28 May 2020

দৈনন্দিন আলাপ ৩৪


করোনা আসার পর শতশত অপকারের মধ্যে একটা উপকার হয়েছে। এই সংকট আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে আমাদের রাষ্ট্রের দুর্বল দিকগুলো। একটি ব্যর্থ লুটপাটবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্যে দীর্ঘদিন বসবাস করলেও যেনো তা বিশ্বাস করতে চাইছিলাম না। অথবা নিজেকে সান্ত্বনা দিয়ে রাখার চেষ্টা করতাম, সবার তো একই অবস্থা।

অথচ দেখুন, করোনা আসার পর আমাদের রাষ্ট্রের লজ্জাস্থান এক এক করে উন্মুক্ত হতে শুরু করেছে। আমরা এমন রাষ্ট্রে, এমন ব্যবস্থার মধ্যেই দিনের পর দিন বসবাস করেছি। ভেবেছি এসব কথা লিখে কি লাভ! যাদের স্বামর্থ আছে তারা নিজের পরের প্রজন্মের কথা ভেবে দেশ ছেড়ে দিবে, যাদের স্বামর্থ নেই তারা চোখমুখ আরো বন্ধ করে আরো সহনশীল হয়ে উঠবে।

করোনা আসার আগে আমরা দুই মাস সময় পেয়েছি প্রস্তুতি নেয়ার। কোনো প্রকার প্রস্তুতি নেয়া হয় নি। আমাদের বর্বর মন্ত্রীসভা উঁচু গলায় বলেছে- সব প্রস্তুতি নেয়া আছে, আমরা করোনার চেয়ে শক্তিশালী। একজন মুর্খ লোক, ১৭ কোটি মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে সক্ষম, আমরা তা বুঝতে পারলাম। বর্বর মন্ত্রী নিজেও জানে করোনায় রাষ্ট্র কোনো প্রস্তুতি নেয়নি।

এরপর টেস্ট আর রোগী ভর্তির প্রসঙ্গ। প্রথমে বললো- কিট কম, টেস্টও কম তাই। টেস্ট যখন হওয়া শুরু করেছে দেখা যাচ্ছে ১০-২০% ই আক্রান্ত বের হচ্ছে। যারা আক্রান্ত হচ্ছে, নিজেদের ইম্যিউন সিস্টেম ভালো হলে তারা রোগমুক্ত হচ্ছে। নচেৎ অকাল মৃত্যুর দিকে ঝুকে পড়ছে। এই মৃত্যুর দায় সরকারের। এছাড়া দুইটি বিষয়। ১. করোনা আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসা দিতে অপারগতা প্রকাশ করা, এবং ২. এই সময়ে অন্যান্য প্রায় সকল রোগের চিকিৎসা সেবা থামিয়ে দেয়া।

জনগণের পক্ষ থেকে সরকারকে মনে করিয়ে দিতে চাই চিকিৎসা সেবা আপনার মনমর্জি নয়; ইচ্ছে হলে দিবেন, না হলে দিবেন না। চিকিৎসা সেবা জনতার মৌলিক অধিকার, জনতার হক। আপনার ইচ্ছা-অনিচ্ছা কোনোটাই এই মৌলিক অধিকার ধার ধারে না। অথচ বাংলাদেশের সরকার জনগণকে চিকিৎসা সেবা দিতে সম্পূর্ণ রূপে ব্যররথ-অসমর্থ। এমন সরকারকে জাদুঘরে পাঠানো ছাড়া জনতার সামনে আর কোনো উপায় খোলা নেই।

এরপর লকডাউনের নামে সিদ্ধান্তহীনতার ফাইজলামি। সিদ্ধান্তগ্রহণের জায়গায় কোন মাথামোটারা বসে আছে জানিনা, কিন্তু তারা যে এতো অপদার্থ তা করোনা না এলে জানা যেতো না। এক গার্মেন্টস খোলা আর বন্ধ করা নিয়ে নাটক করতে করতে সহ্যের সকল সীমা অতিক্রম করে গেছে তারা। সারা দেশে সমানভাবে রোগ ছড়িয়ে দেয়ার কৃতিত্ব তাই সরকারের। গার্মেন্টসের সারা বছরের লাভের টাকা, বিদেশ থেকে আসা রেমিট্যান্স আর ঋণের টাকা, জনগণের ট্যাক্সের টাকা, সারা বছর সড়ক থেকে উঠা শ্রমিক কল্যান চাঁদার টাকা কোথায় যায়! সময় এসে গেছে, এসব হিসেব নেয়ার।

এরপর এরকম একটা ভঙ্গুর আর অথর্ব স্বাস্থ্যখাত নিয়ে রাষ্ট্র কিভাবে ৫০ বছর পার করলো, এ এক বিষ্ময়! সবাই হয় ঘরে বন্দী, অথবা মনোযোগ অন্য দিকে। এখনি সময় সরকারের ভাবমূর্তি পুনোরোদ্ধারের। গণতন্ত্র অনেক আগেই নিহত হয়েছে। এখন ধীরে ধীরে কথা বলার অধিকারটুকু কেড়ে নিতে পারলেই দেশটা বাপদাদার রেখে যাওয়া প্লটে পরিণত হবে। দেশের যখন এমন অবস্থা, তা নিয়ে কোনো কথা বলা যাবে না।

দেশের বাস্তব পরিস্থিতি নিয়ে কার্টুন আঁকায় কার্টুনিস্ট জেলে যায়, সেই কার্টুন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার দেয়ার লেখক জেলে যায়। সাংবাদিক জেলে যায়, শিক্ষক জেলে যায়। আর গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়ায় দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ, মজুতদার ব্যবসায়ী, সিন্ডিকেটের মেম্বার আর অথর্ব সরকারী কর্মচারি।

পুরো জাতি আজ দুইভাগে বিভক্ত। একদিকে যারা মনে করছে এই স্বৈরাচার-স্বেচ্ছাচার বৈধ। তারা হয় রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, পুঁজিপতি, দুর্নীতিগ্রস্থ আমলা, মজুতদার বা চোরাকারবারী। রাষ্ট্র যতো স্বৈরাচারী হবে ততো তাদের ব্যবসার মঙ্গল। তারা মনে করে তাদের দুর্নীতি এবং লুটপাটের বিপক্ষে কথা বলা যাবে না।

অপরদিকে ধ্বংসস্তুপের ছাই থেকে বারবার জন্ম নেয়া ফিনিক্স পাখি- জনতা। অন্যায় ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে এই যুদ্ধের যোদ্ধা তারা। এক সাড়ি জেলে গেলে অপর সাড়ি সামনে এসে দাঁড়ায়। জেল-জুলুম বা মৃত্যুর উর্দ্ধে তারা। তারা- জনতার শক্তি।

মানুষের দেহের মৃত্যু আছে, কিন্তু অন্যায়ের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধের মৃত্যু নেই। এইরকম দুর্নীতি ও লুটপাটগ্রস্থ একটি রাষ্ট্র, বাংলাদেশী জাতি আশা করে না। আমাদের আগামী প্রজন্মের জন্য আমরা অবশ্যই রেখে যাবো- একটি সুন্দর আগামীর বাংলাদেশ।

অন্যায়-স্বৈরাচার রুখে দাঁড়ান।
দুর্নীতি ও লুটপাটের বিরুদ্ধে নিজেদের কণ্ঠস্বর একত্রিত করুন।
বিশ্বাস করতে শিখুন, আগামীর বাংলাদেশ- জনতার বাংলাদেশ।