মানুষকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, বাংলা ভাষায়
বর্ণ কয়টি? চোখ বন্ধ করেই অনেকে মুখস্ত বলে দিতে পারবেন, ৫০টি। কিন্তু এই প্রশ্ন যদি
সত্তর-আশি বা নব্বই দশকের শুরুতে বর্ণমালা শিখেছেন এমন কাউকে জিজ্ঞাসা করা যায়, তিনি
কিছুটা দ্বিধান্বিত হয়ে পড়বেন। কারণ তখন বাংলায় অতিরিক্ত আরেকটি বর্ণ শেখানো হতো। সেই
বর্ণটি দেখতে এখনকার দিনের ‘৯’ এর মতো ছিলো, উচ্চারণ করা হতো ‘লি’ বলে। এটি স্বরবর্ণ
ছিলো, পড়া হতো ঋ এর পর; ছন্দে ছন্দে ঋ-লি। অর্থাৎ তখন স্বরবর্ণ ছিলো ১২টি; মোট বর্ণ
ছিলো ৫১টি। যাই হোক, বাংলা ভাষায় আর ‘লি’ ব্যবহৃত হচ্ছে না যুক্তিতে একে বাদ দেয়া হয়,
ঋ একলা হয়ে যায়।
ভাষা বহতা নদীর মতো। নদী যেমন সবসময় ঢাল
বেয়ে ভাঁটির দিকে এগিয়ে যায়, ভাষাও তেমন সময়ের সাথে সাথে নিজের রূপ বদল করে। নদীতে
বাঁধ দিলে যেমন পানি নিজেই তার গতিপথ খুঁজে বের করে নেয়; তেমনি ভাষাকে বাধা দিয়েও এর
পরিবর্তন আটকানো যায় না। ভাষা বলতে মূলত মুখের ভাষাই বোঝান হয়। সেই মুখের ভাষা আরেকজনের
কাছে পরিবহন করতে প্রয়োজন কিছু চিহ্নের, সেটাই হচ্ছে বর্ণ। আর সেই ভাষার খুঁটিনাটি
নিয়মকানুন বর্ণনা করার মাধ্যম হচ্ছে ব্যাকরণ। ব্যাকরণের আরেকটি অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য
হচ্ছে ভাষার গঠন ও প্রকৃতি সুগঠিত রাখা। নতুন যারা ভাষাটি শিখতে চাইছেন তাদের সঠিকভাবে
দিকনির্দেশনা দেয়াও ব্যাকরণের কাজ।
ভাষা হিসেবে বাংলা আধুনিক বা নতুন ভাষা।
ব্রিটিশ আমলের শেষ দিকে যখন এর ব্যাকরণ নতুন করে লিপিবদ্ধ করা হচ্ছিল, তখন কয়েকজন ভাষাবিজ্ঞানী
যুক্তি দেয়ার চেষ্টা করেন যে, আর্যদের আলংকরিক কিন্তু লুপ্ত সংস্কৃত ভাষাই কালের বিবর্তনে
বাংলা ভাষা হয়েছে। যদিও অনেক ভাষাবিজ্ঞানী এটা মেনে নিতে নারাজ ছিলেন। কয়েকজন ভাষাবিজ্ঞানী
বলার চেষ্টা করেছেন, এই অঞ্চলের মানুষের কথ্য ভাষা পালি’র আঞ্চলিক অপভ্রংশ (পরিবর্তিত
রূপ) মাগধী প্রাকৃত বা গৌড়ীয় প্রাকৃত ভাষা থেকে বিবর্তিত হয়ে এখনকার বাংলা এসেছে। এমনকি
ভাষাবিজ্ঞানীরা এই অঞ্চলের আদি অধিবাসী দ্রাবিড়দের ভাষা তামিলের ভাষারীতির সাথেও বাংলার
মিল খুঁজে পেয়েছেন। যদিও তখন বেশিরভাগ ভাষাবিজ্ঞানী এই যুক্তিতেই স্থির ছিলেন যে, সংস্কৃত
ভাষারই ক্রমবিকশিত রূপ হচ্ছে বাংলা।
সংস্কৃত তখন ভাষা হিসেবে মৃত; এমন একজন
মানুষও ছিলেন না, যিনি মুখের ভাষা হিসেবে সংস্কৃত ব্যবহার করতেন। তার ওপর, গত কয়েক
হাজার বছর ধরে মূলত আচার-অনুষ্ঠানে ব্যবহার করা হবে এমন সম্মানীয় ভাষা হিসেবে গড়ে উঠেছিল
সংস্কৃত। কিন্তু এই পুরো সময় জুড়ে মানুষের মুখের ভাষা ছিলো একদমই আলাদা। এটা ঠিক যে,
সংস্কৃতের ব্যাকরণ অনেক বেশি সুগঠিত ছিলো। তবে এটাও ঠিক যে, মানুষের মুখের ভাষাকে ব্যাখ্যা
করে এমন নিয়মকানুনের বিধিবদ্ধ রূপই হলো- ব্যাকরণ।
বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে তা হয়নি। সংস্কৃত
ব্যাকরণের নিয়মকানুন কপি-পেস্ট করে বসিয়ে দেয়া হয়েছে যেন। হয়তো তাদের যুক্তি ছিলো বাংলা
যেহেতু সংস্কৃতে মেয়ে, তাই মা-মেয়ে একই ব্যাকরণ মেনে চলবে। এটা করতে গিয়ে অপ্রয়োজনীয়
অনেক বিধিবিধান সংস্কৃত ব্যাকরণ থেকে বাংলা ব্যাকরণে ঢুকে গেছে। আবার বাংলা ভাষার অনেক
প্রয়োজনীয় বিষয়ের ঠাই ব্যাকরণ বইয়ে হয়নি। এক্ষেত্রে একটা উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। বাংলা
ভাষা একটি অন্যতম মৌলিক স্বরধ্বনি হলো- ‘অ্যা’। কিন্তু মৌলিক এই স্বরধ্বনিটিকে প্রতিনিধিত্ব
করার মতো কোনো বর্ণ নেই, এর আলাপও করা হয়েছে নিতান্ত অনাদরে।
যাই হোক, আজকের আলাপে ফিরে যাই। কালের বিবর্তনে
সংস্কৃত-নির্ভর অনেক বর্ণ, উচ্চারণ ও ব্যাকরণ বাংলা ভাষায় অপ্রচলিত হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে
রয়েছে ঋ, ঐ, ঔ, ঙ, ঞ, ণ, ষ, ঢ়, ৎ, ঃ এবং ঁ। এর মধ্যে ‘ণ’ নিয়ে বলা যায়, এটি একটি মূর্ধন্য
নাসিক্য ধ্বনি। আরেকটি ‘ন’ আছে বাংলায়, সেটি দন্ত নাসিক্য ধ্বনি। যারা এখনও বাংলা লেখার
চেষ্টা করছেন, তাদের সবচেয়ে বেশি সংগ্রাম করতে হয়, বানানে কোন ‘ন’-টি সঠিক তা নিয়ে।
কারণ বাংলা ভাষায় অনেক আগেই মূর্ধন্য ণ এর উচ্চারণ অপ্রচলিত হয়ে গেছে।
ভাষায় তখন দুইটি ‘ন’ এর দরকার ছিলো, যখন
এই দু’টির উচ্চারণ আলাদা ছিলো। ‘দন্ত’ ধ্বনিগুলো উচ্চারণের সময় বাতাস দাঁত ঘেঁষে বের
হয়- ত, থ, দ, ধ, ন। আর মূর্ধন্যের বেলায় জিহবা উলটে ওপরের তালুর সাথে রেখে ধ্বনির বাতাস
বের করতে হয়- ট, ঠ, ড, ঢ, ণ। বাংলা ভাষায় মূর্ধন্য শব্দগুলো উচ্চারণ করার সময় এখন আর
কেউই জিহবা উলটে ওপরের তালুর সাথে রেখে বাতাস বের করেন না। আর এজন্যই মূর্ধন্য উচ্চারণগুলো
তালব্য উচ্চারণের মতো হয়ে গেছে। তবে পশ্চিম ভারতের কিছু ভাষা যেমন পাঞ্জাবি ভাষায় এখনও
উচ্চারণে মূর্ধন্যর ব্যবহার রয়েছে। তাই খেয়াল করলে দেখা যাবে, পাঞ্জাবিদের ‘পাণি’র
উচ্চারণ আমাদের চেয়ে কিছুটা ভারী এবং উচ্চারণের ক্ষেত্রেও তা কিছুটা ‘ণ’ ও ‘অনুরণিত
র’ এর সংমিশ্রণ।
বাংলা ভাষায় এখন ‘ন’ এর একটিই উচ্চারণ;
আর তা হচ্ছে একদম সহজ ও সাধারণ, হালকা উচ্চারণের নাসিক্য ধ্বনি- ‘ন’। আমরা কেউ আর এখন
‘প্রাণ’ উচ্চারণ করি না, বলি- ‘প্রান’। লবণ’কে বলি লবন, হরিণ’কে বলি হরিন, স্বর্ণ’কে
বলি স্বর্ন। একইভাবে মণ্ডল’কে বলি মন্ডল, কণ্ঠ’কে বলি কন্ঠ, অরণ্য’কে বলি অরন্য। লেখার
ক্ষেত্রেও আমরা কেউ কেউ (ভুলে!) দন্ত ন-ই ব্যবহার করছি। ইতোমধ্যে অপ্রচলিত বর্ণ ও নিয়মাবলী
বাদ দিয়ে যদি বাংলা ব্যাকরণ ঢেলে সাজানো যেতো, তাহলে ভাষা লেখা ও শেখার ক্ষেত্রে আরও
সাবলীল হয়ে উঠতে পারতো।
এখন প্রশ্ন, বাংলা ভাষা বলার সময় যেহেতু
আর মূর্ধন্য ণ উচ্চারিত হচ্ছে না, তাহলে লেখার সময় আমরা তা কেন ব্যবহার করবো। কিন্তু
এই বিষয়টি নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এগিয়ে আসতে হবে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বাংলা একাডেমি
হচ্ছে ভাষা নিয়ে কারবার করে এ ধরণের প্রতিষ্ঠান। বাংলা একাডেমি ২০১৮ সালের পরিমার্জিত
বাংলা অভিধানে যেমন বহুল প্রচলিত ‘গরু’ বাদ দিয়ে ‘গোরু’ লিখেছে, যদিও তা অপ্রচলিত;
তেমনি বর্ণ ও ব্যাকরণের সংস্কারেও তাদের এগিয়ে আসতে হবে।
বর্ণ ও ব্যাকরণের এ ধরণের সংস্কার নতুন
কিছু নয়। স্বরবর্ণ ‘লি’ যেমন সময়ের প্রয়োজনে বাদ দেয়া গেছে, তেমনি এখন অকার্যকর হয়ে
পড়েছে এমন শব্দও তালিকা থেকে বাদ দেয়ার ব্যাপারে আমাদের ভেবে দেখতে হবে। ভাষাকে সহজ
ও সুবিধাজনক করতে যা করা প্রয়োজন, তার সবই করতে হবে। জমানা এগিয়ে যাচ্ছে, ভাষাও এগুচ্ছে
তার নিজস্ব গতিতে; তাহলে বর্ণ ও ব্যাকরণের সংস্কারে প্রতিষ্ঠান কেন পিছিয়ে থাকবে!
এদিকে কেবল বর্ণ সংস্কার করলেই হবে না,
ব্যাকরণকেও করতে হবে সহজবোধ্য ও যুগোপযোগী। অনেক আগের করা ব্যাকরণ বইয়ের ওপরেই, জোড়াতালির
কাটছাঁটে চলছে- বাংলা ভাষার রুগ্ন ব্যাকরণ চর্চা। সেটা না যায় বোঝা, না থাকে মনে। শিক্ষার্থীদের
কাছে তার নিজের ভাষার ব্যাকরণই একটি আতঙ্কের নাম। এই পরিস্থিতি থেকে রক্ষা পেতে বাংলা
ব্যাকরণের সংস্কার করতে হবে; সাথে, তা শিক্ষার্থীদের উপযোগী করে উপস্থাপন করতে হবে।
ভাষা হিসেবে বাংলা আরও অনেক দিন পৃথিবীর বুকে টিকে থাকবে। তবে তার জন্য এর বর্ণ ও ব্যাকরণকেও
যুগোপযোগী হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।