ইয়াজিদিরা পৃথিবীর অন্যতম নির্যাতিত ধর্মীয় জনগোষ্ঠী। এরা মূলত কুর্দি ভাষাভাষী। ইরাকের
কুর্দিস্তানে এদের বৃহদাংশের বাস হলেও তুরস্ক এবং সিরিয়ার কুর্দিস্তানেও তাদের আবাস
রয়েছে। কুর্দিস্তানের বাইরে জার্মানি, জর্জিয়া, আর্মেনিয়া, রাশিয়ায় উল্লেখযোগ্য
সংখ্যক ইয়াজিদির বাস রয়েছে। সব মিলিয়ে এদের সংখ্যা হবে ৮ থেকে ১০ লাখ।
সম্প্রতি এরা
আবার আলোচনায় আসে ‘ইসলামিক স্টেট’ এর গণহত্যার কারনে। গণহত্যার কারন ‘ইসলামিক স্টেট’ এর বিচারে এরা
শয়তানের উপাসক। এর আগেও বিভিন্ন মুসলিম এবং খ্রিস্টিয়ান জাতি-সম্প্রদায় ইয়াজিদিদের
গণহত্যার আগে এই বিবৃতি দেয়। মূলত ইয়াজিদিদের ঈশ্বর বিষয়ক ধারনা, মুসলিম বা
খ্রিস্টিয়ানদের চেয়ে আলাদা। ইয়াজিদিদের সরবোচ্চ ঈশ্বর মালিক তাউস। তার অপর নাম
আযাযেল। মুসলিম এবং খ্রিস্টিয়ান লোককথা অনুসারে সে স্বর্গ থেকে বিতাড়িত দেবদূত
শয়তান ইবলিশ। ইয়াজিদিদের মতে, আযাযেল ঈশ্বরেরই আরেক রূপ এবং স্বয়ং মহান ঈশ্বর।
তিনি ছাড়াও আরও ছয়জন দেবদূত আছেন, যারা সবাই ঈশ্বর। বাকী ছয়জন দেবদূত ঈশ্বরও,
মুসলিম ও খ্রিস্টিয়ান লোককথার সাথে সাংঘারষিক। ইহুদী, খ্রিস্টিয়ান এবং মুসলিমরা
এদের কেবল দেবদূত ফেরেশতা মনে করে। ইয়াজিদি ধর্মমতে এরা সবাই ঈশ্বর বা ঈশ্বরের
প্রকাশ। সেই হিসেবে ইয়াজিদিরা সপ্তেশ্বরবাদী। বাকী ছয়জন ঈশ্বরের নাম হলো- মালিক
দারদেল, মালিক এস্রাফেল, মালিক মিয়াএল, মালিক আজরেইল, মালিক এম্মানেল এবং মালিক নুরেল।
তবে এদের সবারই পুনর্জন্ম হয়েছে বলে বিশ্বাস করা হয়।
সৃষ্টিতত্ত্বের
বিবরনঃ
শুরুতে ঈশ্বর
বাস করতেন মহাজাগতিক সমুদ্রে। তারপর তিনি একটি সাদা মুক্তো তৈরি করেন এবং সেই
মুক্তোটি ভেঙে গেলে পৃথিবী এবং মহাবিশ্ব তৈরির উপাদান বের হয়ে যায়। পৃথিবী তখন
বসবাসের অনুপযুক্ত ছিলো। তারপর ঈশ্বর তার নিজস্ব রূপে তৈরি করেন মালিক তাউসকে। এবং
তাকে তার জ্ঞান এবং ক্ষমতা দান করেন। মালিক তাউসকে সাহায্য করার জন্য সৃষ্টি করেন
আরো ছয়জন দেবদূত ঈশ্বর। তারপর মালিক তাউস পৃথিবীতে আসেন ময়ূরের রূপে। ময়ূরের রঙে
তিনি পৃথিবীকে ফুল এবং ফলে সাজান। প্রথমে আদমকে সৃষ্টি করা হয়েছিলো আত্মা ছাড়া।
মালিক তাউস তাকে আত্মা দান করেন। তারপর তাকে পৃথিবীতে পাঠান এবং তাকে সর্বক্ষেত্রে
সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দান করেন। ইভের নিকট যাওয়ার পূর্বে আদমের একটি সন্তান
হয়। পাত্রে পাওয়া যায় বলে তার নাম শাহিদ বিন জের। সে আদমের ৭২ পুত্রের মধ্যে
অন্যতম। তখন থেকেই ইয়াজিদিরা পৃথিবীতে অবস্থান করছে। তারপর বাকী জাতিরা পৃথিবীতে
আসে। নোয়াহের বন্যার পর, ইয়াজিদিরা সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পরে। দ্বিতীয় বন্যার পর
ইয়াজিদিরা কুর্দিস্তানে বাস করতে আরম্ভ করে। ইয়াজিদিরা সুমেরীয়, ব্যবলনিয় এবং আশিরিয়
সভ্যতা তৈরিতে অংশগ্রহণ করে। একাদশ শতকে মালিক তাউসের প্রতিনিধি মহান সাধক শেখ আদি
বিন মুসাফির ইয়াজিদি ধর্মের সংস্কার করেন। তিনি মালিক তাউসের সংবিধান মানবজাতিকে
প্রদান করেন, যেনো মৃত্যুর পর সবাই তার সাথে স্বর্গে যেতে পারে।
মৃত্যু এবং
মৃত্যুর পরঃ
মৃত্যুর পর
মৃতদেহ ধৌত করা হয়। তারপর মৃতের মুখে শেখ আদির কবরের পবিত্র মাটি বা কাদা দেয়া হয়
এবং যত দ্রুত সম্ভব কবর দেয়া হয়। মৃতের মাথা পূর্ব দিকে রাখা হয়, মুখ উত্তর দিকে
ফিরিয়ে রাখা হয়। মৃতদেহ কবরে নেয়ার সময় গান গাওয়া হয়, মৃত পুরুষ হলে তার স্ত্রী বা
মা কে নাচতে হয়। ইয়াজিদিদের মতে, মৃত্যুর পর শেখ আদি বিন মুসাফির তাদের জন্য ‘সিরাত’ নামক পুলের
উপর অপেক্ষা করবেন। তিনি সেখানে তাদের তিনটি প্রশ্ন করবেন। সে বিয়ে করছে কিনা,
অ-ইয়াজিদি কারো সাথে যৌনসম্পর্ক স্থাপন করেছে কিনা এবং নিজ বর্ণের বাইরে কারো সাথে
যৌনসম্পর্ক স্থাপন করেছে কিনা? উত্তরে খুশি হলে, তিনি তাকে নিয়ে স্বর্গে প্রবেশ
করবেন। সেখানে ইয়াজিদিরা বাস করবে উচ্চ-জীবন। ইয়াজিদি ধর্ম অনুযায়ী স্বর্গ সাতটি
এবং কোনো নরক নেই। প্রথমে ঈশ্বর সাতটি নরক তৈরি করেন। কিন্তু তারপর মালিক তাউস সাত
হাজার বছর কাঁদেন এবং সেই কান্নার জলে নরকের আগুন নিভিয়ে দেন। তাই মানুষের জন্য
কোনো নরক নেই। ইয়াজিদি ধর্মে নিজ পরিবারের বাইরে স্বর্গীয় ভাই-বোন গ্রহনের একটি
আচার আছে। ইয়াজিদিদের মতে, মৃত্যু পরবর্তী জীবনে এই স্বর্গীয় ভাই-বোনেরা তাদের
জন্য অপেক্ষা করবে, স্বর্গে প্রবেশে আগ পর্যন্ত।
পুনর্জন্মঃ
ইয়াজিদি ধর্মে
মৃত্যুকে তুলনা করা হয় পোষাক পরিবর্তনের সাথে। এক পোষাক নষ্ট হয়ে গেলে যেমন মানুষ
পোষাক পরিবর্তন করে নতুন পোষাক পরিধান করে, তেমনি দেহের উপযোগ শেষ হয়ে গেলে
মৃত্যুর মাধ্যমে দেহের পরিবর্তন করে আত্মা নতুন দেহ ধারন করে। এবং প্রত্যেক
প্রাণেরই পুনর্জন্ম হয়। যেমন ইয়াজিদি ধর্মমতে মহান ঈশ্বর মালিক তাউসের পবিত্র
প্রকাশ হয়েছিলো শেখ আদি বিন মুসাফিরের মধ্যে। বাকী ছয়জন ঈশ্বরেরও প্রকাশ হয়েছিলো
ইয়াজিদি ধর্মের আরও ছয়জন শেখের মধ্যে। এবং এই সাতজন শেখই ঈশ্বরের পবিত্র প্রকাশ
হিসেবে, ইয়াজিদিদের নিকট পূজিত হয়। ইয়াজিদি ধর্মমতে আত্মা একটি নির্দিষ্ট
পবিত্রতার স্তরে না পৌঁছানো পর্যন্ত পুনর্জন্ম ঘটতে থাকে।
বর্ণপ্রথাঃ
ইয়াজিদি ধর্মে
বর্ণপ্রথা বিদ্যমান। ঈশ্বর ইয়াজিদিদের সাতটি বর্ণ তৈরি করেন। বর্ণপ্রথা এখনও
ইয়াজিদি ধর্মে মান্য করা হয়। নিজ বর্ণের বাইরে বিয়ে করা নিষেধ। এবং বর্ণদের কাজ ভাগ
করে দেয়া আছে। ইয়াজিদি ধর্মের বর্ণগুলো হলো- ১. মির, ইয়াজিদি যুবরাজ। এরা সরাসরি
ইয়াজিদের বংশধর হিসেবে ইয়াজিদের সিংহাসনে বসেন। দেশে এবং বিদেশে এরা মালিক তাউসের
প্রতিনিধি। ২. শেখ, এরা শেখ আদি বিন মুসাফিরের বংশধর হিসেবে এই বর্ণের
প্রতিনিধিত্ব করেন। শেখ আদির নিজের সন্তান না থাকায় তার ভাতিজা এবং বাকী ছয়জন
শেখের বংশধররাই এখন শেখ। এরা ইয়াজিদিদের ধর্মীয় এবং আধ্যাত্মিক গুরু। শেখদের মধ্যে
যিনি বয়োজ্যেষ্ঠ তাকে বাবা শেখ বলা হয়। ধারনা করা হয়, তাদের বিভিন্ন রোগের নিরাময়
ক্ষমতা আছে। ৩. পির, এরা আদি বিন মুসাফিরের ৪২ জন শিষ্যের বংশধর। কুর্দি ভাষায় ‘পির’ শব্দের মানে
বয়স্ক। ইয়াজিদি সমাজে এরা গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শদাতা হিসেবে দ্বায়িত্ব পালন করেন।
বিবাহ, মৃত্যু এবং অন্যান্য সামাজিক এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালনের দ্বায়িত্ব থাকে
এদের। ৪. ফকির, এরা প্রধান পুরোহিত শ্রেণী। এরা শেখ আদির আলোয় আলোকিত ধারনা করা
হয়। ৫. কাওয়াল, এরা গায়ক এবং বাদক শ্রেণী। ইয়াজিদি অনুষ্ঠান এবং জমায়েতে এরা
ঈশ্বরের স্তবগান গায়। ৬. চাক, এরা লালিশ উপত্যকায় অবস্থিত ঈশ্বরের পবিত্র ঘর এবং
শেখ আদির কবরের রক্ষক। প্রথম তিন বর্ণ থেকেও যে কেউ চাক হতে পারে। ৭. মুরিদ, এরা
সাধারণ ইয়াজিদি। সংখ্যায় এরাই সবচেয়ে বেশী।
ইয়াজিদি নারীঃ
ইয়াজিদি ধর্মগ্রন্থে নারীদের যতটুকু স্বাধীনতা দেয়া আছে, তার চেয়ে বেশি স্বাধীনতা ইয়াজিদি সমাজ নারীদের দিয়েছে। নারীদের ব্যাপারে পুরাতন ধর্মীয় বিধান এখন আর ইয়াজিদি সমাজে মানা হয় না। ইয়াজিদি নারীরা এখন সম্পত্তির ভাগ পেতে পারে। নারীদের বিক্রি করে দেয়া এখন ইয়াজিদি সমাজে নিন্দনীয়। ধর্মগ্রন্থে উল্লেখ থাকলেও গত যিশুশতকে ইয়াজিদি আমির এবং বাবা শেখরা এই সিদ্ধান্ত নেন যে; এই বিধান পুরাতন বিধায়, এগুলো আর ইয়াজিদি সমাজ অনুশীলন করবে না। ধর্মগ্রন্থ যেহেতু অপরিবর্তনশীল তাই বিধানগুলো গ্রন্থে রয়ে গেছে। সাধারণত ইয়াজিদি নারীরা কর্মঠ। তারা প্রত্যেকে সবসময় কিছু না কিছু হাতের কাজ করে। ইয়াজিদি ধর্মীয় এবং সামাজিক উৎসবেও তাদের মুখর পদচারণা থাকে।
ইয়াজিদি ধর্মগ্রন্থঃ
ইয়াজিদিদের দুইটি ধর্মগ্রন্থ, একটি মিশেফা রেশ বা বা বাংলায় 'কালো গ্রন্থ' এবং অপরটি কিতাব আল জিলওয়া বা 'প্রতিভাসের গ্রন্থ'। ধারনা করা হয় দুটি গ্রন্থই ১১-১২ যিশুশতকে রচিত, কিন্তু ইয়াজিদিদের বিশ্বাস, পৃথিবী সৃষ্টির পরপরই মিশেফা রেশ লেখা হয়েছিলো। এটি পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন এবং প্রথম গ্রন্থ। তবে বিশেষজ্ঞদের ধারনা মতে, কিতাব আল জিলওয়া, ইয়াজিদি ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা শেখ আদি বিন মুসাফির কর্তৃক ১১ যিশুশতকে রচিত এবং মিশেফা রেশ তার পরবর্তী শতকে শেখ আদির বিভিন্ন অনুসারী কর্তৃক রচিত। মিশেফা রেশ গ্রন্থে বিশ্বসৃষ্টি, মহান সাত ঈশ্বর, ইয়াজিদিদের সৃষ্টি এবং ঈশ্বরের বিধান বর্ণিত হয়েছে। এবং কিতাব আল জিলওয়া গ্রন্থে ইয়াজিদিদের সাথে ঈশ্বর মালিক তাউসের বিশেষ সম্পর্ক এবং বিশ্বাসীদের আরাধনার কথা বিবৃত হয়েছে।
পবিত্রস্থান ও উপাসনাঃ
ইয়াজিদিদের
নিকট সবচেয়ে পবিত্রস্থান হলো লালিশ উপত্যকা। লালিশ উপত্যকা ইয়াজিদিদের আত্মিক এবং
আধ্যাত্মিক কেন্দ্রবিন্দু। মালিক তাউস পৃথিবীতে সর্বপ্রথম এই স্থানেই নেমে আসেন।
তখন থেকেই এই স্থান পবিত্র। লালিশে রয়েছে শেখ আদি বিন মুসাফিরের কবর এবং
ইয়াজিদিদের পবিত্র উপাসনাগৃহ। উপাসনাগৃহে প্রবেশের পথে একটি জলাশয় আছে। এর নাম
আজ্রাএলের হ্রদ। এর পরই আছে শেখ হাসানের কবর। এর পর শেখ আদির কবর। এবং সেখানে আছে
একটি পবিত্র স্বচ্ছ জলের ঝর্ণা। যে জলে ইয়াজিদি শিশুদের দীক্ষা প্রদান করা হয়।
লালিশের বাইরেও জল পাত্রে করে নিয়ে যাওয়া হয় দীক্ষা দেয়ার উদ্দেশ্যে।
ইয়াজিদিদের
জন্য দিনে পাঁচ বার উপাসনা নির্দিষ্ট। উপাসনাকে বলা হয় ‘নিভেযা’। পাঁচবার
উপাসনার সময় নির্দিষ্ট করে দেয়া আছে। ভোর, সূর্যোদয়, দুপুর, বিকাল এবং সূর্যাস্ত;
এই পাঁচ সময় নিভেযা পালন করতে হয়। তবে বেশিরভাগ ইয়াজিদি সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত এই
দুই সময় নিভেযা পালন করে। সূর্য থাকলে, সূর্যের দিকে মুখ করে উপাসনা করতে হয়।
সূর্য না থাকলে, লালিশের দিকে মুখ করে উপাসনা করতে হয়। এবং উপাসনা অবশ্যই গোপনে
করতে হয়। ইয়াজিদিরা বাহিরের কোনো অভ্যাগতের সামনে উপাসনা করে না।
উৎসব ও
অনুষ্ঠানঃ
সারস্লিয়ে,
ইয়াজিদি নববর্ষ; ইয়াজিদিদের সবচেয়ে বড় সামাজিক এবং ধর্মীয় উৎসব। সারস্লিয়ে শব্দের
উৎস কুর্দি শব্দ ‘সার এ সাল’ অর্থাৎ বছরের মাথা। এপ্রিল মাসের প্রথম বুধবার এই উৎসব
হয়। এই বুধবারকে বলা হয় লাল বুধবার। এটা সেই দিন যেদিন মালিক তাউস প্রথম পৃথিবীতে
এসেছিলেন। রংধনুর সাত রঙে ডিম রঙিন করা নববর্ষের অংশ। মহিলারা রঙিন ডিম এবং লাল
ফুল দরজার সামনে রাখে। নববর্ষে মৃতদের সম্মানে ভোজ রাখা হয়। মহিলারা খাবার পাত্র
নিয়ে কবর পরিদর্শন করেন। ইয়াজিদিরা নববর্ষে একে অপরকে আলিঙ্গন করেন, একে অপরের
বাসায় যান এবং উপহার প্রদান করেন। নববর্ষ ইয়াজিদিদের দিনব্যাপী উৎসব।
নববর্ষের পর
ইয়াজিদিদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব জয়ঝান্ডার প্রদর্শনী। সাতজন ঈশ্বরের প্রতীক
সাতটি জয়ঝান্ডা। কিন্তু এর মধ্যে পাঁচটি জয়ঝান্ডা ১৮৯২ যিশুসনে তুর্কী মুসলিমরা
নিয়ে গেলে আর দুইটি ইয়াজিদিদের নিকট রয়ে যায়। এর মধ্যে সবচেয়ে বড়টি মালিক তাউসের,
সবচেয়ে সম্মানীয়, শেখানি জয়ঝান্ডা। জয়ঝান্ডা কাওয়ালদের তত্ত্বাবধানে থাকে। উৎসবের
সময় জয়ঝান্ডাগুলো ইয়াজিদি গ্রাম থেকে গ্রামে নিয়ে যাওয়া হয়, পরিদরশনের জন্য। তখন
গান গাওয়া হয়। সাধারণ ইয়াজিদিরা জয়ঝান্ডায় চুমু খেয়ে আমিরের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ
করেন।
এরপর সবচেয়ে বড়
উৎসব ‘সাত দিনের পার্বণ’। তখন ইয়াজিদিরা লালিশ উপত্যকায় তীর্থযাত্রা গমন করেন।
সাতদিন ব্যাপী ভোজনোৎসব হয় এবং পঞ্চম দিন ষাঁড় বলি দেয়া হয়। এই সাতদিন ইয়াজিদি
শিশুদের লালিশের স্বচ্ছঝর্ণার জল দ্বারা দীক্ষা প্রদান করা হয়। অক্টোবরের শুরুতে
এই উৎসব হয়। এছাড়া রয়েছে তিন দিনের উপবাস। দিনে উপবাস করা হয় এবং রাতে উৎসব হয়। এই
উপবাস উৎসব হয় ডিসেম্বরে। এছাড়া ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি বলিদান উৎসব হয়। তখন
ইয়াজিদিদের বাবা শেখ ভেড়া বলি দান করেন। ঈশ্বরের নিকট ইব্রাহীম পুত্রের বলিদান
চেষ্টার স্মরণে এই উৎসব হয়।
গনহত্যাঃ
ইয়াজিদিদের
ইতিহাস গনহত্যার ইতিহাস। সর্বশেষ ইসলামিক স্টেট এর গনহত্যার আগে সাদ্দাম হুসাইনের
আমলেও ইয়াজিদিরা বাস্তুচ্যুত হয়। এর আগে ১ম বিশ্বযুদ্ধের সময় তুর্কী মুসলিম এবং
আর্মেনীয় খ্রিস্টিয়ানরা ইয়াজিদিদের হত্যা করে। এরও আগে ১৯০৬ যিশুসনে তুর্কীরা শেখ
আদির কবরকে একটি মাদ্রাসায় পরিণত করে। এর আগে ১৮৯২ যিশুসনে, অটোমান গভর্নর ওমর
পাশা ইয়াজিদিদের তিনটি শর্ত দেন। হয় মুসলিম হও, অথবা জিজিয়া দাও, অথবা খুন হও।
প্রায় পনের হাজার ইয়াজিদিকে হত্যা করা হয়। লালিশ উপত্যকায় সাত বছর তীর্থযাত্রা
বন্ধ থাকে। এভাবে পত্তনের শুরু থেকেই ইয়াজিদিরা গনহত্যার মুখোমুখি হয়। আরব,
তুর্কী, কুর্দি অথবা মুসলিম বা খ্রিস্টিয়ান নির্বিশেষে ইয়াজিদিদের হত্যা করতে চায়।
ইয়াজিদিদের গনহত্যার কারন, মালিক তাউসের প্রতি তাদের বিশ্বাস। আর এখনো ইয়াজিদিদের পৃথিবীর
বুকে টিকিয়ে রেখেছে, মালিক তাউসের প্রতি তাদের বিশ্বাস।
প্রধান
প্রার্থনা
আমেন। আমেন, আমেন!
শামস-আদ-দিনের মধ্যস্থতার মাধ্যমে,
ফাহর-আদ-দিন, নাসির-আদ-দিন,
সাজাদ-আদ-দিন, শেখ হাসান,
শেখ বকর, কাদির আর রাহমান।
প্রভু, তোমার কৌশল কল্যাণময়; তোমার কৌশল
করুণাময়;
তোমার কৌশল ঈশ্বর, রাজা এবং ভূমিদের
রাজা।
আনন্দ এবং সুখের রাজা।
অনন্তকাল থেকে তোমার কৌশল শাশ্বত।
তোমার কৌশল সৌভাগ্যের আসন এবং জীবন।
তোমার কৌশল প্রভু, অনুগ্রহ এবং
সৌভাগ্যের।
তোমার কৌশল জ্বিন এবং মানবজাতির রাজা,
পবিত্র মানুষদের রাজা,
আতঙ্ক এবং প্রশংসার প্রভু,
ধর্মীয় কর্তব্য এবং প্রশংসার আবাস,
প্রশংসা এবং ধন্যবাদে সুযোগ্য।
প্রভু, ভ্রমনের প্রতিপালক,
চন্দ্র এবং অন্ধকারের সার্বভৌম,
সূর্য এবং আগুনের ঈশ্বর,
মহান সিংহাসনের ঈশ্বর,
শুভত্বের প্রভু।
প্রভু! কেউ জানে না কেমন তোমার কৌশল,
তোমার কোনো রূপ নেই; তোমার কোনো
উচ্চতা নেই।
তোমার কোনো সমুখ নেই; তোমার কোনো
সংখ্যা নেই।
প্রভু! রাজা এবং ভিখারিদের বিচারক,
সমাজ এবং পৃথিবীর বিচারক,
তুমি আদমের অনুশোচনা গ্রহণ করেছিলে।
প্রভু, তোমার কোনো আবাস নেই; তোমার
কোনো সম্পদ নেই;
তোমার কোনো পাখা নেই; তোমার কোনো পালক
নেই;
তোমার কোনো কণ্ঠ নেই; তোমার কোনো রঙ
নেই।
তুমি আমাদের ভাগ্যবান এবং সন্তুষ্ট
বানিয়েছো।
তুমি তৈরি করেছিলে যিশু এবং মেরী।
প্রভু, তোমার কৌশল কল্যাণময়,
করুণাময়, বিশ্বস্ত।
তোমার কৌশল প্রভু; আমি অনস্তিত্বশীল।
আমি একজন পতিত পাতক,
একজন পাতক তোমাকে স্মরন করছে।
তুমি আমাদের অন্ধকার থেকে আলোতে চালিত
করো।
প্রভু! আমার পাপ এবং আমার ভুল,
তাদের নিয়ে নাও এবং তাদের অপসারন করো।
হে ঈশ্বর, হে ঈশ্বর, হে ঈশ্বর, আমেন!
শেখ আদির
স্তবগান
সত্য বিষয় ঘিরে আমার অন্তর্দৃষ্টি,
এবং আমার সত্য আমার সাথে মিশে আছে।
এবং আমার অবতরণের সত্য নিজেই স্থাপিত
হয়েছে।
এবং যখন এটা প্রকাশিত হয়েছে, এটা
পুরোপুরি আমার হয়েছে।
এই মহাবিশ্বে যারা আছে সবাই আমার
অধীনে।
এবং সমস্ত বাসযোগ্য অংশ এবং মরুভূমি,
এবং সমস্ত কিছু সৃষ্টি হয়েছে আমার
অধীনে।
এবং আমিই ক্ষমতাসীন শক্তি, সমস্ত যা
পূর্ববর্তী বিদ্যমান।
এবং আমিই সে যে বলি সত্য বচন।
এবং আমিই একমাত্র বিচারক, এবং এই
জগতের অধিপতি।
এবং আমিই সে যার গৌরবে লোকে আরাধনা
করে।
আমার নিকট আস এবং আমার পদে চুম্বন
করো।
এবং আমিই সে যে বেহেশতোকে পৌঁছে
দিয়েছি তার উচ্চতায়।
এবং আমিই সে যে শুরুতে কেঁদেছিলাম।
এবং আমিই শেখ, এক এবং একমাত্র।
এবং আমিই সে যে সমস্ত বিষয়ের প্রকাশ।
এবং আমিই সে যার জন্য সুসংবাদদাতা বই
এসেছে,
আমার প্রভুর কাছ থেকে, যে পাহাড়ও
পুড়িয়ে ফেলে।
এবং আমিই সে যার নিকট সমস্ত সৃষ্ট
মানুষ এসে,
আনুগত্যের জন্য আমার পদে চুম্বন করে।
আমি এনেছি নবযৌবনের প্রথম রসের ফল,
আমার উপস্থিতির মাধ্যমে; এবং আমার
শিষ্যরা আমার নিকট আসো।
এবং ভোরের অন্ধকার সরে গিয়ে আলোকিত
হবার পূর্বে।
আমি তাকে পথপ্রদর্শন করি যে জিজ্ঞাসা
করে।
এবং আমিই সে যে আদমের বেহেশতে বাস
করার কারন।
এবং নিমরোদের বাস গরম জ্বলন্ত আগুনে।
এবং আমিই সে যে একমাত্র আহমদকে
পথপ্রদর্শন করি।
এবং তাকে রাখি আমার পথ এবং পদ্ধতিতে।
এবং আমিই সে যার নিকট সমস্ত সৃষ্টি
আমার শুভ উদ্দেশ্য এবং উপহারের জন্য
আসে।
এবং আমিই সে যে ভ্রমণ করেছি সমস্ত
উচ্চতায়,
এবং শুভত্ব এবং উদারতা আমার কৃপাজাত।
এবং আমিই সে যে সমস্ত হৃদয়ে তৈরি করি
আমার অভিপ্রায়ের ভয়,
এবং তারা আমার ক্ষমতা বিবর্ধিত করে
এবং আমার মহিমায় ভীত হয়।
এবং আমিই সে যে ধ্বংস করি ধেয়ে আসা
সিংহ,
তার গর্জন, এবং আমি তার বিরুদ্ধে
চিৎকার করি এবং সে পাথরে পরিণত হয়।
এবং আমিই সে যার কাছে সাপ আসে,
এবং আমার ইচ্ছায় আমি তাকে পরিণত করি
ধূলায়।
এবং আমিই সে যে পাথরকে তাড়িত করি এবং
তাকে কম্পিত করি,
এবং তাকে সহসাই বিদীর্ণ করে, তার পাশ
থেকে মিষ্টি জল বের করে আনি।
এবং আমিই সে যে নির্দিষ্ট সত্য নিচে
প্রেরণ করি।
আমার কাছ থেকে আসা বই নির্যাতিতদের
প্রশান্তি দিয়েছিলো।
এবং আমিই সে যে যোগ্য বিচার করি;
এবং আমি বিচার করি এটা আমার অধিকার।
এবং আমিই সে যে জলদানের জন্য ঝর্ণা
বানাই,
সমস্ত জল থেকে মিষ্ট এবং স্নিগ্ধ।
এবং আমিই সে যার দয়ার কারনে এটা
আবির্ভূত হয়,
এবং আমার ক্ষমতা বলে, আমি এটাকে
বিশুদ্ধ হতে বলি।
এবং আমিই সে যাকে বেহেশতের প্রভু
প্রতিজ্ঞা করেছেন,
তুমি দক্ষ বিচারক, এবং এই জগতের শাসক।
এবং আমিই সে যে প্রকাশ করি অলৌকিক
বিষয়।
এবং আমার কিছু গুণাবলী প্রতিভাসিত হয়
যা কিছু বিদ্যমান তাতে।
এবং আমিই সে যার কারনে পাহাড়েরা
প্রণাম করে,
আমার নিচে আমার জন্য, এবং আমার
ইচ্ছায়।
এবং আমিই সে যার ভয়াবহ মহিমার পূর্বে
পশুরাও কাঁদত;
তারা আমার আরাধনায় মগ্ন হয়, এবং আমার
পদে চুম্বন করে।
এবং আমি আদি আশ-শামি, মুসাফিরের
পুত্র।
নিশ্চয়ই সমস্ত দয়ালুরা আমার নামে
নির্ধারিত হয়,
স্বর্গীয় রাজত্ব, এবং তার আসন, এবং
সাত জন, এবং পৃথিবী।
আমার জ্ঞানের গোপনে আছে, কোনো ঈশ্বর
নেই আমি ছাড়া।
এইসব বিষয় আমার ক্ষমতার অনুবর্তী।
এবং কোন অবস্থার কারনে তোমরা আমার
নির্দেশিত পথ অস্বীকার করো।
হে মানব! আমাকে অস্বীকার করো না,
কিন্তু সমর্পণ করো।
বিচারের দিনে তুমি খুশি হবে আমার সাথে
মিলিত হয়ে।
যে আমার ভালোবাসা নিয়ে মৃত্যুবরণ করে আমি
তাকে নিক্ষিপ্ত করি
বেহেশতের মধ্যখানে আমার ইচ্ছা এবং
আনন্দের সাথে।
কিন্তু যে আমার প্রতি অমনোযোগী হয়ে
মৃত্যুবরণ করে,
নিক্ষেপ করা হবে যন্ত্রণা এবং
পরিতাপের শাস্তিতে।
আমি বলছি, আমিই একমাত্র এবং সমুচ্চ
গৌরবান্বিত।
আমি সৃষ্টি করি এবং যাকে ইচ্ছা করি
তাকে ধনী বানাই।
আমার প্রতি স্তুতি করো, এবং সমস্ত
বিষয়েরা আমার ইচ্ছার অধীন।
এবং এই মহাবিশ্ব আমার কিছু উপহারের
কারনে আলোকিত।
আমিই সেই রাজা, যিনি নিজেকেই
মহিমান্বিত করেন।
এবং সমস্ত সৃষ্টির সম্পদ আমার আদেশ।
আমি তোমাদের কাছে পরিচিত করছি, হে
লোকেরা, আমার কিছু পথ,
যে আমার জন্য পৃথিবী পরিত্যাগ করার
ইচ্ছা রাখে।
এবং আমি অবশ্যই সত্য বচন বলি।
এবং অতিউচ্চের বাগান তার জন্য যে
আমাকে আনন্দিত করবে।
আমি সত্য অন্বেষা করেছি, এবং সত্যের
প্রতিপাদকে পরিণত হয়েছি।
এবং এই সত্যের মতো তারাও আমার মতো
সরবোচ্চ স্থান অধিকার করতে পারবে।
সমাপ্ত।।
No comments:
Post a Comment