9 August 2018

শাহজাহান খানরা কেন কখনো ক্ষমতা ছাড়ে না?


পরিবহন খাত প্রতিদিন সোনার ডিম দেমা হাঁসের মতো একটা খাত। প্রতিদিন সোনার ডিম দেয় এরকম একটা হাঁসের মালিকানা কেউ ছেড়ে দেয় না। আমার সাথে একজন পরিবহন শ্রমিকের কথা হয়েছিলো এই বিষয়টা নিয়ে। তিনি চন্দ্রা থেকে চিটাগাং রোডের একটা বাসের কন্ট্রাক্টার। তার বাসের রুট- চন্দ্রা> বাইপাইল> সাভার> গাবতলী> ফার্মগেট> মৌচাক> শনির আখড়া> চিটাগাং রোড। সারাদিনে তাকে বেশ কয়েকটা স্টপেজে টাকা দেয়া লাগে। এর মধ্যে বাইপাইলে ৪০০ টাকা, গাবতলীতে ৪০০ টাকা, মৌচাকে ২৫০ টাকা, শনির আখড়ায় ৪০০ টাকা, মাতুয়াইলে ৪০০ টাকা দেয়া লাগে। প্রতিদিন এই বাসকে চান্দা দেয়া লাগে প্রায় ১৮৫০ টাকা (পুলিশের চান্দা আর কোম্পানির টিকেট চেকারদের ১০ টাকা বাদে)। বাসের রুট, টাইপ ইত্যাদির উপর নির্ভর করে সমস্ত বাসকেই চান্দা দেয়া লাগে প্রায় ১৫০০-৩০০০ টাকা। এই টাকাগুলা কই যায়?
এই টাকাগুলা লোকাল্গুন্ডাদের মাধ্যমে তোলা হয়। তারপর সেটা কোনো লোকাল এমপি বা নেতার পকেটে যায়। নেতার মধ্যে প্রধানত যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, ছাত্রলীগ, শ্রমিক লীগ (বা বিএনপির সময় পড়ুন দল), ওয়ার্ড কমিশনার উল্লেখযোগ্য। এই টাকার ফ্লো একদম নিচ থেকে শুরু করে একদম উপর পর্যন্ত প্রবাহমান। একটা সরল অংক- ধরেন ঢাকায় বাস চলে ১ লাখ, প্রতিদিনের চান্দা গড়ে ২,০০০ টাকা। তাইলে কতো টাকা হয়? ২০ কোটি টাকা। আমার কাছ থেকে হয়তো ১০ টাকা বেশি নিতেছে। কিন্তু দিনশেষে টাকাটা ২০ কোটি। এইটাকার ভাগ কে কে পায়? এই সিন্ডিকেটের পিছনে কে কে আছে? কারা এই চান্দার টাকার উচ্ছিষ্টভোগী?
বাসের এই টাকাটা কোথা থেকে আসে। আসে আমার –আপনার পকেট থেকেই। আমাকে-আপনাকে সিটিং এর নামে, বাসের ভাড়া বাড়ছে নামে এই টাকাটা দেয়া লাগে। এই টাকা না দিলে বাস রুটে চলতে পারবেনা। অথচ সেবার নামে কিচ্ছু বাড়ে নাই। একদম কিচ্ছু না। না ঢাকায় জ্যাম কমছে, না বাস স্টপেজ হইছে, না বাসে ফ্রি ওয়াইফাই বা এসি বা জ্যামে বসে পড়ার জন্য পত্রিকা! এমনকি সিটিং সার্ভিসের নামে সবচেয়ে বড় প্রতারনার জাল তৈরী করে রেখেছে ব্যবসায়ীরা। না হয় সিটিং, না দেয় সার্ভিস! কি বিচিত্র! আপনার পকেট থেকে প্রতিদিন ১০ টাকা বের হওয়া মানে মাসে ১০*৩০= ৩০০ টাকা আপনার সিস্টেম লস। আর এই সামান্য সিস্টেম লসের মাসিক আউটপুট ২০ কোটি*৩০= ৬০০ কোটি টাকা।
পরিবহন খাত থেকে হয়তো মাসে ৬০০ কোটি টাকা শাহজাহান খান ইনকাম করেন না। এর ১% ও যদি খান, তাহলে ৬ কোটি টাকা। কোন ব্যবসা মাসে আপনাকে ৬ কোটি টাকা দেবে? যাস্ট ফর নাথিং, একদম কিচ্ছু না করার জন্য এই টাকাটা দিচ্ছি আমরা। কাদের দিচ্ছি এই টাকাটা? যাদের আমাদের নিয়া কোনো চিন্তা নাই। যারা আমাদের নেতা হইয়া বইসা আছেন তাদের। যারা নিজেদের আর নিজের বৌ-বাচ্চা ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারে না তাদের।
এই প্রসেসের ভুক্তভোগী সাধারণ যাত্রীরা আর একই সাথে পরিবহন সেক্টরের শ্রমিকেরা। সাধারণ জনগণ মাঝেমাঝে ফেসবুকে নিজেদের মনের ভাব প্রকাশ করেন। কিন্তু শ্রমিকের পক্ষে বলার জন্য কেউ নাই। এমনকি তারা নিজেরাও না। তারা টাকা তুলে আর দিয়ে দেয়। ঐ কন্ট্রাক্টার আমাকে আক্ষেপ করে বলেছিলেন- ঐ খাচ্চর লোকগুলার লেইগা ট্যাকা তুলতে ভালো লাগে না মামা। কিন্তু কি করুম প্যাটের ধান্দা...
সবাই সবার ধান্ধায় আছে। সাধারণ জনগনের ধান্ধা হওয়া উচিত, আমরা আর এই সিস্টেম লসের অংশ হবো না। শ্রমিকের সাথে খারাপ ব্যবহার করা সমাধান না। এই সিস্টেমের মূলে আঘাত করতে হবে আমাদের। এই নৈরাজ্যের মূলে আঘাত করলেই দূর্নীতির একটা বৃহৎ খুঁটিতে টান পরবে, বিশ্বাস করেন। আমাদের সবাই দূর্নীতির কারনে দেশের প্রতি, রাষ্ট্রের প্রতি বীতশ্রদ্ধ। সবাই এটাকে নিয়তি বলে মেনে নিয়েছেন বা এটাই সিস্টেম হয়ে গেছে বলে মনে করেছেন। এখন সময় যুগ বদলের, এখন সময় নতুন দিনের। আমাদের বাচ্চারা আমাদের স্বপ্ন দেখাতে শেখাচ্ছে। আমাদের একটা নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখা এখন আর কোনো অপরাধ নয়।

No comments:

Post a Comment