প্রচলিত প্রত্যেকটি ধর্মই মানুষের জীবনাচরণের বিধান নিশ্চিত করে। কিছু কম-বেশি, সব ধর্মই মানুষের জীবনের প্রায় প্রতিটি দিকে আলোকপাত করার চেষ্টা করে। ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে আন্তর্জাতিক পর্যায় পর্যন্ত প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই ধর্মগুলোর সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা থাকে। এর মধ্যে ধর্ম হিসেবে সবচেয়ে বেশি রাজনীতি-মূখী ধর্ম হলো- ইসলাম। সবচেয়ে বেশি বিধান, বর্ণিত এবং বিবৃত হয়েছে ইসলাম ধর্মে, তাই এই ধর্মেরই সবচেয়ে রাজনীতিকরন হয়েছে। আর এই রাজনীতিকরনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিলো মহানবীর আমলেই। শাস্ত্রকারদের মতে, রাষ্ট্র-ক্ষমতা ছাড়া 'ইসলাম' সম্পূর্ণ প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। তাই রাজনীতি, রাষ্ট্রক্ষমতা এবং ইসলাম অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। তাই, এখন পর্যন্ত ইসলাম ধর্ম প্রতিষ্ঠার জন্য রাজনীতি বহাল আছে।
ধর্ম প্রতিষ্ঠার জন্য রাজনীতি বহাল থাকলেও, পথ-মত-নীতি নিয়ে মতাদর্শিক পার্থক্য আছে। রাজনীতিবিদগণ বিভিন্নভাবে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন। মোটাদাগে তাদের মধ্যে অন্তত দুইটি প্রধান ভাগ আছে। এবং বর্তমান সময়ে এই দুই ভাগেরই, যারা আলাদা আলাদা ভাবে ইসলাম প্রতিষ্ঠার রাজনীতি করছেন, তাদের মধ্যে বিভেদ অত্যন্ত প্রকট। তাদের দুই দলের হাতেই যথেষ্ট পরিমান তথ্য-প্রমান, দলিল, ঐতিহাসিক উপাদান আছে, রাজনৈতিক ইসলামের মত-পথে নিজেদের সত্য এবং বাকীদের মিথ্যা প্রমান করার মতো।
এর এক পাশে আছেন, মডারেট মুসলিম রাজনীতিবিদ ও রাজনৈতিক দল সমূহ। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য, বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানের 'জামায়াত এ ইসলাম', ইন্দোনেশিয়ার 'জেমাহ ইসলামিয়া', আরব বিশ্বের বেশিরভাগ দেশে 'ইখওয়ানুল মুসলেমিন- মুসলিম ব্রাদারহুড'। এছাড়াও বিভিন্ন দেশে বেনামে মুসলিম ব্রাদারহুড, যেমন- তুরস্ক এবং মরোক্কোতে 'জাস্টিস এন্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি', তিউনিসিয়ায় 'আন-নাহদা আন্দোলন', মিসরে 'ফ্রিডম এন্ড জাস্টিস পার্টি' ইত্যাদি। এছাড়া ফিলিস্তিনের 'হামাস', মালয়েশিয়ার 'প্যান মালয়েশিয়ান ইসলামিক পার্টি' উল্লেখযোগ্য।
এইসব রাজনৈতিক দল, প্রথাগত গণতান্ত্রিক রাজনীতির সাথে যুক্ত। এরা গণতান্ত্রিক রাজনীতির মাধ্যমে ক্ষমতায় আসতে চায়। তাদের মতে, গণতান্ত্রিক ভাবে ক্ষমতায় আসলেও ইসলাম প্রতিষ্ঠা সম্ভব। এই দলগুলো নিজেদের দলের ভেতরেও গণতন্ত্র চর্চা করে।
অপর পাশে আছে, বিভিন্ন জিহাদি দল। যারা মনে করে একমাত্র জিহাদের মাধ্যমেই ইসলাম প্রতিষ্ঠা সম্ভব। জিহাদের একবার ক্ষমতায় চলে আসলে, রাষ্ট্রে ইসলাম প্রতিষ্ঠা হয়ে যাবে। এদের মধ্যে আছে, আন্তর্জাতিক জিহাদি সংগঠন 'আল-কায়েদা'। আল-কায়েদা জিহাদের লক্ষ্যে বিশ্বব্যাপী কাজ করে যাচ্ছে। এদের গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক শাখাগুলো হচ্ছে- আরব উপদ্বীপের আল কায়েদা (আল কায়েদা ইন আরাবিয়ান পেনিনসুলা- আকাপ), ভারতীয় উপমহাদেশের আল কায়েদা (আল কায়েদ ইন ইন্ডিয়ান সাবকন্টিনেন্ট- আকিস), মালয় দ্বীপপুঞ্জের আল কায়েদা (আল কায়েদা ইন মালায় আর্কিওপেলাগো- আকমা), ইসলামি পশ্চিমের আল কায়েদা (আল কায়েদা ইন ইসলামিক মাগরেব), পশ্চিম আফ্রিকার আল কায়েদা, সোমালিয়ার আল কায়েদা, ইরাকের আল কায়েদা, বসনিয়ার আল কায়েদা ইত্যাদি। এছাড়া বিভিন্ন সংগঠন আল কায়েদার সাথে জোট বেধে আছে। এদের মধ্যে উল্লেক্ষ্য- পাকিস্তানের 'তেহরিক ই তালিবান', আফগানিস্তানের 'তালিবান', সিরিয়ার 'আল নুসরা ফ্রন্ট', ইয়েমেনে 'আনসার আল শরিয়া' ইত্যাদি। বৃহত্তম এই ছত্রি-সংগঠন ছাড়াও আরো জিহাদি দল আছে, যারা জিহাদের মাধ্যমে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে চায়। যেমন- আরব বিশ্বে 'হিজবুত তাহরীর', ইরাকে 'আনসার আল ইসলাম', সোমালিয়ায় 'আল শাবাব' ইত্যাদি।
জিহাদের মাধ্যমে ইসলাম প্রতিষ্ঠায় অতি জিহাদি কিছু ব্যক্তি ও সংগঠন সম্প্রতি ইরাক ও সিরিয়ায় খেলাফত প্রতিষ্ঠা করেছে। তাদের দাবী মতে, তারা এখন একটি 'ইসলামি রাষ্ট্র' এবং সারা পৃথিবীর মুসলিমদের তারা প্রতিনিধিত্ব করে। বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন জিহাদি সংগঠন তাদের সাথে একাত্মতা ঘোষনা করে বিশ্বব্যাপী খেলাফত প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এদের মধ্যে আছে- নাইজেরিয়ার 'বোকো হারাম', মধ্য এশিয়া এবং চীনের উইঘুর অঞ্চলের 'তুর্কিস্তান ইসলামি মুভমেন্ট', ফিলিপাইনের 'আবু সায়াফ গ্রুপ', বাংলাদেশে 'আনসারুল্লাহ বাংলা টিম', ইরাক ও সিরিয়ায় 'জুন্দ আল খলিফা' ইত্যাদি।
গণতন্ত্রের প্রশ্নে আগেই মুসলিম রাজনীতিকগণ দুই ভাগে বিভক্ত ছিলেন। এক পক্ষে গণতন্ত্রের পক্ষে, অপরপক্ষ বিপক্ষে। সম্প্রতি, খেলাফতের প্রশ্নে গণতন্ত্রের বিপক্ষের রাজনীতিকগণ আবারো দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছেন। এক পক্ষ এখনই খেলাফত প্রতিষ্ঠার ঘোষনা দিয়ে দিয়েছে। অপর পক্ষের মতে খেলাফতের জন্য মুসলিম বিশ্ব এখনো প্রস্তুত না।
আগেই মুসলিম রাজনীতিবিদগনের মধ্যে গণতন্ত্রচর্চা প্রসঙ্গে মতানৈক্য হয়েছিলো। কেউ গণতন্ত্র চর্চার মাধ্যমে ইসলামকে ক্ষমতায় নিয়ে আসার রাজনীতিতে ছিলেন, কেউ সশস্ত্র জিহাদের মাধ্যমে ইসলামকে ক্ষমতায় আনার চেষ্টায় আছেন। সম্প্রতি ইরাক ও সিরিয়ায় 'ইসলামিক স্টেট- আইএস' নামে খেলাফত প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর, জিহাদিদের মধ্যে দ্বন্দ্ব প্রকট হয়েছে। ১৯৯০ যিশুসনের আগ পর্যন্ত জিহাদের একটা ফর্ম হিসাবে স্বাধিকার আন্দোলনও যুক্ত ছিলো। বিভিন্ন অঞ্চলে মুসলিমদের স্বাধিকার আন্দোলনকে জিহাদ হিসেবে অভিহিত করা হতো। যেমন- ফিলিস্তিন, ফিলিপাইনের বাঙসামরো অঞ্চল, বসনিয়া, রাশিয়ার চেচনিয়া-দাগেস্তান অঞ্চল, চীনের উইঘুর অঞ্চল, মায়ানমারের আরাকান অঞ্চল, ভারতের কাশ্মীর ইত্যাদি ভূখণ্ডের স্বাধিকার আন্দোলনকে জিহাদের সাথে তুলনা করা হতো।
১৯৯০ যিশুসনের পর জিহাদের চেহারা বদলে যেতে থাকে। আফগানিস্তানে রুশ আগ্রাসন ঠেকানোর জন্য, প্রতিষ্ঠিত হয় আফগান জাতীয়তাবাদী জিহাদি সংগঠন 'তালিবান' এবং বহুজাতিক জিহাদিদের আন্তর্জাতিক প্লাটফর্ম 'আল-কায়েদা'। তারপর থেকেই মুসলিম দেশগুলোতে গড়ে উঠতে থাকে বিভিন্ন জিহাদি সংগঠন। এছাড়া ছোট আকারে গড়ে ওঠে 'হিজবুত তাহরীর'।
আল-কায়েদা তার স্বরূপে আসে ২০০১ যিশুসনে, আমেরিকার ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে বিমান হামলার মাধ্যমে। এর পর পরই পৃথিবীব্যাপী তাদের রিক্রুটমেন্ট বেড়ে যায়। তখন পর্যন্ত আল-কায়েদার জিহাদিরা গিয়ে জড়ো হতো আফগানিস্তানে। ২০০৩ যিশুসনে আমেরিকা ইরাক আক্রমন করে। ২০০৬ যিশুসনে আল-কায়েদা ইরাকে তাদের নতুন শাখা খোলে, 'ইরাকের আল-কায়েদা'। এর পর আল-কায়েদা নিজেদের বিস্তৃত করার উদ্দেশ্যে শাখা সম্প্রসারণ করে। একে একে খোলা হয় আরব উপদ্বীপের আল-কায়েদা, উত্তর আফ্রিকার ইসলামি পশ্চিম আল-কায়েদা, সোমালিয়ার আল-কায়েদা, মালয় দ্বীপপুঞ্জের আল-কায়েদা, চেচনিয়ার আল-কায়েদা, স্পেনের আল-কায়েদা ইত্যাদি। এছাড়া বিশ্বব্যাপী জিহাদ সংগঠিত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন দেশের জিহাদি সংগঠনগুলো আল-কায়েদাকে সমর্থন করে এবং একসাথে কাজ করতে সম্মত হয়। এদের মধ্যে ভারতের হরকাতুল জিহাদ, পাকিস্তানের তেহরিক ই তালিবান, লস্কর ই তাইয়েবা, ফিলিপাইনের আবু সায়াফ, সোমালিয়ার আল শাবাব, মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার আনসার আল ইসলাম, আনসার আল শারিয়াহ, আনসার আল দিন, আনসার আল জিহাদ উল্লেখ্য।
বিশ্বব্যাপী আল-কায়েদার নেতা ছিলেন ওসামা বিন লাদেন। তার মৃত্যুর পর নেতা হন, আইমান আল জাওয়াহিরি। তাদের বলা হয় শায়েখ। শাখা আল-কায়েদাগুলোর জন্য আলাদা আলাদা আমির। ইরাকের আল-কায়েদার আমির ছিলেন আবু ওমর আল বাগদাদী। তার মৃত্যুর পর আমির হন-আবু বকর আল বাগদাদী।
২০১১ যিশুসনে মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার আরবী ভাষাভাষী দেশগুলোতে শুরু হয় 'আরব বসন্ত'। আরব বসন্ত গণতন্ত্র না আনুক, সুশাসন না আনুক, জিহাদিদের জন্য বসন্ত নিয়ে আসে। ইরাকের আল-কায়েদা সুন্নি-অধ্যুষিত কয়েকটা ছোটো শহর দখলে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করে- 'ইসলামিক স্টেট অব ইরাক'। এই সময়েই সিরিয়ায় শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। গৃহযুদ্ধের সুযোগে ইসলামিক স্টেট অব ইরাক, সিরিয়ায় প্রবেশ করে এবং প্রতিষ্ঠা করে, 'ইসলামিক স্টেট অব ইরাক এন্ড শাম' বা আইসিস বা আইএস।
২০১৪ যিশুসনের ৩ ফেব্রুয়ারি 'ইসলামিক স্টেট' তাদের আমির আবু বকর আল বাগদাদীর নেতৃত্বে আল-কায়েদার বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে আলাদা কাঠামো তৈরী করে। ২৯ জুন, ২০১৪ যিশুসনে ইরাক এবং সিরিয়ায় তাদের অধিকৃত সুন্নি অঞ্চলগুলো নিয়ে একতরফা খেলাফত ঘোষনা দেয়। বেশিরভাগ জিহাদি সংগঠন এতে সম্মত ছিলো না, বিশেষত আল-কায়েদা এতে প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হয়। আল-কায়েদা সিরিয়াতে ইসলামিক স্টেটের বিরুদ্ধে আলাদা ফ্রন্ট গড়ে তোলে, এর নাম রাখা হয়- আল নুসরা ফ্রন্ট।
এর পর আবু বকর আল বাগদাদীকে কয়েকটি জিহাদি সংগঠন খলিফা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এর মধ্যে নাইজেরিয়ার বোকো হারাম, মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার আনসার দ্বীন, জুন্দুল্লাহ, জুন্দ আল খালিফা, আনসার আল শরিয়া, মধ্য এশিয়ার তুর্কিস্তান ইসলামি মুভমেন্ট, বাংলাদেশের আনসারুল্লাহ বাংলা টিম উল্লেখযোগ্য। বিভিন্ন দেশ থেকে জিহাদিরা খেলাফতের পক্ষে সিরিয়ায় গিয়ে জড়ো হতে থাকে।
খেলাফতের পক্ষের জিহাদিদের মতে এখনই খেলাফত প্রতিষ্ঠার উপযুক্ত সময়। সেক্ষেত্রে আবু বকর আল বাগদাদি সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অপরপক্ষে আল-কায়েদা ও তার ভাতৃ-প্রতিম সংগঠনগুলো মনে করে, এখনো খেলাফত প্রতিষ্ঠার সময় আসে নি। আর খলিফা যদি হতেই হয়, তাহলে আল-কায়েদা প্রধান হিসেবে শায়খ আইমান আল জাওয়াহিরিই হবেন এ জমানার খলিফা; আবু বকর আল বাগদাদি কে? আল-কায়েদা নিজেও বিশ্বব্যাপী খেলাফত প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখছে। কোনো অফিসিয়াল ঘোষনা না আসলেও এরই মধ্যে তারা ভূমিদখলের কাজ শুরু করে দিয়েছে। সিরিয়াতে আল নুসরা ফ্রন্টের ব্যানারে তারা ইদলিব ও আলেপ্পো প্রদেশের বেশিরভাগ জায়গা দখল করে নিয়েছে। কিছু কিছু স্থানে সরাসরি ইসলামিক স্টেট এর জিহাদিদের সাথে সম্মুখ যুদ্ধে জড়িয়ে পরছে। ইয়েমেনে গৃহযুদ্ধের সুযোগে তাদের 'আরব উপদ্বীপের আল-কায়েদা শাখা' হাদরা মাউত, আতাক ও আবিয়ান প্রদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল দখল করে নিয়েছে। লিবিয়াতেও গৃহযুদ্ধের সুযোগে 'শরিয়ত ব্রিগেড' দের্না, সির্ত ও বেনগাজি শহর দখল করে নিয়েছে। আফগানিস্তানের কুন্দুজ প্রদেশ অনেক আগে থেকেই আল-কায়েদার দখলে।
এভাবেই আল-কায়েদা বিশ্বব্যাপী খেলাফত প্রতিষ্ঠা করতে চায়। তাই তারা ইরাক ও সিরিয়াভিত্তিক 'ইসলামিক স্টেট' এর খেলাফতকে অস্বীকার করে। ইতিমধ্যে দুই গ্রুপ নিজেদের আসল ইসলামের রক্ষাকারী, এবং অপরপক্ষকে মুরতাদ বলে ঘোষনা দিয়েছে। আর এই দুই গ্রুপকেই মুরতাদ বলে ঘোষনা দিয়েছে, তুলনামূলক কম শক্তিশালী জিহাদি গ্রুপ হিজবুত তাহরীর। তারাও আল-কায়েদার মতো বিশ্বব্যাপী খেলাফত প্রতিষ্ঠা করতে চায়, কিন্তু বাকী গ্রুপ গুলোর তুলনায় তারা জমিদখলে পিছিয়ে।