![]() |
কুর্দিস্তান ও ইরাকের মানচিত্র |
রাষ্ট্র স্বাধীন হওয়ার আগে আপনি যদি তার ভবিষ্যৎ এর
প্রশ্ন করেন তাহলে কিছু আপত্তি তৈরী হয়। যে সব প্রশ্ন উত্থাপনের কারনে রাষ্ট্রের
স্বাধীনতা বিলম্বিত হতে পারে, তাই নিয়ে এখানে আলোচনা করা যেতে পারে।
টেরিটোরিয়াল ইন্টেগ্রিটিঃ
রাষ্ট্র স্বাধীন হওয়ার ক্ষেত্রে সবাই সাধারণত প্রথম যে
দোহাইটি দেখান, তা হলো টেরিটোরিয়াল এন্টেগ্রিটি। এই দোহাই দিলে আসলে পৃথিবীর কোনো
অঞ্চলই স্বাধীন হতে পারবে না। রাষ্ট্র একটি অতি-আধুনিক ধারণা। এই ধারণা আরো কিছু
গালভরা ধারণা আমদানী করে। এর মধ্যে বহুল প্রচলিত আর সবচেয়ে অস্পষ্ট ধারণা হলো- 'টেরিটোরিয়াল ইন্টেগ্রিটি'।
যেমন বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হয়, তখন
পাকিস্তানের টেরিটোরিয়াল ইন্টেগ্রিটি নষ্ট হয়। বা আমেরিকা যখন স্বাধীন হয়, তখন বৃটিশ সাম্রাজ্যের টেরিটোরিয়াল ইন্টেগ্রিটি নষ্ট হয়। কোনো অঞ্চলের
স্বাধীনতার সময় যদি টেরিটোরিয়াল ইন্টেগ্রিটির দোহাই তোলা হয়, তাহলে তা সবসময় পরাধীন বা স্বাধীনতাকামী জনতার বিপক্ষে যায়।
টেরিটোরিয়াল ইন্টেগ্রিটি ঠিক রাখতে হলে কোনো দেশেরই আসলে স্বাধীন হওয়া উচিত না।
![]() |
কাতালোনিয়ার পতাকা |
ঠিক একই রকম, কুর্দিস্তানের ক্ষেত্রে ইরাকের বা
কাতালোনিয়ার ক্ষেত্রে স্পেনের টেরিটোরিয়াল ইন্টেগ্রিটি নষ্ট হবে, যদি কুর্দিস্তান বা কাতালোনিয়া স্বাধীন হয়ে যায়। সেক্ষেত্রে অনেকে
মাতৃরাষ্ট্রের ক্ষমতাবলয়ের ভেতরেই দরকষাকষি করে, ইন্টেগ্রিটি নষ্ট না করে
স্বাধীনতা লাভের কথা বলেন। কিন্তু এটা প্রায় অসম্ভব একটা প্রক্রিয়া। এই ঘটনা
ঘটানোর জন্য যে পরিমান আন্তর্জাতিক প্রেসার তৈরী করতে হয়, অনেক
স্বাধীনতাকামী অঞ্চল তা করতে সক্ষম নয়। এইরকম একবার সম্ভব হয়েছিলো পূর্ব তিমুরের
বেলায়। ইন্দোনেশিয়াকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এতো প্রেসার দিয়েছিলো যে ইন্দোনেশিয়া
পূর্ব তিমুরকে স্বাধীনতা দিতে বাধ্য হয়। একই ঘটনা কুর্দিস্তান বা কাতালোনিয়ার
ক্ষেত্রে ঘটবে এমনটা আশা করা যায় না।
![]() |
কুর্দিস্তানের পতাকা |
এই ক্ষেত্রে পুরো দেশে গণভোট নেয়াও একটি আকাশকুসুম
কল্পনা। পুরো ইরাক কখনোই কুর্দিস্তানের স্বাধীনতার ব্যাপারে একমত হবে না। বা পুরো
স্পেন কখনোই কাতালোনিয়ার স্বাধীনতা দিতে চাইবেনা। স্বাধীনতাকামী নির্দিষ্ট অঞ্চলেই
তাই গণভোট নেয়া হয়ে থাক। যেমন সম্প্রতি কুর্দিস্তানে স্বাধীনতার ব্যাপারে গণভোট
হয়ে গেলো। বা কিছুদিন পরই কাতালোনিয়াতে গণভোট। ব্রেক্সিটের পর স্কটল্যান্ডে
স্বাধীনতার ব্যাপারে এইরকম একটি গণভোট হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থেকে যায়।
![]() |
স্কটল্যান্ডের পতাকা |
সংখ্যালঘু তত্ত্বঃ
সংখ্যালঘুর ধারণাই একটি ঔপনিবেশবাদী ধারণা। এই
ধারণা আধুনিক কোনো রাষ্ট্রের সাথেই সঙ্গতিপূর্ন নয়। কিন্তু তবু এই তত্ত্ব আধুনিক
রাষ্ট্রগুলোতে চর্চিত হয়ে থাকে কারন রাষ্ট্রের বেশিরভাগ জনগণই ঔপনিবেশিক
শিক্ষাদীক্ষা থেকে বের হয়ে আসতে পারে নি। রাষ্ট্রগুলোও তাদের পুরাতন ঔপনিবেশিক
ধ্যানধারণা থেকে পুরোপুরি মুক্ত হয়ে কল্যাণকামী রাষ্ট্র হওয়ার পথে নিজেদের এগিয়ে
নিয়ে যেতে পারে নি। এই দায়ভার স্বাধীনতার নয়।
ইরাকে কুর্দিরা সংখ্যালঘু হিসেবে দীর্ঘদিন
নির্যাতিত হয়ে আসছিলো। স্বাধীনতার যৌক্তিক এবং ধারাবাহিক দাবীর প্রেক্ষিতে ১৯৯১ সালে
তারা স্বায়ত্তশাসন পায়। ইরাকের স্বায়ত্তশাসিত কুর্দি এলাকাগুলোয় তথাকথিত ছোট
সংখ্যালঘুরা ইরাকের শাসনের চেয়ে বেশি সুখে ছিলো। কুর্দিস্তানে সংখ্যালঘুরা মূলত
ক্যালডিয় খ্রিস্টান, ইয়াজিদি, ইয়ারসানি এবং বাহাই। এছাড়া
কুর্দিস্তান স্বাধীন হয়ে গেলে আরবরাও সেখানে সংখ্যালঘু হয়ে যাবে। কিন্তু
কুর্দিস্তানের স্বাধীনতার পেছনে অন্যতম সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করেছে এই তথাকথিত
সংখ্যালঘুরা। ক্যালডিয়রা আলাদা স্বাধীনতা কমিশন গঠন করেছে। এমনকি কুর্দি এলাকার
আরবরাও স্বাধীনতার পক্ষে বিপুল পরিমানে সাড়া দিয়েছে।
কুর্দিস্তানের স্বাধীনতার যৌক্তিক দাবীতে কেনো
সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘু
নির্বিশেষে হ্যা ভোট দিলো? কারন ইরাক
বহুদিন ধরে তার নাগরিকদের রক্ষা করতে অক্ষম। সাদ্দাম হোসেনের সময়ে সুন্নিদের
দ্বারা শিয়া আর কুর্দিরা নিষ্পেষণের শিকার হয়েছে। আমেরিকান ইরাকে শিয়া কর্তৃক
সুন্নি আর কুর্দিরা হয়েছে নিষ্পেষিত। বাকী অতি-সংখ্যালঘুদের কথা তো যতোটুকু গণমাধ্যমে এসেছে, ততটুকুই।
সর্বশেষ আইসিসের আক্রমণে পর্যদুস্ত ইরাকি বাহিনী কুর্দি আর সুন্নি এলাকাগুলো
নিজেরাই ছেড়ে রেখে চলে এসেছে। ইরাকের অন্যতম প্রধান শহরগুলো যেমন মসুল, রামাদি, ফালুজা, কিরকুক, হিত ইত্যাদি
আইসিস দখল করেছে বিনা বাধায়। কুর্দিদের পেশমারগা বাহিনী সম্প্রতি কিরকুক, মসুল
আইসিসের হাত থেকে উদ্ধার করেছে। নিজেদের এলাকা যেহেতু কুর্দিরা নিজেরাই দেখে রাখতে
পারছে তাই রাষ্ট্র হিসেবে ইরাকের কি দরকার?!
নতুন রাষ্ট্রে সংখ্যালঘু থাকবে কিনা বা সেখানে
সংখ্যালঘুদের কি অবস্থা হবে বা নতুন রাষ্ট্রে সংখ্যালঘুদের কিভাবে ট্রিট করা হবে
এসবের উপর ‘স্বাধীনতা’ নির্ভর করে না। রাষ্ট্র যদি কল্যাণকামী হয়ে উঠে সংখ্যালঘু
তত্ত্ব সেখানে ক্রমশ দুর্বল হয়ে পরে। রাষ্ট্র ভবিষ্যৎ এ কল্যাণকামী হবে কি না, তা
এখনই বলা সম্ভব না। যেসমস্ত ধ্রুবকের কারনে রাষ্ট্র কল্যাণ রাষ্ট্র হয়ে উঠে
সেসমস্ত উপাদান নতুন রাষ্ট্রে মজুত আছে কি না তা নিয়ে আলোচনা হতে পারে।
মানব প্রজাতির মৌলিক সমস্যাঃ
প্রজাতি হিসেবে মানবজাতির একটি মৌলিক সমস্যা ‘আমরা এবং
তোমরা’। মানুষ নিজেদের খুব সহজেই আলাদা করে ফেলতে পছন্দ করে। আমার মতো যারা তারা
‘আমরা’ আর বাকীরা ‘তোমরা’। ইরাকের ক্ষেত্রে এই আমরা-তোমরা বেশ প্রবল। এখানে তিনটি
বড় গ্রুপ সক্রিয়। শিয়া, সুন্নি, কুর্দি। যদি এই তিনটি জাতিকেই আলাদা রাখা হয় তবু
সংকটের সমাধান হবে না। কারন তখন শিয়া, সুন্নি, কুর্দি থেকে নতুন নতুন আমরা-তোমরা
গজাবে। সুন্নিরা ভাগ হয়ে যাবে মালেকি, হানাফি, শাফেয়ি, হাম্বলি গ্রুপে। শিয়ারা ভাগ
হয়ে যাবে যায়েদি, জাফরি, ইসমাইলিয়া গ্রুপে। কুর্দিরা ভাগ হয়ে যাবে সোরানি, গোরানি,
বখতিয়ারি গ্রুপে। এটা মানবজাতির মূলগত সমস্যা। এই সমস্যা কখনোই একটি জাতির
স্বাধীনতা কামনার অন্তরায় হতে পারে না। যদি দুইজন মানুষের জন্য একটা দেশ করা হয়
সেখানেও দুইটা দল থাকবে। একজন সংখ্যাগুরু ক্ষমতাসীন দল, অপরজন সংখ্যালঘু বিরোধীদল।
এইসব প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও স্বাধীনতাকামী অঞ্চলের
স্বাধীনতা চাওয়াটাকে অস্বীকার করা যাবে না। টেরিটোরিয়াল ইন্টেগ্রিটি, সংখ্যালঘু, অধিকার,
মানবাধিকার, কি পারবে কি পারবে না, তলা বিহীন ঝুড়ি ইত্যাদি বায়বীয় টার্ম ব্যবহার
করে স্বাধীনতার মৌলিক দাবীকে অগ্রাহ্য করা যাবে না।