30 January 2017

রোহিঙ্গা কারা?






আমাদের চলে যেতে হবে ১৪৩০ সালে। আরাকানের স্বাধীন রাজা মিন সাও মন পার্শ্ববর্তী 'বামার' রাজার তাড়া খেয়ে বাংলায় রাজনৈতিক আশ্রয় নেন। বাংলাতেও তখন রাজনৈতিক অস্থিরতা। বাংলা সালতানাতে রাজনৈতিক অস্থিরতা শেষ হয়, গনেশপুত্র জালালউদ্দিন যদুর ক্ষমতায় আরোহনের মধ্য দিয়ে। সুলতান জালালউদ্দিন যদুর সহায়তায় ২৪ বছর পর আরাকানের রাজত্ব ফিরে পান, রাজা মিন সাও মন, ১৪৩০ সালে। কৃতজ্ঞতা স্বরুপ তিনি মুসলিমদের 'সুলতান' উপাধী ধারন করেন। রাজদরবারে আরব, ইরানি, তুর্কি ও বাংলার মুসলিমদের উচ্চপদে চাকরি দেন। তখন থেকে স্বাধীন আরাকান রাজ্যের সাথে বাংলার যোগাযোগ। তখন থেকে মুসলিমরা আরাকানে।
'আরাকান' শব্দটি 'রাখাইন' শব্দটির অপভ্রংশ। আঞ্চলিক ভাবে উচ্চারণ করা হয়, 'রা খাই'। মুসলিমরা আরাকানকে ডাকতো 'রৌসাং' বা 'রোসাং' বা 'রোহাং'। আর আরাকানে আরব, ইরানি, তুর্কি ও বাংলার অভিবাসী মুসলিমদের একসাথে ডাকা হতো 'রোহিঙ্গা'। পরবর্তীতে ইসলাম ধর্ম গ্রহণকারী আরাকানীদেরও বলা হতো 'রোহিঙ্গা'। তখনকার আরাকান রাজ্যে এখনকার মায়ানমারের রাখাইন স্টেট ছাড়াও বাংলাদেশের চট্টগ্রাম-কক্সবাজার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম ছিলো। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার বাংলা সালতানাতের দখলে আসে ১৬৬৬ সালে। এখন পর্যন্ত আরাকানের ভাষার সাথে চট্টগ্রামের ভাষার মিল লক্ষণীয়।
আরাকান রাজ্য ১৭৮৫ পর্যন্ত স্বাধীন ছিলো। ১৭৮৫ সালে পার্শ্ববর্তী মান্দালয়-ভিত্তিক বার্মিজ রাজ্য আরাকান দখল করে নেয়। আর মান্দালয় রাজ্য বৃটিশরা দখল করে নেয় ১৮২৬ সালে। বৃটিশরা ১৯৪৮ সালে মায়ানমার ছেড়ে গেলে আরাকান মায়ানমারের একটি স্টেট হয়। মায়ানমার ১৯৬২-২০১১ সাল পর্যন্ত সরাসরি সামরিক শাসনের অধীনে থাকে।
১৯৮২ সালে মায়ানমারের সামরিক সরকার ১৩৫ টি নৃগোষ্ঠীর একটি তালিকা করে। তালিকাভুক্ত নৃগোষ্ঠীগুলোকে মায়ানমারের বৈধ নৃগোষ্ঠী ঘোষনা করা হয়। বাকী নৃগোষ্ঠীসমূহ মায়ানমারের অধিবাসী নয় বলে বিবৃতি দেয়া হয়। বড় তিনটি সহ আরো ১৭-২২ টি নৃগোষ্ঠী এই তালিকা থেকে বাদ পরে। রোহিঙ্গারা দলভুক্ত হয় বাদ পরা তালিকায়। মায়ানমারের 'অদ্ভুত' আইন অনুযায়ী তারা আর মায়ানমারের নাগরিক থাকলো না।
রোহিঙ্গাদের ধরা হয় সবচেয়ে নির্যাতিত জনগোষ্ঠী। জাতিগতভাবে তাদের অবস্থান কুর্দীদের চেয়েও খারাপ। কুর্দীদের নিজেদের কোনো দেশ নেই। তাদের ভূমি চারটি দেশের মধ্যে ভাগেযোগে আছে। আর রোহিঙ্গারা এমন একটি নৃগোষ্ঠী যারা কোনো দেশেরই নাগরিক না। তাদের কোনো দেশ নেই।
মায়ানমারে রোহিঙ্গাদের সংখ্যা ১৩-১৫ লাখ। আর মায়ানমারের বাইরে আছে আরো ১২-১৫ লাখ। এর মধ্যে বাংলাদেশে ৩-৫ লাখ, সৌদি আরবে ৪ লাখ, পাকিস্তানে ২ লাখ, থাইল্যান্ডে ১ লাখ, মালয়েশিয়াতে ৪০ হাজার, ভারতে ৩৫ হাজার, ইন্দোনেশিয়াতে ১২ হাজার রোহিঙ্গা বাস করছে বলে জাতিসংঘের ধারণা। বর্তমানে রোহিঙ্গারা আরাকান স্টেট এর মোট জনসংখ্যার ৩৫%। সরকারীভাবে দমন করে বাইরে না ঠেলে দিলে তারা ৬০% হতে পারতো।

22 January 2017

মুসলিমদের রাজনীতি বা রাজনীতির মুসলিমগণ


প্রচলিত প্রত্যেকটি ধর্মই মানুষের জীবনাচরণের বিধান নিশ্চিত করে। কিছু কম-বেশি, সব ধর্মই মানুষের জীবনের প্রায় প্রতিটি দিকে আলোকপাত করার চেষ্টা করে। ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে আন্তর্জাতিক পর্যায় পর্যন্ত প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই ধর্মগুলোর সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা থাকে। এর মধ্যে ধর্ম হিসেবে সবচেয়ে বেশি রাজনীতি-মূখী ধর্ম হলো- ইসলাম। সবচেয়ে বেশি বিধান, বর্ণিত এবং বিবৃত হয়েছে ইসলাম ধর্মে, তাই এই ধর্মেরই সবচেয়ে রাজনীতিকরন হয়েছে। আর এই রাজনীতিকরনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিলো মহানবীর আমলেই। শাস্ত্রকারদের মতে, রাষ্ট্র-ক্ষমতা ছাড়া 'ইসলাম' সম্পূর্ণ প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। তাই রাজনীতি, রাষ্ট্রক্ষমতা এবং ইসলাম অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। তাই, এখন পর্যন্ত ইসলাম ধর্ম প্রতিষ্ঠার জন্য রাজনীতি বহাল আছে।
ধর্ম প্রতিষ্ঠার জন্য রাজনীতি বহাল থাকলেও, পথ-মত-নীতি নিয়ে মতাদর্শিক পার্থক্য আছে। রাজনীতিবিদগণ বিভিন্নভাবে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন। মোটাদাগে তাদের মধ্যে অন্তত দুইটি প্রধান ভাগ আছে। এবং বর্তমান সময়ে এই দুই ভাগেরই, যারা আলাদা আলাদা ভাবে ইসলাম প্রতিষ্ঠার রাজনীতি করছেন, তাদের মধ্যে বিভেদ অত্যন্ত প্রকট। তাদের দুই দলের হাতেই যথেষ্ট পরিমান তথ্য-প্রমান, দলিল, ঐতিহাসিক উপাদান আছে, রাজনৈতিক ইসলামের মত-পথে নিজেদের সত্য এবং বাকীদের মিথ্যা প্রমান করার মতো।
এর এক পাশে আছেন, মডারেট মুসলিম রাজনীতিবিদ ও রাজনৈতিক দল সমূহ। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য, বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানের 'জামায়াত এ ইসলাম', ইন্দোনেশিয়ার 'জেমাহ ইসলামিয়া', আরব বিশ্বের বেশিরভাগ দেশে 'ইখওয়ানুল মুসলেমিন- মুসলিম ব্রাদারহুড'। এছাড়াও বিভিন্ন দেশে বেনামে মুসলিম ব্রাদারহুড, যেমন- তুরস্ক এবং মরোক্কোতে 'জাস্টিস এন্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি', তিউনিসিয়ায় 'আন-নাহদা আন্দোলন', মিসরে 'ফ্রিডম এন্ড জাস্টিস পার্টি' ইত্যাদি। এছাড়া ফিলিস্তিনের 'হামাস', মালয়েশিয়ার 'প্যান মালয়েশিয়ান ইসলামিক পার্টি' উল্লেখযোগ্য।
এইসব রাজনৈতিক দল, প্রথাগত গণতান্ত্রিক রাজনীতির সাথে যুক্ত। এরা গণতান্ত্রিক রাজনীতির মাধ্যমে ক্ষমতায় আসতে চায়। তাদের মতে, গণতান্ত্রিক ভাবে ক্ষমতায় আসলেও ইসলাম প্রতিষ্ঠা সম্ভব। এই দলগুলো নিজেদের দলের ভেতরেও গণতন্ত্র চর্চা করে।
অপর পাশে আছে, বিভিন্ন জিহাদি দল। যারা মনে করে একমাত্র জিহাদের মাধ্যমেই ইসলাম প্রতিষ্ঠা সম্ভব। জিহাদের একবার ক্ষমতায় চলে আসলে, রাষ্ট্রে ইসলাম প্রতিষ্ঠা হয়ে যাবে। এদের মধ্যে আছে, আন্তর্জাতিক জিহাদি সংগঠন 'আল-কায়েদা'। আল-কায়েদা জিহাদের লক্ষ্যে বিশ্বব্যাপী কাজ করে যাচ্ছে। এদের গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক শাখাগুলো হচ্ছে- আরব উপদ্বীপের আল কায়েদা (আল কায়েদা ইন আরাবিয়ান পেনিনসুলা- আকাপ), ভারতীয় উপমহাদেশের আল কায়েদা (আল কায়েদ ইন ইন্ডিয়ান সাবকন্টিনেন্ট- আকিস), মালয় দ্বীপপুঞ্জের আল কায়েদা (আল কায়েদা ইন মালায় আর্কিওপেলাগো- আকমা), ইসলামি পশ্চিমের আল কায়েদা (আল কায়েদা ইন ইসলামিক মাগরেব), পশ্চিম আফ্রিকার আল কায়েদা, সোমালিয়ার আল কায়েদা, ইরাকের আল কায়েদা, বসনিয়ার আল কায়েদা ইত্যাদি। এছাড়া বিভিন্ন সংগঠন আল কায়েদার সাথে জোট বেধে আছে। এদের মধ্যে উল্লেক্ষ্য- পাকিস্তানের 'তেহরিক ই তালিবান', আফগানিস্তানের 'তালিবান', সিরিয়ার 'আল নুসরা ফ্রন্ট', ইয়েমেনে 'আনসার আল শরিয়া' ইত্যাদি। বৃহত্তম এই ছত্রি-সংগঠন ছাড়াও আরো জিহাদি দল আছে, যারা জিহাদের মাধ্যমে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে চায়। যেমন- আরব বিশ্বে 'হিজবুত তাহরীর', ইরাকে 'আনসার আল ইসলাম', সোমালিয়ায় 'আল শাবাব' ইত্যাদি।
জিহাদের মাধ্যমে ইসলাম প্রতিষ্ঠায় অতি জিহাদি কিছু ব্যক্তি ও সংগঠন সম্প্রতি ইরাক ও সিরিয়ায় খেলাফত প্রতিষ্ঠা করেছে। তাদের দাবী মতে, তারা এখন একটি 'ইসলামি রাষ্ট্র' এবং সারা পৃথিবীর মুসলিমদের তারা প্রতিনিধিত্ব করে। বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন জিহাদি সংগঠন তাদের সাথে একাত্মতা ঘোষনা করে বিশ্বব্যাপী খেলাফত প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এদের মধ্যে আছে- নাইজেরিয়ার 'বোকো হারাম', মধ্য এশিয়া এবং চীনের উইঘুর অঞ্চলের 'তুর্কিস্তান ইসলামি মুভমেন্ট', ফিলিপাইনের 'আবু সায়াফ গ্রুপ', বাংলাদেশে 'আনসারুল্লাহ বাংলা টিম', ইরাক ও সিরিয়ায় 'জুন্দ আল খলিফা' ইত্যাদি।
গণতন্ত্রের প্রশ্নে আগেই মুসলিম রাজনীতিকগণ দুই ভাগে বিভক্ত ছিলেন। এক পক্ষে গণতন্ত্রের পক্ষে, অপরপক্ষ বিপক্ষে। সম্প্রতি, খেলাফতের প্রশ্নে গণতন্ত্রের বিপক্ষের রাজনীতিকগণ আবারো দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছেন। এক পক্ষ এখনই খেলাফত প্রতিষ্ঠার ঘোষনা দিয়ে দিয়েছে। অপর পক্ষের মতে খেলাফতের জন্য মুসলিম বিশ্ব এখনো প্রস্তুত না।
আগেই মুসলিম রাজনীতিবিদগনের মধ্যে গণতন্ত্রচর্চা প্রসঙ্গে মতানৈক্য হয়েছিলো। কেউ গণতন্ত্র চর্চার মাধ্যমে ইসলামকে ক্ষমতায় নিয়ে আসার রাজনীতিতে ছিলেন, কেউ সশস্ত্র জিহাদের মাধ্যমে ইসলামকে ক্ষমতায় আনার চেষ্টায় আছেন। সম্প্রতি ইরাক ও সিরিয়ায় 'ইসলামিক স্টেট- আইএস' নামে খেলাফত প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর, জিহাদিদের মধ্যে দ্বন্দ্ব প্রকট হয়েছে। ১৯৯০ যিশুসনের আগ পর্যন্ত জিহাদের একটা ফর্ম হিসাবে স্বাধিকার আন্দোলনও যুক্ত ছিলো। বিভিন্ন অঞ্চলে মুসলিমদের স্বাধিকার আন্দোলনকে জিহাদ হিসেবে অভিহিত করা হতো। যেমন- ফিলিস্তিন, ফিলিপাইনের বাঙসামরো অঞ্চল, বসনিয়া, রাশিয়ার চেচনিয়া-দাগেস্তান অঞ্চল, চীনের উইঘুর অঞ্চল, মায়ানমারের আরাকান অঞ্চল, ভারতের কাশ্মীর ইত্যাদি ভূখণ্ডের স্বাধিকার আন্দোলনকে জিহাদের সাথে তুলনা করা হতো।
১৯৯০ যিশুসনের পর জিহাদের চেহারা বদলে যেতে থাকে। আফগানিস্তানে রুশ আগ্রাসন ঠেকানোর জন্য, প্রতিষ্ঠিত হয় আফগান জাতীয়তাবাদী জিহাদি সংগঠন 'তালিবান' এবং বহুজাতিক জিহাদিদের আন্তর্জাতিক প্লাটফর্ম 'আল-কায়েদা'। তারপর থেকেই মুসলিম দেশগুলোতে গড়ে উঠতে থাকে বিভিন্ন জিহাদি সংগঠন। এছাড়া ছোট আকারে গড়ে ওঠে 'হিজবুত তাহরীর'।
আল-কায়েদা তার স্বরূপে আসে ২০০১ যিশুসনে, আমেরিকার ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে বিমান হামলার মাধ্যমে। এর পর পরই পৃথিবীব্যাপী তাদের রিক্রুটমেন্ট বেড়ে যায়। তখন পর্যন্ত আল-কায়েদার জিহাদিরা গিয়ে জড়ো হতো আফগানিস্তানে। ২০০৩ যিশুসনে আমেরিকা ইরাক আক্রমন করে। ২০০৬ যিশুসনে আল-কায়েদা ইরাকে তাদের নতুন শাখা খোলে, 'ইরাকের আল-কায়েদা'। এর পর আল-কায়েদা নিজেদের বিস্তৃত করার উদ্দেশ্যে শাখা সম্প্রসারণ করে। একে একে খোলা হয় আরব উপদ্বীপের আল-কায়েদা, উত্তর আফ্রিকার ইসলামি পশ্চিম আল-কায়েদা, সোমালিয়ার আল-কায়েদা, মালয় দ্বীপপুঞ্জের আল-কায়েদা, চেচনিয়ার আল-কায়েদা, স্পেনের আল-কায়েদা ইত্যাদি। এছাড়া বিশ্বব্যাপী জিহাদ সংগঠিত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন দেশের জিহাদি সংগঠনগুলো আল-কায়েদাকে সমর্থন করে এবং একসাথে কাজ করতে সম্মত হয়। এদের মধ্যে ভারতের হরকাতুল জিহাদ, পাকিস্তানের তেহরিক ই তালিবান, লস্কর ই তাইয়েবা, ফিলিপাইনের আবু সায়াফ, সোমালিয়ার আল শাবাব, মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার আনসার আল ইসলাম, আনসার আল শারিয়াহ, আনসার আল দিন, আনসার আল জিহাদ উল্লেখ্য।
বিশ্বব্যাপী আল-কায়েদার নেতা ছিলেন ওসামা বিন লাদেন। তার মৃত্যুর পর নেতা হন, আইমান আল জাওয়াহিরি। তাদের বলা হয় শায়েখ। শাখা আল-কায়েদাগুলোর জন্য আলাদা আলাদা আমির। ইরাকের আল-কায়েদার আমির ছিলেন আবু ওমর আল বাগদাদী। তার মৃত্যুর পর আমির হন-আবু বকর আল বাগদাদী।
২০১১ যিশুসনে মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার আরবী ভাষাভাষী দেশগুলোতে শুরু হয় 'আরব বসন্ত'। আরব বসন্ত গণতন্ত্র না আনুক, সুশাসন না আনুক, জিহাদিদের জন্য বসন্ত নিয়ে আসে। ইরাকের আল-কায়েদা সুন্নি-অধ্যুষিত কয়েকটা ছোটো শহর দখলে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করে- 'ইসলামিক স্টেট অব ইরাক'। এই সময়েই সিরিয়ায় শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। গৃহযুদ্ধের সুযোগে ইসলামিক স্টেট অব ইরাক, সিরিয়ায় প্রবেশ করে এবং প্রতিষ্ঠা করে, 'ইসলামিক স্টেট অব ইরাক এন্ড শাম' বা আইসিস বা আইএস।
২০১৪ যিশুসনের ৩ ফেব্রুয়ারি 'ইসলামিক স্টেট' তাদের আমির আবু বকর আল বাগদাদীর নেতৃত্বে আল-কায়েদার বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে আলাদা কাঠামো তৈরী করে। ২৯ জুন, ২০১৪ যিশুসনে ইরাক এবং সিরিয়ায় তাদের অধিকৃত সুন্নি অঞ্চলগুলো নিয়ে একতরফা খেলাফত ঘোষনা দেয়। বেশিরভাগ জিহাদি সংগঠন এতে সম্মত ছিলো না, বিশেষত আল-কায়েদা এতে প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হয়। আল-কায়েদা সিরিয়াতে ইসলামিক স্টেটের বিরুদ্ধে আলাদা ফ্রন্ট গড়ে তোলে, এর নাম রাখা হয়- আল নুসরা ফ্রন্ট।
এর পর আবু বকর আল বাগদাদীকে কয়েকটি জিহাদি সংগঠন খলিফা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এর মধ্যে নাইজেরিয়ার বোকো হারাম, মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার আনসার দ্বীন, জুন্দুল্লাহ, জুন্দ আল খালিফা, আনসার আল শরিয়া, মধ্য এশিয়ার তুর্কিস্তান ইসলামি মুভমেন্ট, বাংলাদেশের আনসারুল্লাহ বাংলা টিম উল্লেখযোগ্য। বিভিন্ন দেশ থেকে জিহাদিরা খেলাফতের পক্ষে সিরিয়ায় গিয়ে জড়ো হতে থাকে।
খেলাফতের পক্ষের জিহাদিদের মতে এখনই খেলাফত প্রতিষ্ঠার উপযুক্ত সময়। সেক্ষেত্রে আবু বকর আল বাগদাদি সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অপরপক্ষে আল-কায়েদা ও তার ভাতৃ-প্রতিম সংগঠনগুলো মনে করে, এখনো খেলাফত প্রতিষ্ঠার সময় আসে নি। আর খলিফা যদি হতেই হয়, তাহলে আল-কায়েদা প্রধান হিসেবে শায়খ আইমান আল জাওয়াহিরিই হবেন এ জমানার খলিফা; আবু বকর আল বাগদাদি কে? আল-কায়েদা নিজেও বিশ্বব্যাপী খেলাফত প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখছে। কোনো অফিসিয়াল ঘোষনা না আসলেও এরই মধ্যে তারা ভূমিদখলের কাজ শুরু করে দিয়েছে। সিরিয়াতে আল নুসরা ফ্রন্টের ব্যানারে তারা ইদলিব ও আলেপ্পো প্রদেশের বেশিরভাগ জায়গা দখল করে নিয়েছে। কিছু কিছু স্থানে সরাসরি ইসলামিক স্টেট এর জিহাদিদের সাথে সম্মুখ যুদ্ধে জড়িয়ে পরছে। ইয়েমেনে গৃহযুদ্ধের সুযোগে তাদের 'আরব উপদ্বীপের আল-কায়েদা শাখা' হাদরা মাউত, আতাক ও আবিয়ান প্রদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল দখল করে নিয়েছে। লিবিয়াতেও গৃহযুদ্ধের সুযোগে 'শরিয়ত ব্রিগেড' দের্না, সির্ত ও বেনগাজি শহর দখল করে নিয়েছে। আফগানিস্তানের কুন্দুজ প্রদেশ অনেক আগে থেকেই আল-কায়েদার দখলে।
এভাবেই আল-কায়েদা বিশ্বব্যাপী খেলাফত প্রতিষ্ঠা করতে চায়। তাই তারা ইরাক ও সিরিয়াভিত্তিক 'ইসলামিক স্টেট' এর খেলাফতকে অস্বীকার করে। ইতিমধ্যে দুই গ্রুপ নিজেদের আসল ইসলামের রক্ষাকারী, এবং অপরপক্ষকে মুরতাদ বলে ঘোষনা দিয়েছে। আর এই দুই গ্রুপকেই মুরতাদ বলে ঘোষনা দিয়েছে, তুলনামূলক কম শক্তিশালী জিহাদি গ্রুপ হিজবুত তাহরীর। তারাও আল-কায়েদার মতো বিশ্বব্যাপী খেলাফত প্রতিষ্ঠা করতে চায়, কিন্তু বাকী গ্রুপ গুলোর তুলনায় তারা জমিদখলে পিছিয়ে।

মৌলিক চাহিদা কোথা থেকে এলো?

আমার আব্বা বিড়াল পালেন। বেশিরভাগ সময় তারা, খেলে, দৌড়াদৌড়ি করে, রেস্ট নেয়, ঘুমায়। ক্ষুধা লাগলে রান্নাঘরে আসে, মিউ মিউ ডাকে। এইটা প্রাণী হিসেবে প্রাণীকুলের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি যে তাদের ক্ষুধা লাগবে। ক্ষুধা নিবারণ করার জন্য তাদের খাদ্য গ্রহণ করা লাগবে। খাদ্য গ্রহণ করা ছাড়া শরীরের জৈবিক কার্যক্রম ব্যহত হবে। প্রাণের সত্তা টিকিয়ে রাখতে হলে তাই খাদ্য গ্রহন জরুরি। 'খাদ্য' তাই মৌলিক চাহিদাগুলোর মধ্যে প্রথম।
তারপর প্রাণ খুঁজে আশ্রয়। ঝড়-বৃষ্টি থেকে আশ্রয়, অন্ধকার থেকে আশ্রয়। অপর প্রাণীর কাছ থেকে বাঁচার জন্য আশ্রয়, শত্রুর হাত থেকে বাঁচার জন্য আশ্রয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে আশ্রয়, দিনশেষে মাথা গোঁজার ঠাই। আশ্রয় বা 'বাসস্থান' তাই মৌলিক চাহিদাগুলোর মধ্যে দ্বিতীয়।
তারপর প্রাণীকুল রোগে-শোকে পতিত হয়। ঋতু পরিবর্তনজনিত রোগ, অঞ্চল পরিবর্তনজনিত রোগ। আঘাতজনিত রোগ, পরজীবীঘটিত রোগ। রোগমুক্তির কারণ বের করতে না পারায়, পূর্বে বহু জাতি সমূলে উৎপাটিত হয়েছে। তাই রোগ বা আঘাত থেকে মুক্তি বা 'চিকিৎসা' মৌলিক চাহিদাগুলোর মধ্যে তৃতীয়।
প্রাণীকুলের মৌলিক চাহিদার তালিকা এখানে শেষ হতে পারতো। কিন্তু অন্যান্য প্রাণী থেকে মানবজাতি এক ধাপ এগিয়ে থাকায়, তাদের জন্য তালিকা এখানে শেষ হয় না। অন্যান্য প্রাণী থেকে প্রাকৃতিকভাবে দুর্বল হওয়ায় এবং মানবজাতির মধ্যে লজ্জার অনুভূতি তৈরী হওয়ায় তাদের প্রয়োজন হয় আবরণের। আবরণ বা 'বস্ত্র' মানবজাতির চতুর্থ মৌলিক চাহিদা।
অন্যান্য প্রাণীকুল থেকে নিজেদের আলাদা করার জন্য এবং সঞ্চিত জ্ঞান পরবর্তী প্রজন্মে হস্তান্তর করার জন্য মানবজাতি কিছু প্রক্রিয়া অবলম্বন করে। লেখা, আঁকা, সুর, গল্প-গাঁথা, প্রশিক্ষণ সেই অবলম্বন প্রক্রিয়ার অংশ। এই প্রক্রিয়াগুলোকে একসাথে বলা হয় শিক্ষা। যেন সবকিছু নতুন করে শিখতে না হয় তাই 'শিক্ষা' মানবজাতির পঞ্চম মৌলিক চাহিদা।
মৌলিক চাহিদাঃ দায়িত্বের পরিধি
খাদ্য, বাসস্থান, চিকিৎসা, বস্ত্র ও শিক্ষা; মানুষের এই পাঁচটি মৌলিক চাহিদা পূরণ করায় সবার দায়িত্ব আছে। একজন কৃষকের দায়িত্ব খাদ্য ফলানো, একজন বস্ত্র-শ্রমিকের দায়িত্ব বস্ত্র বোনা। একজন চিকিৎসকের দায়িত্ব চিকিৎসা দেয়া, একজন শিক্ষকের দায়িত্ব শিক্ষা দেয়া। মানুষের প্রতিনিধি হিসেবে সরকারের দায়িত্ব এগুলোর যোগান নিশ্চিত করা এবং বন্টন ও ব্যবস্থাপনা সংহত করা। চাহিদাগুলোর উৎপাদন বেশি হলেও লাভ নেই যদি ব্যবস্থাপনায় গলদ থাকে। মানুষের সমাজ এখন অনেক বড়। এতো বড় সমাজে সব মানুষের পক্ষে মৌলিক চাহিদা নিশ্চিত করা তখনই সম্ভব যখন সেগুলোর সুষ্ঠু বন্টন হবে।
মৌলিক চাহিদাঃ কার অধিকার, কার কর্তব্য?
মানবজাতির অংশ হিসেবে প্রত্যেক মানুষের অধিকার, সে তার মৌলিক চাহিদা পূরণ করবে। আর এই অধিকার নিশ্চিত করার জন্যই মানুষের একসাথে থাকা। একসাথে থাকতে থাকতেই গড়ে উঠেছে সভ্যতা। আর সভ্যতার সিঁড়ি বেয়ে আধুনিক রাষ্ট্র। রাষ্ট্রযন্ত্র আর সরকারের দায়িত্ব ও কর্তব্য তাই মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ করা। এমনিতেই রাষ্ট্রগুলোর কৃত্তিম সীমানার কারণে মানবজাতি যথেষ্ট বিভ্রান্ত আর বিব্রত। এর মধ্যে যদি এমন হয় যে কোনো নির্দিষ্ট রাষ্ট্র বা কোনো নির্দিষ্ট সরকার তার মানুষদের মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে, তাহলে সে রাষ্ট্র বা সে সরকার দিয়ে মানুষ কি করবে? রাষ্ট্র বা সরকার যদি মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে না পারে তাহলে সে রাষ্ট্র বা সরকারের কোনো দরকার নেই।
মৌলিক চাহিদায় সংযুক্তি
কখনো কখনো মানবজাতি হিংসা ও অহংকারে পতিত হয়ে যুদ্ধ বা দাঙ্গায় লিপ্ত হয়। কখনো মানবজাতি অতিরিক্ত বুদ্ধির বশীভূত হয়ে গাছ ও পাহাড় কাটে, খাল-নদী ও বনভূমি ধ্বংস করে। এতে প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হয়। আবার কখনো বুদ্ধিহীনতার ফলে অপরিকল্পিত নগরায়ন করে। পরিকল্পনাহীন রাস্তাঘাট, বর্জ্য-ব্যবস্থাপনা ও পানিনিষ্কাশনের ফলে মানুষ ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়। মানবসৃষ্ট এইসব কারণে মানবজাতি সহ অন্যান্য প্রাণীকুলের যথেষ্ট ক্ষতি ইতিমধ্যে হয়েছে। তাই আমরা মনে করি খাদ্য, বাসস্থান, চিকিৎসা, বস্ত্র ও শিক্ষার পাশাপাশি 'স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা' প্রাণীকুলের অন্যতম মৌলিক চাহিদা।