8 March 2021

তুরস্কের ইতিহাস ও রাজনীতি। পর্ব ৬। সেলজুক রুম সালতানাত

সুলাইমান বিন কুতালমিশের পিতা কুতালমিশ বিন আরসালান ছিলেন সেলজুক সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা তুঘরিল বের চাচাতো ভাই। সেলজুক সাম্রাজ্যের বিস্তারে কুতালমিশের অসামান্য ভূমিকা। সেলজুক সিংহাসন অধিকারের প্রশ্নে তিনি আল্প আরসালানের বিরোধিতা করেন এবং পরাজিত হন। তার ছেলে সুলাইমান বাইজেন্টাইন বিদ্রোহীদের সাথে মিলে আনাতোলিয়ায় অবস্থান নেন। ১০৭৭ সালে সুলাইমান নিকেয়া শহরকে রাজধানী করে সেলজুক রুম সালতানাত প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর ১০৮৬ সালে সিরিয়ার সেলজুক আমিরের অধীনে থাকা আলেপ্পো দখল করতে গেলে মারা যান। তার ছেলে কিলিজ আরসালান সুলতান মালিক শাহের বন্দী হিসেবে ইস্ফাহান চলে যান।

১০৮১ সালে সেলজুক রুম সালতানাত ও বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য
১০৯২ সালে মালিক শাহের মৃত্যু হলে কিলিজ আরসালান মুক্ত হন এবং নিকেয়া ফিরে এসে পিতার রাজ্য পুনরুদ্ধার করেন। ১০৯৭ সালে ক্রুসেডার সৈন্যরা রাজধানী নিকেয়া অবরোধ করে। কিলিজ তখন পাশের দানিশমন্দ রাজ্যের সাথে যুদ্ধরত ছিলেন। সেখান থেকে এসে নিকেয়ায় ক্রুসেডারদের মুখোমুখি হন। ক্রুসেডাররা আনাতোলিয়া ও জেরুজালেম অঞ্চলে বেশ কয়েকটি অবরোধ পরিচালনা করে। জেরুজালেম অঞ্চলে তারা ভূমধ্যসাগরের সীমান্তবর্তী বেশ কয়েকটি ক্রুসেডার রাজ্য স্থাপনে সক্ষম হলেও, আনাতোলিয়ায় খুব একটা সাফল্য পায় নি।

কিলিজ আরসালানের পর সেলজুক রুম সালতানাতের ক্ষমতায় আসেন তার পুত্র মালিক শাহ (১১১০-১১১৬), তারপর আসেন রুকনউদ্দিন মাসুদ (১১১৬-১১৫৬)। মালিক শাহ ক্ষমতায় বসে প্রশাসনিক অযোগ্যতার পরিচয় দিলেও সুলতান মাসুদ সফলভাবে রাজ্যপরিচালনা করেন। তার সময়ে শুরু হয় ২য় ক্রুসেড।

ক্রুসেডারদের প্রতিষ্ঠিত রাজ্যসমূহ
(এডেসা, এন্টিওক, ত্রিপোলি ও জেরুজালেম)

ক্রুসেড মূলত বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের হারানো গৌরব ও পরাজিত অঞ্চল দখলের জন্য পরিচালিত বেশ কয়েকটি যুদ্ধের সামস্টিক নাম। তখনকার ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালির বিভিন্ন রাজ্য (পোপের রাজ্য, ভেনিস, জেনোয়া, লোম্বার্ডি ইত্যাদি); এমনকি সুদূর ইংল্যান্ড থেকেও সৈন্যরা ক্রুসেডে অংশ নিতে আসতো। বেশ কয়েকটি অভিযান-অবরোধে ক্রুসেডাররা সফল হলে জেরুজালেম ও লেবাননে খ্রিস্টিয়ান রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়।

সেলজুক রুম সালতানাতের প্রায় প্রত্যেক সুলতানকেই ক্রুসেডারদের মোকাবিলা করতে হয়। সুলতান মাসুদের পর সালতানাতের ক্ষমতায় আসেন সুলতান কিলিজ আরসালান ২য় (১১৫৬-১১৯২)। এরপর গিয়াসউদ্দিন কায়খসরু (১১৯২-১১৯৬), রুকনউদ্দিন সুলাইমান (১১৯৬-১২০৪), কিলিজ আরসালান ৩য় (১২০৪-১২০৫) এবং ২য় দফায় গিয়াসউদ্দিন কায়খসরু (১২০৫-১২১১)।

১১৯০ সালে সেলজুক রুম সালতানাত

এসময় সেলজুক রুম সালতানাতের উপর বাইজেন্টাইন প্রভাব বৃদ্ধি পায়। বাইজেন্টাইনদের সাথে সহযোগিতার সম্পর্ক করতে গিয়ে অনেক সুলতানই গ্রীক স্ত্রী গ্রহন করে। গ্রীক স্ত্রীদের পুত্ররা আবার সুলতান হয়। আনাতোলিয়ার অনেক গ্রীক ইসলাম ধর্ম গ্রহন করে। এভাবে তুর্ক ও গ্রীক জাতির মিশ্রন ঘটতে থাকে এসময়ে।

সিংহাসনের জন্য সেলজুক রুমের যুবরাজদের সংঘাত একদিকে, আরেকদিকে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব সালতানাতকে দুর্বল করতে থাকে। গিয়াসউদ্দিন কায়খসরুর পর রুমের ক্ষমতায় আসেন ইজ্জউদ্দিন কায়কাউস (১২১১-১২২০), আলাউদ্দিন কাউকোবাদ (১২২০-১২৩৭), কায়খসরু ২য় (১২৩৭-১২৪৬)।

সেলজুক রুম সালতানাতের পতাকা
এরই মধ্যে পশ্চিমদিকে শুরু হয় মঙ্গোলদের আক্রমন। মঙ্গোলদের আক্রমনে সেলজুক রুম সালতানাত স্বাধীন রাজ্য হিসেবে তার মর্যাদা হারায়। মঙ্গোলদের করদ রাজ্য হিসেবে আরো কিছুদিন সালতানাত টিকে থাকলেও, ক্ষমতার রাজনীতিতে সুলতান তার গুরুত্ব হারায়। এসময় আনাতোলিয়ার মঙ্গোল সেনাপতিরা ঠিক করে দিতো কে হবে রুমের সুলতান। একই সময়ে ২-৩ জনকে সহ-সুলতান হিসেবে সিংহাসনে বসানোর নজিরও আছে।

১২৪৩ সালের কোসেদাগের যুদ্ধে সেলজুক রুম মুখোমুখি হয় মঙ্গোলদের। যুদ্ধে মঙ্গোল যুদ্ধকৌশলের কাছে পরাজিত হয় সুলতানের বাহিনী, সুলতান আংকারায় পলায়ন করেন। রাজ্যের পক্ষে ভিজিয়ার (প্রধানমন্ত্রী) মঙ্গোল সেনাপতির সাথে চুক্তি করেন। সেই চুক্তিতে সেলজুক রুম সালতানাত মঙ্গোলদের করদ রাজ্যে পরিনত হয়। সুলতানের ক্ষমতা সংকুচিত হয়ে আসে। সালতানাতের প্রভাব রাজধানী কোনিয়ার আশপাশে সীমাবদ্ধ হয়ে যায়।

সেলজুক রুম রাজ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত থাকলেও, তুর্করা তখনো তাদের ঐতিহ্যবাহী বেইলিক (গোত্রভিত্তিক বেদের অধীনস্ত প্রিন্সিপালিটি ব ক্ষুদ্ররাজ্য) প্রথা পরিত্যাগ করেনি। রাজ্যের ভেতরে এবং বাহিরে বেশ কিছু বেইলিক তখন অস্তিত্বশীল ছিলো। কোসেদাগের যুদ্ধে সুলতানের পরাজয় অনেক তুর্কি গোত্র মেনে নিতে পারেনি। তারা এই যুদ্ধের পর তাদের নিজেদের এলাকায় আলাদা বেইলিক প্রতিষ্ঠা করে।

একদিকে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য অপরদিকে মঙ্গোল সাম্রাজ্য। মাঝখানে পতনোন্মুখ সেলজুক রুম সাম্রাজ্য। অনেক বেইলিক তখন একলা বা যুথবদ্ধভাবে মঙ্গোলদের প্রতিহত করতে চাইতো। আবার অনেক বেইলিকের মধ্যেই কোনো সদ্ভাব ছিলো না, নিজেরাও দ্বন্দ্বে লিপ্ত থাকতো। নিজেদের অঞ্চল ও পশুচারণভূমি নিশ্চিত করা গেলেই তারা পাশের বেইলিকে আক্রমনের প্রস্তুতি নিতো।

ক্ষমতার স্থান কখনো শূন্য থাকে না। সেলজুক রুম সাম্রাজ্যের শূন্যস্থান পূরণ করে আনাতোলিয়ার বেইলিকগুলো।

No comments:

Post a Comment