বাংলাদেশের
শিক্ষাব্যবস্থা অতিক্রম করছে এক ভয়াবহ ক্রান্তিলগ্ন। একদিকে দেশে বাড়ছে শিক্ষার
হার, আরেকদিকে শিক্ষিত সমাজ ভুলে যাচ্ছে শিক্ষার উদ্দেশ্য। শিক্ষার হারের সাথে
পাল্লা দিয়ে বাড়ছে শিক্ষিত বেকার এবং প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি। প্রচলিত শিক্ষায়
নৈতিক শিক্ষা এবং কর্মমুখী কারিগরি শিক্ষার অভাব এর প্রধান কারণ। নৈতিক শিক্ষার অভাব
থাকলে মানুষ যতই শিক্ষার সার্টিফিকেট পাক না কেন দেশ পিছিয়েই থাকবে। কর্মমুখী
কারিগরি শিক্ষা না থাকলে শিক্ষিত লোকেরা কেবল চাকরি করতে চাইবে। নিজেরা কিছু করার
মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখার পরিকল্পনা বা ঝুঁকি কোনোটাই তারা নেয়ার জন্য
প্রস্তুত থাকবে না। আর এরসাথে যুক্ত করতে হবে সাংস্কৃতিক শিক্ষা। মানুষের
শুভসত্তাগুলো চর্চার মাধ্যমে শিক্ষা পাবে তার পূর্নাঙ্গতা, দেশ পাবে সংস্কৃতিবান
প্রজন্ম।
নৈতিক
শিক্ষা
নৈতিক
শিক্ষা একজন মানুষকে মানুষ করে তোলার ভিত্তিস্বরূপ। একটি শিশুর শিক্ষার্জন শুরু হয় মায়ের পেটের ভেতরেই। শিশুর
শিক্ষার স্বার্থে মায়ের যেমন সুস্থ-স্বাভাবিক থাকা জরুরি তেমনি মায়ের শিক্ষার্জন
করাও জরুরি। মা এসময় অনাগত শিশুর জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে পারেন। তিনি এসময় কিছু
পড়তে পারেন, গান শুনতে পারেন, ছবি আঁকতে পারেন, অংক করতে পারেন ইত্যাদি। শিশুর
জন্মের পর থেকে ৫ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুর জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়। এসময় একজন
শিশুর মস্তিষ্কের ৯০% গঠনের কাজ সম্পন্ন হয়। এসময় শিশুকে নৈতিক শিক্ষা দেয়ার
প্রধান সময়। এসময় শিশু যে শিক্ষা পায় তা তার আগামী সারাজীবন চেতন বা অবচেতন মনে
রয়ে যায়।
নৈতিক
শিক্ষার মধ্যে অন্যতম হলো- ভালো আর মন্দের মধ্যে পার্থক্য করতে শেখানো। মা যেমন
তার শিশুকে আগুন-পানি থেকে দূরে রাখেন, তেমনি তিনি চেষ্টা করবেন শিশুকে মিথ্যা
বলা, চুরি করা, হিংসা করা ইত্যাদি অশুভ অভ্যাস থেকে দূরে রাখতে। সকল মানুষ সমান,
মেয়ে বা নারীদের প্রতি সম্মান দেখানো, বড়দের সম্মান করা, ছোটোদের স্নেহ-আদর করা, কাজ
বা শ্রমের ভিত্তিতে মানুষকে আলাদা না করা, সকল কাজের প্রতি সম্মান ইত্যাদি এসময়
শেখানো উচিত। এসময় শিশুদের ধন্যবাদ দেয়া শেখানো উচিত। ধন্যবাদ দিলে কমে যায় না,
বরং একটা শব্দের মাধ্যমে আপনি তার কাজ বা সেবাকে মূল্যায়ন করছেন। ভুল করলে তা
স্বীকার করা এবং তার জন্য দুঃখিত বা অনুতপ্ত হওয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ নৈতিক শিক্ষা।
নিজের
কাজগুলো নিজে করা, যেমন- নিজের বই নিজে গুছিয়ে রাখা, নিজের কাপড় নিজে গুছিয়ে রাখা,
সংসারের কাজে মা-বাবা-ভাইবোনকে সাহায্য করা, নিজের জায়গা, নিজের ঘর পরিষ্কার রাখা
নৈতিক শিক্ষার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। এসময় শিশুকে আবর্জনার বিষয়ে ধারণা দিতে হবে।
কোনটা পচনশীল আবর্জনা, কোনটা অপচনশীল আবর্জনা, তাদের আলাদা করতে পারা, তাদের আলাদা
পাত্রে ফেলা এবং কোনো ধরণের আবর্জনা রাস্তায়, বাসার বাইরে, জানালা দিয়ে যেখানে যায়
সেখানে, বাসে-ট্রেনে-নৌকায়, পার্কে, যেখানে অন্য লোকেরা জমায়েত হয় সেখানে না ফেলা
নৈতিক শিক্ষার অংশ। এসময় শিশুকে ছেলে এবং মেয়েদের শরীরের আলাদা হওয়ার বিষয়ে ধারণা
দিতে হবে। ছেলে এবং মেয়ে উভয়ই মানুষ এবং সমান এই শিক্ষা দিতে হবে।
সমাজে
যে কেবল ভালো অনুষঙ্গ আছে তা না। নৈতিক শিক্ষার মধ্যে খারাপ অনুষঙ্গ বিষয়েও ধারণা
দিতে হবে। নিজের শরীরের ব্যক্তিগত জায়গা সম্পর্কে ধারণা দিতে হবে। এসবস্থানে যে কেউ
অর্থাৎ যে কেউ হাত দেক না কেনো, সাথেসাথে চিৎকার দেয়া এবং সেই ঘটনা বাবা-মাকে
জানানো শিশুর অবশ্যকর্তব্য।
কর্মমুখী
কারিগরি শিক্ষা
কর্মমুখী
কারিগরি শিক্ষা ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ নির্মানের মূলমন্ত্র। শিশুর প্রাথমিক স্তরের
শিক্ষাগ্রহণ সম্পন্ন হলে তাকে কারিগরি বিষয়ে ধারণা দিতে হবে। বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান
দেশ। শিশুকে এসময় বিভিন্ন রকম শষ্য-সবজি, চাষাবাদ, বীজ, ঋতু-কাল সম্পর্কে ধারণা
দিতে হবে। স্কুলে বা বাসায় পতিত জমি থাকলে সেখানে চাষ করে দেখাতে হবে কিভাবে চাষ
করা হয়। প্রয়োজনে তাকে গ্রামে বা খামারে নিয়ে গিয়ে কৃষিপদ্ধতি দেখানো যেতে পারে।
বিভিন্নরকম
ইলেকট্রিক এবং মেকানিকাল কাজ সম্পর্কে ধারণা দিতে হবে। ইঞ্জিন, বিদ্যুৎ, প্রাকৃতিক
শক্তি ও জ্বালানী এবং প্রযুক্তি সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা দিতে হবে। যারা এসবকাজে
আগ্রহী হবে তাদের জন্য ওয়ার্কশপের ব্যবস্থা করতে হবে। কাঠের কাজ এবং বিভিন্নরকম
ক্রাফটের কাজ এসময় শেখাতে হবে। সেলাই শেখানোর জন্য স্কুলগুলোতে বিশেষ ক্লাসের
ব্যবস্থা থাকতে হবে।
মাধ্যমিক
স্তরে শিশু কর্মমুখী কারিগরি জ্ঞানার্জন শুরু করবে। স্কুলের খামার ও ওয়ার্কশপ থেকে
তারা ট্রেনিং এবং প্রয়োজনীয় সমস্ত বিষয়গুলো পাবে। এসবই হবে সাধারণ শিক্ষাগ্রহণের
পাশাপাশি। পাশাপাশি তারা যা উৎপাদন করবে সেগুলো বিক্রির ব্যবস্থা করবে স্কুল।
বিক্রির টাকা পাবে শিক্ষার্থী। এতে করে শিক্ষাগ্রহণের সময়েই শিক্ষার্থী
আত্মনির্ভরশীল হয়ে গড়ে উঠবে। পরবর্তীতে তার এই দক্ষতা আত্মকর্মসংস্থান তৈরীতে
সাহায্য করবে। দেশের বেকারত্বের হার কমাতে এবং সর্বাবস্থায় দেশের অর্থনীতিতে
অংশগ্রহন করতে কর্মমুখী কারিগরি শিক্ষার বিকল্প নাই।
কর্মমুখী
কারিগরি শিক্ষা কেবল সুবিধাবঞ্চিত বা অর্থনৈতিকভাবে অস্বাবলম্বী পরিবারের শিশুদের
জন্য নয়। কর্মমুখী কারিগরি শিক্ষা সবার জন্য। শিশুরা স্বাবলম্বী এবং আত্মনির্ভরশীল
হলে পরিবার ও দেশের লাভ। দেশের অর্থনীতি বিকাশের অন্যতম সহায়ক শক্তি- কর্মমুখী
কারিগরি শিক্ষা।
শিক্ষাগ্রহণের
উপায়
০-৫ বছর শিশুদের
শিক্ষাগ্রহণের প্রাক-প্রাথমিক স্তর। এরপরের ১০ বছর অর্থাৎ ৬-১৬ বছর
প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাগ্রহণের স্তর। এরপর ২ বছর উচ্চমাধ্যমিক স্তর। এরপর শিশুরা উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য প্রস্তুত হয়। এই হচ্ছে বাংলাদেশের সাধারণ শিক্ষা
গ্রহণের স্তর।
প্রাক-প্রাথমিক স্তরে
শিশুরা সাধারণত বাসায় বা পরিবারের কাছে শিক্ষাগ্রহণ করে থাকে। কিছু পরিমাণ কিন্ডারগার্টেন এবং
ডেকেয়ার দেশে চালু থাকলেও তা অপ্রতুল। এবং ব্যবস্থার কথা চিন্তা করলেতো বাংলাদেশের কিন্ডারগার্টেনগুলো
নিজেরাই শিশুঅবস্থায় আছে। প্রাক-প্রাথমিক স্তরের
ব্যবস্থা হওয়া উচিত, খেলতে খেলতে শেখা এবং কিভাবে শিখতে হবে তা
শেখা। এসময় শিশুদের গাছ-পাখি-ফল-ফুল-প্রাণী-প্রতিবেশের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার উত্তম মুহুর্ত। এস্তরে রোলনম্বরের নামে শিশুদের
অসুস্থ প্রতিযোগিতার সম্মুখীন করিয়ে দেয়াটা একদম অনুচিত-অন্যায়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে রোল নম্বর
শুরু হতে পারে ১০ বছর বয়সে বা চতুর্থ শ্রেণী থেকে। এস্তরে বাসায় এবং স্কুলে সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি নৈতিক
শিক্ষা দিতে হবে।
এরপর প্রাথমিক
ও মাধ্যমিক স্তরে, শিশুরা জ্ঞানের মূল বিষয়গুলোর সাথে পরিচিত হতে শুরু করবে। তারা
বিজ্ঞান, গণিত, সামাজিক বিজ্ঞান, বাংলা ভাষা, বাংলা সাহিত্য, বাংলাদেশ ও পৃথিবীর
ইতিহাস, বাংলাদেশ ও পৃথিবীর সংস্কৃতি, প্রযুক্তি ও কারিগরি জ্ঞান, ২-৩ টি বিদেশী
ভাষা শিখবে। এসময় তাদের নৈতিক শিক্ষার ট্রেনিং চলতে থাকবে। নৈতিক শিক্ষা শিশুরা
তাদের জীবনে এবং আশপাশে প্রয়োগ করা শুরু করবে। পাশাপাশি তাদের সুনির্দিষ্ট কোন
বিষয়ে আগ্রহ আছে কিনা তা ঠিক করবে। যার যে বিষয়ে আগ্রহ সে সেই বিষয়ে বিস্তারিত
জানার চেষ্টা করবে। কেউ গণিতে পারদর্শী হবে, কেউ বিজ্ঞানে মনোযোগ পাবে, কেউ গান বা
বাজনায় আগ্রহী হবে, কেউ ছবি আঁকা বা অভিনয়ে নিজেকে খোঁজার চেষ্টা করবে।
মাধ্যমিক
স্তরের শুরুতে বা শিশুর ১১-১২ বছর বয়সে কারিগরি জ্ঞান সম্পর্কে ধারণা দিতে হবে।
এসময় তারা হাতেকলমে কারিগরি শিক্ষা গ্রহণের জন্য প্রস্তুত হবে। কারিগরি শিক্ষার মধ্যে
উল্লেখ্য- কৃষি কাজ, কাঠের কাজ, মেকানিকাল বিভিন্ন কাজ, ইলেকট্রিক বিভিন্ন কাজ,
বিভিন্ন রকম ক্রাফটের কাজ, সেলাই কাজ ইত্যাদি। প্রাথমিক কারিগরি ধারণা পাওয়ার পর
যার যে বিষয়ে আগ্রহ এবং দক্ষতা তৈরী হবে, তাকে সেই বিষয়ে পারদর্শী করে তুলতে হবে।
কারিগরি মাধ্যম থেকে কিছু পরিমাণ অর্থোপার্জনের রাস্তা মাধ্যমিক স্তরেই বের করতে
হবে। এতে করে শিক্ষাগ্রহণকারীর উপর অর্থনৈতিক চাপ কমবে। শিশু উদ্যোগী হবে এবং
নিজের কর্মসংস্থান তৈরীতে নিজেই সচেষ্ট হবে।
উচ্চশিক্ষার
ক্ষেত্রে গবেষণার পরিধি বিস্তৃত করতে হবে, মৌলিক গবেষণায় প্রণোদনা দিতে হবে।
সাধারণ শিক্ষার সাথে নৈতিক এবং কারিগরি শিক্ষার সমন্বয় করার পর যে শিক্ষার্থী
উচ্চশিক্ষার স্তরে পৌঁছাবে, তাকে সঠিক দিকনির্দেশনা দেয়া গেলে দেশ এমন এক প্রজন্ম
পাবে যে প্রজন্মের জন্য বাংলাদেশের ইতিহাস গর্বিত হবে।