ইদানিং শুধু সুইসাইড
হচ্ছে আশপাশে। মাঝে মাঝে মনে হয়, যারা সুইসাইড করছে তারা কি আমার চেয়েও বেশি বিষণ্ন?
তারা কি আমার চেয়েও বেশি কষ্টে আর হতাশায় আছে? তাদের জীবন কি আমার জীবনের চায়েও ভারী
যে তা আর বহন করা যাচ্ছে না? কখনো কখনো যে আমার নিজের মনে হয় নি যে সুইসাইড করে ফেলি,
তা নয়। মাঝে মাঝে মনে হয়, এই জীবন থেকে ছুটি দরকার। কখনো মনে হয়, জীবনে যা দরকার ছিলো
সব পেয়ে গেছে, নতুন করে আর কিছু পাওয়ার দরকার নেই। কখনো জীবনকে এতো ভারী মনে হয় যে,
আর বহন করতে পারছি না।
এই যেমন, আজকেই ভাবছিলাম,
জীবনটা যদি আবার শুরু করা যেতো, মন্দ হতো না। আবার শুরু থেকে শুরু করতাম! হয়তো শৈশবের
সেই দুরন্ত সময়ে ফিরে যেতাম; কোনো চিন্তা নেই। শুধু স্কুলে ক্লাস করা, পড়াশোনা করা
আর খেলা। অথবা বিশ্ববিধ্যালয় জীবনে; রাত জেগে আড্ডা দেওয়া আর ছবি দেখা, চা খাওয়া আর
বই পড়া। কোনো চিন্তা নেই, অতীত নিয়ে কোনো অনুশোচনা নেই, ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনো দুশ্চিন্তা
নেই। আসলেই কি তাই? এর পরেই ভাবনা এলো, জীবন তো একটাই। সুখদুঃখ, আনন্দ-বেদনা, দুশ্চিন্তা-অনুশোচনা
সব এই এক জীবনকে ঘিরেই। যারা যায় আর ফিরে আসে না, আর ফিরে আসা সম্ভবও না। জীবন মাত্র
একবারই আমাদের চেতনাকে এই সুযোগ দিচ্ছে। ভালো হলেও ভালো, খারাপ হলেও ভালো; আমাদের কাজ
শুধু বর্তমানে বাঁচা।
আমি আমার জীবনের
প্রথম সুইসাইড নোট লিখি ক্লাস সিক্সে। তখন আমি সুইসাইড শব্দটির সাথে পরিচিত, কিভাবে
তা করে জানি না। কি এক কারণে যেন খুব অভিমান হয়েছিল আব্বার ওপর। বিতৃষ্ণা চলে এসেছিল
নিজের জীবনের ওপর। কিন্তু ঠিক কি কারনে এমনটা হয়েছিল, এখন আর তা মনে পড়ে না। মনে হলো
সুইসাইড করবো; কালকেই করবো। স্কুলের কোনো এক হোমওয়ার্ক খাতার পেছনের পৃষ্ঠায় গোটা গোটা
হাতে কি লিখেছিলাম এখন তাও আর মনে নেই। শুধু মনে আছে মূল বিষয়টি। ‘আমি যদি মরে যাই,
আমার যা আছে, তা ছোটো দুই ভাই আসিফ আর আবীরের মধ্যে সমান ভাগ করে দিও।’
আমার যা আছে বলতে,
আমার আসলে তখন কিছুই ছিলো না। কয়েকটা কমিকসের বই আর কাপড়-চোপড়। ঐ সময় আমার দুই ভাই
আমার খুব কাছে ছিলো। ভাগ কিভাবে করে তাও বুঝতাম না। তবে মনে হয়েছিল, সমান দুই ভাগ করে
দিতে হবে; নাহলে খুব অন্যায় হয়ে যাবে। কিভাবে মরবো সে বিষয়েও কিছুটা ভেবেছিলাম। এটা
আমার এখনো মনে পড়ে। তখন শুনতে পেতাম, কেউ বিষ খেয়েছে বা গলায় দড়ি দিয়েছে। কিন্তু আমি
তখন এতো ছোটো ছিলাম যে, বিষ বা দড়ি কিভাবে জোগাড় করা যায়, তা ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি।
তাই ভেবে বের করেছিলাম, ট্রাকের নিচে পড়ে মরে যাবো।
আমি তখন বেশ কয়েকজন
সহপাঠীর সঙ্গে হেঁটে স্কুলে যাই। স্কুলে যাওয়ার রাস্তাটায় চলে ট্রাক। ট্রাককে আমার
মনে হতো দানবীয় কোনো যানবাহন। এর সঙ্গে সামান্য গুঁতা খেলেও আর রক্ষা নেই। তখন ভেবে
বের করেছিলাম, এরকম কোনো ট্রাক যাওয়ার সময় আস্তে করে এর নিচে পড়ে যাবো। সবাই মনে করবে
এক্সিডেন্ট, কিন্তু আসলে সুইসাইড। আমার মরাও হবে আবার কেউ বুঝতেও পারবে না। হঠাৎ আবার
আব্বা-আম্মা, আসিফ-আবীর, স্কুলের বন্ধু, খেলার মাঠ আর কমিক্স বইগুলোর জন্য কষ্ট হলো।
কিন্তু কি আর করা কিছু পেতে হলে তো কিছু ছাড়তে হয়। মৃত্যুকে পেতে হলে এসব মায়া আমাকে
ছাড়তে হবে। আমার এইটুকু মনে আছে সেদিন রাতে একাকী কেঁদে ঘুমাতে গিয়েছিলাম।
পরদিন উঠে পুরো বিষয়টা
আমি একদম ভুলে যাই। পরদিন আবার স্কুলে যাই, স্কুলের মাঠে টিফিন পিরিয়ডে বরফ-পানি খেলি,
স্কুল থেকে এসে নিজেদের গলিতে ক্রিকেট খেলি। মাগরিবের আজানের সঙ্গে সঙ্গে বাসায় ফিরে
গিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে পড়তে বসি। রাতে টিভিতে সিন্দাবাদ বা হারকিউলিস দেখি, খাওয়া-দাওয়া
করে ঘুমাতে যাই। ক্লাস সিক্সের পুরো বছর বিষয়টা আর আমার মনে পড়ে না।
এরপর ক্লাস সেভেনে
বা এইটে, পুরোনো খাতা বিক্রি করার আগে একটু ঘেটে দেখছিলাম। তখন ঐ খাতাটা আবার আমার
সামনে পড়ে। একটু ভয়ও পাই, তাও ভালো খাতাটা আম্মার হাতে পড়েনি, পড়লে তো অন্তত একদফা
নিশ্চিত মাইর। আবার কষ্টও লেগেছিলো, ছোটোবেলায় কতো ছোটো মানুষ ছিলাম আমি। না হয় আব্বা
কিছু একটা নিয়ে কিছু একটা বলেছে, বা কিছু একটা কিনে দেওয়ার কথা, বলেছে পড়ে কিনে দেবে,
বা এরকমই কিছু একটা।
ঐ সময় আমি যদি মরে
যেতাম, ক্লাস সেভেন বা এইটে ঘটা ঘটনাগুলো আমার সাথে আর ঘটতো না। তা ভালো হোক বা খারাপ,
সব এখন আর মনে নেই, মনে থাকার কথাও না, নতুন ঘটনা। প্রত্যেকটা দিন নতুন হয়ে আমাদের
কাছে আসে, প্রত্যেক দিন আমাদের সাথে ঘটে নতুন কোনো ঘটনা। যেদিন আমরা মরে যাবো, আমাদের
সাথে ঘটতে পারে এমন সব সম্ভাব্য ঘটনাগুলোও থেমে যাবে। আমরা শুধু স্মৃতি হয়ে বেঁচে থাকবো,
আরেকজনের মনে।
সব চাওয়া যদি এক
জীবনেই পূরণ হয়, তাহলে তো এই জগতটাই বেহেশতো হয়ে উঠবে। তাই সব মানুষেরই কিছু অপূর্ণতা
থাকবে, অপ্রাপ্তি থাকবে। শুধু পাওয়াই জীবন নয়, পাওয়া ও না পাওয়া মিলিয়েই জীবন।
No comments:
Post a Comment