কয়েকদিন আগে এক বড়ভাইয়ের সাথে বিভিন্ন বিষয়
নিয়ে কথা হচ্ছিলো। তো কথা তার স্বাভাবিক নিয়ম মতে এক ডাল থেকে আরেক ডালে ঘুরে বেড়াচ্ছিল।
হঠাৎ আমরা দুজনেই খেয়াল করলাম, আমাদের আলোচনায় শাকিব খান চলে এসেছে। আলাপ শেষ করার
আগে আমি বললাম- আরেহ শাকিব খান এতো গুরুত্বপূর্ণ টপিক না! ওই ভাই বললেন, শাকিব অবশ্যই
গুরুত্বপূর্ণ, নাহলে আমাদের ১ ঘন্টার আলাপে ৫ মিনিট শাকিব খান থাকবে কেন?
আসলেই তাই! আমাদের কারও কারও ক্ষেত্রে এই
সময়টা আরও অনেক বেশি। বাসে, মাঠে, চায়ের দোকানে, বন্ধুদের আড্ডায়, ফেসবুকে সব জায়গায়
শাকিব খানের কথা। কেউ জানতে চাইছেন, কেউ জানাতে চাইছেন, কেউ মিম করে মজা নিতে চাইছেন;
যে ফরম্যাটেই হোক না কেন, আলোচনা কিন্তু শাকিবকে নিয়েই। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না,
তিনি এই মুহূর্তে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের সবচেয়ে জনপ্রিয় নায়ক!
শাকিব খানকে নিয়ে মানুষের এতো আগ্রহ কেন?
আমরা মানুষের এই আগ্রহের পেছনের ৪টি কারণ এখানে খুঁজে বের করার চেষ্টা করবো।
কারণ ১: শাকিব রোমান্টিক হিরো!
বাংলাদেশের মানুষের মাঝে চরম জনপ্রিয় রোমান্টিক
হিরো ছিলেন সালমান শাহ। সালমান শাহের অকাল মৃত্যুর পর বাংলাদেশের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে
নিজেকে প্রমানের জন্য অনেক হিরো ছিলেন- রিয়াজ, ফেরদৌস, আমিন খান, অমিত হাসান, আলেকজান্ডার
বো প্রমুখ। কিন্তু তারা কেউই নিজেকে মাস-পিপলের কাছে রোমান্টিক হিরো হিসেবে তুলে ধরতে
পারেননি। এই শূন্যস্থান পূরণ করেছেন শাকিব। তিনি নিজেকে মাস-পিপলের কাছে রোমান্টিক
হিরো হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন।
আর এক্ষেত্রে হয়ত মাস-পিপলের অবচেতনে ‘এস’
ফ্যাক্টর কাজ করেছে। সালমান শাহের নামের সাথে শাকিব খানের নামের ‘এস’ ধ্বনির মিল সম্ভবত
দর্শকদের অবচেতনে এই জায়গা তৈরি করেছে। দর্শক ভেবে থাকতে পারেন, সালমান শাহ যা দিতে
পারতেন, তা হয়ত শাকিবের কাছ থেকে পাওয়া যাবে। এই অতৃপ্তি শাকিবের একের পর এক হিট ছবির
পেছনে আরেকটি কারণ হতে পারে।
কারণ ২: শাকিব ফ্যাশন আইকন!
শাকিব হয়ত শহুরে মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্তের
কাছে তার ফিল্ম নিয়ে ততোটা পৌঁছাতে পারেননি। কিন্তু আসলে বাংলাদেশে এমন মানুষ পাওয়া
কষ্টকর হবে যে তার নাম শোনেনি। দীর্ঘদিন বাংলাদেশের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি এবং এফডিসির
প্রতিনিধিত্ব করেছেন তিনি। বাংলাদেশের মুভির আকালের সময়েও তিনি কিছু সিনেমা নিয়ে মানুষের
সামনে হাজির ছিলেন। বিশেষ করে এই কারণেই বাংলাদেশের মফস্বল ও গ্রামাঞ্চলে এখনও তুমুল
জনপ্রিয় তিনি।
গ্রামাঞ্চলে জনপ্রিয়তার কারণেই শাকিব খান
বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান ফ্যাশন আইকনে পরিণত হয়েছিলেন। তিনি ছেঁড়া-ফাটা জিন্স পরলে,
সেটা গ্রামের তরুণরা ফলো করা শুরু করতো। তিনি চুলে সিলভার কালার করালে, গ্রামের সেলুনগুলোতে
তরুণদের ভিড় পড়ে যেতো চুল রঙ করাতে। তার নাম্বার ওয়ান শাকিব খান লেখা হলুদ রঙের টিশার্ট,
বাংলাদেশের গ্রাম-মফস্বলে আসলে কি পরিমাণ বিক্রি হয়েছে, তার কোনো পরিসংখ্যান নেই। আপনি
স্বীকার করেন আর না করেন, শাকিব খান বাংলাদেশের মফস্বলের তরুণদের ফ্যাশন আইকন।
কারণ ৩: অর্থনীতিতে শাকিবের অবদান!
বাংলা সিনেমার খড়ার সময় শাকিব খান ফিল্ম
ইন্ডাস্ট্রিকে জীবিত রেখেছেন। হোক অনেকে পরিবার নিয়ে সিনেমা হলে যাওয়া বন্ধ করেছে,
অনেক জায়গায় সিনেমা হলই বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু শাকিবের বেশ ভালো পরিমাণ ফ্যান-ফলোয়ার
আছে যারা তার সব ছবি দেখেছে। সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে সরাসরি
অবদান রেখেছেন তিনি, এ কথা কোনো সন্দেহ না রেখেই বলা যায়। পাশাপাশি একজন ফ্যাশন আইকন
হিসেবে তিনি দেশের অর্থনীতিতে পরোক্ষ ভূমিকাও রেখেছেন।
শাকিবের নতুন চুলের কাট, চুলের কালারের
সাথে তাল মিলাতে গিয়ে গ্রামের সেলুনগুলোকে তুলনামূলক আধুনিক হতে হয়েছে। তার মতো প্যান্ট,
শার্ট, টিশার্ট, চশমা ইত্যাদি উৎপাদন ও বিক্রি করে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে কতজন ব্যবসায়ী,
দোকানদার বা হকার কয় টাকার ব্যবসা করেছেন তারও কোনো হিসাব নেই। তার নতুন একটি মুভি
বাজারে আসার পর নানান সেক্টরে ঠিক কতো টাকার ব্যবসা হয়, বাংলাদেশে অর্থনীতি বিষয়ক ভালো
কোনো প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলে এ হিসাব করা যেত। যাই হোক, আপনি আপনার পরিচিত গ্রামের মানুষদের
কাছ থেকে ব্যক্তি পর্যায়ের হিসাবটা জেনে নিতে পারেন।
কারণ ৪: গসিপ মানুষের পছন্দের টপিক!
এ বিষয় নিয়ে সমাজবিজ্ঞানীদের বিস্তর গবেষণা
আছে। মানুষ না কি আদতে গসিপ করা পছন্দ করে, তা সে যেই ফরম্যাটেই হোক না কেন! নিন্দা,
পরচর্চা, গিবত, চোগলখোরি ইত্যাদি আসলে মানুষ যুগ যুগ ধরে করে আসছে। আপনি খেয়াল করে
দেখুন- বাসে, চায়ের দোকানে বা অফিসের বারান্দায় কি নিয়ে কথা হচ্ছে? আরেকজনের বিষয়ে
নিন্দাসূচক কিছু বলে অপরকে আনন্দ দেয়া বিষয়টি খোলা চোখে নির্দোষ মনে হলেও, এটি আসলে
মানুষের মৌলিক নেতিবাচক বৈশিষ্ট্য। অনেক মানুষের তো জীবনের একটা বড় অংশই কেটে যায় আরেকজন
কি করলো তা আলোচনা করে!
যাই হোক, শাকিব খান পাবলিক ফিগার হিসেবে
দেশের সবার কাছে পরিচিত, আবার সিনেমার হিরো হিসেবে রাজনীতিবিদদের তুলনায় নির্বিষ। তার
ওপর ফ্যাশন আইকন হিসেবে তার লাইফস্টাইল নিয়ে মানুষের মধ্যে স্বাভাবিক আগ্রহ আছে। এর
মানে তিনি যা করবেন তা মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রে থাকবে এটাই স্বাভাবিক। আর মানুষের
এই গসিপ রান্নায় মসলার জোগান দেন বিনোদন সাংবাদিকরা। দিনশেষে তো তাদের নিউজ থেকে কামাই
করা লাগে! ফলে এখানে একটা উইন-উইন অবস্থা তৈরি হয়। যেখানে মানুষ যা দেখতে চায়, তা মিডিয়াওয়ালারা
দেখায়; আবার অপর পাশে মিডিয়া যা দেখায় মানুষ তা দেখে। আর এক্ষেত্রে মানুষের হাজার বছরে
গড়ে ওঠা ন্যাচারের বলির পাঠা- শাকিব খান।
লেখাটা শেষ করতে করতে আমিও ওই বড়ভাইয়ের
মতো ভাবতে শুরু করেছি, শাকিব আসলে গুরুত্বপূর্ণ!