27 September 2020

পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রঃ মূল্যবোধের আলাপ


পারিবারিক মূল্যবোধের কথা বলি। পারিবারিক মূল্যবোধ আসবে কোত্থেকে? পরিবার নিজেই তো মূল্যবোধ শিখে আসে নি। পরিবার আসলে শেখায় ৩ বেলা খাওয়া, ১ বেলা ঘুম, পড়াশোনা শেখার নামে অসুস্থ প্রতিযোগিতা করা, ক্লাসে ১ম হতে হবে বিষয়ক নির্যাতন ইত্যাদি। পরিবারের ধারণা ক্লাসে ১ম হলে, ভালো চাকরি হবে, ভালো চাকরি হলে ছেলে আগামী জীবন ভালোভাবে খেয়েপরে বেঁচে থাকতে পারবে। খেয়েপরে বেঁচে থাকার টেকনিক শেখাই আমাদের পারিবারিক মূল্যবোধ।

অনেকে পরিবারের দোষ দিতে চায় না, বলে মাত্র ৩ জেনারেশন আগে আমরা কৃষক ছিলাম, অনেক যুদ্ধ-দাঙ্গা-ক্ষরা-দুর্ভিক্ষ থেকে আমাদের প্রবৃত্তি খাওয়াপরার সংগ্রামকেই জীবনের মূল্যবোধ হিসেবে আত্মস্থ করে নিয়েছে। ৩ জেনারেশন আগে কেবল আমরাই কৃষক ছিলাম না, পৃথিবীর বেশিরভাগ জাতিই কৃষক ছিলো। চাইনিজ, জাপানিজ, কোরিয়ানরাও ৩ জেনারেশন আগে কৃষক ছিলো। তারা কিভাবে পারিবারিক মূল্যবোধ শিখে গেলো!

যুদ্ধ-দাঙ্গা-ক্ষরা-দুর্ভিক্ষ এর ভেতর দিয়ে যায়নি, এমন জাতি একটাও নেই পৃথিবীতে। ক্ষেত্রবিশেষে তারা আমাদের চে আরো বেশি গিয়েছে। ১ম বিশ্বযুদ্ধের আগে আগে জাপান যখন কোরিয়া আর চীন দখল করে নিচ্ছিলো তখন জাপানে তাদের ব্যাপারে প্রবাদের মতো কিছু কথা প্রচলিত ছিলো- কোরিয়ানরা অলস আর চাইনিজরা মাথামোটা। অলস কোরিয়ান, মাথামোটা চাইনিজ আর দখলদার জাপানিজরা এখন কে কেমন আছে?

পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র, মানুষের জীবনের ৩ গুরুত্বপূর্ণ সংগঠন। মূল্যবোধের বিচারে এই তিনটার কার্যক্রমে খুব বেশি পার্থক্য নেই। পরিবার যাকে লোকমা দিয়ে খাওয়ায়, সমাজ তাকে ছায়া দিয়ে রাখে, রাষ্ট্রে সেই ধনে-মানে প্রতিষ্ঠিত হয়।

মানুষ আসলে অপরাধপ্রবণ প্রাণী। সুযোগ পেলেই অপরাধ করবে। কিন্তু খুন ও ধর্ষণ এমন অপরাধ যাকে কোনোভাবেই জাস্টিফাই করা যায় না। কেবলমাত্র নিজের জীবন ও সম্ভ্রম রক্ষা করা ছাড়া খুন করার কোনো কারণ থাকতে পারে না। মানুষ খুন করার চেয়ে বড় কোনো অপরাধ নেই। খুন তো তাও বলা যায় নিজেকে রক্ষার জন্য করা গেছে, ধর্ষনকে কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন।

ধর্ষন মানে আরেকজনকে ছোট করা, হেয় করা। তা সে নারী হোক বা পুরুষ হোক, সুস্থ হোক বা প্রতিবন্ধী হোক, বাচ্চা হোক বা বয়স্ক হোক। জোরজবরদস্তিমূলক পেশীতন্ত্রের প্রকট আলামত- ধর্ষন।

যে ধর্ষন করে সে বছরের ৩৬৫ দিন, দিনের ২৪ ঘণ্টা ধর্ষন করে বেড়ায় না। কিন্তু এটা এমন অপরাধ যাকে কোনোভাবেই ব্যাখ্যা করার কিছু নেই। একবার করে ফেললেই হয়ে গেলো। সারাবছর পেশীতন্ত্রের ভার বয়ে বেরানো মানুষটাই দিনশেষে ধর্ষক হয়ে উঠে। মানুষের সমাজ থেকে পুরোপুরি ধর্ষন বিলুপ্ত করা হয়ত সম্ভব না, কিন্তু তার লাগাম টেনে ধরা সম্ভব।

যদি পরিবার যথাযথভাবে তার বাচ্চাকে যৌন শিক্ষা দেয়, তাকে শেখায় যে যৌনকর্ম জোর করে করার বিষয় না। যৌনকর্ম একটি অত্যন্ত স্বাভাবিক আচরণ, যেটা আরেকজনের সম্মতিতে করতে হয়। এমনকি প্রত্যেকবার যৌনকর্মের আগে সম্মতি নেয়া প্রয়োজন। একবার সম্মত হলেই যে অপরজন পরেরবার সম্মত হবে এমন মনে করার কোন কারণ নেই। এছাড়া যৌনকর্ম মানবজাতির সদস্য বৃদ্ধির একটি স্বাভাবিক প্রবণতা। তুমিও এভাবে এসেছো, আমিও এভাবে এসেছি।

পরিবার থেকে বাচ্চাকে নিজের প্রাইভেট পার্টস শেখানো। তাকে শেখানো, এগুলো তোমার এমন নিজস্ব অংগ, যেগুলো এমনকি বাবা-দাদারো ধরার অধিকার নেই।

মানুষকে মানুষ হিসেবে সম্মান করতে শেখানো। নারী বা পুরুষ, সাদা বা কালো, প্রতিবন্ধী বা দুর্বল, বাঙ্গালী বা আদিবাসি, মুসলমান বা হিন্দু হিসেবে নয়। সকল মানুষই মানুষ, কেউ আপনার চেয়ে ছোট বা বড় নয়। আরেকজনকে একটু অন্যরকম দেখা যায় তাই সে আমার চেয়ে নিচে বা উপরে, কেউ আপনার ধর্ম পালন করে না তাই সে আপনার চেয়ে নিচে, কেউ কিছু টাকাপয়সা করে ফেলেছে বা রাজনীতি করে বলে আপনার চেয়ে উপরে, এমনটা নয়। সবার আগে পরিবার থেকে শেখান, সকল মানুষ সমান। সকল মানুষ সমান...

সমাজের দায়িত্ব ধর্ষককে সামাজিকভাবে বয়কট করা। কিছু লোক থাকে যারা ধর্ষকের পক্ষে সাফাই গায়, নিতান্ত নিরুপায় হয়ে ও এই ধর্ষনটা করতে বাধ্য হয়েছে টাইপ বক্তব্য দেয়। কেউ আবার বলার চেষ্টা করে, ভিকটিমেরই দোষ ছিলো, ও কম জামাকাপড় পরে ধর্ষককে উস্কানি দিয়েছে। চোখের সামনে গিয়ে পেটিকোট মেলে দিলে কার মাথা ঠিক থাকে বলেন?! আপনার সামনে মেলে দিলে আপনি করতেন না ধর্ষন!

এদের চিনে রাখুন, ধর্ষক ও ধর্ষকের পক্ষে সাফাই গাওয়া দুইজনেই সমান অপরাধী। ধর্ষককে বিচারের মুখোমুখি করুন আর সাফাই গাওয়া লোকগুলোকে ৩ বেলা থাবরান। ৩ বেলা বন-চটকানা খেলে ধর্ষনের পক্ষে সাফাই গাওয়া লোকগুলো হয়ত পরেরবার সাফাই গাওয়ার আগে মৌন থাকবে। এমনকি যদি যেকোনো দেশের রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রী বা জাতিসংঘের মহাসচিবও ধর্ষনের পক্ষে সাফাই গাইতে আসে, তাকেও ৩ বেলা থাবরানো যেতে পারে।

আর বাদ থাকে রাষ্ট্র। রাষ্ট্রকে কোনোভাবেই ছাড় দেয়া যাবে না। রাষ্ট্রের উপর প্রবল চাপ তৈরী করতে হবে যেন ধর্ষকের সর্বোচ্চ শাস্তি হয়। বিচার এমন হবে না যেন কোনো নির্দোষ দোষী হয় বা ব্যাক্তিগত শত্রুতার জেরে কেউ ধর্ষকের তকমা পায়। আবার বিচার মানে এমন না, যে মনে হলো আর ক্রসফায়ারে দিয়ে দিলাম। বিচার ছাড়া রাষ্টীয় হত্যাকাণ্ড অপরাধকে আরো বাড়িয়ে দেয়। রাষ্ট্রকে ক্রমাগত চাপ দিয়ে যেতে হবে যেন সে দ্রুততম সময়ের মধ্যে সঠিক অপরাধীকে বিচারের মুখোমুখি করতে পারে। অপরাধীর যে কোনো পরিচয়ের উপরে রাষ্ট্র নিশ্চিত করবে যেন অপরাধী তার সাজা পায়। একজন অপরাধীও যদি আইন ও বিচারের ফাক গলে বের হয়, বাকী যারা আছে তারা অপরাধ করতে উৎসাহী হয়।

এখন ২০২০, স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র। এখানে নিজে ছাত্রলীগ করলে অপরাধ থেকে মাফ পাওয়া যায়, মামা যুবলীগ করলে অপরাধ থেকে মাফ পাওয়া যায়, বাপ স্বেচ্ছাসেবক লীগ করলে অপরাধ থেকে মাফ পাওয়া যায়, রাজনীতি করা লাগে না সামান্য সুসম্পর্ক থাকলেও অপরাধ থেকে মাফ পাওয়া যায়। পকেটে টাকা থাকলে অপরাধ থেকে মাফ পাওয়া যায়, ব্যবসায়ী-শিল্পপতি হলে অপরাধ থেকে মাফ পাওয়া যায়। অপরাধ করে বিচারের মুখোমুখি না হওয়ার জন্য এখানে আছে ১০১ টি কায়দা।

এর দায় কার? এর দায় আমাদের।

আমাদের বাচ্চারা বিকালে মাদ্রাসা থেকে এসে বলবে- বাবা... আল্লার ভয় দেখিয়ে হুজুর কি জানি করেছে, ওখান দিয়ে রক্ত পরছে। সেটাতে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করবেন পিতা। যাক হুজুর বলাৎকার করার পর মাদ্রাসার গ্রিলে ঝুলিয়ে দেয় নি বাচ্চাকে, যে ৮ বছরের বাচ্চা সুইসাইড করেছে। ৮ বছরের বাচ্চা না বোঝে বলাৎকার, না বোঝে সুইসাইড।

অথবা আমাদের বাচ্চারা আর স্কুল থেকে আসছেনা দেখে রাত ১১ টায় বের হয়ে দেখতে পাবো, বাসা থেকে ১ মাইল দুরে রাস্তার পাশে ঝোপে পরে আছে প্রিয়জনের রক্তাক্ত শরীর। ধর্ষনের পরে খুন। ধর্ষন যে করেছে তাকে আমি চিনবো। কিন্তু গণ্যমান্যরা এসে বলবে- বিষয়টা সেটেল করে ফেলো, ২০ হাজার টাকা দিবো। তাছাড়া ঘরে আরেকটা মেয়ে আছে, তার কথাওতো বিবেচনায় রাখতে হবে।

আমার মেয়ের বা বোনের ধর্ষনকারীরা চোখের সামনে ঘুরে বেড়াবে, দোকানে বসে চা খাবে, ভোটের সময় ভোট চাইতে আসবে। মিছিলের সামনে দেখা যাবে তাদের। পুলিশের কাছে নালিশ দিতে গেলে বলবে নালিশ নেয়া যাবে না, ধর্ষকরা অনেক বিচিঅলা লোক, বোঝেনিতো বিষয়টা। তারচেয়ে একটা দারোয়ানের চাকরি নেন, আমাদের ভারমুক্ত করেন।

স্ত্রীকে নিয়ে ঘুরতে বের হবো। আমার হাত মুখ বেঁধে রেখে ৫-৭ জন নেশাখোর বন্ধু মিলে ধর্ষন করবে আমার স্ত্রীকে। মজার দৃশ্য- ধর্ষন। বন্ধুরা মিলে একটু মজা করলে কি কোনো দোষ হয়, বলেন! আপনারাই বলেন।

এমন একটা বাংলাদেশ পেয়ে গর্বে আমাদের বুক ভরে যায়।

No comments:

Post a Comment