27 September 2016

ব্রেক্সিট ও স্কটল্যান্ড ইস্যু

মানচিত্রঃ ইউরোপীয় ইউনিয়ন। 


ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এর প্রতিষ্ঠা ১৯৫৭ সালে। যুক্তরাজ্য সেখানে যোগদান করে ১৯৭৩ সালে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের নিজস্ব কিছু নীতিমালা আছে। সদস্যরাষ্ট্র গুলো সেগুলো মেনে ইউনিয়নে যোগদান করে, এবং সেগুলো মেনে চলতে হয়।
ইউনিয়নে যোগদান করলে বড় রাষ্ট্রগুলোর আসলে অসুবিধা। আর ছোটো রাষ্ট্রগুলোর সুবিধা। যেমন কারো অর্থনীতি ডাউন হলে, তাকে সবাই মিলে টেনে তোলে। যেমন- গ্রীস। তাকে ইউনিয়নের সবাই টেনে তুলেছে, সবার কন্ট্রিবিউশন ছিলো। কিন্তু সবচেয়ে বড় অনুদানটা দিতে হয়েছে, জার্মানীর। তাই জার্মানীর অর্থনীতিতে আবার এটার প্রভাব পরেছে।
আবার এখন, ইউনিয়নের মাথাব্যাথা সিরিয়া আর ইরাক থেকে আসা শরণার্থীরা। প্রায় ৪০ লাখ শরণার্থী আছে ইউরোপে। ইউনিয়ন সেটা সবার মধ্যে ভাগ করে দিবে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় ভাগটা পরেছে জার্মানীর, প্রায় ১০ লাখ। কেউ কেউ বলছিলো, তারা শরণার্থী নিবে না। যেমন- যুক্তরাজ্য, সার্বিয়া, মেসিডোনিয়া, এস্তোনিয়া। কিন্তু ইউনিয়ন প্রেসার দিয়েছে। শরণার্থী নেয়াই লাগবে। যুক্তরাজ্য সেই প্রেসার নিবো না।

ইউনিয়নের ব্যাপারে, যুক্তরাজ্যের দৃষ্টিভঙ্গিঃ
১. ইউনিয়ন সবসময় যুক্তরাজ্যের উপর দায়িত্ব চাপিয়ে দিতে চায়।
২. সেক্ষেত্রে যুক্তরাজ্য, জার্মানী বা ফ্রান্সের সমান মর্যাদা পায় না। (জার্মানী আর ফ্রান্সের সাথে যুক্তরাজ্যের আগে থেকেই প্রতিযোগিতা)।
৩. ইউনিয়নের কারনে যুক্তরাজ্যের অর্থনীতি ডাউন খেয়েছে, পাউন্ডের দাম কমছে।

যুক্তরাজ্যের ব্যাপারে, ইউনিয়নের দৃষ্টিভঙ্গিঃ
১. সে জার্মানী আর ফ্রান্সের সমান মর্যাদা চায়, অথচ তাদের সমান দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত না।
২. ইউনিয়নের যৌথ কাজ গুলোর ব্যাপারে যুক্তরাজ্য সহমর্মী না।
সুতরাং যুক্তরাজ্য ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তে গণভোট নেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করে। যার নাম দেয়া হয় 'ব্রেক্সিট'।

স্কটল্যান্ড ইস্যুঃ
স্কটল্যান্ড এর আগে ২০১৪ এর সেপ্টেম্বরে স্বাধীনতার পক্ষে গণভোট নেয়। সেই গণভোটে স্বাধীনতাকামীরা ৪৮% বাই ৫২% ভোটে হারে। স্কটল্যান্ডের জনগণ ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে থাকতে চায়। তারা ভেবেছে, যুক্তরাজ্য যেহেতু ইউনিয়নে আছে, আলাদা হয়ে গেলে আল্টিমেটলি তারা ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে যাবে। তারা ব্রেক্সিটেও ইউনিয়নে থাকার পক্ষে মত দেয়। কিন্তু যুক্তরাজ্য যেহেতু ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে যাবার পক্ষে জয়লাভ করছে, স্কটল্যান্ড তাই আবার স্বাধীনতার প্রশ্নে গণভোট চায়। এবার তারা যুক্তরাজ্য থেকে আলাদা হয়ে, স্বাধীন দেশ হিসেবে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে যোগদান করবে। হয়তো ২০১৭ সালেই নতুন রেফারান্ডাম আসবে।
স্কটল্যান্ডের পতাকা

একই ইস্যু উত্তর আয়ারল্যান্ড এর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। কিন্তু সেখানে স্বাধীনতার প্রশ্নে এখনো গণভোট হয় নাই, এবং হওয়ার ব্যাপারে কোনো আলোচনাও এখনো হয় নাই। তবে স্কটল্যান্ড স্বাধীন হওয়ার পর, উত্তর আয়ারল্যান্ড ইস্যু জোরদার হতে পারে।

ব্রেক্সিট ভোটে যুক্তরাজ্যঃ
১. স্কটল্যান্ড এবং উত্তর আয়ারল্যান্ড এ ইউনিয়নে থেকে যাবার পক্ষে ভোট বেশি। ইংল্যান্ড এবং ওয়েলস এ বের হয়ে যাবার পক্ষে ভোট বেশি।
২. যুক্তরাজ্যের তরুন সমাজ ইউনিয়নে থেকে যাবার পক্ষে, মধ্যবয়সীরা বের হয়ে যাবার পক্ষে।
৩. সংসদের সরকারি দল ও বিরোধীদল দুই পক্ষই, ইউনিয়নে থেকে যাবার পক্ষে, জনগণের বৃহৎ অংশ বের হয়ে যাবার পক্ষে।
৪. ৫১.৯০% জনগণ বের হয়ে যাবার পক্ষে, ৪৮.১০% জনগণ থেকে যাবার পক্ষে।

[সাধারণ তথ্যঃ 
দেশঃ যুক্তরাজ্য। United Kingdom.
পূর্ণ নামঃ United Kingdom of Great Britain and Northern Ireland.
রাজ্যভাগঃ ১. ইংল্যান্ড, ২. স্কটল্যান্ড, ৩. ওয়েলস, ৪. উত্তর আয়ারল্যান্ড।]

আঞ্চলিক পরাশক্তি হিসেবে তুরস্কের গল্প

মানচিত্রঃ তুরস্ক ও তার প্রতিবেশি রাষ্ট্রসমূহ।

তুরস্ক নিজেকে আঞ্চলিক পরাশক্তি ভাবতে পছন্দ করে। তার কাজ কর্মে তাই পরাশক্তি পরাশক্তি একটা প্রভাব পরে। অবস্থানগত দিক থেকে তুরস্ক মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থিত, কিছুটা অংশ ইউরোপ ভূখন্ডে পরেছে। মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইল এর পর আমেরিকার সবচেয়ে ভালো বন্ধু তুরস্ক।
তুরস্ক প্রথম মুসলিম দেশ যে ইসরাইলকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। আমেরিকা ইসরাইলের স্বার্থ রক্ষা করে দূর থেকে, আর পাশে থেকে স্বার্থ রক্ষা করে তুরস্ক।
সাইপ্রাস, গ্রীসের সাথে যুক্ত হওয়ার জন্য গণভোট নেয়। গণভোটে সাইপ্রাসের জনগণ গ্রীসের সাথে যুক্ত হওয়ার পক্ষে রায় দেয়। তুরস্ক সাইপ্রাসে সেনা পাঠায়। সাইপ্রাসকে যুদ্ধের মুখে ঠেলে দেয়, উত্তর সাইপ্রাস নামে সাইপ্রাসীয় তুর্কীদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র গঠন করে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় আর্মেনিয়া স্বাধীনতা চায়। সেই আন্দোলন কঠোর ভাবে দমন করে তুরস্ক। আর্মেনিয়াতে ব্যাপক গণহত্যা চালায়। সেই গণহত্যায় ১৫-১৮ লক্ষ লোককে হত্যা করা হয়, স্বাধীনতা চাওয়ার অপরাধে।
বর্তমান সময়ে ইসলামি খেলাফত রাষ্ট্র, 'ইসলামিক স্টেট' এর পেছনেও তুরস্কের ভূমিকা রয়েছে। তুরস্ক কেনো ইসলামিক স্টেট কে সমর্থন করে? তুরস্ক সিরিয়া থেকে তেল যে দামে কিনতো, তার চার ভাগের এক ভাগ দামে কিনে ইসলামিক স্টেট থেকে। ইসলামিক স্টেট এর চোরাই তেল আর প্রত্ন-সম্পদের সবচেয়ে বড় ক্রেতা তুরস্ক। আবার অপরদিকে তারা সিরিয়া এবং ইরাকের কুর্দিরা যে স্বাধীন কুর্দিস্তান প্রতিষ্ঠা করতে চায়, তার বিরোধী। এমনকি তুরস্কে কুর্দি, কুর্দিস্তান, আনাতোলিয়া এই শব্দগুলো পর্যন্ত নিষিদ্ধ; যদিও তুরস্কের ২০% জনগণ কুর্দি। সে তার নাকের ডগায় এরকম স্বাধীন কুর্দিস্তান দেখতে চায় না। সিরিয়া এবং ইরাক ভেঙে ইসলামিক স্টেট হলে তুরস্কের আপত্তি নাই, কুর্দিস্তান হলে আপত্তি আছে।

তুরস্কের পতাকা

তুরস্ক কেবল আর্মেনিয়াতে গণহত্যা চালিয়েছে এমনটা ভাবলে ভুল হবে। যারাই তুরস্ক থেকে স্বাধীনতা চেয়েছে, তাদের উপরই গণহত্যা চালিয়েছে তুরস্ক। গ্রীস স্বাধীনতা চাওয়ায়, প্রায় ৯ লাখ লোককে হত্যা করা হয়। কসোভো, আলবেনিয়া, সার্বিয়া তে গণহত্যা চালায়। সেখানে মারা যায় প্রায় ৩ লাখ লোক। সিরিয়াতে আশিরিয় লোকেদের উপর গণহত্যা চালায় তুরস্ক। সেখানে মারা যায় প্রায় ২-২.৫ লাখ লোক। কুর্দিদের উপর বিভিন্ন সময় গণহত্যা চালানো হয়। বেশি চালানো হয় সিরনাক, ভান, হাক্কারি ও দিয়ারবাকির প্রদেশে। সেগুলোতে প্রায় ৮-১০ লাখ লোক মৃত্যুবরণ করে। ছোটোখাটো গণহত্যার কথাতো বাদ, যেগুলোতে হাজারের ফিগারে লাশ গুনা হয়েছে। কোনো গণহত্যার জন্য ক্ষমা চাওয়া দূরে থাক, স্বীকার পর্যন্ত করে নি তুরস্ক।
তুরস্ক ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে ঢুকতে চায়। ইউরোপীয় সমাজ তুরস্ককে গ্রহন করতে নারাজ। কারন ইউরোপের এই রুগ্ন ব্যাক্তিটি ইউনিয়নে ঢোকার পর জার্মানি, ফ্রান্সের সমান মর্যাদা চাইবে। ইউরোপের ছোটো ছোটো জাতিরাষ্ট্র গুলোই, ইউনিয়নে তুরস্ককে চায় না।
মধ্যপ্রাচ্যের যে কোনো ঘটনায় তুরস্ক নাক গলায়। বিষয়টা- 'গায়ে মানে না, আপনি মোড়ল' টাইপ। সে সবাইকে পরামর্শ দিতে যায়, কেউ শুনতে চায় না। কারন সেখানে সবচেয়ে বেশি থাকে তুরস্কের স্বার্থ। আর কম করে হলেও আমেরিকার স্বার্থ থাকে সেখানে। এই চরিত্র এখন, জাস্টিস এন্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (তুর্কী ভাষায়, এ.কে. পার্টি) আসার পর হয় নি। আগে থেকেই ছিলো। এর আগে স্যেকুলার সরকার থাকার সময়ও একই ভাবে নাক গলাতো তুরস্ক। এখন এই পার্টির সময়, সেটা বিস্তৃত হয়েছে। এখন মরোক্কো থেকে ইন্দোনেশিয়া, সব মুসলিম দেশে তাদের স্বার্থ বর্তমান। আর লোকেশন আশপাশে হলে, ইহুদী-খ্রিস্টিয়ান রাষ্ট্র নির্বিশেষে তুরস্কের স্বার্থ বর্তমান।

1 September 2016

কাশ্মীরের সমস্যার সমাধান

মানচিত্রঃ কাশ্মীর ২০১৫। [নীলঃ ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মু ও কাশ্মীর,
সবুজঃ পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত আজাদ কাশ্মীর ও গিলগিট বালতিস্তান
এবং কমলাঃ চীন নিয়ন্ত্রিত আকসাই চীন।]

যতোবার কাশ্মীর প্রসঙ্গ সামনে আসে, ততোবার ভারত কাশ্মীরকে তার অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে দাবী করে, ততোবার পাকিস্তান কাশ্মীরকে আজাদি (স্বাধীনতা) দিতে চায়। আসল বিষয়টা হলো, ১৯৪৭ যিশুসনের আগস্টে এই দুই দেশের স্বাধীন হয়ে যাওয়াটাই কাশ্মীরের সবচেয়ে বড় সমস্যা। এই দুই দেশ একসাথে কাশ্মীরকে চাপ দিয়ে ধরে রেখেছে, যেনো সে নিজের পায়ে কখনো না দাঁড়াতে পারে।
১৯৪৭ এর আগস্টে কি হয়েছিলো? ১৯৪৭ যিশুসনের আগস্টে বৃটিশ ভারতের জমি ভাগ হয়ে দুইটি স্বাধীন দেশ হয়েছিলো। আর বৃটিশ ভারতের বাইরের ৫৮৫ টি দেশীয় স্বাধীন রাজ্য (প্রিন্সলি স্টেট) পরাধীন হয়েছিলো। ভারত আর পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার আগ পর্যন্ত দেশীয় স্বাধীন রাজ্যগুলো বৃটিশ-রাজের সাথে একধরণের চুক্তিতে আবদ্ধ ছিলো। চুক্তি অনুযায়ী রাজ্যগুলোর প্রতিরক্ষা আর পররাষ্ট্রনীতি দেখতো বৃটিশ-রাজ। ১৯৪৭ যিশুসনে ভারত আর পাকিস্তানের স্বাধীনতার আগে আগে, বৃটিশ সরকার দেশীয় রাজ্যগুলোকে আহবান করে, হয় ভারতে যোগ দিতে, নয় পাকিস্তানে যোগ দিতে, অথবা স্বাধীন থাকতে। স্বাধীন থাকার কথা বলা হলেও আদতে তা সম্ভব ছিলো না। একপাশে জাতীয়তাবাদী ঢেউ, অপরপাশে বৃটিশ-রাজের দায়িত্ব ত্যাগ। দেশীয় রাজ্যগুলো কেউ চুক্তি করে ইউনিয়ন ভুক্ত হলো, কেউ চাপে পরে ইউনিয়ন ভুক্ত হলো। সমস্যা হলো তিনটি রাজ্য নিয়ে। কাশ্মীর, জুনাগড় ও হায়দ্রাবাদ।
কাশ্মীরের সমস্যা হলো, কাশ্মীরের বেশিরভাগ জনগণ ধর্মীয়ভাবে মুসলিম। তারা পাকিস্তানে যোগ দিতে চায়। কিন্তু রাজা হিন্দু, তিনি ভারতে যোগ দিতে চান। ঠিক উল্টা সমস্যা জুনাগড়ের। জুনাগড়ের জনগণ বেশিরভাগ হিন্দু, তারা ভারতে যোগ দিতে চায়। নবাব মুসলমান, তিনি পাকিস্তানে যোগ দিতে চান। [যদিও জুনাগড়ের সাথে পাকিস্তানের কোনো ভূমিসংযোগ নাই। জুনাগড় বর্তমানে আরবসাগর তীরবর্তী গুজরাটের একটি জেলা।] হায়দ্রাবাদের ক্ষেত্রে সমস্যা সবচেয়ে প্রকট। হায়দ্রাবাদের জনগণ স্বাধীন থাকতে চায়, সম্রাট নিজাম উল মুলক ও স্বাধীন থাকতে চান। হায়দ্রাবাদ আয়তন আর জনসংখ্যায়ও বিশাল, তখনকার দেশীয় রাজ্যগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড়। কিন্তু হায়দ্রাবাদের চারদিকে ভারত। সমুদ্রে যাওয়ার কোনো রাস্তা নাই। শেষ পর্যন্ত হায়দ্রাবাদের নিজাম পর্তুগালের সম্রাটকে প্রস্তাব দেন তার কাছে গোয়া বিক্রি করে দেয়ার জন্য, যেনো হায়দ্রাবাদের ভাগে সমুদ্রে পরে। যাই হোক সেটা ভিন্ন গল্প।
কাশ্মীরের মুসলিম জাতীয়তাবাদীদের পাকিস্তান যোগদানের চাপ একদিকে, অপরদিকে ভারতের চাপ ভারতে যোগদানের জন্য। দফায় দফায় বৈঠক হচ্ছে। এমন অবস্থায় কাশ্মীরের রাজা হরি সিং স্বাধীন থাকার সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৪৭ যিশুসনের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান ও ১৫ আগস্ট ভারত স্বাধীন হয়। স্বাধীন হওয়ার পরও তারা উভয়ে চাপ অব্যাহত রাখে। ভারত মনে করে কাশ্মীর পাকিস্তানে যোগ দিলো এই, পাকিস্তান মনে করে কাশ্মীর এই ভারতে যোগ দিলো প্রায়। দুজনেই কাশ্মীরকে অবিশ্বাস করে, দুজনেই চায় কাশ্মীর তার অংশ হোক। ভারত এমন অবস্থায় কাশ্মীরের রাজা হরি সিং কে অন্তত একটা প্রতিরক্ষামূলক চুক্তি করতে চাপ দেয়, যেনো বহিঃশত্রু(!)'র আক্রমণে ভারত তাকে বাঁচাতে পারে। এদিকে কাশ্মীর-পাকিস্তান সীমান্তে পশতু উপজাতীয় সৈন্যদল প্রস্তুত। ভারত যোগদানের ন্যুনতম আভাষ পেলেই তারা শ্রীনগর আক্রমণ করে দখল করে নেবে।
প্রসঙ্গক্রমে, ১৯৪৭ যিশুসনের আগে ভারত নামে কোনো একক রাজনৈতিক ইউনিটের অস্তিত্ব পাওয়া যায় না। ১৮৫৭ পর্যন্ত একটু পাওয়া যায়, তা ভারতবর্ষ নামে। তার আগে ভারতের ইতিহাসে কোনো একক ভারত ছিলো না। একইসাথে অনেক রাজ্য আর অনেক রাজা ছিলো। প্রত্যেকের আলাদা ইতিহাস আর পরিচয় ছিলো। সুতরাং ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ কথাটা সম্পূর্ণ ভুল এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। আর পাকিস্তান নিজেই একটা আগাগোড়া রাজনৈতিক ভুল।
১৯৪৭ যিশুসনে কাশ্মীরের রাজা ছিলেন হরি সিং। তিনি ১৯২৫ যিশুসনে ক্ষমতায় আসেন। তার পিতার দাদা গুলাব সিং ১৮৪৬ যিশুসনে মাত্র ৭৫ লাখ রুপির বিনিময়ে বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর কাছ থেকে কাশ্মীর কিনে নেন। তার আগে কাশ্মীর পাঞ্জাবের স্বাধীন শিখ রাজা 'রণজিৎ সিং' এর অধীনে ছিলো। রণজিৎ সিং ১৮১৯ যিশুসনে আফগানদের যুদ্ধে পরাজিত করে কাশ্মীর দখলে নেন। ১৭৫৩ যিশুসনে আফগানরা কাশ্মীরের দখল নেয়। তার আগে ১৫৪০ থেকে ১৭৫৩ পর্যন্ত কাশ্মীর মুঘল সাম্রাজ্যের অধীনে থাকে।
তো, অবিশ্বাসের সে সময়ে, ১৯৪৭ যিশুসনের অক্টোবরের ২৪ তারিখ রাজা হরি সিং দিল্লী আসেন, চুক্তির বিষয়ে কথা বলার জন্য। এই সময়ে পশতু সৈন্যদল পাকিস্তান সীমান্ত দিয়ে ঢুকে পরে, দখল করে নেয় গিলগিট-বালতিস্তান সহ কাশ্মীরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল। লাদাখের পশ্চিম পাশে প্রবেশ করে চীনা সেনাবাহিনী। তারাও কাশ্মীরের একটা অংশ দখল করে, নাম দেয়- 'আকসাই চীন'। আকসাই চীন এখনো চীনের তিব্বত প্রদেশের অংশ। পশতু সৈন্যরা কাশ্মীরে প্রবেশের পর, ভারতের সেনাবাহিনীও কাশ্মীরে প্রবেশ করে। অল্পের জন্য রাজধানী শ্রীনগরের পতন ঠেকায় ভারতীয় সেনারা। রাজা হরি সিং ভারতে অন্তর্ভুক্তি বিষয়ক চুক্তি করেন। চুক্তি অনুযায়ী কাশ্মীর ভারতীয় ইউনিয়নে 'স্বায়ত্তশাসিত রাজ্য' হিসেবে যোগদান করে। ভারতীয় ইউনিয়নে তার নাম হয় 'জম্মু ও কাশ্মীর'। অপরদিকে পাকিস্তান তার অধিকৃত কাশ্মীরে প্রতিষ্ঠা করে 'আজাদ কাশ্মীর'। দুই কাশ্মীরের মাঝখানে ভারত এবং পাকিস্তান একটা 'যুদ্ধবিরতি সীমানারেখা' আকে, এর নাম দেয়া হয়- 'লাইন অব কন্ট্রোল' (এলওসি)। কাশ্মীরের আজাদীর বিনিময়ে পাকিস্তান গিলগিট-বালতিস্তান এর বিস্তীর্ণ এলাকায় আলাদা প্রশাসন কায়েম করে, নিজের অঞ্চল হিসেবে অন্তর্ভূক্ত করে। ভারত অধিকৃত জম্মু ও কাশ্মীরও স্বায়ত্তশাসন পায়নি।
কাশ্মীর ভারত চায় না, পাকিস্তান ও চায় না। কাশ্মীর চায় আজাদি (স্বাধীনতা)। ভারত এবং পাকিস্তান উভয়েই কাশ্মীরের স্বাধীনতা চায় না। উপরন্তু, কাশ্মীরের দখল নিয়ে পরস্পর যুদ্ধে জড়িয়েছে চার বার। ১৯৪৭, ১৯৬৫, ১৯৭১ এবং ১৯৯৯ যিশুসনে ভারত এবং পাকিস্তান নিজেরা কাশ্মীর নিয়ে যুদ্ধ করলেও, তারা কাশ্মীরের স্বাধীনতা চায় না। কাশ্মীরের স্বাধীনতার প্রশ্নে গনভোট চায় না, কাশ্মীরের ব্যাপারে কাশ্মীরের জনগণের মতামত জানতে চায় না। এমনকি ন্যুনতম জাতিসঙ্ঘের হস্তক্ষেপও চায় না।
কাশ্মীরের সমস্যার সহজতম সমাধান হতে পারে, গণভোটের মাধ্যমে কাশ্মীরের জনতার রায় জানতে চাওয়া এবং রায় মোতাবেক কাশ্মীরকে তার আজাদির পথে হাটতে দেয়া।

9 June 2016

কার্যত স্বাধীন রাষ্ট্রঃ কসোভো



কসোভো ইউরোপের বলকান অঞ্চলে অবস্থিত এর রাজধানীর নাম- প্রিস্টিনা কসোভো ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০০৮ যিশুসনে সার্বিয়া থেকে স্বাধীনতা ঘোষনা করে তবে মূলত ১৯৯২ যিশুসন থেকেই কসোভো কার্যত স্বাধীন ইউরোপীয় ইউনিয়নের বেশিরভাগ রাষ্ট্রই সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে কসোভোকে স্বীকৃতি দিয়েছে

সংক্ষিপ্ত ইতিহাসঃ
কসোভো অঞ্চলে প্রথম মানববসতির নিদর্শন পাওয়া যায় ব্রৌঞ্জ যুগে সেখানে তখন বাস করতো থ্রেসিয়, কেল্টিক এবং ইল্লিরিয় বিভিন্ন উপজাতিরা। ইতিহাসে প্রথমবার এখানে রাজ্য গড়ে তোলে ইল্লিরিয়রা, যিশুপূর্ব প্রায় ৪০০ সনে। সেই রাজ্য রোমান সাম্রাজ্যের দখলে চলে যায় ১৬৮ যিশুপূর্বসনে। রোমানরা এই অঞ্চলের নাম দেয়- ইল্লিরিসাম। কসোভো অঞ্চল ইল্লিরিসাম নামে রোমান সাম্রাজ্যের ডালমাশিয়া প্রদেশের অন্তর্ভূক্ত হয়। ৮৩৯ যিশুসনে এই অঞ্চল বুলগেরিয় সাম্রাজ্যের দখলে চলে যায়। তখন এই অঞ্চলে পূর্ব-স্লাভিয় উপজাতিরা বসতি স্থাপন করা শুরু করে এবং খ্রিস্টিয়ান ধর্মও প্রবেশ করে। সেখান থেকে ১০১৮ যিশুসনে এই অঞ্চল চলে যায় বায়জান্টাইন সাম্রাজ্যের দখলে। ১১৮০ যিশুসনে পূর্ব-স্লাভিয় উপজাতিরা ‘সার্বিয় সাম্রাজ্য’ গঠন করলে কসোভো অঞ্চল সেখানে যুক্ত হয়। তখন কসোভো নামে একক কোনো অঞ্চল ছিলো না। প্রিজরেন, জাকোভে, পেজ, মিত্রোভিচে নামে আলাদা আলাদা ঐতিহাসিক নগরী ও তৎসংলগ্ন বসতি ছিলো। ‘কসোভোর মাঠ’ নামে একটি সমতল ভূমির নামে পরবর্তীতে এই অঞ্চলের নামকরন করা হয় কসোভো। 

১৪৫৫ যিশুসনে এই অঞ্চল অটোমান সাম্রাজ্যের দখলে চলে যায়। তখন এটা রুমেলিয়া বিলায়েত (প্রদেশ) এর অংশ ছিলো। অটোমান সাম্রাজ্যের শাসনকালে কসোভো অঞ্চলে আলবেনিয় জাতির বসতি স্থাপন শুরু হয় এবং একই সাথে ইসলাম ধর্মও প্রবেশ করে। ১৮৬৪ যিশুসনে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ‘কসোভো’ নামে বিলায়েত গঠন করা হয়। কসোভো বিলায়েতের আয়তন বর্তমান কসোভোর আয়তনের প্রায় তিনগুন ছিলো। পরবর্তীতে অটোমান সাম্রাজ্য ইউরোপ ভূখণ্ডে ক্রমেই দুর্বল হয়ে পরলে, সাম্রাজ্যের ইউরোপীয় বিলায়েতগুলো একে একে স্বাধীন হয়ে যায়। কসোভো বিলায়েতের পূর্ব পাশে সার্বিয়া রাজ্য এবং পশ্চিম পাশে মন্টেনেগ্রো রাজ্য, স্বাধীন হয়ে যায়। ১৯১৩ যিশুসনের প্রথম বলকান যুদ্ধে, অটোমান সাম্রাজ্যের পরাজয় হলে, কসোভো বিলায়েত, সার্বিয়া রাজ্য এবং মন্টেনেগ্রো রাজ্য ভাগাভাগি করে নেয়। বিলায়েতের পূর্ব অংশ পরে সার্বিয়া রাজ্যের ভাগে এবং পশ্চিম অংশ পরে মন্টেনেগ্রো রাজ্যের ভাগে। ১৯১৮ যিশুসনের ডিসেম্বরের ১ তারিখে ‘সার্ব-ক্রোট এবং স্লোভেনদের রাজ্য’ প্রতিষ্ঠিত হলে, সার্বিয়া রাজ্য এবং মন্টেনেগ্রো রাজ্য তাদের কসোভো অঞ্চল সহ রাজ্যে যোগদান করে। ‘সার্ব-ক্রোট এবং স্লোভেনদের রাজ্য’ই পরবর্তীতে ‘যুগোস্লাভ রাজ্য’ নামে পরিচিতি লাভ করে। কসোভোর জাতিগত আলবেনিয়রা হয়ে পরে সংখ্যালঘু। 

১৯৪৫ যিশুসনে যুগোস্লাভিয়ায় সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। ‘কসোভো’ বর্তমান আয়তনের আকারে জানুয়ারি ৩১, ১৯৪৬ যিশুসনে, সার্বিয়া প্রজাতন্ত্রের ‘স্বায়ত্বশাসিত প্রদেশ’ হিসেবে ‘যুগোস্লাভ ফেডারেশনে’ যুক্ত হয়। যুগোস্লাভিয়া ফেডারেশনের ক্রান্তিকালে ‘কসোভো স্বায়ত্বশাসিত প্রদেশ’ ফেডারেশনের বাকী ৬ প্রজাতন্ত্রের সমান মর্যাদা দাবী করে। কসোভোর গণপরিষদ, ১৯৯০ যিশুসনের ২ জুলাই নিজেকে যুগোস্লাভিয়া ফেডারেশনের অন্তর্ভূক্ত প্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘোষনা করে। ‘সার্বিয়া প্রজাতন্ত্র’ এর বিরোধীতা করে এবং কসোভোতে গৃহযুদ্ধের উপক্রম হয়। ১৯৯২ যিশুসনের মে মাসে কসোভোর স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রাণপুরুষ ইব্রাহিম রগুভা ‘কসোভো প্রজাতন্ত্রের’ রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত হন এবং কসোভো প্রজাতন্ত্র নিজেকে সার্বিয়া থেকে স্বাধীন ঘোষনা করে। যুগোস্লাভিয়ার বাকী প্রজাতন্ত্রগুলোতেও তখন স্বাধীনতা আন্দোলন চলছে। ১৯৯২ যিশুসনের মে মাসেই কসোভো রাষ্ট্র কার্যত স্বাধীন হয়ে পরে। কসোভোকে প্রজাতন্ত্র হিসেবে একমাত্র আলবেনিয়া স্বীকৃতি প্রদান করে। যুগোস্লাভিয়ার বাকী প্রজাতন্ত্রগুলো স্বাধীন হয়ে গেলে, সার্বিয়া কসোভোর দিকে মনোযোগ দেয়। ১৯৯৪ যিশসনে কসোভোতে সার্ব-সেনারা প্রবেশ করে, যুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধ ঠেকাতে কসোভোতে, ন্যাটো এবং জাতিসংঘ প্রবেশ করে। ১৯৯৯ যিশুসনের ১০ জুন জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। সার্ব-সেনারা কসোভো অঞ্চল জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে ছেড়ে দিয়ে ফেরত যায়। সার্বিয়া এবং রাশিয়া কখনোই কসোভোকে সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে মেনে নেয় নি। সার্বিয়া এখন পর্যন্ত কসোভোকে তার অধীনস্ত প্রদেশ ‘কসোভো ও মেতোহিজা’ মনে করে।

সর্বশেষ, ২০০৮ যিশুসনের ১৭ ফেব্রুয়ারি, ন্যাটো, জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উপস্থিতিতে কসোভোর গণপরিষদ সার্বভৌম ‘কসোভো প্রজাতন্ত্র’ এর স্বাধীনতা ঘোষনা করে। জুন ২৩, ২০১৫ এর হিসাব মোতাবেক, জাতিসংঘ সদস্যভুক্ত ১৯৩ টি রাষ্ট্রের ১০৮ টি রাষ্ট্র কসোভোকে সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।

ভূগোল ও পরিবেশঃ
কসোভো ইউরোপ মহাদেশের বলকান অঞ্চলে অবস্থিত সম্পূর্ন ভূমিবেস্টিত একটি রাষ্ট্র এর আয়তন ১০,৯০৮ বর্গ কিলোমিটার এর দক্ষিন-পশ্চিম দিকে আলবেনিয়া, দক্ষিন-পূর্ব দিকে মেসিডোনিয়া, পশ্চিম দিকে মন্টেনেগ্রো এবং উত্তর ও পূর্ব দিকে সার্বিয়া কসোভোর সবচেয়ে বেশি ভূমি-সংযোগ সার্বিয়ার সাথে প্রয়োজনে কসোভো আলবেনিয়ার সমুদ্র-বন্দর ব্যবহার করে

কসোভো এবং মেতোহিজার দুটি প্রধান সমতলভূমি ছাড়া, বাকী পুরো কসোভোই পাহাড়ী অঞ্চল আবহাওয়া মূলত ভূমধ্যসাগরীয় ঠান্ডা-প্রধান কসোভোর আয়তনের প্রায় ৩৯% বনভূমি

কসোভোর সর্বোচ্চ বিন্দু- দেরাভিচা, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ২,৬৫৬ মিটার বা ৮,৭১৪ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত বৃহত্তম নদী- ‘শ্বেত ড্রিননদী এছাড়া প্রধান নদীগুলোর মধ্যে আছে- সিটানিসা, ইবার এবং দক্ষিণ মোরাভা বৃহত্তম হ্রদ- ‘গাজিভোদা হ্রদ এছাড়া প্রধান হ্রদ্গুলোর মধ্যে আছে- রাদোনিক হ্রদ, বাটলাভা হ্রদ, বাদোভস হ্রদ ইত্যাদি পাহাড়ী এলাকা হওয়ায় কসোভোতে প্রচুর জলপ্রপাতের অবস্থান এর মধ্যেমিরুশা জলপ্রপাত-গুচ্ছসবচেয়ে বিখ্যাত পর্যটন-আকর্ষন

কসোভোতে প্রাকৃতিক সম্পদ হিসেবে রৌপ্য, নিকেল, তামা, সীসা, দস্তা, লোহা, কোবাল্ট, এবং বক্সাইটের প্রচুর পরিমানে মজুত রয়েছে

জনসংখ্যাঃ
২০১১ যিশুসনের আদমশুমারী অনুযায়ী কসোভোর মোট জনসংখ্যা- ১৭,৩৯,৮২৫ জন কসোভোর সংখ্যাগুরু অধিবাসী  মূলত জাতিগত আলবেনিয় এরা জনসংখ্যার প্রায় ৯২.% এছাড়া জনসংখ্যার বাকী জনগোষ্ঠীরা হলো- .% সার্ব, .% বসনিয়, .% তুর্কী, .% আশকালি, .% গোরানিয়, .% কপ্টিক, .% রোমানি এবং ০.% অন্যান্য

কসোভোর ধর্মগুলোর মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকের ধর্ম ইসলাম তারা জনসংখ্যার ৯৫.৬%। তারপর খ্রিস্টিয়ান, ৩.৬৯%। এছাড়া ধর্মহীন ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বী আছে, ০.৭১%।

কসোভোর দাপ্তরিক ভাষা দুইটি- আলবেনিয় ও সার্ব। এছাড়া সংখ্যালঘুদের ভাষা হিসেবে বসনিয়, তুর্কী, গোরানিয় এবং রোমানি ভাষা স্বীকৃত।

২০১১ যিশুসনের আদমশুমারী মোতাবেক, কসোভোর জনসংখ্যার ঘনত্ব, প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ১৫৯ জন। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ০.৬৪%। প্রত্যাশিত গড় আয়ু ৭১.৩ বছর। সাক্ষরতার হার ৯৩%

সরকার ও রাজনীতিঃ
কসোভো প্রধানমন্ত্রী-শাসিত বহুদলীয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। রাষ্ট্র প্রধান- রাষ্ট্রপতি, তার হাতে কিছু পরিমান ক্ষমতা থাকে। প্রধানমন্ত্রী সরকার প্রধান। কসোভোর গণপরিষদের নাম- এসেম্বলি অব কসোভো। ‘এসেম্বলি অব কসোভো’ এক কক্ষ বিশিষ্ঠ এবং ১২০ আসন সংবলিত। কসোভোর গণপরিষদে সংখ্যালঘুদের জন্য ২০ টি আসন সংরক্ষিত রাখা আছে। এর মধ্যে ১০ টি আসন সার্বদের জন্য সংরক্ষিত। ৩ টি আসন বসনিয়দের জন্য, ২ টি আসন তুর্কীদের জন্য। এবং ১ টি করে আসন- গোরানিয়, রোমানি, আশকালি, কপ্টিক এবং অন্যান্যদের জন্য বরাদ্দ।

কসোভোর রাজনীতির ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দল- ‘ডেমোক্রেটিক লীগ অব কসোভো’। ১৯৯০ যিশুসনের ‘কসোভো প্রজাতন্ত্র’ গঠনে অহিংস আন্দোলনের মাধ্যমে জনপ্রিয় হয় দলটি। দলটির প্রতিষ্ঠাতা কসোভোর স্বাধীনতার প্রবাদ পুরুষ ইব্রাহিম রগুভা এছাড়া কসোভোর স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়, ‘কসোভো লিবারেশন আর্মি- কেএলএ’ নামে গেরিলা সংগঠন গড়ে ওঠে। বর্তমানে দুইটি রাজনৈতিক দল, কসোভো লিবারেশন আর্মির দুইজন কমান্ডারের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছে। একটি ‘ডেমোক্রেটিক পার্টি অব কসোভো’ এবং অপরটি ‘অ্যালায়েন্স ফর দ্যা ফিউচার অব কসোভো’। এছাড়া কসোভোর গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য- ইনিশিয়েটিভ ফর কসোভো, ভেটেভেনডোসজে- সেলফ ডিটারমিনেশন, লিবারেল পার্টি অব কসোভো ইত্যাদি। বড় দুই দল, ডেমোক্রেটিক লীগ অব কসোভো এবং ডেমোক্রেটিক পার্টি অব কসোভোর জোট সরকার, বর্তমানে কসোভোর ক্ষমতায়।

সংস্কৃতিঃ
কসোভোর সংস্কৃতি মূলত আলবেনিয় সংস্কৃতি। তবে তাতে সার্ব সংস্কৃতির মিশ্রণ লক্ষ্য করা যায়। এছাড়া ছোটো নৃগোষ্ঠীগুলোর নিজস্ব ভাষা-সংস্কৃতি-সাহিত্য লক্ষণীয়। বর্তমান কসোভো সরকার প্রত্যেক নৃগোষ্ঠীকে নিজস্ব সংস্কৃতি চর্চার অধিকার দিতে আগ্রহীসাহিত্য-চর্চা ও গণমাধ্যম গুলোতে, আলবেনিয় ও সার্ব দুই ভাষারই ব্যবহার করা হয় ।

অর্থনীতিঃ
কসোভোর মুদ্রার নাম ‘ইউরো’। কিন্তু কসোভো ‘ইউরো জোন’ বা ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য নয়। ইউরোপ অঞ্চলের একক মুদ্রা হিসেবে ইউরো প্রচলনের পর থেকেই কসোভো ইউরো ব্যবহার করা করে আসছে। তার আগে কসোভো ‘জার্মান মার্ক’ ব্যবহার করতো। ১৯৯৯ যিশুসনে সার্ব দিনারের পরিবর্তে জার্মান মার্ক প্রচলন করা হয়।

সাবেক যুগোস্লাভিয়ার প্রজাতন্ত্রগুলোর মধ্যে কসোভোর অর্থনীতি ছিলো সবচেয়ে দুর্বল। ১৯৯২ যিশুসনে প্রথম স্বাধীনতা ঘোষণার পরপরই অর্থনীতি পুনোরোদ্ধারে মনোনিবেশ করে কসোভো। কসোভোর অর্থনীতির সর্ববৃহৎ খাত, খনিজ পদার্থ থেকে আয়। তারপর কৃষি এবং পর্যটন। কসোভোর খনিজ সম্পদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সীসা, তামা, দস্তা, রূপা, লোহা, নিকেল এবং বক্সাইটের মজুত ।

কসোভো খাদ্যে স্বয়ংসম্পুর্ণ নয়। খাদ্য সামগ্রী এবং মাংস তাই কসোভোর প্রথম স্থানে থাকা আমদানী পণ্য ।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও আইনগত অবস্থানঃ
কসোভো যুগোস্লাভিয়া প্রজাতন্ত্র থেকে প্রথম স্বাধীনতা ঘোষণা করে ১৯৯২ যিশুসনের ২৫ মে। কিন্তু তখন কসোভোকে আলবেনিয়া ছাড়া আর কেউ স্বীকৃতি দেয় নি। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উপস্থিতিতে কসোভোর গণপরিষদ আবারো স্বাধীনতা ঘোষণা করে, ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০০৮ যিশুসনে। জুন ২৩, ২০১৫ এর হিসাব মোতাবেক জাতিসংঘের সদস্যরাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ১০৮ টি রাষ্ট্র কসোভোকে সার্বভৌম হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ইউরোপিয় ইউনিয়নের ২৮ টি রাষ্ট্রের ২৩ টিই কসোভোকে সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। সার্বিয়া কখনোই কসোভোকে সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে মেনে নেয় নি। একমাত্র ‘রাশিয়ার’ ভেটো-ক্ষমতাই কসোভোর জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্র হওয়ার পেছনে প্রধান বাঁধা।

প্রশাসনিক বিভাগঃ
কসোভো রাষ্ট্র ৭ টি জেলায় (আলবেনিয় ভাষায় ‘রাইয়ুন’ বা সার্ব ভাষায় ‘ওকরুযি’) বিভক্ত। জেলাগুলো হলো- মিত্রোভিচে, প্রিস্টিনা, ফেরিযাজ, পেজে, জিলান, জাকোভে এবং প্রিজরেন। জেলাগুলো মূলত কসোভোর ঐতিহাসিক অঞ্চলগুলোকে প্রতিনিধিত্ব করে। জেলাগুলোকে আবার ভাগ করা হয়েছে নগরে (আলবেনিয় ভাষায় ‘কমুনা’ বা সার্ব ভাষায় ‘অপ্সতিনা’) কসোভোকে মোট ৩৮ টি নগরে ভাগ করা হয়েছে। নগর গুলোই কসোভোর মূল প্রশাসনিক বিভাগ। নগর গুলোকে আবার পৌর বসতি (মিউনিসিপাল সেটেলমেন্ট) এবং গ্রামে ভাগ করে হয়েছে। নগরগুলো হলো- মিত্রোভিচে জেলায়- মিত্রোভিচে, উত্তর মিত্রোভিচে, স্কেনদেরাজ, ভুশত্রি, লেপোসাভিক, যুবিন পটক এবং যেভেচেন; প্রিস্টিনা জেলায়- প্রিস্টিনা, পডুজেভে, অবিলিক, লিপজান, নভো বেরদে, ফুশে কসোভো, গ্রাসানিচা এবং গ্লোগক; ফেরিযাজ জেলায়- ফেরিযাজ, হানি ই এলেযিত, কাচানিক, শ্তিমে এবং শ্তের্পচে; পেজে জেলায়- পেজে, ইস্তক এবং ক্লিনা; জিলান জেলায়- জিলান, ক্লোকত, কামেনিচা, রানিলুগ, ভিতিনা এবং পারতেশ; জাকোভে জেলায়- জাকোভে, দেকান, রাহোভেচ এবং জুনিক; প্রিজরেন জেলায়- প্রিজরেন, দ্রাগাশ, মালিশেভা, মামুশা এবং সুহারেকে।

রাষ্ট্রপতিগণের তালিকাঃ
নাম
ক্ষমতাকাল
টিপ্পনী
ইব্রাহিম রগুভা
মে ২৫, ১৯৯২- জানুয়ারি ০১, ২০০৬
ফেব্রুয়ারি ০১, ২০০০ থেকে মার্চ ০৪, ২০০২; রাষ্ট্রপতি পদ ছিলোনা।
নেখহাত দাচি
জানুয়ারি ০১, ২০০৬- ফেব্রুয়ারি ১০, ২০০৬
ভারপ্রাপ্ত।
ফাতমির সেজদিউ
ফেব্রুয়ারি ১০, ২০০৬- সেপ্টেম্বর ২৭, ২০১০

জাকুপ ক্রাসনিকি
সেপ্টেম্বর ২৭, ২০১০- ফেব্রুয়ারি ২২, ২০১১
১ম দফা। ভারপ্রাপ্ত।
বেহগেত পাচোল্লি
ফেব্রুয়ারি ২২, ২০১১- এপ্রিল ০৪, ২০১১

জাকুপ ক্রাসনিকি
এপ্রিল ০৪, ২০১১- এপ্রিল ০৭, ২০১১
২য় দফা। ভারপ্রাপ্ত।
আতিফেতে জাহজাগা
এপ্রিল ০৭, ২০১১- এপ্রিল ০৭, ২০১৬

হাশিম থাচি
এপ্রিল ০৭, ২০১৬- চলছে...


প্রধানমন্ত্রীগণের তালিকাঃ
নাম
ক্ষমতাকাল
টিপ্পনী
বুজার বুকোশি
মে ২৫, ১৯৯২- ফেব্রুয়ারি ০১, ২০০০
ফেব্রুয়ারি ০১, ২০০০ থেকে মার্চ ০৪, ২০০২; প্রধানমন্ত্রী পদ ছিলোনা।
বাজরাম রেখেপি
মার্চ ০৪, ২০০২- ডিসেম্বর ০৩, ২০০৪

রামুশ হারাদিনাজ
ডিসেম্বর ০৩, ২০০৪- মার্চ ০৮, ২০০৫

আদম সালিহাজ
মার্চ ০৮, ২০০৫- মার্চ ১৫, ২০০৫
ভারপ্রাপ্ত।
বাজরাম কুসুমি
মার্চ ১৫, ২০০৫- মার্চ ১০, ২০০৬

আগিম সেকু
মার্চ ১০, ২০০৬- জানুয়ারি ০৯, ২০০৮

হাসিম থাচি
জানুয়ারি ০৯, ২০০৮- ডিসেম্বর ০৯, ২০১৪

ইসা মুসতাফা
ডিসেম্বর ০৯, ২০১৪- চলছে...


তড়িৎ সহায়িকাঃ
সাংবিধানিক নামঃ কসোভো প্রজাতন্ত্র (রিপাবলিকা এ কসোভেস [আলবেনিয়]; রিপাবলিকা কসোভো [সার্ব])
অবস্থানঃ বলকান অঞ্চল, ইউরোপ মহাদেশ।
রাজধানীঃ প্রিস্টিনা।
আয়তনঃ ১০,৯০৮ বর্গ কিলোমিটার (৪,২১২ বর্গ মাইল)।
জনসংখ্যাঃ ১৭,৩৯,৮২৫ জন (২০১১ আদমশুমারী)
জনসংখ্যার ঘনত্বঃ ২২০ জন, বর্গ কিলোমিটার প্রতি।
জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারঃ ০.৬৮% (২০১৫ হিসাব)।
মুদ্রাঃ ইউরো
ভাষাঃ আলবেনিয় ও সার্ব (দাপ্তরিক), বসনিয়, তুর্কী, গোরানিয় এবং রোমানি
নৃগোষ্ঠীঃ ৯২.৯% আলবেনিয়, ১.৫% সার্ব, ১.৬% বসনিয়, ১.১% তুর্কী, ০.৯% আশকালি, ০.৬% গোরানিয়, ০.৫% কপ্টিক, ০.৪% রোমানি এবং ০.৩% অন্যান্য
ধর্মঃ ৯৫.৬% মুসলিম, ৩.৬৯% খ্রিস্টিয়ান এবং ০.৭১% ধর্মহীন ও অন্যান্য।
সাক্ষরতার হারঃ ৯৩% (২০১১ হিসাব)।
জিডিপিঃ ১৬.৯৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (পিপিপি, ২০১৪ হিসাব)।
স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠাঃ মে ২৫, ১৯৯২ [একমাত্র আলবেনিয়া স্বীকৃত]; ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০০৮ [আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় স্বীকৃত] (সার্বিয়া থেকে)
জাতীয় বীরঃ ইব্রাহিম রগুভা, কসোভোর জাতির জনক।
জাতীয় সঙ্গীতঃ ইউরোপা (ইউরোপ)
আইনসভাঃ এসেম্বলি অব কসোভো (১২০ আসন)।
সরকারের ধরনঃ প্রধানমন্ত্রীশাসিত গণতন্ত্র।
আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিঃ জুন ২৩, ২০১৫ মোতাবেক জাতিসংঘভূক্ত ১০৮ টি রাষ্ট্র স্বীকৃতি দিয়েছে।
প্রধান প্রধান নগরঃ প্রিজরেন, মিত্রোভিচে, ফেরিযাজ, জাকোভে, পেজে, জিলান, গ্লোগক, লিপজান, সুহারেকে, রাহোভেচ, পডুজেভে, স্কেনদেরাজ এবং ভুশত্রি
সর্বোচ্চ বিন্দুঃ দেরাভিচে পর্বত (২,৬৫৬ মিটার/৮,৭১৪ ফুট)
সময় স্থানঃ জিএমটি +১