24 February 2021

তুরস্কের ইতিহাস ও রাজনীতি। পর্ব ১। তুর্কি শব্দের উৎপত্তি

 

বর্তমান মানচিত্রে কাজাকস্তান, মঙ্গোলিয়া, রাশিয়া আর চীন যে জায়গায় মিলেছে, সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এক বিস্তির্ন পার্বত্যঞ্চল- আলতাই। আলতাই পর্বতমালার দক্ষিণপূর্বে  গোবি মরুভূমি, আর চারপাশে মধ্য এশিয়ার বিস্তৃত স্তেপ। স্তেপের জনগোষ্ঠী পৃথিবীর ইতিহাসে বিখ্যাত তাদের যাযাবর জীবন আর পশুপালন নির্ভর অর্থনীতির জন্য। শুষ্ক আবহাওয়া আর পর্যাপ্ত পশুচারণভূমির অভাবে তারা এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ভ্রমণ করে বেড়ায়। খাবারের অভাব আর টিকে থাকার প্রতিযোগিতা তাদেরকে করেছে দক্ষ যোদ্ধা এবং সাহসী শিকারী।

ধারণা করা হয় তুর্কি জনগোষ্ঠী এই আলতাই পর্বতমালার অধিবাসী ছিলো। তুর্কদের কাছে আলতাই পবিত্র পাহাড়, আলতাই মানে তাদের পূর্বপুরুষের আবাস, স্বর্ণপাহাড়। তুর্কি ও মঙ্গোল ভাষায় আল মানে স্বর্ণ এবং তাই মানে পাহাড়। প্রায় ৪০০-৫০০ সালের দিকে চারণভূমির খোজে তারা চারপাশের স্তেপে ছড়িয়ে পরতে থাকে। ক্রমে এই যাযাবর যোদ্ধারা নিজেদের জন্য সংস্থান করে রাজ্যের, জড়িয়ে পরে রাজনীতিতে। রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হলেও তুর্কিরা যাযাবর জীবন ত্যাগ করেনি। ফলে তাদের রাজ্য তাদের তাবুর মতো চারপাশে ছড়িয়ে যায়।

প্রথমে বলে রাখা ভালো, তুরস্কের তুর্কি আর আলোচ্য তুর্কি মহাজনগোষ্ঠী এক বিষয় নয়। তুর্কি জনগোষ্ঠী এক বিশাল মহাজাতি। এই তুর্কি জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত জাতিগুলো হলো- তুর্কি, আজারবাইজানী, উজবেক, কাজাক, উইঘুর, তুর্কমেন, তাতার, কিরগিজ, বাশকির, চুভাশ, খোরাসানি তুর্ক, কাশকাই, কারাকালপাক, কুমিক, ক্রিমিয়ান তাতার, ইয়াকুত, কারাচাই ইত্যাদি।

আধুনিক রাষ্ট্র হিসাব করলে তুরস্ক ছাড়াও আজারবাইজান, উজবেকিস্তান, কাজাকস্তান, তুর্কমেনিস্তান, কিরগিজস্তান তুর্কি মহাজনগোষ্ঠী অধ্যুষিত রাষ্ট্র। এছাড়া চীন, রাশিয়া, মঙ্গোলিয়া, ইরান, আফগানিস্তান, তাজিকিস্তান, বুলগেরিয়া, ইউক্রেন ও মোলদাভিয়াতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ তুর্কিরা রয়েছে।

মানচিত্রে তুর্কি মহাগনগোষ্ঠী

যাযাবর শিকারী তুর্কিরা প্রাচীনকালে লিখিত ইতিহাস সংরক্ষণে খুব বেশি আগ্রহী ছিলো না। তাই তাদের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় প্রতিবেশী চীনা রাজ্যদের ঐতিহাসিক দলিলাদিতে। তুর্ক শব্দের উৎপত্তিস্থল হিসেবে প্রথম যে শব্দটিকে গবেষকরা চিহ্নিত করেন তা হলো- গোকতুর্ক, প্রাচীন প্রোটো-তুর্কি ভাষায় এর উচ্চারন ছিলো- কোকতুরুক। গোক শব্দের মানে অমর বা স্বর্গীয় আর তুর্ক শব্দের মানে শিরস্ত্রাণ। প্রাচীন তুর্কিদের শিরস্ত্রাণ তাই আলতাই পর্বতের মতো উপর দিকে চোখা।

৫৪৫ সালে পশ্চিমা ওয়েই রাজ্য আলতাই পর্বতের অভিজাতদের কাছে দূত পাঠান। সেই দূতগণ গোকতুর্ক অভিজাত হিসেবে আশিনা গোত্রের বুমিন এর সাথে দেখা করেছেন বলে উল্লেখ করেন। বুমিন পরবর্তীতে ৫৫১ সালে আলতাই পর্বতমালা ও পূর্বপাশের বিস্তির্ন মঙ্গোল স্তেপ দখল করে নিজেকে খাগান/খান ঘোষণা করেন। তার প্রতিষ্ঠিত রাজ্য ইতিহাসে প্রথম তুর্কি প্রতিষ্ঠিত রাজ্য। বুমিনের রাজ্যকে বলা হতো- গোকতুর্ক খানাতে

গোকতুর্ক খানাতে (৫৫১-৬০৩)

আলতাই পাহাড়ে তুর্কদের ধর্ম ছিলো তেংরি। প্রতিবেশী মঙ্গোলরাও একই ধর্ম পালন করতো। এই ধর্মে সৃষ্টিকর্তা হলেন আকাশদেবতা গোকতেংরি। গোকতেংরির ছেলে ওদতেংরি- সময়ের দেবতা, বোজতেংরি স্তেপভূমির দেবতা, উমায়- উর্বরতা ও কুমারীত্বের দেবী, কায়রা- আলো ও জীবনের দেবতা, উলগেন- ভালো কাজের দেবতা, মেরগেন- জ্ঞানের দেবতা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। তেংরিকে বলা হতো তুর্কদের দেবতা। ধর্ম হিসেবে তেংরি ছিলো সর্বেশ্বরবাদী এবং শামানবাদী ধর্ম।

পাশাপাশি তুর্করা পরিচিত হয় বৌদ্ধ ধর্মের সাথে। প্রতিবেশী চীন থেকে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা গোকতুর্ক খানাতেতে ধর্মপ্রচার করতে যায়। যাযাবর তুর্করা বৌদ্ধ ও তেংরি ধর্মের একটি মিশ্রধর্ম পালন করতে থাকে। পশ্চিমে তুর্করা প্রতিবেশী হিসেবে পরিচিত হয় মুসলিমদের সাথে। ধীরে ধীরে তুর্করা ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হতে থাকে। কারাখানিদ খানাতের রাজা সালতুক বুগরা খান তুর্কি রাজাদের মধ্যে প্রথম ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন ৯৩৪ সালে।

তেংরি ধর্মের প্রতীক

ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ তুর্কি সাম্রাজ্যগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- গোকতুর্ক সাম্রাজ্য (৫৫১-৬০৩), খাজার খানাতে (৬১৮-১০৪৮), উইঘুর খানাতে (৭৪৪-৮৪০), ওঘুজ ইয়াবগু খানাতে (৭৫০-১০৫৫), কারাখানিদ খানাতে (৮৪০-১২১২), গজনবী সাম্রাজ্য (৯৬৩-১১৮৬), সেলজুক সাম্রাজ্য (১০৩৭-১১৯৪) ইত্যাদি।

ওঘুজ তুর্কদের একটি শাখা কাস্পিয়ান সাগর আর আরল সাগরের মধ্যবর্তী স্থানে সাম্রাজ্য গড়ে তোলে এবং ক্রমে আরো পশ্চিমে সরে আসতে থাকে। সেলজুক সাম্রাজ্যের সময়কালে তারা পারস্য (বর্তমান ইরান) হয়ে আনাতোলিয়ায় (তৎকালীন বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য) প্রবেশ করে। সেলজুক সাম্রাজ্যের পতন হলে আনাতোলিয়ার তুর্করা গড়ে তোলে সেলজুক রুম সালতানাত। সেলজুক রুম সালতানাতের সময়ে তুর্করা তাদের উপজাতীয় বেইলিকের (গোত্রভিত্তিক বে শাসিত রাজ্য ব্যবস্থা) অধীনে শাসিত হতে থাকে। বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের সীমান্তে এরকম একটি বেইলিক ওসমানীয় বেইলিক পরবর্তীতে হয়ে উঠে একসময়কার পরাশক্তি অটোমান সাম্রাজ্য। কালের বিবর্তনে অটোমান সাম্রাজ্যের পতন হলে আনাতোলিয়া আর পূর্ব থ্রেস অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় তুরস্ক প্রজাতন্ত্র

 

*সংযুক্তি

তুর্কি জনগোষ্ঠীর তালিকা

জাতি

জনসংখ্যা

রাষ্ট্রে অবস্থান

ধর্ম

তুর্কি

৭ কোটি ৫৭ লক্ষ

তুরস্ক, তুর্কি সাইপ্রাস

সুন্নি ইসলাম, শিয়া ইসলাম

আজারবাইজানি

৩ কোটি ১৩ লক্ষ

আজারবাইজান, ইরান, রাশিয়া

সুন্নি ইসলাম, শিয়া ইসলাম

উজবেক

৩ কোটি ৭ লক্ষ

উজবেকিস্তান

সুন্নি ইসলাম

কাজাক

১ কোটি ৫১ লক্ষ

কাজাকস্তান, চীন, রাশিয়া

সুন্নি ইসলাম

উইঘুর

১ কোটি ১৯ লক্ষ

জিনজিয়াং উইঘুর (চীন)

সুন্নি ইসলাম

তুর্কমেন

৮০ লক্ষ

তুর্কমেনিস্তান

সুন্নি ইসলাম

তাতার

৬২ লক্ষ

তাতারস্তান (রাশিয়া)

সুন্নি ইসলাম, অর্থডক্স খ্রিস্টিয়ান

কিরগিজ

৬০ লক্ষ

কিরগিজস্তান, চীন

সুন্নি ইসলাম

বাশকির

১৭ লক্ষ

বাশকোরতোস্তান (রাশিয়া)

সুন্নি ইসলাম

চুভাশ

১৫ লক্ষ

চুভাশিয়া (রাশিয়া)

অর্থডক্স খ্রিস্টিয়ান, তেংরি

খোরাসানি তুর্ক

১০ লক্ষ

ইরান

শিয়া ইসলাম

কাশকাই

৯ লক্ষ ৫০ হাজার

ইরান

শিয়া ইসলাম

কারাকালপাক

৮ লক্ষ

কারাকালপাকস্তান (উজবেকিস্তান)

সুন্নি ইসলাম

কুমিক

৫ লক্ষ ২০ হাজার

দাগেস্তান (রাশিয়া)

সুন্নি ইসলাম

ইয়াকুত

৪ লক্ষ ৯০ হাজার

শাখা প্রজাতন্ত্র (রাশিয়া)

অর্থডক্স খ্রিস্টিয়ান, তেংরি

কারাচাই

৩ লক্ষ ৫০ হাজার

কারাচাই-চেরকেশিয়া (রাশিয়া)

সুন্নি ইসলাম

তুভা

২ লক্ষ ৮০ হাজার

তুভা প্রজাতন্ত্র (রাশিয়া)

বৌদ্ধ, তেংরি

গাগাউজ

১ লক্ষ ৩০ হাজার

গাগাউজিয়া (মোলদাভিয়া)

অর্থডক্স খ্রিস্টিয়ান

বালকার

১ লক্ষ ১২ হাজার

কাবার্দিনো-বালকারিয়া (রাশিয়া)

সুন্নি ইসলাম

নোগাই

১ লক্ষ ১০ হাজার

দাগেস্তান (রাশিয়া)

সুন্নি ইসলাম

সালার

১ লক্ষ ৫ হাজার

চীন

সুন্নি ইসলাম

অন্যান্য

৩ লক্ষ (প্রায়)

--

--

 

No comments:

Post a Comment