ছোটবেলায় পড়া প্রবাদবাক্য এভাবে সত্য হয়ে
জীবনে ফিরে ফিরে আসবে, কখনও ভাবিনি। কিন্তু আমাদের ভাবনা দিয়ে তো আর দুনিয়া চলে না,
প্রবাদ তাই আমাদের জীবনে বারবার ঘুরেফিরে আসে।
‘লাইফ ইজ নট আ বেড অব রোজেস’ প্রবাদবাক্যটি
আমি প্রথম শুনি, অনেক ছোটবেলায় আমার আব্বার মুখে। তখন আমি হয়তো কলেজে উঠেছি। রাত জাগা
শুরু করেছি। দিনে ঘুমাই, রাতে বসে মুভি দেখি, বই পড়ি, কবিতা লেখি। কেমন এক স্বপ্নের
মতো জীবনে বসবাস ছিল তখন, এখন তা ভাবি। কোনো চিন্তা বা দুশ্চিন্তা নেই; বাসা ভাড়া দেয়া,
বাজার করা, বাসে চড়া, চাকরি করা, বসের অকারণ বকাবাজি শোনা, সুন্দর মুখোশের কলিগদের
অকারণ পলিটিক্স কিছুই ছিলো না জীবনে।
তখনকার রুটিন ছিল অনেকটা এরকম - সন্ধ্যায়
আড্ডা দিতে বের হতাম, কমপক্ষে রাত ১১টা পর্যন্ত গল্পের উজির-নাজির মেরে বাসায় এসে খাওয়া-দাওয়া
করতাম, রাত ১২টায় মুভি দেখা শুরু করতাম বা নতুন কোনো বই বা কবিতা, নতুবা এমনি বসে থাকা,
ভোরে নাস্তা করে ঘুমুতে যাওয়া, দুপুর ২টায় ঘুম থেকে উঠে ভাত খেয়ে ঝিমুতে ঝিমুতে সন্ধ্যার
আড্ডার জন্য প্রস্তুতি নেয়া, ব্যাস এইটুকুই। আব্বা মাঝেমাঝে রাতে উঠলে দেখতে পেতেন
আমার রুমের লাইট জ্বালানো, ছুটির দিনে দেখতেন অনেক বেলা করে ঘুম থেকে উঠছি। তখন একদিন
রাতে আমার রুমে এসে আব্বা এই প্রবাদবাক্যটি বলেছিলেন।
আমার আব্বা অনেক ভালো ভালো কথা বলেছেন আমাদের,
কিন্তু বলার ধরণ হয়তো ভালো ছিল না। সত্যি বলতে কি, তখন এসব কথা আমাদের ভালো লাগতো না।
ওপরের বাক্যের সাথে প্রাসঙ্গিক নানান কথা আব্বা বিভিন্ন সময় আমাদের বলেছেন, বাইরের
দুনিয়া কতো কঠিন, টাকা কামাই করা কতো কঠিন, মানুষ ও সম্পর্ক মেইনটেইন করা কতো কঠিন;
অফিস, বস আর কলিগদের সাথে চলা; পাবলিক ট্রান্সপোর্টে চড়া, বাজার করা, অর্থ লেনদেন করা
ইত্যাদি সব বিষয় নিয়েই বলেছেন। কিন্তু কখনও কানে তুলিনি। এখন মনে হয়, তখন যদি মন দিয়ে
আব্বার কথা শুনতাম, এখন কিছুটা হলেও ঝামেলা কম হতো! এখন এই লেখা যারা পড়বেন তারাও হয়ত
আমার মতো - ‘ধ্যাত, খালি বেশি কথা বলে’ ভেবে রঙিন জগতে ডুব দিবেন। তবে সময় হওয়ার পর
যখন এই কথাগুলো বুঝতে শুরু করবেন, তখন দেখতে পাবেন, পেছনে ফিরে যাওয়ার আর কোনো উপায়
খোলা নেই। আমার আব্বা নিজের দায়িত্ব ঠিকই পালন করেছেন, আমারই বোঝার মতো বয়স তখন হয়ে
উঠেনি।
এখন যখন আস্তে আস্তে সব বুঝতে শুরু করেছি, সারভাইভাল টু দ্য ফিটেস্টের দুনিয়ায় একদম তলানিতে নিজেকে আবিষ্কার করেছি। আবার নতুন করে সব শুরু করতে হয়েছে, কিন্তু এর মধ্যেই কেটে গেছে অনেকখানি সময়। পশ্চিমা দুনিয়ার বাচ্চাদের কমপক্ষে এক যুগ পর নিজের দায়িত্ব নেয়া শিখেছি। প্রতিটি পদক্ষেপে ঠকে-ঠেকে মানুষের ব্যবহার সম্পর্কে ধারণা পেয়েছি, এখনও পাচ্ছি। অন্তর্দৃষ্টি-সম্পন্ন কোনো জ্যোতিষীর মতোই আব্বার দিব্যবানী প্রতিদিন হুবহু মিলে যায়।
আমি পাবলিক বাসে মানুষের গাদাগাদির
ভেতর একলা বসে ভাবতে থাকি পুরনো দিনের কথা।