সারা পৃথিবীর মুক্তিকামী মানুষ ইসরাইলকে মধ্যপ্রাচ্যের একটি
অন্যতম দখলদার শক্তি হিসেবে দেখে থাকে। গত ৭২ বছর ধরে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার
প্রশ্নে শান্তিকামী সকল মুসলমান ইসরাইল থেকে নির্দিষ্ট দুরত্ব বজায় রেখে আসছে।
কিন্তু সম্প্রতি সেই দুরত্ব কমিয়ে আনছে বিভিন্ন আরব রাষ্ট্র।
জাতিসংঘ, যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ সমর্থনে
১৯৪৮ সালের ১৪ মে ফিলিস্তিনের অধিকৃত জমিতে প্রতিষ্ঠিত হয় ইসরাইল। আরব এবং মুসলমান
রাষ্ট্রগুলো এই অন্যায় জবরদস্তিমূলক জমি অধিগ্রহণ মেনে নিতে পারে নি। ফলশ্রুতিতে
১৯৪৮, ১৯৫৬, ১৯৬৭ ও ১৯৭৩ সালে ইসরাইলের সাথে মোট ৪ বার আরব রাষ্ট্রগুলোর যুদ্ধ হয়।
কিন্তু দুর্বল সমরনীতি, কূটনীতি ও গোয়েন্দাদের ব্যররথতায় প্রত্যেকটি যুদ্ধেই আরব
রাষ্ট্রগুলো পরাজিত হয়। ইসরাইলকে অর্থ, অস্ত্র, প্রশিক্ষণ ও যাবতীয় রকম সাহায্য
করে যুক্তরাজ্য-যুক্তরাষ্ট্র সহ পশ্চিমা শক্তি।
ইসরাইলকে রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে এবং ফিলিস্তিনিদের
নিজের ভূমি থেকে সরিয়ে শরনার্থী বানাতে সমস্ত তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র।
ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর প্রথম মুসলিমপ্রধান রাষ্ট্র হিসেবে তুরস্ক ইসরাইলকে
স্বীকৃতি দেয় ১৯৪৯ সালে। কিন্তু ২০০৮ সালে ইসরাইলের গাজা আক্রমনের পর
তুরস্ক-ইসরাইলের সম্পর্ক তলানিতে পৌঁছায়। ২০০৮-৯ সালে ইসরাইল গাজায় ব্যাপক
ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। তুরস্ক একটি ত্রাণবাহী জাহাজ গাজায় পাঠাতে চাইলে ইসরাইল তাতে
বাঁধা দেয়। ইসরাইল গাজায় মানবিক ত্রাণ পৌঁছাতে না দিয়ে বরং জাহাজে আক্রমণ করে। সেই
আক্রমনে ৯ জন তুর্কি নাগরিক নিহত হয়। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান এরপর
আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ফোরামে ইসরাইলকে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করেন এবং ইসরাইলের সাথে
যাবতীয় সম্পর্ক সীমিত করে নিয়ে আসেন।
ইসরাইলের সাথে ২য় মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে সম্পর্ক ছিলো
ইরানের। পাহলভী রাজতন্ত্রের অধীনে ইরান আর ইসরাইলের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক
ছিলো। এই সম্পর্কের অনুঘটক ছিলো যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু ১৯৭৯ সালে ইরানের ইসলামি
বিপ্লবের পর ইমাম খোমেনি সরকার ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন
করে।
এরপর ইসরাইলের সাথে শান্তিচুক্তি করে মিসর ১৯৭৮ সালে।
মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত, ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী মেনাচেম বেগিনের মধ্যে ‘ক্যাম্প ডেভিড শান্তিচুক্তি’ স্বাক্ষরিত হয় ১৯৭৮ সালের ১৭
সেপ্টেম্বর। শান্তিচুক্তির উদ্যোক্তা ছিলেন ‘নান আদার দেন’ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার। সাদাত ও বেগিন
শান্তিচুক্তির জন্য শান্তিতে নোবেলও পান ১৯৭৮ সালে। শান্তিচুক্তি হলেও সাদাতকে
রক্ত দিয়ে পরিশোধ করতে হয়েছে এর মূল্য। ১৯৮১ তে এক অভ্যুত্থানে নিহত হন আনোয়ার
সাদাত। মিসরের জনগণ আজও ইসরাইলকে শত্রুরাষ্ট্র গণ্য করে। ২০০৬ সালের এক জরিপে দেখা
যায় ৯২% মিসরীয় ইসরাইলকে শত্রুরাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত করে।
ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিতে হলে জনগণের মতামতকে অগ্রাহ্য করতে
হয়। হয় রাজতন্ত্র নাহয় স্বৈরাচারী সরকারই কেবল পারে ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিতে।
যুক্তরাষ্ট্র তাই মধ্যপ্রাচ্যের জনগণের আধিকার আদায়ের বিরুদ্ধবাদী সাম্রাজ্যবাদী
শক্তি এবং রাজতন্ত্র-স্বৈরতন্ত্রের প্রধান পৃষ্ঠপোষক। মিসরের স্বৈরশাসক হোসনি
মোবারকের পতনের পর গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত মুরসি সরকারের সময় ইসরাইলের সাথে
মিসরের ঘনিষ্ঠতা কমে আসে। কিন্তু মুরসিকে হঠিয়ে অবৈধভাবে ক্ষমতাদখলকারী ‘প্রেসিডেন্ট সিসি’ আবার ইসরাইলের সাথে ঘনিষ্ঠ হচ্ছে।
সিসিকে অবৈধভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকতে হলে ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ
সাহায্য লাগবেই।
এরপর মুসলিমপ্রধান রাষ্ট্র হিসেবে জর্দান ইসরাইলের সাথে
শান্তিচুক্তি করে ১৯৯৪ সালে। শান্তিচুক্তি করলেও জর্দান-ইসরাইল সম্পর্ক সুখকর হয়
নি। ইসরাইল কর্তৃক বিতাড়িত ফিলিস্তিনি শর্নার্থী ও তাদের বংশধররা জর্দানের মোট
জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক। ফিলিস্তিনি শরনার্থীদের প্রবল চাপে বিধ্বস্ত জর্দান তাই
ইসরাইল থেকে নির্দিষ্ট দুরত্ব বজায় রাখে।
মধ্যপ্রাচ্যের ঘোলাটে রাজনীতিকে আরো উস্কে দিয়ে সুবিধা বের
করে আনতে পারদর্শী যুক্তরাষ্ট্র, সুযোগ কাজে লাগাতে ওস্তাদ। এ বিষয়ে
যুক্তরাষ্ট্রের হাতিয়ার প্রায় ১০০ বছরের সাম্রাজ্যবাদী ইন্সটিংক্ট এবং
মধ্যপ্রাচ্যের গণবিরোধী রাজতন্ত্র-স্বৈরতন্ত্র। ২০১১ সালে আরব রাষ্ট্রগুলোর জনতা
দীর্ঘ শোষন-দুর্নীতি ও রাজতন্ত্র-স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠে। শুরু হয় জনতার
স্বতঃস্ফুর্ত জাগরণ- ‘আরব বসন্ত’। আর
অপরদিকে আরব বসন্ত থেকে সুবিধা বাগিয়ে নিতে উৎসুক যুক্তরাষ্ট্র সহ সাম্রাজ্যবাদী
পশ্চিমা শক্তি।
আরব বসন্তের ঢেউ একেক রাষ্ট্রে একেকভাবে লাগে। ব্যাপক
আন্দোলনে একে একে পতন হয় স্বৈরাচারী প্রেসিডেন্টদের। তিউনিসিয়ার প্রেসিডেন্ট জাইন
আল আবেদীন বেন আলী, মিসরের প্রেসিডেন্ট হোসনি মুবারক, লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট
মুয়াম্মার গাদ্দাফির পতন হয়। ব্যাপক সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে রাজতন্ত্রগুলো
তখনকার মতো পরিস্থিতি সামাল দেয়। সৌদি আরব, বাহরাইন, জর্দান, ওমান, কাতার ও
সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাজতন্ত্রের ভিত কাপিয়ে দেয় আরব বসন্ত। ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া
ও ইয়েমেনে শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। গৃহযুদ্ধে শুরু হয় সাম্রাজ্যবাদীদের মজার খেলা- ‘প্রক্সি ওয়ার’; মাটি আপনার, যুদ্ধ আমার।
সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ কোনোক্রমেই ক্ষমতা ছাড়তে
রাজি না হওয়ায়, বিরোধী পক্ষরা সশস্ত্র পথে হাঁটতে বাধ্য হয়। যুক্তরাষ্ট্র ও
মধ্যপ্রাচ্যে তার অত্যন্ত ঘনিষ্ট ইসরাইল, সৌদি আরব, কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাত
বিরোধীদের সবরকম সাহায্য দিতে থাকে। বাশার আল আসাদের সাহায্যে এগিয়ে আসে- রাশিয়া ও
ইরান। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ হয়ে যায় সৌদি আরব বনাম ইরানের লড়াই, যুক্তরাষ্ট্র বনাম
রাশিয়ার প্রেস্টিজ।
গৃহযুদ্ধ চলাকালীন দেশগুলোতে অর্থাৎ সিরিয়া, লিবিয়া ও
ইয়েমেনে; সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার ও বাহরাইন যে পরিমান মেধা-অর্থ ব্যয়
করেছে তার কিয়দাংশ নিজের দেশের জনগণের জন্য ব্যয় করলে সেসব দেশের রাজতন্ত্রে
অতিষ্ট জনগণ আরো একটু সুখী হতে পারতো।
ইয়েমেনের পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ। সেখানে গৃহযুদ্ধের পাশাপাশি
চলছে দুর্ভিক্ষ। অপুষ্টিতে ভোগা ইয়েমেনি শিশুরা ঘাস আর মাটি খেয়ে থাকছে। আর
নিরস্ত্র ইয়েমেনিদের উপর নির্বিচারে বোমাবর্ষণ চলছে। বোমাবর্ষণ চলছে মসজিদে,
বাজারে, হাসপাতালে এবং বেসামরিক এলাকায়। এন্ড অল ক্রেডিট গৌস টু, গেস হু...! দ্যা
ওয়ান এন্ড ওনলি সৌদি আরব। ইয়েমেনে সৌদি আরবের সহযোগী সংযুক্ত আরব আমিরাত আর
মুখোমুখি ইয়েমেনের যুদ্ধবিদ্ধস্ত জনগণ আর ইরান।
যে সৌদি আরব, মক্কা ও মদিনার পবিত্র দুই মসজিদের খাদেম,
সারা পৃথিবীর মুসলমানের ভরসা এবং নির্ভরতার জায়গা; সাম্রাজ্যবাদকে সহযোগিতা করতে
গিয়ে, রাজতন্ত্র টিকিয়ে রাখতে গিয়ে তার বিবেকবুদ্ধি লোপ পেয়েছে। একই সাথে
বিবেকবুদ্ধি বিসর্জন দিয়ে, ফিলিস্তিনিদের দীর্ঘ মুক্তির সংগ্রামের সাথে
বিশ্বাসঘাতকতা করে, ইসরাইলের সাথে শান্তিচুক্তি করেছে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও
বাহরাইন।
গত ১৩ আগস্ট সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ১১ সেপ্টেম্বর বাহরাইন,
ইসরাইলের সাথে শান্তিচুক্তি করে। সৌদি আরবও ইসরাইলের সাথে ক্রমেই দুরত্ব কমিয়ে
আনছে। আশা করা যায় মুহাম্মদ বিন সালমান যুবরাজ থাকতে থাকতেই সৌদি আরব ও ইসরাইলের
সম্পর্ক স্থাপিত হয়ে যাবে। সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইনের হঠকারী এই সিদ্ধান্তকে
আবার স্বাগত জানিয়েছে আরেক স্বৈরাচার মিসরের প্রেসিডেন্ট সিসি।
সিরিয়া-ইয়েমেন-লিবিয়া ফ্রন্টে ইরান ও তুরস্ককে ঠেকাতে না
পেরে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন প্রভৃতি রাজতান্ত্রিক স্বৈরাচারি
সরকার ইসরাইলের ঘনিষ্ঠ হচ্ছে। ইসরাইলের সাথে আরব এসকল রাষ্ট্রের যে কোনো রকম
সম্পর্ক একটি স্বাধীন ফিলিস্তিনের স্বপ্নকে আরো দীর্ঘায়িত করবে এবং যুক্তরাষ্ট্রের
সাম্রাজ্যবাদকে শক্তি জোগাবে।
No comments:
Post a Comment