যেক দেবদেবীর জন্য আলাদা আলাদা পুরোহিত ছিলেন। প্রত্যেক মন্দিরের জন্য
আলাদা আলাদা পুরোহিত ছিলেন। এভাবে প্রচুর সংখ্যাক পুরোহিত সরাসরি পুরোহিত-বিভাগের
সাথে জড়িত ছিলেন। পুরোহিত-বিভাগ দেখাশোনা করতেন একজন উর্দ্ধতন পুরোহিত। তার উপাধি
ছিল- মেহিকাত্ল তেওহুয়াতজিন।
এরপরের স্তরে আছেন,
ত্লেনামাকাক অর্থাৎ অগ্নি-পুরোহিত। ত্লেনামাকাকরা
নরবলির দায়িত্বপ্রাপ্ত পুরোহিত। নরবলিসংক্রান্ত কাজ,
শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সম্পাদন করার দায়িত্ব ছিলো
তাদের। এরপর, ত্লামাকাজতেকুইহুয়াকু বা
যোদ্ধা-পুরোহিত। এদের দায়িত্ব ছিলো যুদ্ধক্ষেত্রে আজটেকবাহিনীর সামনে থাকা। এই
পুরোহিতেরা আজটেক বাহিনীকে যুদ্ধে উদ্দীপ্ত করতো। কখনো এরা সম্রাটের প্রতিনিধি
হিসেবে শত্রুরাজার কাছে দূত হিসেবে যেতো। এরপর চিহুয়াতলামাকাজকুই অর্থাৎ মহিলা
পুরোহিত। আজটেক সমাজে মহিলারা পুরোহিত হতে পারতো।
এরপর ত্লামাতিনি অর্থাৎ জ্ঞানী মানুষ। মূলত ত্লামাতিনিরা
শিক্ষক পুরোহিত। এদের কাজ ছিলো প্রধানত শিক্ষানবিশ পুরোহিতদের শিক্ষা দেয়া। তবে
এছাড়া তারা বই লিখতো, বই
কপি করতো, কবিতা লিখতো, ডাক্তারি করতো ইত্যাদি। তারা একই সাথে কবি, দার্শনিক,
পরামর্শদাতা,
গাইড এবং সমাজের অগ্রসর জ্ঞানী অংশ। এরপর
ওসেলোকুয়াসুইল্লি অর্থাৎ জাগুয়ার পুরোহিত। এরা মূলত জাদুকর পুরোহিত। এছাড়া এরা
ভবিষ্যৎবাণী করতো। জাদুকর পুরোহিতের ঐতিহ্য মূলত হুয়াস্তেকা জাতির। তেতোনালমাকানি
অর্থাৎ শিক্ষানবিশ পুরোহিত। যেসব শিশুসন্তান পুরোহিত হওয়ার জন্য লেখাপড়া করবে
তাদের শিক্ষানবিশ পুরোহিত বলা হবে। শিক্ষানবিশ পুরোহিতদের জন্য আলাদা স্কুল এবং
পাঠ্যক্রমের ব্যবস্থা ছিলো।
৪.৪ রাজনীতি
আজটেক রাজনীতিতে সবচেয়ে
গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন সম্রাট। যেকোনো সিদ্ধান্ত মূলত তিনিই নিয়ে থাকতেন। তবে
রাষ্ট্রসংক্রান্ত সিদ্ধান্তগুলো পরামর্শ করে নেয়া হতো বেশিরভাগ সময়। আজটেক গণজীবনে
জনমতের প্রতি বিশেষ দুর্বলতা ছিলো। সম্রাটকে পরামর্শ দেয়া যেতো। এক্ষেত্রে মূলত
রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতো- রাজপরিবারের সদস্যরা, বয়োজৈষ্ঠ যোদ্ধা এবং পুরোহিতরা, অভিজাত এবং কোনো
কোনো ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীরা।
৪.৫ প্রশাসনিক বিভাগ
আজটেক সাম্রাজ্য মূলত তিনটি নগররাষ্ট্রের একটি
জোট। এই তিনটি নগররাষ্ট্র হচ্ছে- তেনোশতিতলান,
তেহকোকো এবং ত্লাকোপান। এরপর যতোগুলো নগররাষ্ট্র
আজটেক সাম্রাজ্য অধিকার করেছে তার সুবিধা এই তিনটি নগররাষ্ট্রই ভোগ করেছে। রাজধানী
এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নগররাষ্ট্র হিসেবে তেনোশতিতলান সবার চেয়ে বেশি সুবিধা
পেয়েছে। সুবিধা ভাগের ক্ষেত্রে মূলত অগ্রাধিকার দেয়া হতো ‘কর’কে। এছাড়া দখলকৃত
নগররাষ্ট্রের আর তেমন কোনো হেরফের করা হতো না। আজটেক সম্রাটের জন্য স্বীকৃতি আর কর, এই দুইই ছিলো তখনকার আজটেকদের সাম্রাজ্য বিস্তারের
মূলনীতি। এতে করে রাষ্ট্রগুলোর ব্যবসা-বাণিজ্য,
কৃষি এবং শিল্প ক্ষতিগ্রস্থ হতো না। তবে অস্বীকার
বা বিদ্রোহের ফলাফল হতো ভয়াবহ।
তিনটি
প্রধান নগররাষ্ট্র ছাড়াও, শাসনকাজের সুবিধার্তে পুরো সাম্রাজ্যকে ৩২ টি প্রদেশে ভাগ করা হয়েছিলো। কোনো কোনো প্রদেশে একের অধিক নগররাষ্ট্র ছিলো। প্রদেশগুলো হলো- আতলান, আতোতোনিল্কো, হুয়ে-আতোতোনিল্কো, আহোকোপান,
চিহুয়াতলান, কোইত্লাহুয়াকান, কোতাশত্লান, চুয়াহুয়াকান, চুয়াউহ্নাহুয়াক,
কোয়োল্পান, হুয়াহতুস্কো, হুয়াহতেপাক, মালিনাল্কো, ওকুইলান, ওশিতিপান,
কুয়াউহতেওপান, শোসোনোশকো, তেপেয়াকাক, তেপেকোয়াকুইল্কো, ত্লাশকো, ত্লাকোযাউতিতলান, ত্লাপাকোয়ান, ত্লাপান, ত্লাতলাউকুইতেপাক, ত্লাশকুইয়াশকো, তোহপান, তোশ্তেপাক,
তলুচান, ৎযিকোয়াক, শিলোতেপাক, হোশোতিলান
এবং ইয়োহুয়ালতেপাক।
No comments:
Post a Comment