গতলেখায় আমরা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ নিয়ে কথা বলেছিলাম। আজকে বলতে চাই বঙ্গবন্ধুর নিজের আদর্শবিচ্যুতির কথা। বঙ্গবন্ধু নিজে যে আদর্শে পরিচালিত হয়েছিলেন ১৯৪০ থেকে ১৯৭১, সুদীর্ঘ ৩১ বছর; সেই আদর্শ তিনি নিজেই লঙ্ঘন করেন ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের চারটি মূল স্তম্ভ- অন্যায়ের সাথে আপোষহীনতা, সত্যবাদীতা, জনগণের স্বার্থে নিজেকে নিয়োজিত রাখা এবং সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন দেখা। ১৯৭২ সালে ক্ষমতাগ্রহণের পর এই চারটি মূলস্তম্ভ থেকে দূরে সরে যান বঙ্গবন্ধু। তিনি অন্যায়ের সাথে আপোষ করতে শুরু করেন। যে স্বপ্ন দেখে বাঙ্গালীরা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পরে সে স্বপ্ন হয়ে যায় অলীক কল্পনা। যে কাজগুলো দেশে ফিরেই করা দরকার ছিলো সেগুলো তিনি করেন নি।
দেশে ফিরেই একটি জাতীয় সরকার গঠন করে দেশকে একতাবদ্ধ করার প্রয়োজন ছিলো। এই প্রয়োজন তিনি এমন সময় উপলব্ধি করেন যখন সময় ফুরিয়ে এসেছে। দেশ স্বাধীন হলেও মানুষের মুক্তি দূর থেকে দূরে সরে যাচ্ছিলো। সমাজতন্ত্রের প্রশ্নে আওয়ামী লীগের অতিবিপ্লবী অংশটি বের হয়ে গিয়ে গঠন করে জাসদ (জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল)। জাসদ সেই সময় ত্রাসের রাজত্বকায়েম করে। জাসদকে মোকাবেলা করা আর নিজের ক্ষমতাকে পোক্ত করার জন্য তিনি গঠন করেন রক্ষীবাহিনী। এই জাসদ আর রক্ষীবাহিনীর মাঝখানে পরে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয় সাধারণ জনগণ। অথচ বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে বেশি ভাবা উচিত ছিলো জনগণের কথা।
যে সত্যবাদীতা বঙ্গবন্ধুর ৩০ বছরের রাজনৈতিক জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অর্জন ছিলো স্বাধীনতার পর তার জায়গা নিয়ে নেয় আত্মম্ভরিতা আর স্বেচ্ছাচার। এসময় তিনি মানুষ চিনতে ভুল করেন। তিনি কে দেশপ্রেমিক আর কে চাটুকার তার পার্থক্য করতে ব্যর্থ হন। তিনি কোনটা প্রশংসা আর কোনটা মোসাহেবী তা আলাদা করতে ব্যর্থ হন। এর দায় তাকে নিজের আর নিজের পরিবারের জীবন দিয়ে দিতে হয়েছে। মোসাহেবের দল বঙ্গবন্ধুর লাশের উপর দিয়ে গিয়ে ক্ষমতায় বসে আর বিবৃতি দেয়- ফেরাউনের পতন হয়েছে। মানুষ চিনতে ভুল না করলে দেশ আরো এগিয়ে যেতে পারতো।
১৯৭৩-৭৪ এই সালগুলোতে বেশকয়েকটা প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাংলাদেশকে মোকাবেলা করতে হয়। দেশে দেখা দেয় দুর্ভিক্ষ। একটি নতুন দেশের জন্য দুর্ভিক্ষ সামাল দেয়া খুব ভয়াবহ ব্যপার যদি সেই দেশে প্রবল দুর্নীতি উপস্থিত থাকে। যেই বঙ্গবন্ধু গ্রাম থেকে গ্রামে ঘুড়ে লোকেদের খোঁজখবর নিয়েছেন, সেই বঙ্গবন্ধু দুর্ভিক্ষের খবর জানতে নির্ভর করেন মোসাহেব আর দুর্নীতিবাজ রাজনৈতিকদের উপর।
স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু সোনার বাংলা গঠনের স্বপ্ন দেখা থেকেও দূরে সরে যান। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত বঙ্গবন্ধুকে এসময় চিহ্নিত করা হয়- স্বৈরতান্ত্রিক, কতিপয়তান্ত্রিক, একনায়কতান্ত্রিক, গোষ্ঠীতান্ত্রিক ইত্যাদি অভিধায়। তিনি একের পর এক ভুল সিদ্ধান্ত নিতে থাকেন এসময়। সেনাবাহিনীর ক্ষমতা কমিয়ে আনা, রক্ষীবাহিনীকে সেনাবাহিনীর সমমর্যাদায় বসানো, বিরোধীদের উপর দমন-পীড়ন, দেশপ্রেমিক নেতাদের চিনতে ব্যর্থ হওয়া, জনগণের চাহিদা বুঝতে না পারা এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতিকে মদদ দেয়া এসবই মূল কারণ।
অন্যায় ছাড়া কোনো সমাজ নাই। কিন্তু মানুষ অন্যায়ের বিচার চায়। বিচার না থাকা অথবা একেকজনের জন্য একেকরকম বিচার থাকাই বিচারহীনতা। বিচারের প্রশ্নে সেসময় বঙ্গবন্ধু পক্ষপাতদুষ্ট আচরন করেন। যে কারণে পরবর্তীতে সেনাবাহিনীতে বেশকিছু ‘বিপথগামী তরুণ’ তৈরী হয়। তরুণরা নিজেরা বিপথগামী হয়নি, তাদের বিপথগামী করা হয়েছে। তরুণদের বিপথগামী করার সমসংখ্যাক দায় বঙ্গবন্ধুরও।
তরুণদের রাগিয়ে দিয়ে যেকোনো কাজ উদ্ধার করা বেশ সহজ। এইসমস্ত ক্ষেপাটে তরুণেরা বিদেশী কিছু গোয়েন্দাসংস্থার উস্কানি পায়। মদদ পাওয়ার মতো সিনিয়র অফিসাররা এই ক্ষোভে আরো ঘি ঢেলে দেয়। ফলাফল বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুতে বঙ্গবন্ধুর নিজের যতোটুকু দায় ততোটুকু দায় বিপথগামী তরুণদের। এবং এই দায়ের আরেক হিস্যা বিদেশী স্বার্থবাদী কিছু বিচ্ছিন্ন লোক আর বিদেশী গোয়েন্দা সংস্থার।
যারা বিভিন্ন সময়ে বঙ্গবন্ধুর অকালমৃত্যু নিয়ে হীনমন্যতায় ভোগেন বা পুরো বাঙ্গালী জাতিকে বেঈমান বলে দোষারোপ করেন তাদের আরো বিস্তাড়িত ভেবে কথা বলার জন্য অনুরোধ করবো। ইতিহাস আপনার আবেগ দিয়ে চলে না। ইতিহাস কয়েকটা ঘটনা ছাড়া আর কিছুই না। এক ঘটনা, তার ফলশ্রুতিতে আরেক ঘটনা, এভাবেই ইতিহাস সামনের দিকে এগোয়।
ইতিহাস তার নিজের মতো আগাবে। পেছনে যা গিয়েছে তা গত হয়েছে। এখন আমাদের সময় সামনে তাকানোর। একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখা এখন কোনো অলীক কল্পনা নয়। যেদিন আমরা বিশ্বাস করতে শুরু করবো জাতি হিসেবে আমরা অনন্য, সেদিন থেকেই আমাদের উন্নতি শুরু হবে। সেদিন থেকেই আমরা নিজের গর্ব করে বলতে পারবো- আমরা বাঙ্গালী, আমরা বাংলাদেশী।