অনেক ছোটবেলায় রোজার ঈদ করতে নানাবাড়ি
যেতাম আমরা। রোজার ঈদ নানাবাড়ি আর কোরবানির ঈদ দাদাবাড়ি। তখন নানাবাড়ি যেতে খুব ভালো
লাগতো। আমরা তিন ভাই সারা বছর অপেক্ষা করে থাকতাম কখন নানাবাড়ি রোজার ঈদ হবে, আর কখন
নানাবাড়ি যাবো! অন্তত ক্লাস টেন পর্যন্ত এই ছিলো আমাদের ঈদের ছুটির রুটিন। ঐ সময় মনে
হতো নানাবাড়ির দিককার আত্মীয়স্বজনেরাও রোজার ঈদে আমাদের জন্য অপেক্ষা করে আছেন।
কতো স্মৃতি সেই সময়ের! কতো মানুষ, খোলা
উঠান, শুকনো চরা, সমবয়সী কাজিনেরা মিলে গ্রাম আর গ্রামের হাট-বাজার ঘুড়ে বেড়ানো, দিনভর
খেলাধুলা, আব্বা-আম্মার শাসনহীন সাতদিন। কিন্তু এর মধ্যে আজকে বলবো একদম ছোটবেলাকার
একটা স্মৃতি। আমি পড়ি ক্লাস টু বা থ্রিতে, ঠিক মনে নেই। নানাবাড়িতে আম্মার এক চাচাত
বোন ছিলেন, আমাদের খালা, নাম হাসিনা। তিনি তখন পড়তেন ক্লাস নাইন বা টেনে। তিনি আমাদের
খুবই আদর করতেন।
হাসিনা খালা খুবই হাসি-খুশি মানুষ ছিলেন।
আমার যতোদূর মনে পড়ে খুবই চঞ্চল ছিলেন তিনি। দৌড়াদৌড়ি করতেন, খেলতেন, আশপাশের সবার
সঙ্গে হেসে কথা বলতেন, দুষ্টামি করতেন। চানরাতে আমাদের হাতে মেহেদী দিয়ে দিতেন। আমার
নাকের নিচে কলম দিয়ে গোঁফ এঁকে দিতেন। তারপর সবাইকে দেখাতে নিয়ে যেতেন; পুশকিনে বড়
হইয়া গেছে, দেখেন অর মোচ হইছে! তখন বাড়িতে আম্মার বেশ কয়েকজন চাচাত বোন ছিলেন, যারা
স্কুলে পড়তেন। মাইনূর, কোহিনূর, হাসিনা খালার এক বড় বোন; নাম মনে নেই, তার সাথেই পড়তেন।
সবার চেয়ে বেশি প্রাণোচ্ছল ছিলেন হাসিনা খালা।
হাসিনা খালা আমাকে কোলে নিয়ে ঘুড়ে বেড়াতেন।
খেতের মাঝখানের আইল ধরে আমাকে কোলে নিয়ে ঘুড়ে বেড়াতেন তিনি। আশপাশের বাড়িতে নিয়ে যেতেন,
বলতেন- আমাদের মুশফিকা আপার ছেলে, ঢাকা থাকে। নানাবাড়ির পেছনের দিককার খেতগুলোর মাঝখানে
তখন দুইটা বড় তাল গাছ ছিল। সেই তাল গাছের ছায়ায় আমাকে নিয়ে বসে থাকতেন তিনি। তার স্কুলের
বান্ধবীরা আমাকে দেখতে একবার তার বাড়িতে এসেছিলেন।
তখন মাটির চুলায় রান্না হতো। আমারও একদিন
শখ হলো নিজের জন্য একটা মাটির চুলা লাগবে। হাসিনা খালারা প্রথমে আমাকে বোঝাতে চেষ্টা
করলেন, এগুলো মেয়েদের খেলা; চুলা, হাঁড়ি-পাতিল, রান্না-বান্না। ছেলেদের খেলা হলো ফুটবল,
ক্রিকেট, গোল্লাছুট, হাডুডু। আমি যখন নাছোড়বান্দা, তখন তিনি রাজি হলেন, ঠিক আছে তোকেও
একটা চুলা বানিয়ে দিবো। সেই দুই তাল গাছের নিচে আমার জন্য চুলা বানাতে বসলেন তিনি।
খেতের পাশের খাল থেকে কাদা তুলে আনলেন। সেগুলো আকার দিয়ে, লেপে, রোদে দিয়ে, দুই দিনেই
বানিয়ে ফেললেন মাটির চুলা। সেই চুলার ওজন একটু বেশি হলেও তিনি সেটা ধরে এদিক-ওদিক সরাতে
পারতেন।
এই ছিল হাসিনা খালার সাথে আমার স্মৃতি।
আত্মীয় এবং কাছের লোকদের খোঁজখবর না নেওয়ার বিষয়ে আমার একটা দুর্নাম আছে। এর মধ্যে
জীবন চলেছে জীবনের গতিতে। নানান কাজে ও অকাজে ব্যস্ত থেকেছি। এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার
পর দীর্ঘদিন নানাবাড়ি যাইনি। এসময় ঢাকাতেই ঈদ করতাম। তখন চিটাগাং রোড-কাচপুর এলাকায়
মারাত্মক যানজট হতো। যানজট ভালো লাগতো না বলে দাদাবাড়ি-নানাবাড়ি কোথাও যেতাম না। মাঝখানে
শুধু আম্মার কাছ থেকে শুনেছিলাম, পাশাপাশি কোনো এক গ্রামে হাসিনা খালার বিয়ে হয়েছে।
এরপর কোনো এক কাজে নানাবাড়ি যাই মাস্টার্স
পরীক্ষা দেওয়ার পর, ২০১৩ সালে। নানাবাড়ি আর আগেকার মতো নেই। নানাবাড়ির সেই খোলা উঠানে
কোনো এক মামা বাড়ি বানিয়েছেন। নিজেদের মধ্যে ঝগড়াবিবাদ করে কেউ বেড়া দিয়েছেন; যাদের
স্বামর্থ আছে তারা তুলেছেন ইটের দেয়াল। যাদের সাথে খেলতাম, ছেলেরা কাজের জন্য ঢাকা
বা বিদেশবিভূইয়ে পাড়ি জমিয়েছেন, মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে। পিঠাপিঠি মামাতো ভাই শ্যামলও
নেই তখন ৪ বছর হয়েছে। কেমন যেনো এক শূন্যতা! কেমন যেনো এক হাহাকার!
নানীকে জিজ্ঞাসা করলাম, হাসিনা খালা আসে
না বাড়িতে? এই প্রশ্নটা না করলেই ভালো হতো। নানী বললেন, অয় তো এখানেই থাকে অনেকদিন।
আমিতো জানি না কিছু। খুশি মনে বের হলাম, তিন ঘর পরেই হাসিনা খালাদের ঘর, গিয়ে দেখে
আসি। গিয়ে দেখলাম, একটা খাটের সঙ্গে শিকল দিয়ে বাঁধা আছেন তিনি। উস্কুখুশকু জামা-কাপড়,
চুল। চোখে-মুখে রাজ্যের বিষণ্নতা। সাথে সাথে আমি ধাক্কা খেলাম। হাসিনা খালা আমাকে দেখে
চিনতে পারলেন। ‘পুশকিনে আইছে… কেমন আছস বাবা… এত দিন পর নানিবাড়ি আসে কেউ… কেমন আছস…
কতো বড় হইছে আমাগো পুশকিনে…’
আমার সাথে খুব স্বাভাবিকভাবে কথা বললেন
খালা। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, আপনার শরীর কেমন আছে, বললেন- ভালো। শিকলের কথাটা আর তাকে
জিজ্ঞাসা করতে পারলাম না। খুব দ্রুত ভালো থাইকেন খালা, বলে সেখান থেকে চলে আসলাম আমি।
এসে নানিকে জিজ্ঞাসা করলাম, হাসিনা খালার কি হয়েছে, তাকে শিকল দিয়ে বেধে রাখা হয়েছে
কেন? নানি যা বললেন তার সারসংক্ষেপ হলো এই যে, তার জামাইটা ভালো পড়ে নাই। খালি মারধর
করতো, অত্যাচার করতো। একটা মেয়ে হয়েছিলো তার। মাথার সমস্যা নাকি আগেই টুকটাক দেখা দিয়েছিলো।
একদিন কাউকে কিছু না বলে, মেয়েকে নিয়ে স্বামীর বাড়ি থেকে পালিয়ে, ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা
দেন খালা। ঢাকায় গিয়ে মেয়েকে হঠাৎ হারিয়ে ফেলেন তিনি। তখন মাথা পুরোপুরি খারাপ হয়ে
যায় তার।
মেয়েকে আর খুঁজে পান নি হাসিনা খালা।
ঢাকায় পাগলের মতো কিছুদিন এই এলাকা ঐ এলাকা ঘোরাঘুরি করেন আর মেয়েকে খোঁজেন। একদিন
তাদের গ্রামের এক লোক তাকে দেখে চিনতে পারেন। তিনি তার ভাইদের ফোন দেন। ভাইয়েরা গিয়ে
তাকে ঢাকা থেকে বাড়িতে নিয়ে আসেন। এমনিতে কথাবার্তা স্বাভাবিক। শুধু যখন মেয়ের কথা
মনে পড়ে তখন পাগল হয়ে যান খালা। মেয়েকে খুঁজতে তখন ঢাকার দিকে রওনা দিতে চান তিনি।
এ জন্যই তাকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। জামাই আরেকটা বিয়ে করেছে, খোঁজখবরও নেয় না।
এরপর আমি আর নানাবাড়ি যাইনি। এখন হাসিনা
খালার কি খবর তাও জানি না। তার সাথে আমার দুইটা স্মৃতি। আমি যতোই মাটির চুলার কথা মনে
করতে যাই ততোই তা ঝাপসা হয়ে আসে। খেতের মাঝখানে দৌড়ানো হাসিনা খালাকে আমি দেখতে পাই
শিকল দিয়ে বাঁধা। ঢাকায় আমি যখন কিছু না কিছু করছিলাম, খালা তখন তার হারিয়ে যাওয়া মেয়েকে
পাগলের মতো খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন।
মানুষের জীবন তো আসলে কয়েকটা ঘটনা মাত্র;
আসলে কিছু স্মৃতির সমষ্টি। আমার জীবন আর অন্য কারও জীবন এক বিন্দুতে মিলে যায়, যখন
আমাদের দেখা হয়।