11 November 2019

রংধনু লাইভ


বিকাল ৩ টার গ্রামবাংলার খবরে আপনাদের আমন্ত্রন জানাচ্ছি আমি সাবিনা ইয়াসমিন।

কিছুক্ষণ আগে পাওয়া সূত্র মোতাবেক উত্তরার দিয়াবাড়ী নামক এলাকায় রংধনু ব্রিজের নিচে আজ বেলা ১১ টার দিকে পাওয়া গেছে এক জোড়া লাশ। একটি পুরুষের লাশ এবং আরেকটি মহিলার লাশ। ঘটনাস্থলে আছেন আমাদের সহকর্মী শরীফ। আমরা তার কাছ থেকে বিস্তারিত জানবো। শরীফ, আমাকে শুনতে পাচ্ছেন? শরীফ...

জি, সাবিনা, আপনি দেখতে পাচ্ছেন আমি রংধনু ব্রিজের ঠিক পাশেই দাঁড়িয়ে আছি। এখানে অনেক মানুষের সমাগম। তারা লাশ দেখতে এসেছেন। এখানে একটি জোড়া খুন হয়েছে। লাশ পাওয়া গেছে বেলা ১১ টার দিকে। আপনারা দেখতে পাচ্ছেন প্রচুর পুলিশ এসেছে এখানে। পুলিশ ঘটনাস্থল ঘেরাও দিয়ে রেখেছে। কাউকেই সেখানে যেতে দেয়া হচ্ছেনা। একটু আগে গোয়েন্দাদের একটি টিম এসে এখানে পৌছেছে। তারা ঘটনাটি বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করবেন। সাবিনা...

শরীফ আপনি কি প্রত্যক্ষদর্শী বা এলাকাবাসী কারো সাথে কথা বলেছেন? তারা এ বিষয়ে কি বলছেন? শরীফ...

সাবিনা। আমি ইতিমধ্যে এলাকাবাসী অনেকের সাথে কথা বলেছি। তারা বলেছেন এখানে প্রতি মাসেই দুই একটা খুনখারাবি হয়। এটা তেমন কিছু না। তবে এবারের খুনটা একটু ব্যতিক্রম। তারা এর আগে এরকম খুন দেখেননি। দুইটি লাশ একসাথে নেই। মহিলার লাশটি একটি বস্তার ভেতর রাখা ছিলো। পুলিশ বলেছে সেটা মোট ১৮ টুকরায় ছিলো সেখানে। মহিলার মাথাটা আলাদা একটা পলিথিনে রাখা ছিলো। পুরুষের লাশটা ছিলো মহিলার লাশের বস্তার ৫০-৬০ গজ দূরে। পুরুষের মাথাটাও আলাদা করা। বাকী অংশগুলো কাটার চেষ্টা করা হয়েছিলো বলে পুলিশ এবং এলাকাবাসী আমাদের জানিয়েছে। তবে খুনি কেবল পুরুষের হাতদুটি আলাদা করতে পেরেছিলো।

আপনারা দেখতে পারছেন এখানে অনেক লোক জড়ো হয়েছেন। তারা লাশ দেখতে এসেছেন। অনেক পুলিশ এসেছে এখানে। তারা এখনো লাশের পরিচয় বের করতে পারেনি। এলাকাবাসীর একজনের সাথে আমি এখন কথা বলবো।

- আপনি এখানে কয়টা থেকে আছেন?
- আমি শুরু থেইকাই আছি এইহানে। ১১ টার দিক কামে যাওনের সুম লাশ আর জটলা দেইখা আটকাইছি। কামে যাওনের আর মন নাই।
- আপনার কি মনে হয়, কে করতে পারে এই কাজ?
- আমি কিছু কইবার পারুম না। চেয়ারমেন আর মেম্বর দুই গ্রুপ... (চুপ করে গিয়ে) খারাপ মেয়েছেলের এইহানে আনাগোনা বেশি। এইডা তাগোর কেউ অইতে পারে।
- আর পুরুষ লোকটা?
- পুরুষটা লগে থাকবার পারে। আবার দামাদামি নিয়াও এই কাম অইবার পারে। কওন যায় না।
- জি, ধন্যবাদ। আমরা আবার আসবো আপনার কাছে।

আপনারা দেখতে পাচ্ছেন, এইখানে জায়গা কিছুটা নীরব হওয়ায়, সন্ধ্যার পর বিভিন্ন রকম মেয়েদের আগমন বেড়ে যায়। তাদের সাথে থাকে পুরুষেরা। এই দুইজন তাদের কেউ হবার বিষয়ে ধারণা করছেন এলাকাবাসীরা। পুলিশ বলছে এই খুনের ঘটনা গতকাল রাত ১২ টা থেকে ভোর ৬ টার মধ্যে হয়েছে। তবে নিশ্চিত করে কিছুই বলা যাচ্ছে না। সাবিনা...

শরীফ তাদের সাথে কি কি পাওয়া গেছে বলে আপনি জানতে পেরেছেন? শরীফ...

সাবিনা। তাদের সাথের কিছুই পাওয়া যায় নি। কোনো ফোন বা মানিব্যাগ বা কোনো ধরণের পার্স বা ব্যাগ। বা এমন কোনো কিছু যা থেকে তাদের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যেতে পারে। তবে পুলিশ ও গোয়েন্দারা ইতিমধ্যে লাশের হাত থেকে আঙ্গুলের ছাপ নিয়ে তদন্ত করতে পাঠিয়েছেন বলে জানিয়েছেন। সরকারের ডাটাবেজ থেকে তাদের পরিচয় উদ্ধার করা যাবে বলে তাদের বিশ্বাস। তবে পুলিশ জানিয়েছে মেয়েটির হাতে একটি আংটি ছিলো। ধারণা করা হচ্ছে আংটিটি মেয়েটির বিয়ের আংটি। সেক্ষেত্রে মেয়েটির সংসারী বা চাকুরীজীবী নারী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। সাবিনা...

শরীফ আপনি কি পুলিশের কারো সাথে কথা বলেছেন? শরীফ...

সাবিনা। আমি এখানকার দায়িত্বরত পুলিশদের সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছি। তারা আমাকে তেমন কিছু জানানি। বলেছে, তদন্তের স্বার্থে এখন কিছু বলা যাবে না। তদন্ত শেষ হওয়ার পর কনফারেন্স ডেকে প্রেসকে জানানো হবে। ডাটেবেজ থেকে এখনো তাদের কোনো পরিচয় উদ্ধার করা যায়নি। তবে পুলিশ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বলে আমাদের জানিয়েছে। সাবিনা... আমরা ইতিমধ্যে জানিয়েছি মেয়েটির হাতে একটি আংটি পাওয়া গিয়েছে। হয়তো তাদের কাছে আরো মূল্যবান কিছু থাকতে পারে, যেজন্য তাদের জীবন দেয়া লেগেছে। এলাকাবাসীদের একটা অংশ এখন মেয়েটিকে আর খারাপ মেয়ে ভাবছেনা। হয়তো দামী কোনো বস্তু বা ছিনতাই থেকে এ খুনের ঘটনা ঘটেছে। সাবিনা...

শরীফ এলাকাবাসীর কাছে কি আর কোনো তথ্য আছে? শরীফ...

সাবিনা। এলাকাবাসীদের মধ্যে যাকে দিয়ে পুলিশ বস্তা খুলিয়েছে তিনি এখন আমাদের সাথে আছেন। এই যুবককে পুলিশ বলেছে লাশের বিভিন্ন অংশ শরীরে যেভাবে থাকে সেভাবে রাখতে। আমরা এখন তার সাথে কথা বলবো...

- পুলিশ আপনাকে কি বলেছে?
- পুলিশ আমারে ডাক দিয়া কইলো বস্তাডা খুইলা লাশটা সাজায়া দে, ১০০ ট্যাকা দিমু। আমার ভয় লাগতাছিলো দেইখা পুলিশ স্যারে কইলো, না করলে তরে লগে কইরা থানায় নিয়া গিয়া নাস্তাপানি দিমু। পরে আমি বস্তা খুললাম।
- বস্তা খুলে আপনি কি দেখলেন?
- বস্তা খুইলা আমি খালি দেহি লাল মাংস। পোলা না মাইয়া বোঝনের উপায় নাই। ঐডা ছিলো পাও, হাডু পর্যন্তপরে বস্তারতে পাও নামাইলাম। দেকলাম মাইয়ার পাও।
- মেয়ের পা, আপনি কিভাবে বুঝলেন?
- পাওয়ে নেইলপলিশ করা আছিলো। পরে পাইলাম কবজি পর্যন্ত হাত। হাতেও নেইলপলিশ করা আছিলো। এরপর নামাইলাম কবজি থেইকা কনুই, হাডু থেইকা রান, বুকের খাচা। (কিছুক্ষণ চুপ থেকে) পরে নিচের দিকে পাইলাম একটা দুধ, একটা আলেদা পলির ভেতর মাথাডা। পলিডা আমি খুলি নাই। আর মাথার নিচে নাড়িভুরি আলেদা। তহন বস্তা উল্ডাইয়া দিছিলাম। আমি আর কিছু কইতে পারুম না।

দর্শক আপনারা দেখতে পারছেন, যুবকটি ঘটনায় হতবিহবল হয়ে গেছে। সে আর কিছু বলতে পারছেনা। সে একটু দূরে দাঁড়িয়ে বমি করছে। পুলিশ তাকে জোর করে এই কাজ করিয়েছে। নইলে তাকে থানায় ধরে নিয়ে যাবার হুমকি দেয়া হয়েছে। তবে হুমকিতে ভয় পেয়ে এই যুবক একটি সাহসিকতার কাজ করেছে। সে পুলিশকে লাশ গুছিয়ে দিয়ে সাহায্য করেছে। সাবিনা...

শরীফ খুন কিভাবে করা হয়েছে, কিছু জানতে পেরেছেন? শরীফ...

খুনটা কিভাবে করা হয়েছে তা এখনো জানা যায় নি, সাবিনা। তবে পুলিশ ধারণা করছে ধারালো কোনো অস্ত্র দিয়ে তাদের খুন করা হয়েছে। গোয়েন্দাদের একটি বিশেষ বাহিনী গোপনসূত্রে আমাদের জানিয়েছে, আলামত দেখে মনে হচ্ছে খুন করার আগে ধর্ষন করা হয়েছে। পুরুষটিকে আগে খুন করা হয়েছে, মহিলাটিকে পরে। তবে লাশ কাটার সময় মহিলাটিকে আগে কাটা হয়েছে। পরে পুরুষটিকে কাটা হয়েছে। তারা আরো ধারণা করছেন, আগে মাথা কাটা হয়েছে। মহিলা এবং পুরুষ, দুইজনেরই। তবে পুরুষটির হাত কাটার পর, হয় অস্ত্রের ধার কমে এসেছিলো অথবা সকাল হয়ে যাচ্ছিলো বলে এলোপাথাড়ি ঘষে লাশের বিভিন্ন জায়গা কাটার চেষ্টা করা হয়েছিলো।

এমনিতে দিয়াবাড়ী জায়গাটা কিছুটা নির্জন। লোকজন এখনো এখানে খুব কম। মাত্র কয়েকবাড়ি লোক থাকে এখানে। তারাও কোনো সাড়াশব্দ পায়নি বলে জানিয়েছে পুলিশকে। দিনের বেলা এ জায়গা শুটিংস্পট হিসেবে ব্যবহৃত হয়। দিনের বেলা এ জায়গা যেমন সুন্দর, রাতের বেলা তেমনি ভয়ঙ্কর। সাবিনা...

শরীফ তাদের পরিচয় কি পাওয়া গেলো? পুলিশের কি তৎপরতা লক্ষ্য করছেন? শরীফ...

সাবিনা। পুলিশ জায়গাটি ঘিরে রেখেছে। কাউকে কাছে যেতে দেয়া হচ্ছেনা। লাশ দুটো সাদা কাপড়ে ঢেকে দেয়া হয়েছে। কিছুক্ষণ পরপর গোয়েন্দাদের দল গিয়ে লাশ দুটো দেখে আসছেন। কয়েকজন একটা গাড়িতে করে হেডকোয়ার্টারে গিয়েছেন বলে আমাদের কাছে খবর এসেছে। তবে সেখান থেকে তারা এখনো ফেরত আসেননি, সাবিনা। তবে ধারণা করা হচ্ছে লাশ দুটো কোনো দম্পতির, যারা এখানে বেড়াতে এসেছিলেন। বিকেলের সৌন্দর্য উপভোগ করার পর হয়তো সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিলো। সন্ধ্যায় বা প্রথমরাত্রে তারা কোনো ছিনতাইকারী দলের হাতে পরেছিলো। রংধনু ব্রিজের কাছে এই জায়গাটা খুব ভয়ংকর। এলাকাবাসী নিজেরাই এই জায়গাটা সন্ধ্যার পর এড়িয়ে চলেন। হয়তো ছিনতাইকারীরা অনেক আগেই তাদের টার্গেট করেছিলো। ছিনতাই করার পর হয়তো মেয়েটিকে আলাদা করে ধর্ষন করা হয়। পুরুষটিকে হয়তো এসময় মেরে ফেলা হয়। মেয়েটিকে ধর্ষনের পর খুন করা হয়। খুনের পর টুকরো টুকরো করে বস্তায় ভরা হয়। পুরুষটির লাশ কিছুটা দূরে পাওয়া গেছে। হয়তো তাকে সেখানেই খুন করা হয়েছে। হয়তো তারা বিবাহিত ছিলো, কর্মব্যস্ত জীবনের ফাঁকে কিছুটা সময় ঘুরতে এসেছিলো। হয়তো তারা প্রেমিক-প্রেমিকা ছিলো, এখানে দেখা করতে এসেছিলো। সাবিনা...

শরীফ খুন হওয়ার সময় তাদের ভাবনার বিষয়ে আমাদের দর্শকদের কিছু বলুন। শরীফ...

সাবিনা। এটা আমাদের পক্ষে কখনই জানা সম্ভব নয়। মেয়েটিকে যখন পুরুষটির কাছ থেকে আলাদা করা হচ্ছিলো, তখন সাবিনা, তারা দুজনে কি ভাবছিলো এটা আমাদের পক্ষে আর কখনই জানা সম্ভব নয়। হয়তো তারা নিজেদের নিয়ে ভাবছিলো, হয়তো সংসারের কথা ভাবছিলো, ভালোবাসার কথা ভাবছিলো। হয়তো খুনিদের কথা ভাবছিলো। এখান থেকে মুক্ত হতে পারলে কি কি করবে তা ভাবছিলো। আমরা এটা জানতে পারিনা, সাবিনা। যখন মেয়েটিকে ধর্ষন করা হচ্ছিলো ততক্ষণে পুরুষটিকে মেরে ফেলা হয়েছিলো। পুরুষটিকে মেরে তারপর ধর্ষন করতে আসা লোকদের বিষয়ে মেয়েটি কিছু ভেবেছিলো কিনা তা আমরা জানিনা। সাবিনা...

আপনাকে ধন্যবাদ শরীফ।

আপনাকেও ধন্যবাদ সাবিনা।

দর্শক আপনারা যাবেন না। তদন্ত শেষ হলেই আমরা আবার আপনাদের কাছে ফিরে আসবো, রংধনু লাইভে। ততক্ষণ সাথে থাকুন।

লাইভ শেষ করার পর শরীফ তার ফোন চেক করলো। কাজের মধ্যে বেশ কয়েকবার ফোন এসেছে তার। তবে এর মধ্যে একটাও নাজনীনের ফোন না। নাজনীন শরীফের স্ত্রী, মায়ের বাড়ি গেছে গতকাল। রাতে বাসায় ফিরতে ফিরতে বেশ দেরী হয়েছে শরীফের। এসেই ঘুমিয়ে গেছে, সকালে উঠেই আবার অফিস, সেখান থেকে আবার স্পটে তাড়াহুড়া করে আসতে হয়েছে, ফোন দেয়ার সময় পায়নি। এখন ফোন দিলো শরীফ নিজেই, ফোন বন্ধ।

বেশ কয়েকবার ফোনে বন্ধ পেয়ে শাশুড়িকে ফোন দিলো শরীফ। সালাম দিয়ে জিজ্ঞাসা করলো- ‘আম্মা নাজনীন কই?’ ওর ফোন বন্ধ পাচ্ছি... ওপাশ থেকে যে উত্তর এলো তাতে শরীফের মেরুদণ্ড বেয়ে শীতল স্রোত নেমে এলো। ‘ও তো কাল রাতেই বের হয়েছে, বাসায় যাবে বলে... বাসায় পৌঁছায়নি...?’ ‘আমি দেখছি আম্মা...’ বলে ফোন রেখে দিলো শরীফ।

রংধনু ব্রিজের পাশে দাঁড়িয়ে আছে শরীফ। দাঁড়িয়ে ঘামছে।



10 November 2019

স্বার্থ ও দ্বন্দ্ব : আন্দোলনে নানামুখী রাজনীতি


জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে তীব্র উপাচার্যবিরোধী আন্দোলন চলছে। ইতিমধ্যে এই আন্দোলনকে কেন্দ্র করে নানান পক্ষ সক্রিয় হয়েছে। পক্ষে বিপক্ষে নানান কথা-বার্তা, যুক্তি-তথ্য উপস্থাপন, কার্টুন-দেয়াল লিখন, ঝগড়া-বিতণ্ডা চলছে। এমনকি সারা দেশের জনগণের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে এটা জাতীয় ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। তো আমাদের জানা দরকার সেই আন্দোলন কারা করছে? কেন করছে?

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. ফারজানা ইসলাম দেশের প্রথম নারী উপাচার্য হিসেবে ইতিহাসের পাতায় ইতিমধ্যে নিজের অবস্থান তৈরী করে নিয়েছেন। কিন্তু তার স্বার্থকতা এর আগের উপাচার্য ড. আনোয়ার হোসেনকে পদচ্যুত করার আন্দোলনে তিনি শামিল ছিলেন। তিনি আগে থেকেই জানেন একজন উপাচার্যের কি করা উচিত, কোথায় কোথায় একজন উপাচার্য দুর্নীতি করতে পারে এবং কখন একজন উপাচার্যকে পদত্যাগ করানোর জন্য আন্দোলন করা হয়।

চলমান এই আন্দোলনে বেশ কয়েকটি পক্ষ আছে, যেমন সব আন্দোলনেই থাকে। একপক্ষে উপাচার্য নিজে, তার সাথে উপাচার্যপন্থী শিক্ষক এবং ছাত্রলীগের একাংশ। অপরদিকে উপাচার্যবিরোধী শিক্ষকেরা, ছাত্রদের সাধারণ প্লাটফর্ম ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর’ এবং ছাত্রলীগের অপরাংশ। উপাচার্যবিরোধী শিক্ষকেরা নানান ঘরানার, কেউ আওয়ামীপন্থী কিন্তু উপাচার্যবিরোধী, কেউ বিএনপিপন্থী। কেবল হাতে গোনা কয়েকজন শিক্ষক ছাত্রদের স্বার্থপন্থী এবং দুর্নীতিবিরোধী মনোভাব পোষণ করেন।

যে কোনো দুর্নীতির বিপক্ষে কথা বলেন বলে সব ক্ষমতাসীন উপাচার্যের চক্ষুশূল, এমন কিছু শিক্ষক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো আছেন, এরাই ছাত্রদের মূল ভরসার জায়গা। অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, অধ্যাপক রায়হান রাইন, অধ্যাপক সাঈদ ফেরদৌসসহ আর কয়েকজন। তারাও জানেন এই উপাচার্যের পদত্যাগ দুর্নীতি রোধের কোনো উপায় না, এরপর যে উপাচার্য হবে, সেও দুর্নীতি করবে। দুর্নীতি করবে কারন সমস্যাটা অন্য কোথাও, সমস্যাটা সিস্টেমে। উপাচার্য পদটি প্রশাসনিক কিন্তু এটার নিয়োগের ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ কোনো নিয়োগ প্রক্রিয়া নেই, কোনো ধরণের জবাবদিহিতা নেই, বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের ক্ষমতা স্বৈরাচারী।

সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর, জাহাঙ্গীরনগরের প্রগতিশীল ছাত্রজোট এবং সাংস্কৃতিক জোটের সমন্বয়ে গঠিত একটা প্লাটফর্ম, যেখানে সাধারণ ছাত্রদের উপস্থিতি লক্ষণীয়। সাধারন ছাত্ররাও এখানে নিজের কথা বলতে পারে, দাবী দাওয়া তুলতে পারে। প্রগতিশীল ছাত্রজোট হচ্ছে আবার ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র ফ্রন্ট, ছাত্র মৈত্রী ইত্যাদি ছাত্রসংগঠনগুলোর জোট। ছাত্রলীগের মন্তব্য ‘এরা কেবল আন্দোলনই করে’। আসলে আন্দোলন করা ছাড়া আর কিইবা করার আছে এদের? এটা খুবই স্বাভাবিক যে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনগুলো সাধারণ ছাত্রদের স্বার্থ দেখে রাখে না। কিন্তু কাউকে না কাউকে তো সেটা দেখাই লাগবে।

লাইব্রেরীতে সিট সংকট, সিট বাড়াও আন্দোলন; উপাচার্যের দুর্নীতি, দুর্নীতি বিরোধী আন্দোলন; ভর্তি ফরমের মূল্যবৃদ্ধি; মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে আন্দোলন; এইসব আন্দোলন করতে করতে আর সাধারণ ছাত্রদের দাবিদাওয়া নিয়ে কথা বলতে বলতেই প্রগতিশীল ছাত্রজোটের নেতারা তাদের ক্যাম্পাস জীবন সমাপ্ত করেন। ছাত্রলীগ বা ছাত্রদল এসময় কি করে? তারা করে টেন্ডার বানিজ্য, নিয়োগ বাণিজ্য, চাঁদাবাজি, পার্সেন্টেজবাজি, বাকি খাওয়া, হলে অযথা ক্ষমতা দেখানো, টাকাপয়সা এবং স্বার্থ নিয়ে নিজেদের মধ্যে গ্রুপিং এবং মারামারি।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সাম্প্রতিক তিনটি গ্রুপ এভাবেই আলাদাভাবে প্রকট হয়েছে। একটি গ্রুপ সভাপতি জুয়েল রানার, আরেকটি গ্রুপ সাধারণ সম্পাদক আবু সুফিয়ান চঞ্চলের, আরেকটি গ্রুপ যুগ্ম-সাধারন সম্পাদক সাদ্দাম হোসাইনের। এর মধ্যে উপয়াচার্যের ঈদ সালামীর ২৫% নেয়ার পর থেকেই বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ত্যাগ করেছে সাধারণ সম্পাদক চঞ্চল, এ সপ্তাহে সে কেন্দ্রীয় কমিটির কাছে পদত্যাগপত্রও জমা দিয়েছে। আরেক গ্রুপের নেতা সাদ্দাম সাবেক কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক রব্বানীর সাথে সালামীর ২৫% নিয়ে ফোনালাপ করতে গিয়ে ধরা খেয়েছে। সাদ্দাম ও তার গ্রুপও বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে। আর বাকি যে এক গ্রুপ থাকলো সভাপতির নেতৃত্বে, যারা সালামীর ৫০% পেয়েছে, তারাই গত কয়েকদিন আগে উপাচার্যবিরোধী আন্দোলনে শিক্ষক ও ছাত্রদের মারধর করেছে।

এদের কারো ছাত্রবাদী কোনো স্বার্থ নেই। এদের চলাফেরা দেখলেই বোঝা যায় এদের হাতে টাকা আছে। দামী ফোন, দামী মোটর সাইকেল, বিলাশবহুল জীবনযাপন, হলের রুমে ফ্রিজ, টিভি, সোফা ইত্যাদি। এদের অনেকের পিতাই বাকী ছাত্রদের অভিভাবকদের মতো মধ্যবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্ত। পিতার কামাইয়ে এরকম দামী মোটরসাইকেল চালনা করা অসম্ভব। এই খরচের টাকার উৎস কোথায়? অনেক উৎসের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত কাজের একটি নির্দিষ্ট পার্সেন্টেজ অন্যতম। আর এখানেই উপাচার্য ড. ফারজানা ইসলাম ফেঁসে গেছেন।

প্রফেসর ড. ফারজানা ইসলামের বিরুদ্ধে কেবল ছাত্রলীগকে টাকা বা পার্সেন্টেজ দেয়ার অভিযোগই শেষ নয়। এই পার্সেন্টেজের লেনদেন তিনি সম্পন্ন করেন তার স্বামী ‘আখতার হোসাইন’ ও গুণধর সুপুত্র ‘প্রতীক’ এবং তার পিএস ‘সানোয়ার’এর মাধ্যমে। তার সমস্ত অপকর্মের সহযোগী এই তিন পুরুষ। তার পুত্র প্রতীক এর আগেও শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম এবং সেখানে ঘুষ গ্রহণের কেলেঙ্কারীতে জড়িত। বেশ কয়েকটি শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম এবং অস্বচ্ছতার অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখ্য- কৃষক লীগের সাবেক সভাপতি মোতাহার মোল্লার ছেলে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের মোস্তাকিম বিন মোতাহারের নিয়োগ।

আওয়ামীপন্থী শিক্ষকদের অংশটি মূলত আগের উপাচার্য শরীফ এনামুল কবিরের অনুগত, ড. ফারজানা উপাচার্য হওয়ার আগে নিজেও শরীফ এনামুল কবিরের অনুগত শিক্ষক ছিলেন। শরীফ এনামুল কবিরের অনুগত শিক্ষকরা একটি বিশেষ স্বার্থের জায়গা থেকে আন্দোলনে আছেন। তারা যতটুকু ফারজানাকে ক্ষমাতাচ্যুত করতে চান তার চেয়ে বেশি শরীফ এনামুল কবিরের ক্ষমতা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে চান। বিএনপিপন্থী শিক্ষকদের রাজনীতি করার জায়গা এখন খুবই সীমিত। বিভিন্ন আন্দোলনের মাধ্যমে তারা নিজেদের চাঙ্গা রাখেন। আওয়ামীপন্থী শিক্ষকদের দলাদলিতে আসলে বিএনপি-জামাতপন্থী শিক্ষকদের লাভ বেশি। তারা বিভিন্ন পক্ষ অবলম্বন করে প্রশাসনিক সুবিধাদি নিয়ে থাকেন।

ড. ফারজানা ইসলামের পর যিনি উপাচার্য হবেন তিনি দুর্নীতি করবেন না বা নিয়োগ বাণিজ্য করবেন না বা সাধারণ ছাত্রদের স্বার্থ দেখে রাখবেন এমনটা বলা যায় না। তিনি ড. ফারজানার চেয়েও বেশি দুর্নীতিগ্রস্থ হতে পারেন, কিন্তু এই ভয়ে তো ড. ফারজানার বিরুদ্ধে আন্দোলন থামিয়ে দেয়া যায় না। পদত্যাগ না করলেও তার কৃতকর্মের তদন্ত হওয়া উচিত, কোথায় কোথায় তিনি দুর্নীতি করেছেন, সেই দুর্নীতির বিষয়ে তার ব্যাখ্যা কি?

জাহাঙ্গীনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্নীতি এবং আন্দোলন আসলে বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। সারা দেশ এবং দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দৈনন্দিন চিত্রের প্রতিনিধিত্ব করছে এই ঘটনাগুলো। স্বচ্ছতার অভাব, জবাবদিহিতার অভাব, দক্ষ ও যোগ্য লোকের যথাজায়গায় না থাকার ফলাফল এই দুর্নীতি। আর দুর্নীতির খবর প্রকাশিত হলে গায়ে না মাখিয়ে নির্লিপ্ত থাকা, যা করেছি বেশ করেছির মনোভাব পোষণ করাই আন্দোলনের কারণ।

ছাত্রবান্ধব বিশ্ববিদ্যালয় নির্মানে প্রশাসনের করণীয় কি হতে পারে? 
১. বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক দায়িত্ব যোগ্য ব্যক্তিকে অর্পন করা, সাধারণ ছাত্রদের প্রতি যার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা থাকবে। 
২. শিক্ষক নিয়োগকে আরো স্বচ্ছ করা, মেধার পাশাপাশি প্রয়োজনে লিখিত পরীক্ষা ও ডেমো ক্লাসে ছাত্রদের মার্কিং এর উপর ভিত্তি করে শিক্ষক নিয়োগ। 
৩. অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি জ্ঞানের মৌলিক চর্চা এবং গবেষণাকে প্রাধান্য দেয়া। গবেষণায় বরাদ্দ বৃদ্ধি করা। 
৪. বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত অর্থনৈতিক এবং প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা এবং নিয়মিত তা নিরীক্ষা করা। 
৫. কোনো ধরণের অপরাধ বা কেলেঙ্কারীর আলামত পাওয়া গেলে দ্রুততম সময়ের মধ্যে তার তদন্ত করা, তদন্তের রিপোর্ট অতিদ্রুত জনগণের সামনে প্রকাশ করা। 
৬. অপরাধ বা কেলেঙ্কারীর সাথে জড়িত থাকলে স্বেচ্ছায় পদত্যাদের সংস্কৃতি চালু করা।