27 September 2016

ব্রেক্সিট ও স্কটল্যান্ড ইস্যু

মানচিত্রঃ ইউরোপীয় ইউনিয়ন। 


ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এর প্রতিষ্ঠা ১৯৫৭ সালে। যুক্তরাজ্য সেখানে যোগদান করে ১৯৭৩ সালে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের নিজস্ব কিছু নীতিমালা আছে। সদস্যরাষ্ট্র গুলো সেগুলো মেনে ইউনিয়নে যোগদান করে, এবং সেগুলো মেনে চলতে হয়।
ইউনিয়নে যোগদান করলে বড় রাষ্ট্রগুলোর আসলে অসুবিধা। আর ছোটো রাষ্ট্রগুলোর সুবিধা। যেমন কারো অর্থনীতি ডাউন হলে, তাকে সবাই মিলে টেনে তোলে। যেমন- গ্রীস। তাকে ইউনিয়নের সবাই টেনে তুলেছে, সবার কন্ট্রিবিউশন ছিলো। কিন্তু সবচেয়ে বড় অনুদানটা দিতে হয়েছে, জার্মানীর। তাই জার্মানীর অর্থনীতিতে আবার এটার প্রভাব পরেছে।
আবার এখন, ইউনিয়নের মাথাব্যাথা সিরিয়া আর ইরাক থেকে আসা শরণার্থীরা। প্রায় ৪০ লাখ শরণার্থী আছে ইউরোপে। ইউনিয়ন সেটা সবার মধ্যে ভাগ করে দিবে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় ভাগটা পরেছে জার্মানীর, প্রায় ১০ লাখ। কেউ কেউ বলছিলো, তারা শরণার্থী নিবে না। যেমন- যুক্তরাজ্য, সার্বিয়া, মেসিডোনিয়া, এস্তোনিয়া। কিন্তু ইউনিয়ন প্রেসার দিয়েছে। শরণার্থী নেয়াই লাগবে। যুক্তরাজ্য সেই প্রেসার নিবো না।

ইউনিয়নের ব্যাপারে, যুক্তরাজ্যের দৃষ্টিভঙ্গিঃ
১. ইউনিয়ন সবসময় যুক্তরাজ্যের উপর দায়িত্ব চাপিয়ে দিতে চায়।
২. সেক্ষেত্রে যুক্তরাজ্য, জার্মানী বা ফ্রান্সের সমান মর্যাদা পায় না। (জার্মানী আর ফ্রান্সের সাথে যুক্তরাজ্যের আগে থেকেই প্রতিযোগিতা)।
৩. ইউনিয়নের কারনে যুক্তরাজ্যের অর্থনীতি ডাউন খেয়েছে, পাউন্ডের দাম কমছে।

যুক্তরাজ্যের ব্যাপারে, ইউনিয়নের দৃষ্টিভঙ্গিঃ
১. সে জার্মানী আর ফ্রান্সের সমান মর্যাদা চায়, অথচ তাদের সমান দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত না।
২. ইউনিয়নের যৌথ কাজ গুলোর ব্যাপারে যুক্তরাজ্য সহমর্মী না।
সুতরাং যুক্তরাজ্য ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তে গণভোট নেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করে। যার নাম দেয়া হয় 'ব্রেক্সিট'।

স্কটল্যান্ড ইস্যুঃ
স্কটল্যান্ড এর আগে ২০১৪ এর সেপ্টেম্বরে স্বাধীনতার পক্ষে গণভোট নেয়। সেই গণভোটে স্বাধীনতাকামীরা ৪৮% বাই ৫২% ভোটে হারে। স্কটল্যান্ডের জনগণ ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে থাকতে চায়। তারা ভেবেছে, যুক্তরাজ্য যেহেতু ইউনিয়নে আছে, আলাদা হয়ে গেলে আল্টিমেটলি তারা ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে যাবে। তারা ব্রেক্সিটেও ইউনিয়নে থাকার পক্ষে মত দেয়। কিন্তু যুক্তরাজ্য যেহেতু ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে যাবার পক্ষে জয়লাভ করছে, স্কটল্যান্ড তাই আবার স্বাধীনতার প্রশ্নে গণভোট চায়। এবার তারা যুক্তরাজ্য থেকে আলাদা হয়ে, স্বাধীন দেশ হিসেবে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে যোগদান করবে। হয়তো ২০১৭ সালেই নতুন রেফারান্ডাম আসবে।
স্কটল্যান্ডের পতাকা

একই ইস্যু উত্তর আয়ারল্যান্ড এর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। কিন্তু সেখানে স্বাধীনতার প্রশ্নে এখনো গণভোট হয় নাই, এবং হওয়ার ব্যাপারে কোনো আলোচনাও এখনো হয় নাই। তবে স্কটল্যান্ড স্বাধীন হওয়ার পর, উত্তর আয়ারল্যান্ড ইস্যু জোরদার হতে পারে।

ব্রেক্সিট ভোটে যুক্তরাজ্যঃ
১. স্কটল্যান্ড এবং উত্তর আয়ারল্যান্ড এ ইউনিয়নে থেকে যাবার পক্ষে ভোট বেশি। ইংল্যান্ড এবং ওয়েলস এ বের হয়ে যাবার পক্ষে ভোট বেশি।
২. যুক্তরাজ্যের তরুন সমাজ ইউনিয়নে থেকে যাবার পক্ষে, মধ্যবয়সীরা বের হয়ে যাবার পক্ষে।
৩. সংসদের সরকারি দল ও বিরোধীদল দুই পক্ষই, ইউনিয়নে থেকে যাবার পক্ষে, জনগণের বৃহৎ অংশ বের হয়ে যাবার পক্ষে।
৪. ৫১.৯০% জনগণ বের হয়ে যাবার পক্ষে, ৪৮.১০% জনগণ থেকে যাবার পক্ষে।

[সাধারণ তথ্যঃ 
দেশঃ যুক্তরাজ্য। United Kingdom.
পূর্ণ নামঃ United Kingdom of Great Britain and Northern Ireland.
রাজ্যভাগঃ ১. ইংল্যান্ড, ২. স্কটল্যান্ড, ৩. ওয়েলস, ৪. উত্তর আয়ারল্যান্ড।]

আঞ্চলিক পরাশক্তি হিসেবে তুরস্কের গল্প

মানচিত্রঃ তুরস্ক ও তার প্রতিবেশি রাষ্ট্রসমূহ।

তুরস্ক নিজেকে আঞ্চলিক পরাশক্তি ভাবতে পছন্দ করে। তার কাজ কর্মে তাই পরাশক্তি পরাশক্তি একটা প্রভাব পরে। অবস্থানগত দিক থেকে তুরস্ক মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থিত, কিছুটা অংশ ইউরোপ ভূখন্ডে পরেছে। মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইল এর পর আমেরিকার সবচেয়ে ভালো বন্ধু তুরস্ক।
তুরস্ক প্রথম মুসলিম দেশ যে ইসরাইলকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। আমেরিকা ইসরাইলের স্বার্থ রক্ষা করে দূর থেকে, আর পাশে থেকে স্বার্থ রক্ষা করে তুরস্ক।
সাইপ্রাস, গ্রীসের সাথে যুক্ত হওয়ার জন্য গণভোট নেয়। গণভোটে সাইপ্রাসের জনগণ গ্রীসের সাথে যুক্ত হওয়ার পক্ষে রায় দেয়। তুরস্ক সাইপ্রাসে সেনা পাঠায়। সাইপ্রাসকে যুদ্ধের মুখে ঠেলে দেয়, উত্তর সাইপ্রাস নামে সাইপ্রাসীয় তুর্কীদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র গঠন করে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় আর্মেনিয়া স্বাধীনতা চায়। সেই আন্দোলন কঠোর ভাবে দমন করে তুরস্ক। আর্মেনিয়াতে ব্যাপক গণহত্যা চালায়। সেই গণহত্যায় ১৫-১৮ লক্ষ লোককে হত্যা করা হয়, স্বাধীনতা চাওয়ার অপরাধে।
বর্তমান সময়ে ইসলামি খেলাফত রাষ্ট্র, 'ইসলামিক স্টেট' এর পেছনেও তুরস্কের ভূমিকা রয়েছে। তুরস্ক কেনো ইসলামিক স্টেট কে সমর্থন করে? তুরস্ক সিরিয়া থেকে তেল যে দামে কিনতো, তার চার ভাগের এক ভাগ দামে কিনে ইসলামিক স্টেট থেকে। ইসলামিক স্টেট এর চোরাই তেল আর প্রত্ন-সম্পদের সবচেয়ে বড় ক্রেতা তুরস্ক। আবার অপরদিকে তারা সিরিয়া এবং ইরাকের কুর্দিরা যে স্বাধীন কুর্দিস্তান প্রতিষ্ঠা করতে চায়, তার বিরোধী। এমনকি তুরস্কে কুর্দি, কুর্দিস্তান, আনাতোলিয়া এই শব্দগুলো পর্যন্ত নিষিদ্ধ; যদিও তুরস্কের ২০% জনগণ কুর্দি। সে তার নাকের ডগায় এরকম স্বাধীন কুর্দিস্তান দেখতে চায় না। সিরিয়া এবং ইরাক ভেঙে ইসলামিক স্টেট হলে তুরস্কের আপত্তি নাই, কুর্দিস্তান হলে আপত্তি আছে।

তুরস্কের পতাকা

তুরস্ক কেবল আর্মেনিয়াতে গণহত্যা চালিয়েছে এমনটা ভাবলে ভুল হবে। যারাই তুরস্ক থেকে স্বাধীনতা চেয়েছে, তাদের উপরই গণহত্যা চালিয়েছে তুরস্ক। গ্রীস স্বাধীনতা চাওয়ায়, প্রায় ৯ লাখ লোককে হত্যা করা হয়। কসোভো, আলবেনিয়া, সার্বিয়া তে গণহত্যা চালায়। সেখানে মারা যায় প্রায় ৩ লাখ লোক। সিরিয়াতে আশিরিয় লোকেদের উপর গণহত্যা চালায় তুরস্ক। সেখানে মারা যায় প্রায় ২-২.৫ লাখ লোক। কুর্দিদের উপর বিভিন্ন সময় গণহত্যা চালানো হয়। বেশি চালানো হয় সিরনাক, ভান, হাক্কারি ও দিয়ারবাকির প্রদেশে। সেগুলোতে প্রায় ৮-১০ লাখ লোক মৃত্যুবরণ করে। ছোটোখাটো গণহত্যার কথাতো বাদ, যেগুলোতে হাজারের ফিগারে লাশ গুনা হয়েছে। কোনো গণহত্যার জন্য ক্ষমা চাওয়া দূরে থাক, স্বীকার পর্যন্ত করে নি তুরস্ক।
তুরস্ক ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে ঢুকতে চায়। ইউরোপীয় সমাজ তুরস্ককে গ্রহন করতে নারাজ। কারন ইউরোপের এই রুগ্ন ব্যাক্তিটি ইউনিয়নে ঢোকার পর জার্মানি, ফ্রান্সের সমান মর্যাদা চাইবে। ইউরোপের ছোটো ছোটো জাতিরাষ্ট্র গুলোই, ইউনিয়নে তুরস্ককে চায় না।
মধ্যপ্রাচ্যের যে কোনো ঘটনায় তুরস্ক নাক গলায়। বিষয়টা- 'গায়ে মানে না, আপনি মোড়ল' টাইপ। সে সবাইকে পরামর্শ দিতে যায়, কেউ শুনতে চায় না। কারন সেখানে সবচেয়ে বেশি থাকে তুরস্কের স্বার্থ। আর কম করে হলেও আমেরিকার স্বার্থ থাকে সেখানে। এই চরিত্র এখন, জাস্টিস এন্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (তুর্কী ভাষায়, এ.কে. পার্টি) আসার পর হয় নি। আগে থেকেই ছিলো। এর আগে স্যেকুলার সরকার থাকার সময়ও একই ভাবে নাক গলাতো তুরস্ক। এখন এই পার্টির সময়, সেটা বিস্তৃত হয়েছে। এখন মরোক্কো থেকে ইন্দোনেশিয়া, সব মুসলিম দেশে তাদের স্বার্থ বর্তমান। আর লোকেশন আশপাশে হলে, ইহুদী-খ্রিস্টিয়ান রাষ্ট্র নির্বিশেষে তুরস্কের স্বার্থ বর্তমান।

1 September 2016

কাশ্মীরের সমস্যার সমাধান

মানচিত্রঃ কাশ্মীর ২০১৫। [নীলঃ ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মু ও কাশ্মীর,
সবুজঃ পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত আজাদ কাশ্মীর ও গিলগিট বালতিস্তান
এবং কমলাঃ চীন নিয়ন্ত্রিত আকসাই চীন।]

যতোবার কাশ্মীর প্রসঙ্গ সামনে আসে, ততোবার ভারত কাশ্মীরকে তার অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে দাবী করে, ততোবার পাকিস্তান কাশ্মীরকে আজাদি (স্বাধীনতা) দিতে চায়। আসল বিষয়টা হলো, ১৯৪৭ যিশুসনের আগস্টে এই দুই দেশের স্বাধীন হয়ে যাওয়াটাই কাশ্মীরের সবচেয়ে বড় সমস্যা। এই দুই দেশ একসাথে কাশ্মীরকে চাপ দিয়ে ধরে রেখেছে, যেনো সে নিজের পায়ে কখনো না দাঁড়াতে পারে।
১৯৪৭ এর আগস্টে কি হয়েছিলো? ১৯৪৭ যিশুসনের আগস্টে বৃটিশ ভারতের জমি ভাগ হয়ে দুইটি স্বাধীন দেশ হয়েছিলো। আর বৃটিশ ভারতের বাইরের ৫৮৫ টি দেশীয় স্বাধীন রাজ্য (প্রিন্সলি স্টেট) পরাধীন হয়েছিলো। ভারত আর পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার আগ পর্যন্ত দেশীয় স্বাধীন রাজ্যগুলো বৃটিশ-রাজের সাথে একধরণের চুক্তিতে আবদ্ধ ছিলো। চুক্তি অনুযায়ী রাজ্যগুলোর প্রতিরক্ষা আর পররাষ্ট্রনীতি দেখতো বৃটিশ-রাজ। ১৯৪৭ যিশুসনে ভারত আর পাকিস্তানের স্বাধীনতার আগে আগে, বৃটিশ সরকার দেশীয় রাজ্যগুলোকে আহবান করে, হয় ভারতে যোগ দিতে, নয় পাকিস্তানে যোগ দিতে, অথবা স্বাধীন থাকতে। স্বাধীন থাকার কথা বলা হলেও আদতে তা সম্ভব ছিলো না। একপাশে জাতীয়তাবাদী ঢেউ, অপরপাশে বৃটিশ-রাজের দায়িত্ব ত্যাগ। দেশীয় রাজ্যগুলো কেউ চুক্তি করে ইউনিয়ন ভুক্ত হলো, কেউ চাপে পরে ইউনিয়ন ভুক্ত হলো। সমস্যা হলো তিনটি রাজ্য নিয়ে। কাশ্মীর, জুনাগড় ও হায়দ্রাবাদ।
কাশ্মীরের সমস্যা হলো, কাশ্মীরের বেশিরভাগ জনগণ ধর্মীয়ভাবে মুসলিম। তারা পাকিস্তানে যোগ দিতে চায়। কিন্তু রাজা হিন্দু, তিনি ভারতে যোগ দিতে চান। ঠিক উল্টা সমস্যা জুনাগড়ের। জুনাগড়ের জনগণ বেশিরভাগ হিন্দু, তারা ভারতে যোগ দিতে চায়। নবাব মুসলমান, তিনি পাকিস্তানে যোগ দিতে চান। [যদিও জুনাগড়ের সাথে পাকিস্তানের কোনো ভূমিসংযোগ নাই। জুনাগড় বর্তমানে আরবসাগর তীরবর্তী গুজরাটের একটি জেলা।] হায়দ্রাবাদের ক্ষেত্রে সমস্যা সবচেয়ে প্রকট। হায়দ্রাবাদের জনগণ স্বাধীন থাকতে চায়, সম্রাট নিজাম উল মুলক ও স্বাধীন থাকতে চান। হায়দ্রাবাদ আয়তন আর জনসংখ্যায়ও বিশাল, তখনকার দেশীয় রাজ্যগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড়। কিন্তু হায়দ্রাবাদের চারদিকে ভারত। সমুদ্রে যাওয়ার কোনো রাস্তা নাই। শেষ পর্যন্ত হায়দ্রাবাদের নিজাম পর্তুগালের সম্রাটকে প্রস্তাব দেন তার কাছে গোয়া বিক্রি করে দেয়ার জন্য, যেনো হায়দ্রাবাদের ভাগে সমুদ্রে পরে। যাই হোক সেটা ভিন্ন গল্প।
কাশ্মীরের মুসলিম জাতীয়তাবাদীদের পাকিস্তান যোগদানের চাপ একদিকে, অপরদিকে ভারতের চাপ ভারতে যোগদানের জন্য। দফায় দফায় বৈঠক হচ্ছে। এমন অবস্থায় কাশ্মীরের রাজা হরি সিং স্বাধীন থাকার সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৪৭ যিশুসনের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান ও ১৫ আগস্ট ভারত স্বাধীন হয়। স্বাধীন হওয়ার পরও তারা উভয়ে চাপ অব্যাহত রাখে। ভারত মনে করে কাশ্মীর পাকিস্তানে যোগ দিলো এই, পাকিস্তান মনে করে কাশ্মীর এই ভারতে যোগ দিলো প্রায়। দুজনেই কাশ্মীরকে অবিশ্বাস করে, দুজনেই চায় কাশ্মীর তার অংশ হোক। ভারত এমন অবস্থায় কাশ্মীরের রাজা হরি সিং কে অন্তত একটা প্রতিরক্ষামূলক চুক্তি করতে চাপ দেয়, যেনো বহিঃশত্রু(!)'র আক্রমণে ভারত তাকে বাঁচাতে পারে। এদিকে কাশ্মীর-পাকিস্তান সীমান্তে পশতু উপজাতীয় সৈন্যদল প্রস্তুত। ভারত যোগদানের ন্যুনতম আভাষ পেলেই তারা শ্রীনগর আক্রমণ করে দখল করে নেবে।
প্রসঙ্গক্রমে, ১৯৪৭ যিশুসনের আগে ভারত নামে কোনো একক রাজনৈতিক ইউনিটের অস্তিত্ব পাওয়া যায় না। ১৮৫৭ পর্যন্ত একটু পাওয়া যায়, তা ভারতবর্ষ নামে। তার আগে ভারতের ইতিহাসে কোনো একক ভারত ছিলো না। একইসাথে অনেক রাজ্য আর অনেক রাজা ছিলো। প্রত্যেকের আলাদা ইতিহাস আর পরিচয় ছিলো। সুতরাং ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ কথাটা সম্পূর্ণ ভুল এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। আর পাকিস্তান নিজেই একটা আগাগোড়া রাজনৈতিক ভুল।
১৯৪৭ যিশুসনে কাশ্মীরের রাজা ছিলেন হরি সিং। তিনি ১৯২৫ যিশুসনে ক্ষমতায় আসেন। তার পিতার দাদা গুলাব সিং ১৮৪৬ যিশুসনে মাত্র ৭৫ লাখ রুপির বিনিময়ে বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর কাছ থেকে কাশ্মীর কিনে নেন। তার আগে কাশ্মীর পাঞ্জাবের স্বাধীন শিখ রাজা 'রণজিৎ সিং' এর অধীনে ছিলো। রণজিৎ সিং ১৮১৯ যিশুসনে আফগানদের যুদ্ধে পরাজিত করে কাশ্মীর দখলে নেন। ১৭৫৩ যিশুসনে আফগানরা কাশ্মীরের দখল নেয়। তার আগে ১৫৪০ থেকে ১৭৫৩ পর্যন্ত কাশ্মীর মুঘল সাম্রাজ্যের অধীনে থাকে।
তো, অবিশ্বাসের সে সময়ে, ১৯৪৭ যিশুসনের অক্টোবরের ২৪ তারিখ রাজা হরি সিং দিল্লী আসেন, চুক্তির বিষয়ে কথা বলার জন্য। এই সময়ে পশতু সৈন্যদল পাকিস্তান সীমান্ত দিয়ে ঢুকে পরে, দখল করে নেয় গিলগিট-বালতিস্তান সহ কাশ্মীরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল। লাদাখের পশ্চিম পাশে প্রবেশ করে চীনা সেনাবাহিনী। তারাও কাশ্মীরের একটা অংশ দখল করে, নাম দেয়- 'আকসাই চীন'। আকসাই চীন এখনো চীনের তিব্বত প্রদেশের অংশ। পশতু সৈন্যরা কাশ্মীরে প্রবেশের পর, ভারতের সেনাবাহিনীও কাশ্মীরে প্রবেশ করে। অল্পের জন্য রাজধানী শ্রীনগরের পতন ঠেকায় ভারতীয় সেনারা। রাজা হরি সিং ভারতে অন্তর্ভুক্তি বিষয়ক চুক্তি করেন। চুক্তি অনুযায়ী কাশ্মীর ভারতীয় ইউনিয়নে 'স্বায়ত্তশাসিত রাজ্য' হিসেবে যোগদান করে। ভারতীয় ইউনিয়নে তার নাম হয় 'জম্মু ও কাশ্মীর'। অপরদিকে পাকিস্তান তার অধিকৃত কাশ্মীরে প্রতিষ্ঠা করে 'আজাদ কাশ্মীর'। দুই কাশ্মীরের মাঝখানে ভারত এবং পাকিস্তান একটা 'যুদ্ধবিরতি সীমানারেখা' আকে, এর নাম দেয়া হয়- 'লাইন অব কন্ট্রোল' (এলওসি)। কাশ্মীরের আজাদীর বিনিময়ে পাকিস্তান গিলগিট-বালতিস্তান এর বিস্তীর্ণ এলাকায় আলাদা প্রশাসন কায়েম করে, নিজের অঞ্চল হিসেবে অন্তর্ভূক্ত করে। ভারত অধিকৃত জম্মু ও কাশ্মীরও স্বায়ত্তশাসন পায়নি।
কাশ্মীর ভারত চায় না, পাকিস্তান ও চায় না। কাশ্মীর চায় আজাদি (স্বাধীনতা)। ভারত এবং পাকিস্তান উভয়েই কাশ্মীরের স্বাধীনতা চায় না। উপরন্তু, কাশ্মীরের দখল নিয়ে পরস্পর যুদ্ধে জড়িয়েছে চার বার। ১৯৪৭, ১৯৬৫, ১৯৭১ এবং ১৯৯৯ যিশুসনে ভারত এবং পাকিস্তান নিজেরা কাশ্মীর নিয়ে যুদ্ধ করলেও, তারা কাশ্মীরের স্বাধীনতা চায় না। কাশ্মীরের স্বাধীনতার প্রশ্নে গনভোট চায় না, কাশ্মীরের ব্যাপারে কাশ্মীরের জনগণের মতামত জানতে চায় না। এমনকি ন্যুনতম জাতিসঙ্ঘের হস্তক্ষেপও চায় না।
কাশ্মীরের সমস্যার সহজতম সমাধান হতে পারে, গণভোটের মাধ্যমে কাশ্মীরের জনতার রায় জানতে চাওয়া এবং রায় মোতাবেক কাশ্মীরকে তার আজাদির পথে হাটতে দেয়া।