27 September 2020

পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রঃ মূল্যবোধের আলাপ


পারিবারিক মূল্যবোধের কথা বলি। পারিবারিক মূল্যবোধ আসবে কোত্থেকে? পরিবার নিজেই তো মূল্যবোধ শিখে আসে নি। পরিবার আসলে শেখায় ৩ বেলা খাওয়া, ১ বেলা ঘুম, পড়াশোনা শেখার নামে অসুস্থ প্রতিযোগিতা করা, ক্লাসে ১ম হতে হবে বিষয়ক নির্যাতন ইত্যাদি। পরিবারের ধারণা ক্লাসে ১ম হলে, ভালো চাকরি হবে, ভালো চাকরি হলে ছেলে আগামী জীবন ভালোভাবে খেয়েপরে বেঁচে থাকতে পারবে। খেয়েপরে বেঁচে থাকার টেকনিক শেখাই আমাদের পারিবারিক মূল্যবোধ।

অনেকে পরিবারের দোষ দিতে চায় না, বলে মাত্র ৩ জেনারেশন আগে আমরা কৃষক ছিলাম, অনেক যুদ্ধ-দাঙ্গা-ক্ষরা-দুর্ভিক্ষ থেকে আমাদের প্রবৃত্তি খাওয়াপরার সংগ্রামকেই জীবনের মূল্যবোধ হিসেবে আত্মস্থ করে নিয়েছে। ৩ জেনারেশন আগে কেবল আমরাই কৃষক ছিলাম না, পৃথিবীর বেশিরভাগ জাতিই কৃষক ছিলো। চাইনিজ, জাপানিজ, কোরিয়ানরাও ৩ জেনারেশন আগে কৃষক ছিলো। তারা কিভাবে পারিবারিক মূল্যবোধ শিখে গেলো!

যুদ্ধ-দাঙ্গা-ক্ষরা-দুর্ভিক্ষ এর ভেতর দিয়ে যায়নি, এমন জাতি একটাও নেই পৃথিবীতে। ক্ষেত্রবিশেষে তারা আমাদের চে আরো বেশি গিয়েছে। ১ম বিশ্বযুদ্ধের আগে আগে জাপান যখন কোরিয়া আর চীন দখল করে নিচ্ছিলো তখন জাপানে তাদের ব্যাপারে প্রবাদের মতো কিছু কথা প্রচলিত ছিলো- কোরিয়ানরা অলস আর চাইনিজরা মাথামোটা। অলস কোরিয়ান, মাথামোটা চাইনিজ আর দখলদার জাপানিজরা এখন কে কেমন আছে?

পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র, মানুষের জীবনের ৩ গুরুত্বপূর্ণ সংগঠন। মূল্যবোধের বিচারে এই তিনটার কার্যক্রমে খুব বেশি পার্থক্য নেই। পরিবার যাকে লোকমা দিয়ে খাওয়ায়, সমাজ তাকে ছায়া দিয়ে রাখে, রাষ্ট্রে সেই ধনে-মানে প্রতিষ্ঠিত হয়।

মানুষ আসলে অপরাধপ্রবণ প্রাণী। সুযোগ পেলেই অপরাধ করবে। কিন্তু খুন ও ধর্ষণ এমন অপরাধ যাকে কোনোভাবেই জাস্টিফাই করা যায় না। কেবলমাত্র নিজের জীবন ও সম্ভ্রম রক্ষা করা ছাড়া খুন করার কোনো কারণ থাকতে পারে না। মানুষ খুন করার চেয়ে বড় কোনো অপরাধ নেই। খুন তো তাও বলা যায় নিজেকে রক্ষার জন্য করা গেছে, ধর্ষনকে কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন।

ধর্ষন মানে আরেকজনকে ছোট করা, হেয় করা। তা সে নারী হোক বা পুরুষ হোক, সুস্থ হোক বা প্রতিবন্ধী হোক, বাচ্চা হোক বা বয়স্ক হোক। জোরজবরদস্তিমূলক পেশীতন্ত্রের প্রকট আলামত- ধর্ষন।

যে ধর্ষন করে সে বছরের ৩৬৫ দিন, দিনের ২৪ ঘণ্টা ধর্ষন করে বেড়ায় না। কিন্তু এটা এমন অপরাধ যাকে কোনোভাবেই ব্যাখ্যা করার কিছু নেই। একবার করে ফেললেই হয়ে গেলো। সারাবছর পেশীতন্ত্রের ভার বয়ে বেরানো মানুষটাই দিনশেষে ধর্ষক হয়ে উঠে। মানুষের সমাজ থেকে পুরোপুরি ধর্ষন বিলুপ্ত করা হয়ত সম্ভব না, কিন্তু তার লাগাম টেনে ধরা সম্ভব।

যদি পরিবার যথাযথভাবে তার বাচ্চাকে যৌন শিক্ষা দেয়, তাকে শেখায় যে যৌনকর্ম জোর করে করার বিষয় না। যৌনকর্ম একটি অত্যন্ত স্বাভাবিক আচরণ, যেটা আরেকজনের সম্মতিতে করতে হয়। এমনকি প্রত্যেকবার যৌনকর্মের আগে সম্মতি নেয়া প্রয়োজন। একবার সম্মত হলেই যে অপরজন পরেরবার সম্মত হবে এমন মনে করার কোন কারণ নেই। এছাড়া যৌনকর্ম মানবজাতির সদস্য বৃদ্ধির একটি স্বাভাবিক প্রবণতা। তুমিও এভাবে এসেছো, আমিও এভাবে এসেছি।

পরিবার থেকে বাচ্চাকে নিজের প্রাইভেট পার্টস শেখানো। তাকে শেখানো, এগুলো তোমার এমন নিজস্ব অংগ, যেগুলো এমনকি বাবা-দাদারো ধরার অধিকার নেই।

মানুষকে মানুষ হিসেবে সম্মান করতে শেখানো। নারী বা পুরুষ, সাদা বা কালো, প্রতিবন্ধী বা দুর্বল, বাঙ্গালী বা আদিবাসি, মুসলমান বা হিন্দু হিসেবে নয়। সকল মানুষই মানুষ, কেউ আপনার চেয়ে ছোট বা বড় নয়। আরেকজনকে একটু অন্যরকম দেখা যায় তাই সে আমার চেয়ে নিচে বা উপরে, কেউ আপনার ধর্ম পালন করে না তাই সে আপনার চেয়ে নিচে, কেউ কিছু টাকাপয়সা করে ফেলেছে বা রাজনীতি করে বলে আপনার চেয়ে উপরে, এমনটা নয়। সবার আগে পরিবার থেকে শেখান, সকল মানুষ সমান। সকল মানুষ সমান...

সমাজের দায়িত্ব ধর্ষককে সামাজিকভাবে বয়কট করা। কিছু লোক থাকে যারা ধর্ষকের পক্ষে সাফাই গায়, নিতান্ত নিরুপায় হয়ে ও এই ধর্ষনটা করতে বাধ্য হয়েছে টাইপ বক্তব্য দেয়। কেউ আবার বলার চেষ্টা করে, ভিকটিমেরই দোষ ছিলো, ও কম জামাকাপড় পরে ধর্ষককে উস্কানি দিয়েছে। চোখের সামনে গিয়ে পেটিকোট মেলে দিলে কার মাথা ঠিক থাকে বলেন?! আপনার সামনে মেলে দিলে আপনি করতেন না ধর্ষন!

এদের চিনে রাখুন, ধর্ষক ও ধর্ষকের পক্ষে সাফাই গাওয়া দুইজনেই সমান অপরাধী। ধর্ষককে বিচারের মুখোমুখি করুন আর সাফাই গাওয়া লোকগুলোকে ৩ বেলা থাবরান। ৩ বেলা বন-চটকানা খেলে ধর্ষনের পক্ষে সাফাই গাওয়া লোকগুলো হয়ত পরেরবার সাফাই গাওয়ার আগে মৌন থাকবে। এমনকি যদি যেকোনো দেশের রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রী বা জাতিসংঘের মহাসচিবও ধর্ষনের পক্ষে সাফাই গাইতে আসে, তাকেও ৩ বেলা থাবরানো যেতে পারে।

আর বাদ থাকে রাষ্ট্র। রাষ্ট্রকে কোনোভাবেই ছাড় দেয়া যাবে না। রাষ্ট্রের উপর প্রবল চাপ তৈরী করতে হবে যেন ধর্ষকের সর্বোচ্চ শাস্তি হয়। বিচার এমন হবে না যেন কোনো নির্দোষ দোষী হয় বা ব্যাক্তিগত শত্রুতার জেরে কেউ ধর্ষকের তকমা পায়। আবার বিচার মানে এমন না, যে মনে হলো আর ক্রসফায়ারে দিয়ে দিলাম। বিচার ছাড়া রাষ্টীয় হত্যাকাণ্ড অপরাধকে আরো বাড়িয়ে দেয়। রাষ্ট্রকে ক্রমাগত চাপ দিয়ে যেতে হবে যেন সে দ্রুততম সময়ের মধ্যে সঠিক অপরাধীকে বিচারের মুখোমুখি করতে পারে। অপরাধীর যে কোনো পরিচয়ের উপরে রাষ্ট্র নিশ্চিত করবে যেন অপরাধী তার সাজা পায়। একজন অপরাধীও যদি আইন ও বিচারের ফাক গলে বের হয়, বাকী যারা আছে তারা অপরাধ করতে উৎসাহী হয়।

এখন ২০২০, স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র। এখানে নিজে ছাত্রলীগ করলে অপরাধ থেকে মাফ পাওয়া যায়, মামা যুবলীগ করলে অপরাধ থেকে মাফ পাওয়া যায়, বাপ স্বেচ্ছাসেবক লীগ করলে অপরাধ থেকে মাফ পাওয়া যায়, রাজনীতি করা লাগে না সামান্য সুসম্পর্ক থাকলেও অপরাধ থেকে মাফ পাওয়া যায়। পকেটে টাকা থাকলে অপরাধ থেকে মাফ পাওয়া যায়, ব্যবসায়ী-শিল্পপতি হলে অপরাধ থেকে মাফ পাওয়া যায়। অপরাধ করে বিচারের মুখোমুখি না হওয়ার জন্য এখানে আছে ১০১ টি কায়দা।

এর দায় কার? এর দায় আমাদের।

আমাদের বাচ্চারা বিকালে মাদ্রাসা থেকে এসে বলবে- বাবা... আল্লার ভয় দেখিয়ে হুজুর কি জানি করেছে, ওখান দিয়ে রক্ত পরছে। সেটাতে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করবেন পিতা। যাক হুজুর বলাৎকার করার পর মাদ্রাসার গ্রিলে ঝুলিয়ে দেয় নি বাচ্চাকে, যে ৮ বছরের বাচ্চা সুইসাইড করেছে। ৮ বছরের বাচ্চা না বোঝে বলাৎকার, না বোঝে সুইসাইড।

অথবা আমাদের বাচ্চারা আর স্কুল থেকে আসছেনা দেখে রাত ১১ টায় বের হয়ে দেখতে পাবো, বাসা থেকে ১ মাইল দুরে রাস্তার পাশে ঝোপে পরে আছে প্রিয়জনের রক্তাক্ত শরীর। ধর্ষনের পরে খুন। ধর্ষন যে করেছে তাকে আমি চিনবো। কিন্তু গণ্যমান্যরা এসে বলবে- বিষয়টা সেটেল করে ফেলো, ২০ হাজার টাকা দিবো। তাছাড়া ঘরে আরেকটা মেয়ে আছে, তার কথাওতো বিবেচনায় রাখতে হবে।

আমার মেয়ের বা বোনের ধর্ষনকারীরা চোখের সামনে ঘুরে বেড়াবে, দোকানে বসে চা খাবে, ভোটের সময় ভোট চাইতে আসবে। মিছিলের সামনে দেখা যাবে তাদের। পুলিশের কাছে নালিশ দিতে গেলে বলবে নালিশ নেয়া যাবে না, ধর্ষকরা অনেক বিচিঅলা লোক, বোঝেনিতো বিষয়টা। তারচেয়ে একটা দারোয়ানের চাকরি নেন, আমাদের ভারমুক্ত করেন।

স্ত্রীকে নিয়ে ঘুরতে বের হবো। আমার হাত মুখ বেঁধে রেখে ৫-৭ জন নেশাখোর বন্ধু মিলে ধর্ষন করবে আমার স্ত্রীকে। মজার দৃশ্য- ধর্ষন। বন্ধুরা মিলে একটু মজা করলে কি কোনো দোষ হয়, বলেন! আপনারাই বলেন।

এমন একটা বাংলাদেশ পেয়ে গর্বে আমাদের বুক ভরে যায়।

13 September 2020

ইরান-তুরস্ককে ঠেকাতে ইসরাইল-আরব জোট

 
 
সারা পৃথিবীর মুক্তিকামী মানুষ ইসরাইলকে মধ্যপ্রাচ্যের একটি অন্যতম দখলদার শক্তি হিসেবে দেখে থাকে। গত ৭২ বছর ধরে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার প্রশ্নে শান্তিকামী সকল মুসলমান ইসরাইল থেকে নির্দিষ্ট দুরত্ব বজায় রেখে আসছে। কিন্তু সম্প্রতি সেই দুরত্ব কমিয়ে আনছে বিভিন্ন আরব রাষ্ট্র।
 
জাতিসংঘ, যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ সমর্থনে ১৯৪৮ সালের ১৪ মে ফিলিস্তিনের অধিকৃত জমিতে প্রতিষ্ঠিত হয় ইসরাইল। আরব এবং মুসলমান রাষ্ট্রগুলো এই অন্যায় জবরদস্তিমূলক জমি অধিগ্রহণ মেনে নিতে পারে নি। ফলশ্রুতিতে ১৯৪৮, ১৯৫৬, ১৯৬৭ ও ১৯৭৩ সালে ইসরাইলের সাথে মোট ৪ বার আরব রাষ্ট্রগুলোর যুদ্ধ হয়। কিন্তু দুর্বল সমরনীতি, কূটনীতি ও গোয়েন্দাদের ব্যররথতায় প্রত্যেকটি যুদ্ধেই আরব রাষ্ট্রগুলো পরাজিত হয়। ইসরাইলকে অর্থ, অস্ত্র, প্রশিক্ষণ ও যাবতীয় রকম সাহায্য করে যুক্তরাজ্য-যুক্তরাষ্ট্র সহ পশ্চিমা শক্তি।
 
ইসরাইলকে রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে এবং ফিলিস্তিনিদের নিজের ভূমি থেকে সরিয়ে শরনার্থী বানাতে সমস্ত তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর প্রথম মুসলিমপ্রধান রাষ্ট্র হিসেবে তুরস্ক ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয় ১৯৪৯ সালে। কিন্তু ২০০৮ সালে ইসরাইলের গাজা আক্রমনের পর তুরস্ক-ইসরাইলের সম্পর্ক তলানিতে পৌঁছায়। ২০০৮-৯ সালে ইসরাইল গাজায় ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। তুরস্ক একটি ত্রাণবাহী জাহাজ গাজায় পাঠাতে চাইলে ইসরাইল তাতে বাঁধা দেয়। ইসরাইল গাজায় মানবিক ত্রাণ পৌঁছাতে না দিয়ে বরং জাহাজে আক্রমণ করে। সেই আক্রমনে ৯ জন তুর্কি নাগরিক নিহত হয়। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান এরপর আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ফোরামে ইসরাইলকে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করেন এবং ইসরাইলের সাথে যাবতীয় সম্পর্ক সীমিত করে নিয়ে আসেন।
 
ইসরাইলের সাথে ২য় মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে সম্পর্ক ছিলো ইরানের। পাহলভী রাজতন্ত্রের অধীনে ইরান আর ইসরাইলের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিলো। এই সম্পর্কের অনুঘটক ছিলো যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু ১৯৭৯ সালে ইরানের ইসলামি বিপ্লবের পর ইমাম খোমেনি সরকার ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে।
 
এরপর ইসরাইলের সাথে শান্তিচুক্তি করে মিসর ১৯৭৮ সালে। মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত, ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী মেনাচেম বেগিনের মধ্যে ক্যাম্প ডেভিড শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ১৯৭৮ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর। শান্তিচুক্তির উদ্যোক্তা ছিলেন নান আদার দেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার। সাদাত ও বেগিন শান্তিচুক্তির জন্য শান্তিতে নোবেলও পান ১৯৭৮ সালে। শান্তিচুক্তি হলেও সাদাতকে রক্ত দিয়ে পরিশোধ করতে হয়েছে এর মূল্য। ১৯৮১ তে এক অভ্যুত্থানে নিহত হন আনোয়ার সাদাত। মিসরের জনগণ আজও ইসরাইলকে শত্রুরাষ্ট্র গণ্য করে। ২০০৬ সালের এক জরিপে দেখা যায় ৯২% মিসরীয় ইসরাইলকে শত্রুরাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত করে।
 
ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিতে হলে জনগণের মতামতকে অগ্রাহ্য করতে হয়। হয় রাজতন্ত্র নাহয় স্বৈরাচারী সরকারই কেবল পারে ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিতে। যুক্তরাষ্ট্র তাই মধ্যপ্রাচ্যের জনগণের আধিকার আদায়ের বিরুদ্ধবাদী সাম্রাজ্যবাদী শক্তি এবং রাজতন্ত্র-স্বৈরতন্ত্রের প্রধান পৃষ্ঠপোষক। মিসরের স্বৈরশাসক হোসনি মোবারকের পতনের পর গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত মুরসি সরকারের সময় ইসরাইলের সাথে মিসরের ঘনিষ্ঠতা কমে আসে। কিন্তু মুরসিকে হঠিয়ে অবৈধভাবে ক্ষমতাদখলকারী প্রেসিডেন্ট সিসি আবার ইসরাইলের সাথে ঘনিষ্ঠ হচ্ছে। সিসিকে অবৈধভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকতে হলে ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ সাহায্য লাগবেই।
 
এরপর মুসলিমপ্রধান রাষ্ট্র হিসেবে জর্দান ইসরাইলের সাথে শান্তিচুক্তি করে ১৯৯৪ সালে। শান্তিচুক্তি করলেও জর্দান-ইসরাইল সম্পর্ক সুখকর হয় নি। ইসরাইল কর্তৃক বিতাড়িত ফিলিস্তিনি শর্নার্থী ও তাদের বংশধররা জর্দানের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক। ফিলিস্তিনি শরনার্থীদের প্রবল চাপে বিধ্বস্ত জর্দান তাই ইসরাইল থেকে নির্দিষ্ট দুরত্ব বজায় রাখে।
 
মধ্যপ্রাচ্যের ঘোলাটে রাজনীতিকে আরো উস্কে দিয়ে সুবিধা বের করে আনতে পারদর্শী যুক্তরাষ্ট্র, সুযোগ কাজে লাগাতে ওস্তাদ। এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের হাতিয়ার প্রায় ১০০ বছরের সাম্রাজ্যবাদী ইন্সটিংক্ট এবং মধ্যপ্রাচ্যের গণবিরোধী রাজতন্ত্র-স্বৈরতন্ত্র। ২০১১ সালে আরব রাষ্ট্রগুলোর জনতা দীর্ঘ শোষন-দুর্নীতি ও রাজতন্ত্র-স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠে। শুরু হয় জনতার স্বতঃস্ফুর্ত জাগরণ- আরব বসন্ত। আর অপরদিকে আরব বসন্ত থেকে সুবিধা বাগিয়ে নিতে উৎসুক যুক্তরাষ্ট্র সহ সাম্রাজ্যবাদী পশ্চিমা শক্তি।
 
আরব বসন্তের ঢেউ একেক রাষ্ট্রে একেকভাবে লাগে। ব্যাপক আন্দোলনে একে একে পতন হয় স্বৈরাচারী প্রেসিডেন্টদের। তিউনিসিয়ার প্রেসিডেন্ট জাইন আল আবেদীন বেন আলী, মিসরের প্রেসিডেন্ট হোসনি মুবারক, লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট মুয়াম্মার গাদ্দাফির পতন হয়। ব্যাপক সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে রাজতন্ত্রগুলো তখনকার মতো পরিস্থিতি সামাল দেয়। সৌদি আরব, বাহরাইন, জর্দান, ওমান, কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাজতন্ত্রের ভিত কাপিয়ে দেয় আরব বসন্ত। ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া ও ইয়েমেনে শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। গৃহযুদ্ধে শুরু হয় সাম্রাজ্যবাদীদের মজার খেলা- প্রক্সি ওয়ার; মাটি আপনার, যুদ্ধ আমার।
 
সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ কোনোক্রমেই ক্ষমতা ছাড়তে রাজি না হওয়ায়, বিরোধী পক্ষরা সশস্ত্র পথে হাঁটতে বাধ্য হয়। যুক্তরাষ্ট্র ও মধ্যপ্রাচ্যে তার অত্যন্ত ঘনিষ্ট ইসরাইল, সৌদি আরব, কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাত বিরোধীদের সবরকম সাহায্য দিতে থাকে। বাশার আল আসাদের সাহায্যে এগিয়ে আসে- রাশিয়া ও ইরান। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ হয়ে যায় সৌদি আরব বনাম ইরানের লড়াই, যুক্তরাষ্ট্র বনাম রাশিয়ার প্রেস্টিজ।
 
গৃহযুদ্ধ চলাকালীন দেশগুলোতে অর্থাৎ সিরিয়া, লিবিয়া ও ইয়েমেনে; সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার ও বাহরাইন যে পরিমান মেধা-অর্থ ব্যয় করেছে তার কিয়দাংশ নিজের দেশের জনগণের জন্য ব্যয় করলে সেসব দেশের রাজতন্ত্রে অতিষ্ট জনগণ আরো একটু সুখী হতে পারতো।
 
ইয়েমেনের পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ। সেখানে গৃহযুদ্ধের পাশাপাশি চলছে দুর্ভিক্ষ। অপুষ্টিতে ভোগা ইয়েমেনি শিশুরা ঘাস আর মাটি খেয়ে থাকছে। আর নিরস্ত্র ইয়েমেনিদের উপর নির্বিচারে বোমাবর্ষণ চলছে। বোমাবর্ষণ চলছে মসজিদে, বাজারে, হাসপাতালে এবং বেসামরিক এলাকায়। এন্ড অল ক্রেডিট গৌস টু, গেস হু...! দ্যা ওয়ান এন্ড ওনলি সৌদি আরব। ইয়েমেনে সৌদি আরবের সহযোগী সংযুক্ত আরব আমিরাত আর মুখোমুখি ইয়েমেনের যুদ্ধবিদ্ধস্ত জনগণ আর ইরান।
 
যে সৌদি আরব, মক্কা ও মদিনার পবিত্র দুই মসজিদের খাদেম, সারা পৃথিবীর মুসলমানের ভরসা এবং নির্ভরতার জায়গা; সাম্রাজ্যবাদকে সহযোগিতা করতে গিয়ে, রাজতন্ত্র টিকিয়ে রাখতে গিয়ে তার বিবেকবুদ্ধি লোপ পেয়েছে। একই সাথে বিবেকবুদ্ধি বিসর্জন দিয়ে, ফিলিস্তিনিদের দীর্ঘ মুক্তির সংগ্রামের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে, ইসরাইলের সাথে শান্তিচুক্তি করেছে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইন।
 
গত ১৩ আগস্ট সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ১১ সেপ্টেম্বর বাহরাইন, ইসরাইলের সাথে শান্তিচুক্তি করে। সৌদি আরবও ইসরাইলের সাথে ক্রমেই দুরত্ব কমিয়ে আনছে। আশা করা যায় মুহাম্মদ বিন সালমান যুবরাজ থাকতে থাকতেই সৌদি আরব ও ইসরাইলের সম্পর্ক স্থাপিত হয়ে যাবে। সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইনের হঠকারী এই সিদ্ধান্তকে আবার স্বাগত জানিয়েছে আরেক স্বৈরাচার মিসরের প্রেসিডেন্ট সিসি।
 
সিরিয়া-ইয়েমেন-লিবিয়া ফ্রন্টে ইরান ও তুরস্ককে ঠেকাতে না পেরে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন প্রভৃতি রাজতান্ত্রিক স্বৈরাচারি সরকার ইসরাইলের ঘনিষ্ঠ হচ্ছে। ইসরাইলের সাথে আরব এসকল রাষ্ট্রের যে কোনো রকম সম্পর্ক একটি স্বাধীন ফিলিস্তিনের স্বপ্নকে আরো দীর্ঘায়িত করবে এবং যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদকে শক্তি জোগাবে।