জাহাঙ্গীরনগর
বিশ্ববিদ্যালয়ে তীব্র উপাচার্যবিরোধী আন্দোলন চলছে। ইতিমধ্যে এই আন্দোলনকে কেন্দ্র
করে নানান পক্ষ সক্রিয় হয়েছে। পক্ষে বিপক্ষে নানান কথা-বার্তা, যুক্তি-তথ্য
উপস্থাপন, কার্টুন-দেয়াল লিখন, ঝগড়া-বিতণ্ডা চলছে। এমনকি সারা দেশের জনগণের
মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে এটা জাতীয় ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। তো আমাদের জানা দরকার
সেই আন্দোলন কারা করছে? কেন করছে?
জাহাঙ্গীরনগর
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. ফারজানা ইসলাম দেশের প্রথম নারী উপাচার্য
হিসেবে ইতিহাসের পাতায় ইতিমধ্যে নিজের অবস্থান তৈরী করে নিয়েছেন। কিন্তু তার
স্বার্থকতা এর আগের উপাচার্য ড. আনোয়ার হোসেনকে পদচ্যুত করার আন্দোলনে তিনি শামিল
ছিলেন। তিনি আগে থেকেই জানেন একজন উপাচার্যের কি করা উচিত, কোথায় কোথায় একজন
উপাচার্য দুর্নীতি করতে পারে এবং কখন একজন উপাচার্যকে পদত্যাগ করানোর জন্য আন্দোলন
করা হয়।
চলমান
এই আন্দোলনে বেশ কয়েকটি পক্ষ আছে, যেমন সব আন্দোলনেই থাকে। একপক্ষে উপাচার্য নিজে,
তার সাথে উপাচার্যপন্থী শিক্ষক এবং ছাত্রলীগের একাংশ। অপরদিকে উপাচার্যবিরোধী
শিক্ষকেরা, ছাত্রদের সাধারণ প্লাটফর্ম ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর’ এবং
ছাত্রলীগের অপরাংশ। উপাচার্যবিরোধী শিক্ষকেরা নানান ঘরানার, কেউ আওয়ামীপন্থী
কিন্তু উপাচার্যবিরোধী, কেউ বিএনপিপন্থী। কেবল হাতে গোনা কয়েকজন শিক্ষক ছাত্রদের
স্বার্থপন্থী এবং দুর্নীতিবিরোধী মনোভাব পোষণ করেন।
যে
কোনো দুর্নীতির বিপক্ষে কথা বলেন বলে সব ক্ষমতাসীন উপাচার্যের চক্ষুশূল, এমন কিছু
শিক্ষক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো আছেন, এরাই ছাত্রদের মূল ভরসার জায়গা।
অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, অধ্যাপক রায়হান রাইন, অধ্যাপক সাঈদ ফেরদৌসসহ আর কয়েকজন।
তারাও জানেন এই উপাচার্যের পদত্যাগ দুর্নীতি রোধের কোনো উপায় না, এরপর যে উপাচার্য
হবে, সেও দুর্নীতি করবে। দুর্নীতি করবে কারন সমস্যাটা অন্য কোথাও, সমস্যাটা
সিস্টেমে। উপাচার্য পদটি প্রশাসনিক কিন্তু এটার নিয়োগের ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ কোনো
নিয়োগ প্রক্রিয়া নেই, কোনো ধরণের জবাবদিহিতা নেই, বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের
ক্ষমতা স্বৈরাচারী।
সন্ত্রাসের
বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর, জাহাঙ্গীরনগরের প্রগতিশীল ছাত্রজোট এবং সাংস্কৃতিক জোটের
সমন্বয়ে গঠিত একটা প্লাটফর্ম, যেখানে সাধারণ ছাত্রদের উপস্থিতি লক্ষণীয়। সাধারন
ছাত্ররাও এখানে নিজের কথা বলতে পারে, দাবী দাওয়া তুলতে পারে। প্রগতিশীল ছাত্রজোট
হচ্ছে আবার ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র ফ্রন্ট, ছাত্র মৈত্রী ইত্যাদি ছাত্রসংগঠনগুলোর
জোট। ছাত্রলীগের মন্তব্য ‘এরা কেবল আন্দোলনই করে’। আসলে আন্দোলন করা ছাড়া আর কিইবা
করার আছে এদের? এটা খুবই স্বাভাবিক যে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনগুলো সাধারণ ছাত্রদের
স্বার্থ দেখে রাখে না। কিন্তু কাউকে না কাউকে তো সেটা দেখাই লাগবে।
লাইব্রেরীতে
সিট সংকট, সিট বাড়াও আন্দোলন; উপাচার্যের দুর্নীতি, দুর্নীতি বিরোধী আন্দোলন;
ভর্তি ফরমের মূল্যবৃদ্ধি; মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে আন্দোলন; এইসব আন্দোলন করতে করতে
আর সাধারণ ছাত্রদের দাবিদাওয়া নিয়ে কথা বলতে বলতেই প্রগতিশীল ছাত্রজোটের নেতারা
তাদের ক্যাম্পাস জীবন সমাপ্ত করেন। ছাত্রলীগ বা ছাত্রদল এসময় কি করে? তারা করে
টেন্ডার বানিজ্য, নিয়োগ বাণিজ্য, চাঁদাবাজি, পার্সেন্টেজবাজি, বাকি খাওয়া, হলে
অযথা ক্ষমতা দেখানো, টাকাপয়সা এবং স্বার্থ নিয়ে নিজেদের মধ্যে গ্রুপিং এবং
মারামারি।
জাহাঙ্গীরনগর
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সাম্প্রতিক তিনটি গ্রুপ এভাবেই আলাদাভাবে প্রকট হয়েছে।
একটি গ্রুপ সভাপতি জুয়েল রানার, আরেকটি গ্রুপ সাধারণ সম্পাদক আবু সুফিয়ান চঞ্চলের,
আরেকটি গ্রুপ যুগ্ম-সাধারন সম্পাদক সাদ্দাম হোসাইনের। এর মধ্যে উপয়াচার্যের ঈদ
সালামীর ২৫% নেয়ার পর থেকেই বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ত্যাগ করেছে সাধারণ সম্পাদক
চঞ্চল, এ সপ্তাহে সে কেন্দ্রীয় কমিটির কাছে পদত্যাগপত্রও জমা দিয়েছে। আরেক গ্রুপের
নেতা সাদ্দাম সাবেক কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক রব্বানীর সাথে সালামীর ২৫% নিয়ে
ফোনালাপ করতে গিয়ে ধরা খেয়েছে। সাদ্দাম ও তার গ্রুপও বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে। আর
বাকি যে এক গ্রুপ থাকলো সভাপতির নেতৃত্বে, যারা সালামীর ৫০% পেয়েছে, তারাই গত
কয়েকদিন আগে উপাচার্যবিরোধী আন্দোলনে শিক্ষক ও ছাত্রদের মারধর করেছে।
এদের
কারো ছাত্রবাদী কোনো স্বার্থ নেই। এদের চলাফেরা দেখলেই বোঝা যায় এদের হাতে টাকা
আছে। দামী ফোন, দামী মোটর সাইকেল, বিলাশবহুল জীবনযাপন, হলের রুমে ফ্রিজ, টিভি,
সোফা ইত্যাদি। এদের অনেকের পিতাই বাকী ছাত্রদের অভিভাবকদের মতো মধ্যবিত্ত বা
নিম্নমধ্যবিত্ত। পিতার কামাইয়ে এরকম দামী মোটরসাইকেল চালনা করা অসম্ভব। এই খরচের
টাকার উৎস কোথায়? অনেক উৎসের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত কাজের একটি নির্দিষ্ট
পার্সেন্টেজ অন্যতম। আর এখানেই উপাচার্য ড. ফারজানা ইসলাম ফেঁসে গেছেন।
প্রফেসর
ড. ফারজানা ইসলামের বিরুদ্ধে কেবল ছাত্রলীগকে টাকা বা পার্সেন্টেজ দেয়ার অভিযোগই
শেষ নয়। এই পার্সেন্টেজের লেনদেন তিনি সম্পন্ন করেন তার স্বামী ‘আখতার হোসাইন’ ও
গুণধর সুপুত্র ‘প্রতীক’ এবং তার পিএস ‘সানোয়ার’এর মাধ্যমে। তার সমস্ত অপকর্মের
সহযোগী এই তিন পুরুষ। তার পুত্র প্রতীক এর আগেও শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম এবং সেখানে
ঘুষ গ্রহণের কেলেঙ্কারীতে জড়িত। বেশ কয়েকটি শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম এবং অস্বচ্ছতার
অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখ্য- কৃষক লীগের সাবেক সভাপতি মোতাহার মোল্লার ছেলে আন্তর্জাতিক
সম্পর্ক বিভাগের মোস্তাকিম বিন মোতাহারের নিয়োগ।
আওয়ামীপন্থী
শিক্ষকদের অংশটি মূলত আগের উপাচার্য শরীফ এনামুল কবিরের অনুগত, ড. ফারজানা
উপাচার্য হওয়ার আগে নিজেও শরীফ এনামুল কবিরের অনুগত শিক্ষক ছিলেন। শরীফ এনামুল
কবিরের অনুগত শিক্ষকরা একটি বিশেষ স্বার্থের জায়গা থেকে আন্দোলনে আছেন। তারা
যতটুকু ফারজানাকে ক্ষমাতাচ্যুত করতে চান তার চেয়ে বেশি শরীফ এনামুল কবিরের ক্ষমতা
পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে চান। বিএনপিপন্থী শিক্ষকদের রাজনীতি করার জায়গা এখন খুবই
সীমিত। বিভিন্ন আন্দোলনের মাধ্যমে তারা নিজেদের চাঙ্গা রাখেন। আওয়ামীপন্থী
শিক্ষকদের দলাদলিতে আসলে বিএনপি-জামাতপন্থী শিক্ষকদের লাভ বেশি। তারা বিভিন্ন পক্ষ
অবলম্বন করে প্রশাসনিক সুবিধাদি নিয়ে থাকেন।
ড.
ফারজানা ইসলামের পর যিনি উপাচার্য হবেন তিনি দুর্নীতি করবেন না বা নিয়োগ বাণিজ্য
করবেন না বা সাধারণ ছাত্রদের স্বার্থ দেখে রাখবেন এমনটা বলা যায় না। তিনি ড.
ফারজানার চেয়েও বেশি দুর্নীতিগ্রস্থ হতে পারেন, কিন্তু এই ভয়ে তো ড. ফারজানার
বিরুদ্ধে আন্দোলন থামিয়ে দেয়া যায় না। পদত্যাগ না করলেও তার কৃতকর্মের তদন্ত হওয়া
উচিত, কোথায় কোথায় তিনি দুর্নীতি করেছেন, সেই দুর্নীতির বিষয়ে তার ব্যাখ্যা কি?
জাহাঙ্গীনগর
বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্নীতি এবং আন্দোলন আসলে বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। সারা দেশ এবং
দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দৈনন্দিন চিত্রের প্রতিনিধিত্ব করছে এই ঘটনাগুলো।
স্বচ্ছতার অভাব, জবাবদিহিতার অভাব, দক্ষ ও যোগ্য লোকের যথাজায়গায় না থাকার ফলাফল
এই দুর্নীতি। আর দুর্নীতির খবর প্রকাশিত হলে গায়ে না মাখিয়ে নির্লিপ্ত থাকা, যা
করেছি বেশ করেছির মনোভাব পোষণ করাই আন্দোলনের কারণ।
ছাত্রবান্ধব
বিশ্ববিদ্যালয় নির্মানে প্রশাসনের করণীয় কি হতে পারে?
১. বিশ্ববিদ্যালয়ের
প্রশাসনিক দায়িত্ব যোগ্য ব্যক্তিকে অর্পন করা, সাধারণ ছাত্রদের প্রতি যার স্বচ্ছতা
ও জবাবদিহিতা থাকবে।
২. শিক্ষক নিয়োগকে আরো স্বচ্ছ করা, মেধার পাশাপাশি প্রয়োজনে
লিখিত পরীক্ষা ও ডেমো ক্লাসে ছাত্রদের মার্কিং এর উপর ভিত্তি করে শিক্ষক নিয়োগ।
৩.
অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি জ্ঞানের মৌলিক চর্চা এবং গবেষণাকে প্রাধান্য দেয়া।
গবেষণায় বরাদ্দ বৃদ্ধি করা।
৪. বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত অর্থনৈতিক এবং প্রশাসনিক
কর্মকাণ্ডে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা এবং নিয়মিত তা নিরীক্ষা করা।
৫. কোনো ধরণের অপরাধ
বা কেলেঙ্কারীর আলামত পাওয়া গেলে দ্রুততম সময়ের মধ্যে তার তদন্ত করা, তদন্তের
রিপোর্ট অতিদ্রুত জনগণের সামনে প্রকাশ করা।
৬. অপরাধ বা কেলেঙ্কারীর সাথে জড়িত
থাকলে স্বেচ্ছায় পদত্যাদের সংস্কৃতি চালু করা।
No comments:
Post a Comment