11 November 2019

রংধনু লাইভ


বিকাল ৩ টার গ্রামবাংলার খবরে আপনাদের আমন্ত্রন জানাচ্ছি আমি সাবিনা ইয়াসমিন।

কিছুক্ষণ আগে পাওয়া সূত্র মোতাবেক উত্তরার দিয়াবাড়ী নামক এলাকায় রংধনু ব্রিজের নিচে আজ বেলা ১১ টার দিকে পাওয়া গেছে এক জোড়া লাশ। একটি পুরুষের লাশ এবং আরেকটি মহিলার লাশ। ঘটনাস্থলে আছেন আমাদের সহকর্মী শরীফ। আমরা তার কাছ থেকে বিস্তারিত জানবো। শরীফ, আমাকে শুনতে পাচ্ছেন? শরীফ...

জি, সাবিনা, আপনি দেখতে পাচ্ছেন আমি রংধনু ব্রিজের ঠিক পাশেই দাঁড়িয়ে আছি। এখানে অনেক মানুষের সমাগম। তারা লাশ দেখতে এসেছেন। এখানে একটি জোড়া খুন হয়েছে। লাশ পাওয়া গেছে বেলা ১১ টার দিকে। আপনারা দেখতে পাচ্ছেন প্রচুর পুলিশ এসেছে এখানে। পুলিশ ঘটনাস্থল ঘেরাও দিয়ে রেখেছে। কাউকেই সেখানে যেতে দেয়া হচ্ছেনা। একটু আগে গোয়েন্দাদের একটি টিম এসে এখানে পৌছেছে। তারা ঘটনাটি বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করবেন। সাবিনা...

শরীফ আপনি কি প্রত্যক্ষদর্শী বা এলাকাবাসী কারো সাথে কথা বলেছেন? তারা এ বিষয়ে কি বলছেন? শরীফ...

সাবিনা। আমি ইতিমধ্যে এলাকাবাসী অনেকের সাথে কথা বলেছি। তারা বলেছেন এখানে প্রতি মাসেই দুই একটা খুনখারাবি হয়। এটা তেমন কিছু না। তবে এবারের খুনটা একটু ব্যতিক্রম। তারা এর আগে এরকম খুন দেখেননি। দুইটি লাশ একসাথে নেই। মহিলার লাশটি একটি বস্তার ভেতর রাখা ছিলো। পুলিশ বলেছে সেটা মোট ১৮ টুকরায় ছিলো সেখানে। মহিলার মাথাটা আলাদা একটা পলিথিনে রাখা ছিলো। পুরুষের লাশটা ছিলো মহিলার লাশের বস্তার ৫০-৬০ গজ দূরে। পুরুষের মাথাটাও আলাদা করা। বাকী অংশগুলো কাটার চেষ্টা করা হয়েছিলো বলে পুলিশ এবং এলাকাবাসী আমাদের জানিয়েছে। তবে খুনি কেবল পুরুষের হাতদুটি আলাদা করতে পেরেছিলো।

আপনারা দেখতে পারছেন এখানে অনেক লোক জড়ো হয়েছেন। তারা লাশ দেখতে এসেছেন। অনেক পুলিশ এসেছে এখানে। তারা এখনো লাশের পরিচয় বের করতে পারেনি। এলাকাবাসীর একজনের সাথে আমি এখন কথা বলবো।

- আপনি এখানে কয়টা থেকে আছেন?
- আমি শুরু থেইকাই আছি এইহানে। ১১ টার দিক কামে যাওনের সুম লাশ আর জটলা দেইখা আটকাইছি। কামে যাওনের আর মন নাই।
- আপনার কি মনে হয়, কে করতে পারে এই কাজ?
- আমি কিছু কইবার পারুম না। চেয়ারমেন আর মেম্বর দুই গ্রুপ... (চুপ করে গিয়ে) খারাপ মেয়েছেলের এইহানে আনাগোনা বেশি। এইডা তাগোর কেউ অইতে পারে।
- আর পুরুষ লোকটা?
- পুরুষটা লগে থাকবার পারে। আবার দামাদামি নিয়াও এই কাম অইবার পারে। কওন যায় না।
- জি, ধন্যবাদ। আমরা আবার আসবো আপনার কাছে।

আপনারা দেখতে পাচ্ছেন, এইখানে জায়গা কিছুটা নীরব হওয়ায়, সন্ধ্যার পর বিভিন্ন রকম মেয়েদের আগমন বেড়ে যায়। তাদের সাথে থাকে পুরুষেরা। এই দুইজন তাদের কেউ হবার বিষয়ে ধারণা করছেন এলাকাবাসীরা। পুলিশ বলছে এই খুনের ঘটনা গতকাল রাত ১২ টা থেকে ভোর ৬ টার মধ্যে হয়েছে। তবে নিশ্চিত করে কিছুই বলা যাচ্ছে না। সাবিনা...

শরীফ তাদের সাথে কি কি পাওয়া গেছে বলে আপনি জানতে পেরেছেন? শরীফ...

সাবিনা। তাদের সাথের কিছুই পাওয়া যায় নি। কোনো ফোন বা মানিব্যাগ বা কোনো ধরণের পার্স বা ব্যাগ। বা এমন কোনো কিছু যা থেকে তাদের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যেতে পারে। তবে পুলিশ ও গোয়েন্দারা ইতিমধ্যে লাশের হাত থেকে আঙ্গুলের ছাপ নিয়ে তদন্ত করতে পাঠিয়েছেন বলে জানিয়েছেন। সরকারের ডাটাবেজ থেকে তাদের পরিচয় উদ্ধার করা যাবে বলে তাদের বিশ্বাস। তবে পুলিশ জানিয়েছে মেয়েটির হাতে একটি আংটি ছিলো। ধারণা করা হচ্ছে আংটিটি মেয়েটির বিয়ের আংটি। সেক্ষেত্রে মেয়েটির সংসারী বা চাকুরীজীবী নারী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। সাবিনা...

শরীফ আপনি কি পুলিশের কারো সাথে কথা বলেছেন? শরীফ...

সাবিনা। আমি এখানকার দায়িত্বরত পুলিশদের সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছি। তারা আমাকে তেমন কিছু জানানি। বলেছে, তদন্তের স্বার্থে এখন কিছু বলা যাবে না। তদন্ত শেষ হওয়ার পর কনফারেন্স ডেকে প্রেসকে জানানো হবে। ডাটেবেজ থেকে এখনো তাদের কোনো পরিচয় উদ্ধার করা যায়নি। তবে পুলিশ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বলে আমাদের জানিয়েছে। সাবিনা... আমরা ইতিমধ্যে জানিয়েছি মেয়েটির হাতে একটি আংটি পাওয়া গিয়েছে। হয়তো তাদের কাছে আরো মূল্যবান কিছু থাকতে পারে, যেজন্য তাদের জীবন দেয়া লেগেছে। এলাকাবাসীদের একটা অংশ এখন মেয়েটিকে আর খারাপ মেয়ে ভাবছেনা। হয়তো দামী কোনো বস্তু বা ছিনতাই থেকে এ খুনের ঘটনা ঘটেছে। সাবিনা...

শরীফ এলাকাবাসীর কাছে কি আর কোনো তথ্য আছে? শরীফ...

সাবিনা। এলাকাবাসীদের মধ্যে যাকে দিয়ে পুলিশ বস্তা খুলিয়েছে তিনি এখন আমাদের সাথে আছেন। এই যুবককে পুলিশ বলেছে লাশের বিভিন্ন অংশ শরীরে যেভাবে থাকে সেভাবে রাখতে। আমরা এখন তার সাথে কথা বলবো...

- পুলিশ আপনাকে কি বলেছে?
- পুলিশ আমারে ডাক দিয়া কইলো বস্তাডা খুইলা লাশটা সাজায়া দে, ১০০ ট্যাকা দিমু। আমার ভয় লাগতাছিলো দেইখা পুলিশ স্যারে কইলো, না করলে তরে লগে কইরা থানায় নিয়া গিয়া নাস্তাপানি দিমু। পরে আমি বস্তা খুললাম।
- বস্তা খুলে আপনি কি দেখলেন?
- বস্তা খুইলা আমি খালি দেহি লাল মাংস। পোলা না মাইয়া বোঝনের উপায় নাই। ঐডা ছিলো পাও, হাডু পর্যন্তপরে বস্তারতে পাও নামাইলাম। দেকলাম মাইয়ার পাও।
- মেয়ের পা, আপনি কিভাবে বুঝলেন?
- পাওয়ে নেইলপলিশ করা আছিলো। পরে পাইলাম কবজি পর্যন্ত হাত। হাতেও নেইলপলিশ করা আছিলো। এরপর নামাইলাম কবজি থেইকা কনুই, হাডু থেইকা রান, বুকের খাচা। (কিছুক্ষণ চুপ থেকে) পরে নিচের দিকে পাইলাম একটা দুধ, একটা আলেদা পলির ভেতর মাথাডা। পলিডা আমি খুলি নাই। আর মাথার নিচে নাড়িভুরি আলেদা। তহন বস্তা উল্ডাইয়া দিছিলাম। আমি আর কিছু কইতে পারুম না।

দর্শক আপনারা দেখতে পারছেন, যুবকটি ঘটনায় হতবিহবল হয়ে গেছে। সে আর কিছু বলতে পারছেনা। সে একটু দূরে দাঁড়িয়ে বমি করছে। পুলিশ তাকে জোর করে এই কাজ করিয়েছে। নইলে তাকে থানায় ধরে নিয়ে যাবার হুমকি দেয়া হয়েছে। তবে হুমকিতে ভয় পেয়ে এই যুবক একটি সাহসিকতার কাজ করেছে। সে পুলিশকে লাশ গুছিয়ে দিয়ে সাহায্য করেছে। সাবিনা...

শরীফ খুন কিভাবে করা হয়েছে, কিছু জানতে পেরেছেন? শরীফ...

খুনটা কিভাবে করা হয়েছে তা এখনো জানা যায় নি, সাবিনা। তবে পুলিশ ধারণা করছে ধারালো কোনো অস্ত্র দিয়ে তাদের খুন করা হয়েছে। গোয়েন্দাদের একটি বিশেষ বাহিনী গোপনসূত্রে আমাদের জানিয়েছে, আলামত দেখে মনে হচ্ছে খুন করার আগে ধর্ষন করা হয়েছে। পুরুষটিকে আগে খুন করা হয়েছে, মহিলাটিকে পরে। তবে লাশ কাটার সময় মহিলাটিকে আগে কাটা হয়েছে। পরে পুরুষটিকে কাটা হয়েছে। তারা আরো ধারণা করছেন, আগে মাথা কাটা হয়েছে। মহিলা এবং পুরুষ, দুইজনেরই। তবে পুরুষটির হাত কাটার পর, হয় অস্ত্রের ধার কমে এসেছিলো অথবা সকাল হয়ে যাচ্ছিলো বলে এলোপাথাড়ি ঘষে লাশের বিভিন্ন জায়গা কাটার চেষ্টা করা হয়েছিলো।

এমনিতে দিয়াবাড়ী জায়গাটা কিছুটা নির্জন। লোকজন এখনো এখানে খুব কম। মাত্র কয়েকবাড়ি লোক থাকে এখানে। তারাও কোনো সাড়াশব্দ পায়নি বলে জানিয়েছে পুলিশকে। দিনের বেলা এ জায়গা শুটিংস্পট হিসেবে ব্যবহৃত হয়। দিনের বেলা এ জায়গা যেমন সুন্দর, রাতের বেলা তেমনি ভয়ঙ্কর। সাবিনা...

শরীফ তাদের পরিচয় কি পাওয়া গেলো? পুলিশের কি তৎপরতা লক্ষ্য করছেন? শরীফ...

সাবিনা। পুলিশ জায়গাটি ঘিরে রেখেছে। কাউকে কাছে যেতে দেয়া হচ্ছেনা। লাশ দুটো সাদা কাপড়ে ঢেকে দেয়া হয়েছে। কিছুক্ষণ পরপর গোয়েন্দাদের দল গিয়ে লাশ দুটো দেখে আসছেন। কয়েকজন একটা গাড়িতে করে হেডকোয়ার্টারে গিয়েছেন বলে আমাদের কাছে খবর এসেছে। তবে সেখান থেকে তারা এখনো ফেরত আসেননি, সাবিনা। তবে ধারণা করা হচ্ছে লাশ দুটো কোনো দম্পতির, যারা এখানে বেড়াতে এসেছিলেন। বিকেলের সৌন্দর্য উপভোগ করার পর হয়তো সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিলো। সন্ধ্যায় বা প্রথমরাত্রে তারা কোনো ছিনতাইকারী দলের হাতে পরেছিলো। রংধনু ব্রিজের কাছে এই জায়গাটা খুব ভয়ংকর। এলাকাবাসী নিজেরাই এই জায়গাটা সন্ধ্যার পর এড়িয়ে চলেন। হয়তো ছিনতাইকারীরা অনেক আগেই তাদের টার্গেট করেছিলো। ছিনতাই করার পর হয়তো মেয়েটিকে আলাদা করে ধর্ষন করা হয়। পুরুষটিকে হয়তো এসময় মেরে ফেলা হয়। মেয়েটিকে ধর্ষনের পর খুন করা হয়। খুনের পর টুকরো টুকরো করে বস্তায় ভরা হয়। পুরুষটির লাশ কিছুটা দূরে পাওয়া গেছে। হয়তো তাকে সেখানেই খুন করা হয়েছে। হয়তো তারা বিবাহিত ছিলো, কর্মব্যস্ত জীবনের ফাঁকে কিছুটা সময় ঘুরতে এসেছিলো। হয়তো তারা প্রেমিক-প্রেমিকা ছিলো, এখানে দেখা করতে এসেছিলো। সাবিনা...

শরীফ খুন হওয়ার সময় তাদের ভাবনার বিষয়ে আমাদের দর্শকদের কিছু বলুন। শরীফ...

সাবিনা। এটা আমাদের পক্ষে কখনই জানা সম্ভব নয়। মেয়েটিকে যখন পুরুষটির কাছ থেকে আলাদা করা হচ্ছিলো, তখন সাবিনা, তারা দুজনে কি ভাবছিলো এটা আমাদের পক্ষে আর কখনই জানা সম্ভব নয়। হয়তো তারা নিজেদের নিয়ে ভাবছিলো, হয়তো সংসারের কথা ভাবছিলো, ভালোবাসার কথা ভাবছিলো। হয়তো খুনিদের কথা ভাবছিলো। এখান থেকে মুক্ত হতে পারলে কি কি করবে তা ভাবছিলো। আমরা এটা জানতে পারিনা, সাবিনা। যখন মেয়েটিকে ধর্ষন করা হচ্ছিলো ততক্ষণে পুরুষটিকে মেরে ফেলা হয়েছিলো। পুরুষটিকে মেরে তারপর ধর্ষন করতে আসা লোকদের বিষয়ে মেয়েটি কিছু ভেবেছিলো কিনা তা আমরা জানিনা। সাবিনা...

আপনাকে ধন্যবাদ শরীফ।

আপনাকেও ধন্যবাদ সাবিনা।

দর্শক আপনারা যাবেন না। তদন্ত শেষ হলেই আমরা আবার আপনাদের কাছে ফিরে আসবো, রংধনু লাইভে। ততক্ষণ সাথে থাকুন।

লাইভ শেষ করার পর শরীফ তার ফোন চেক করলো। কাজের মধ্যে বেশ কয়েকবার ফোন এসেছে তার। তবে এর মধ্যে একটাও নাজনীনের ফোন না। নাজনীন শরীফের স্ত্রী, মায়ের বাড়ি গেছে গতকাল। রাতে বাসায় ফিরতে ফিরতে বেশ দেরী হয়েছে শরীফের। এসেই ঘুমিয়ে গেছে, সকালে উঠেই আবার অফিস, সেখান থেকে আবার স্পটে তাড়াহুড়া করে আসতে হয়েছে, ফোন দেয়ার সময় পায়নি। এখন ফোন দিলো শরীফ নিজেই, ফোন বন্ধ।

বেশ কয়েকবার ফোনে বন্ধ পেয়ে শাশুড়িকে ফোন দিলো শরীফ। সালাম দিয়ে জিজ্ঞাসা করলো- ‘আম্মা নাজনীন কই?’ ওর ফোন বন্ধ পাচ্ছি... ওপাশ থেকে যে উত্তর এলো তাতে শরীফের মেরুদণ্ড বেয়ে শীতল স্রোত নেমে এলো। ‘ও তো কাল রাতেই বের হয়েছে, বাসায় যাবে বলে... বাসায় পৌঁছায়নি...?’ ‘আমি দেখছি আম্মা...’ বলে ফোন রেখে দিলো শরীফ।

রংধনু ব্রিজের পাশে দাঁড়িয়ে আছে শরীফ। দাঁড়িয়ে ঘামছে।



No comments:

Post a Comment