4 June 2022

মাটির চুলা

 


অনেক ছোটবেলায় রোজার ঈদ করতে নানাবাড়ি যেতাম আমরা। রোজার ঈদ নানাবাড়ি আর কোরবানির ঈদ দাদাবাড়ি। তখন নানাবাড়ি যেতে খুব ভালো লাগতো। আমরা তিন ভাই সারা বছর অপেক্ষা করে থাকতাম কখন নানাবাড়ি রোজার ঈদ হবে, আর কখন নানাবাড়ি যাবো! অন্তত ক্লাস টেন পর্যন্ত এই ছিলো আমাদের ঈদের ছুটির রুটিন। ঐ সময় মনে হতো নানাবাড়ির দিককার আত্মীয়স্বজনেরাও রোজার ঈদে আমাদের জন্য অপেক্ষা করে আছেন।

কতো স্মৃতি সেই সময়ের! কতো মানুষ, খোলা উঠান, শুকনো চরা, সমবয়সী কাজিনেরা মিলে গ্রাম আর গ্রামের হাট-বাজার ঘুড়ে বেড়ানো, দিনভর খেলাধুলা, আব্বা-আম্মার শাসনহীন সাতদিন। কিন্তু এর মধ্যে আজকে বলবো একদম ছোটবেলাকার একটা স্মৃতি। আমি পড়ি ক্লাস টু বা থ্রিতে, ঠিক মনে নেই। নানাবাড়িতে আম্মার এক চাচাত বোন ছিলেন, আমাদের খালা, নাম হাসিনা। তিনি তখন পড়তেন ক্লাস নাইন বা টেনে। তিনি আমাদের খুবই আদর করতেন।

হাসিনা খালা খুবই হাসি-খুশি মানুষ ছিলেন। আমার যতোদূর মনে পড়ে খুবই চঞ্চল ছিলেন তিনি। দৌড়াদৌড়ি করতেন, খেলতেন, আশপাশের সবার সঙ্গে হেসে কথা বলতেন, দুষ্টামি করতেন। চানরাতে আমাদের হাতে মেহেদী দিয়ে দিতেন। আমার নাকের নিচে কলম দিয়ে গোঁফ এঁকে দিতেন। তারপর সবাইকে দেখাতে নিয়ে যেতেন; পুশকিনে বড় হইয়া গেছে, দেখেন অর মোচ হইছে! তখন বাড়িতে আম্মার বেশ কয়েকজন চাচাত বোন ছিলেন, যারা স্কুলে পড়তেন। মাইনূর, কোহিনূর, হাসিনা খালার এক বড় বোন; নাম মনে নেই, তার সাথেই পড়তেন। সবার চেয়ে বেশি প্রাণোচ্ছল ছিলেন হাসিনা খালা।

হাসিনা খালা আমাকে কোলে নিয়ে ঘুড়ে বেড়াতেন। খেতের মাঝখানের আইল ধরে আমাকে কোলে নিয়ে ঘুড়ে বেড়াতেন তিনি। আশপাশের বাড়িতে নিয়ে যেতেন, বলতেন- আমাদের মুশফিকা আপার ছেলে, ঢাকা থাকে। নানাবাড়ির পেছনের দিককার খেতগুলোর মাঝখানে তখন দুইটা বড় তাল গাছ ছিল। সেই তাল গাছের ছায়ায় আমাকে নিয়ে বসে থাকতেন তিনি। তার স্কুলের বান্ধবীরা আমাকে দেখতে একবার তার বাড়িতে এসেছিলেন।

তখন মাটির চুলায় রান্না হতো। আমারও একদিন শখ হলো নিজের জন্য একটা মাটির চুলা লাগবে। হাসিনা খালারা প্রথমে আমাকে বোঝাতে চেষ্টা করলেন, এগুলো মেয়েদের খেলা; চুলা, হাঁড়ি-পাতিল, রান্না-বান্না। ছেলেদের খেলা হলো ফুটবল, ক্রিকেট, গোল্লাছুট, হাডুডু। আমি যখন নাছোড়বান্দা, তখন তিনি রাজি হলেন, ঠিক আছে তোকেও একটা চুলা বানিয়ে দিবো। সেই দুই তাল গাছের নিচে আমার জন্য চুলা বানাতে বসলেন তিনি। খেতের পাশের খাল থেকে কাদা তুলে আনলেন। সেগুলো আকার দিয়ে, লেপে, রোদে দিয়ে, দুই দিনেই বানিয়ে ফেললেন মাটির চুলা। সেই চুলার ওজন একটু বেশি হলেও তিনি সেটা ধরে এদিক-ওদিক সরাতে পারতেন।

এই ছিল হাসিনা খালার সাথে আমার স্মৃতি। আত্মীয় এবং কাছের লোকদের খোঁজখবর না নেওয়ার বিষয়ে আমার একটা দুর্নাম আছে। এর মধ্যে জীবন চলেছে জীবনের গতিতে। নানান কাজে ও অকাজে ব্যস্ত থেকেছি। এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার পর দীর্ঘদিন নানাবাড়ি যাইনি। এসময় ঢাকাতেই ঈদ করতাম। তখন চিটাগাং রোড-কাচপুর এলাকায় মারাত্মক যানজট হতো। যানজট ভালো লাগতো না বলে দাদাবাড়ি-নানাবাড়ি কোথাও যেতাম না। মাঝখানে শুধু আম্মার কাছ থেকে শুনেছিলাম, পাশাপাশি কোনো এক গ্রামে হাসিনা খালার বিয়ে হয়েছে।

এরপর কোনো এক কাজে নানাবাড়ি যাই মাস্টার্স পরীক্ষা দেওয়ার পর, ২০১৩ সালে। নানাবাড়ি আর আগেকার মতো নেই। নানাবাড়ির সেই খোলা উঠানে কোনো এক মামা বাড়ি বানিয়েছেন। নিজেদের মধ্যে ঝগড়াবিবাদ করে কেউ বেড়া দিয়েছেন; যাদের স্বামর্থ আছে তারা তুলেছেন ইটের দেয়াল। যাদের সাথে খেলতাম, ছেলেরা কাজের জন্য ঢাকা বা বিদেশবিভূইয়ে পাড়ি জমিয়েছেন, মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে। পিঠাপিঠি মামাতো ভাই শ্যামলও নেই তখন ৪ বছর হয়েছে। কেমন যেনো এক শূন্যতা! কেমন যেনো এক হাহাকার!

নানীকে জিজ্ঞাসা করলাম, হাসিনা খালা আসে না বাড়িতে? এই প্রশ্নটা না করলেই ভালো হতো। নানী বললেন, অয় তো এখানেই থাকে অনেকদিন। আমিতো জানি না কিছু। খুশি মনে বের হলাম, তিন ঘর পরেই হাসিনা খালাদের ঘর, গিয়ে দেখে আসি। গিয়ে দেখলাম, একটা খাটের সঙ্গে শিকল দিয়ে বাঁধা আছেন তিনি। উস্কুখুশকু জামা-কাপড়, চুল। চোখে-মুখে রাজ্যের বিষণ্নতা। সাথে সাথে আমি ধাক্কা খেলাম। হাসিনা খালা আমাকে দেখে চিনতে পারলেন। ‘পুশকিনে আইছে… কেমন আছস বাবা… এত দিন পর নানিবাড়ি আসে কেউ… কেমন আছস… কতো বড় হইছে আমাগো পুশকিনে…’

আমার সাথে খুব স্বাভাবিকভাবে কথা বললেন খালা। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, আপনার শরীর কেমন আছে, বললেন- ভালো। শিকলের কথাটা আর তাকে জিজ্ঞাসা করতে পারলাম না। খুব দ্রুত ভালো থাইকেন খালা, বলে সেখান থেকে চলে আসলাম আমি।
এসে নানিকে জিজ্ঞাসা করলাম, হাসিনা খালার কি হয়েছে, তাকে শিকল দিয়ে বেধে রাখা হয়েছে কেন? নানি যা বললেন তার সারসংক্ষেপ হলো এই যে, তার জামাইটা ভালো পড়ে নাই। খালি মারধর করতো, অত্যাচার করতো। একটা মেয়ে হয়েছিলো তার। মাথার সমস্যা নাকি আগেই টুকটাক দেখা দিয়েছিলো। একদিন কাউকে কিছু না বলে, মেয়েকে নিয়ে স্বামীর বাড়ি থেকে পালিয়ে, ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেন খালা। ঢাকায় গিয়ে মেয়েকে হঠাৎ হারিয়ে ফেলেন তিনি। তখন মাথা পুরোপুরি খারাপ হয়ে যায় তার।

মেয়েকে আর খুঁজে পান নি হাসিনা খালা। ঢাকায় পাগলের মতো কিছুদিন এই এলাকা ঐ এলাকা ঘোরাঘুরি করেন আর মেয়েকে খোঁজেন। একদিন তাদের গ্রামের এক লোক তাকে দেখে চিনতে পারেন। তিনি তার ভাইদের ফোন দেন। ভাইয়েরা গিয়ে তাকে ঢাকা থেকে বাড়িতে নিয়ে আসেন। এমনিতে কথাবার্তা স্বাভাবিক। শুধু যখন মেয়ের কথা মনে পড়ে তখন পাগল হয়ে যান খালা। মেয়েকে খুঁজতে তখন ঢাকার দিকে রওনা দিতে চান তিনি। এ জন্যই তাকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। জামাই আরেকটা বিয়ে করেছে, খোঁজখবরও নেয় না।

এরপর আমি আর নানাবাড়ি যাইনি। এখন হাসিনা খালার কি খবর তাও জানি না। তার সাথে আমার দুইটা স্মৃতি। আমি যতোই মাটির চুলার কথা মনে করতে যাই ততোই তা ঝাপসা হয়ে আসে। খেতের মাঝখানে দৌড়ানো হাসিনা খালাকে আমি দেখতে পাই শিকল দিয়ে বাঁধা। ঢাকায় আমি যখন কিছু না কিছু করছিলাম, খালা তখন তার হারিয়ে যাওয়া মেয়েকে পাগলের মতো খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন।

মানুষের জীবন তো আসলে কয়েকটা ঘটনা মাত্র; আসলে কিছু স্মৃতির সমষ্টি। আমার জীবন আর অন্য কারও জীবন এক বিন্দুতে মিলে যায়, যখন আমাদের দেখা হয়।

2 June 2022

সুইসাইড নোট


ইদানিং শুধু সুইসাইড হচ্ছে আশপাশে। মাঝে মাঝে মনে হয়, যারা সুইসাইড করছে তারা কি আমার চেয়েও বেশি বিষণ্ন? তারা কি আমার চেয়েও বেশি কষ্টে আর হতাশায় আছে? তাদের জীবন কি আমার জীবনের চায়েও ভারী যে তা আর বহন করা যাচ্ছে না? কখনো কখনো যে আমার নিজের মনে হয় নি যে সুইসাইড করে ফেলি, তা নয়। মাঝে মাঝে মনে হয়, এই জীবন থেকে ছুটি দরকার। কখনো মনে হয়, জীবনে যা দরকার ছিলো সব পেয়ে গেছে, নতুন করে আর কিছু পাওয়ার দরকার নেই। কখনো জীবনকে এতো ভারী মনে হয় যে, আর বহন করতে পারছি না।

এই যেমন, আজকেই ভাবছিলাম, জীবনটা যদি আবার শুরু করা যেতো, মন্দ হতো না। আবার শুরু থেকে শুরু করতাম! হয়তো শৈশবের সেই দুরন্ত সময়ে ফিরে যেতাম; কোনো চিন্তা নেই। শুধু স্কুলে ক্লাস করা, পড়াশোনা করা আর খেলা। অথবা বিশ্ববিধ্যালয় জীবনে; রাত জেগে আড্ডা দেওয়া আর ছবি দেখা, চা খাওয়া আর বই পড়া। কোনো চিন্তা নেই, অতীত নিয়ে কোনো অনুশোচনা নেই, ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনো দুশ্চিন্তা নেই। আসলেই কি তাই? এর পরেই ভাবনা এলো, জীবন তো একটাই। সুখদুঃখ, আনন্দ-বেদনা, দুশ্চিন্তা-অনুশোচনা সব এই এক জীবনকে ঘিরেই। যারা যায় আর ফিরে আসে না, আর ফিরে আসা সম্ভবও না। জীবন মাত্র একবারই আমাদের চেতনাকে এই সুযোগ দিচ্ছে। ভালো হলেও ভালো, খারাপ হলেও ভালো; আমাদের কাজ শুধু বর্তমানে বাঁচা।

আমি আমার জীবনের প্রথম সুইসাইড নোট লিখি ক্লাস সিক্সে। তখন আমি সুইসাইড শব্দটির সাথে পরিচিত, কিভাবে তা করে জানি না। কি এক কারণে যেন খুব অভিমান হয়েছিল আব্বার ওপর। বিতৃষ্ণা চলে এসেছিল নিজের জীবনের ওপর। কিন্তু ঠিক কি কারনে এমনটা হয়েছিল, এখন আর তা মনে পড়ে না। মনে হলো সুইসাইড করবো; কালকেই করবো। স্কুলের কোনো এক হোমওয়ার্ক খাতার পেছনের পৃষ্ঠায় গোটা গোটা হাতে কি লিখেছিলাম এখন তাও আর মনে নেই। শুধু মনে আছে মূল বিষয়টি। ‘আমি যদি মরে যাই, আমার যা আছে, তা ছোটো দুই ভাই আসিফ আর আবীরের মধ্যে সমান ভাগ করে দিও।’

আমার যা আছে বলতে, আমার আসলে তখন কিছুই ছিলো না। কয়েকটা কমিকসের বই আর কাপড়-চোপড়। ঐ সময় আমার দুই ভাই আমার খুব কাছে ছিলো। ভাগ কিভাবে করে তাও বুঝতাম না। তবে মনে হয়েছিল, সমান দুই ভাগ করে দিতে হবে; নাহলে খুব অন্যায় হয়ে যাবে। কিভাবে মরবো সে বিষয়েও কিছুটা ভেবেছিলাম। এটা আমার এখনো মনে পড়ে। তখন শুনতে পেতাম, কেউ বিষ খেয়েছে বা গলায় দড়ি দিয়েছে। কিন্তু আমি তখন এতো ছোটো ছিলাম যে, বিষ বা দড়ি কিভাবে জোগাড় করা যায়, তা ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি। তাই ভেবে বের করেছিলাম, ট্রাকের নিচে পড়ে মরে যাবো।

আমি তখন বেশ কয়েকজন সহপাঠীর সঙ্গে হেঁটে স্কুলে যাই। স্কুলে যাওয়ার রাস্তাটায় চলে ট্রাক। ট্রাককে আমার মনে হতো দানবীয় কোনো যানবাহন। এর সঙ্গে সামান্য গুঁতা খেলেও আর রক্ষা নেই। তখন ভেবে বের করেছিলাম, এরকম কোনো ট্রাক যাওয়ার সময় আস্তে করে এর নিচে পড়ে যাবো। সবাই মনে করবে এক্সিডেন্ট, কিন্তু আসলে সুইসাইড। আমার মরাও হবে আবার কেউ বুঝতেও পারবে না। হঠাৎ আবার আব্বা-আম্মা, আসিফ-আবীর, স্কুলের বন্ধু, খেলার মাঠ আর কমিক্স বইগুলোর জন্য কষ্ট হলো। কিন্তু কি আর করা কিছু পেতে হলে তো কিছু ছাড়তে হয়। মৃত্যুকে পেতে হলে এসব মায়া আমাকে ছাড়তে হবে। আমার এইটুকু মনে আছে সেদিন রাতে একাকী কেঁদে ঘুমাতে গিয়েছিলাম।

পরদিন উঠে পুরো বিষয়টা আমি একদম ভুলে যাই। পরদিন আবার স্কুলে যাই, স্কুলের মাঠে টিফিন পিরিয়ডে বরফ-পানি খেলি, স্কুল থেকে এসে নিজেদের গলিতে ক্রিকেট খেলি। মাগরিবের আজানের সঙ্গে সঙ্গে বাসায় ফিরে গিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে পড়তে বসি। রাতে টিভিতে সিন্দাবাদ বা হারকিউলিস দেখি, খাওয়া-দাওয়া করে ঘুমাতে যাই। ক্লাস সিক্সের পুরো বছর বিষয়টা আর আমার মনে পড়ে না।

এরপর ক্লাস সেভেনে বা এইটে, পুরোনো খাতা বিক্রি করার আগে একটু ঘেটে দেখছিলাম। তখন ঐ খাতাটা আবার আমার সামনে পড়ে। একটু ভয়ও পাই, তাও ভালো খাতাটা আম্মার হাতে পড়েনি, পড়লে তো অন্তত একদফা নিশ্চিত মাইর। আবার কষ্টও লেগেছিলো, ছোটোবেলায় কতো ছোটো মানুষ ছিলাম আমি। না হয় আব্বা কিছু একটা নিয়ে কিছু একটা বলেছে, বা কিছু একটা কিনে দেওয়ার কথা, বলেছে পড়ে কিনে দেবে, বা এরকমই কিছু একটা।

ঐ সময় আমি যদি মরে যেতাম, ক্লাস সেভেন বা এইটে ঘটা ঘটনাগুলো আমার সাথে আর ঘটতো না। তা ভালো হোক বা খারাপ, সব এখন আর মনে নেই, মনে থাকার কথাও না, নতুন ঘটনা। প্রত্যেকটা দিন নতুন হয়ে আমাদের কাছে আসে, প্রত্যেক দিন আমাদের সাথে ঘটে নতুন কোনো ঘটনা। যেদিন আমরা মরে যাবো, আমাদের সাথে ঘটতে পারে এমন সব সম্ভাব্য ঘটনাগুলোও থেমে যাবে। আমরা শুধু স্মৃতি হয়ে বেঁচে থাকবো, আরেকজনের মনে।

সব চাওয়া যদি এক জীবনেই পূরণ হয়, তাহলে তো এই জগতটাই বেহেশতো হয়ে উঠবে। তাই সব মানুষেরই কিছু অপূর্ণতা থাকবে, অপ্রাপ্তি থাকবে। শুধু পাওয়াই জীবন নয়, পাওয়া ও না পাওয়া মিলিয়েই জীবন।