কয়েকদিন পরপর স্বাধীনতাকামী ফিলিস্তিনিরা
মৃত্যুবরণ করে মিডিয়ার আলোচনায় আসে। আমরা সাধারণ জনগন হিসেবে কিছুদিন সামাজিক
যোগাযোগ মাধ্যমে সক্রিয় থাকি, তারপর বিবিধ ইস্যুতে আবার ব্যস্ত হয়ে যাই।
ফিলিস্তিনিদের সংগ্রাম চলতেই থাকে। নিজের ভূমিতে বিদেশী মানুষ হয়ে থাকার যন্ত্রনা
তারা নিজেরা ছাড়া আর কেউ জানেনা।
এই যন্ত্রনার প্রথম রূপরেখা প্রণয়ন করা হয়
১৯১৭ সালে, বেলফোর ঘোষণার মাধ্যমে। এরপর ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনিরা নিজেদের মাতৃভূমি
হারিয়ে হয়ে যায় নিজের দেশে পরবাসী। তাদের জমিতে জোরপূর্বক প্রতিষ্ঠা করা হয় ‘ইসরাইল
রাষ্ট্র’। ইসরাইল রাষ্ট্রের একের পর এক ভয়াবহ সিদ্ধান্তে রসদ জুগিয়ে এসেছে
আমেরিকা। সে হিসেবে ফিলিস্তিনের জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের সবচেয়ে বড় শত্রু হওয়ার কথা
আমেরিকার। কিন্তু আমেরিকা এতো বছর যাবৎ কিভাবে ইসরাইলের সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়ন
করছে?
আমেরিকা-ইসরাইল গংদের প্রধান শক্তি মুসলিম
রাষ্ট্রগুলোর জ্ঞানার্জনের প্রতি অনিহা, প্রচণ্ড স্বার্থপরতা এবং বৃহৎ অনৈক্য। ইসরাইল
যেখানে জ্ঞান-বিজ্ঞানে এগিয়ে যাচ্ছে, পরমানু বোমা তৈরী করছে, ন্যানোটেকনোলজিতে
উন্নয়ন করছে; সেখানে মুসলিমদের মনোযোগের প্রধান কেন্দ্রবিন্দু আপনি শিয়া নাকি
সুন্নি, আপনি হানাফি নাকি সালাফি, আপনি দাঁত ব্রাশ করেন নাকি মেসওয়াক ব্যবহার
করেন। জ্ঞান-বিজ্ঞান বলতে আপনি বোঝেন প্রায় ১ হাজার বছর আগের ইবনে সিনা, আল
কিন্দী, আল ফারাবী। এদের পর পৃথিবী আরো ১ হাজার বছর এগিয়ে গেছে। এইটা ইসরাইল জানে।
ইসরাইল জানে আপনি কোন কোন বিষয়ে কনসার্ন! তাই তারা তাদের পরিকল্পনা ধীরে ধীরে
বাস্তবায়নের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারছে।
সম্প্রতি আমেরিকা তাদের ইসরাইলি দূতাবাস
জেরুজালেমে সরিয়ে নিয়েছে। এইটা মূলত ইসরাইল রাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের দাবী ‘ইসরাইলের
রাজধানী জেরুজালেম’ এই ধারণার প্রতি সমর্থন। আমেরিকার দেখাদেখি ক্রমে আরো রাষ্ট্র
এই মতের প্রতি সহানুভূতিশীল হবে। আমেরিকা যেভাবে ইসরাইলকে দিনের পর দিন ভরণপোষণ
করে আসছে, এটা বিশ্বশান্তির জন্য মারাত্মক হুমকি।
ইসরাইলকে এই ভরনপোষণের গোঁড়ায় পানি ঢেলে
এটাকে আরো সজীব আর প্রাণবন্ত করতে ভূমিকা পালন করছে বর্তমান সৌদী আরবের সরকার। সৌদী
আরবের বর্তমান যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান সম্প্রতি ফিলিস্তিনি মুক্তি সংগ্রাম
নিয়ে তার বোঝাপড়া ব্যক্ত করেছেন- ‘আলোচনার টেবিলে আসুন, শান্তি প্রস্তাব গ্রহণ
করুন, তা না হলে অভিযোগ জানানো বন্ধ করে চুপ থাকুন।’ এই স্টেটমেন্টের মাধ্যমে তিনি
আসলে ফিলিস্তিনের মুক্তি সংগ্রামকে কটাক্ষ করেছেন। সৌদী যুবরাজ না হলে তার এই
বক্তব্যকে বেয়াদবি হিসেবে ধরে নেয়া যেতো। আলোচনার টেবিলে আসুন! কার সাথে আলোচনা?
শান্তি প্রস্তাব গ্রহণ করুন! গাজায় ৬০ জন নিহত আর ৩,০০০ জন আহত ফিলিস্তিনির
সংগ্রামের দাম শান্তি প্রস্তাব। কি কি শান্তির প্রস্তাব করতে পারে ইসরাইল আর
আমেরিকা? আমরা কিছু ধারণা করি- ধারা ১, এখন থেকে ইসরাইলের রাজধানী জেরুজালেম। ধারা
২, এখন থেকে পশ্চিম তীর আর গাজাসহ পুরো ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডই ইসরাইল রাষ্ট্র। ধারা
৩, এখন থেকে সকল ফিলিস্তিনি ইসরাইলের ২য় শ্রেনীর নাগরিক। তা না হলে অভিযোগ জানানো
বন্ধ করে চুপ থাকুন! আপনার কাছে কে অভিযোগ জানাতে গেছে? আপনি তো অনেক আগেই আপনার
মস্তিষ্ক আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতির কাছে বন্ধক দিয়ে রেখেছেন। মধ্যপ্রাচ্যে আপনার
মূল আগ্রহ- ইরানকে আটকাও, ইয়েমেনে সাধারণ মানুষ মারো, সিরিয়ায় আরো বেশিদিন গৃহযুদ্ধ
চলুক আর সারা পৃথিবীতে কট্টরপন্থী ইসলাম ছড়িয়ে যাক। মুসলমানদের দুই পবিত্র শহরের
খিদমতগার হয়েও আপনি জেরুজালেমকে ইসরাইলের হাতে তুলে দিতে পেছনে ফিরে তাকালেন না।
কেবল সৌদী আরব নয় পুরো মধ্যপ্রাচ্য ফিলিস্তিন
প্রশ্নে কাঠগড়ায়। সিরিয়া আর ইরাক নাহয় যুদ্ধবিধ্বস্ত। জর্দান, মিসর, তুরস্ক, আরব আমিরাত, কাতার!? অনেক অনেক
বিষয়ে তারা মুসলিম বিশ্বের ত্রানকর্তা হিসেবে সামনে চলে আসে। অথচ নিজেদের মধ্যে
প্রবল অবিশ্বাস। জর্দান মিসরকে সন্দেহ করে। মিসর কাতারকে সন্দেহ করে। সৌদী আরব আর
কাতার একই মত অবলম্বন করেও দুইজন দুই জনের দিকে পিঠ দিয়ে আছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত
ইয়েমেনে, আরব আমিরাত যতোটা আগ্রহ পায় তার কানা পরিমাণ আগ্রহও পায়না ফিলিস্তিনের
মুক্তি সংগ্রামে। তুরস্কতো আরেক স্বাধীনতাকামী কুর্দিদের ঠেকাতে ঠেকাতে নিজেদের
প্রেসিয়াস শক্তি ক্ষয় করে ফেলতেছে। এর সুযোগ নিতেছে ইসরাইল আর আমেরিকা। সুযোগ
নিবেইনা বা কেন? এরা এইরকম একটা পরিস্থিতির জন্যই তো দীর্ঘদিন অপেক্ষা করে আছে।
কেউ ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা বিষয়ে ন্যূনতম আওয়াজ করতে নারাজ। বাকী গরিব মুসলিম
দেশগুলো যেমন- বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, মালি এরা দর্শকের মতো। একবার
সৌদী আরবের দিকে তাকায়, আরেকবার তুরস্কের দিকে তাকায়। তাকায়া তাকায়া ভাবে কার দিকে
গেলে অর্থনৈতিক সাহায্য বেশি পাওয়া যাবে।
ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার এইরকম এক সংকট
মুহুর্তে আমাদের সকলের উচিত ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের পাশে দাঁড়ানো। এটা
ফেসবুকের প্রোফাইল পিকচার চেঞ্জ করার মাধ্যমে করা যায় আবার নিজের নিজের জায়গায়
প্রতিবাদ অব্যহত রেখেও করা যায়। এমনকি স্বাধীনতার পক্ষে লেখা একটা লাইনও স্বাধীনতা
আন্দোলনকে ত্বরান্বিত করতে পারে। আপনার নাড়া দেয়া একটি মুহুর্ত একটি দিনকে
প্রভাবিত করতে পারে। একটি দিন একটি মানুষকে প্রভাবিত করতে পারে। একটি মানুষ পুরো
পৃথিবীকে প্রভাবিত করতে পারে। এই আন্দোলন থামার নয়। ফিলিস্তিনের পূর্ন স্বাধীনতা
না আসা পর্যন্ত এই আন্দোলন চলবে।
No comments:
Post a Comment