আব্বু, তুমি যত দিন পেটের ভেতর আছো, ততদিনই আমি তোমাকে রক্ষা করতে পারবো। আমার মনে হয়, তুমি হাজার বছর আমার পেটের ভেতর থাকো। এখান থেকে আমি তোমাকে বের করবো না। তোমার নানু কি বলেছে জানো! তোমাকে দুনিয়ায় রাখা ঠিক হবে না।তুমি তো আমার পেটের মধ্যে এই দুনিয়াতেই আছো। আছো না।
ফুলে
ওঠা ৯ মাসের পেঠে হাত বোলাতে বোলাতে এই কথাগুলো ভাবছিলো মেয়েটি। পাশের রুম থেকে মেয়েটির
মা এসে বললো, ‘এতো মায়া বাড়াইয়া লাভ নাই… এই বাচ্চা থাকলে তরে আর বিয়া দেওন যাইবো
না… আকাম করার টাইমে মনে আছিল না…’
‘আকাম
কি আমি একলা করছি নাকি… তুমি খালি আমারে বকো…’
‘বকবো
না… আদর করবো… কখন ব্যাথা উঠে লগে লগে জানাবি… একদম দেরি করবি না… আবার কান্দা শুরু
করছে… খালি কান্দে… এহন কাইন্দা লাভ আছে আর…’ বলে আবার পাশের রুমে চলে যায় মেয়েটির
মা।
দেখছো
তোমার নানু তোমারে তাড়াতাড়ি বের করে ফেলতে চায়। আমি তো চাই না আব্বু। আমি চাই তুমি
আমার পেটে হাজার হাজার বছর থাকো। তুমি আমার সাথে মারা যাও, আর নইলে আমাকে তোমার সাথে
নিয়ে যাও।
পেটে
হাত বোলাতে বোলাতে কাদতে থাকে মেয়েটি। কাদতে কাদতে ভাবে,
আব্বু,
তোমাকে আমি কোনো নাম দিইনি। তুমি হয়তো এই দুনিয়ায় আসার পর ১০ মিনিট বাচবে। তুমি আমাকে
১০ মিনিট দেখবে। যে তোমাকে ১০ মাস পেটে রাখলো, তাকে তুমি দেখবে ১০ মিনিট। তুমি তোমার
সারা জীবনেও আমাকে মা বলে ডাকতে পারবে না। যে তোমাকে পেটে রেখে বড় করলো, সেই তোমাকে
নিজের কাছে রাখতে পারবে না। তোমাকে পেল-পুষে বড় করতে পারবে না। তোমাকে খাইয়ে দিতে পারবে
না, ঘুম পাড়িয়ে দিতে পারবে না, কোলে নিতে পারবে না।
বিশ্বাস
করো আব্বু, আমি সারা জীবন তোমার স্মৃতি বহন করবো। তোমার মাধ্যমেই আমি মা হতে যাচ্ছি।
তুমি যখন আমার পেটে আসো, আমি প্রথমে বুঝিনি। তুমি আমার প্রথম প্রেমের ফুল, আমি কিভাবে
লোকেদের বুঝাবো। তুমি যখন আমার ভেতরে বেড়ে উঠতে থাকলে, আমি টের পেলাম তুমি আমার ভেতর
আছো, জানো আমি কতো ভয় পেয়েছিলাম। লোকলজ্জার ভয়ে আমি সারারাত কেদেছি। মানুষকে আমি কি
বলবো, ভেবে দুশ্চিন্তা করেছি। অথচ দেখো, আমি তোমার মা, তুমি আমার সন্তান। আর আমাদের
মাঝে এক ভারী দেয়ালের মতো এই পরিবার, সমাজ আর লোকজন।
আমার
আব্বু, আমি জানি, তুমি আমার কথা বুঝতে পারো, তুমি আমার কথা শুনতে পাও। তুমি তোমার হাত-পা
বুলিয়ে দেখো, বাইরের দুনিয়া ঠিক আছে কি না। আব্বু বাইরের এই দুনিয়া, বড়ই নিষ্ঠুর। তারা
তোমাকে বাচতে দিতে চায় না। কারণ তোমার বাবা, তুমি পেটে আসার পর আর তোমাকে চায় না। তোমার
বাবা বলেছে, আমাকে আর বিয়ে করবে না। আমার কোনো আফসোস নেই। তোমার বাবার মতো ভীরু লোকের
সাথে সারা জীবন থাকা যায় না। তোমার বাবা আরও কি বলেছে জানো, তুমি না কি ভুল করে হয়েছো।
তুমি কি ভুল করে হয়েছো আব্বু! ভুল নাহয় আমার আর তোমার বাবার হয়েছে। তোমার কি ভুল হয়েছে!
তুমি তো আর বলোনি, আমাকে দুনিয়ায় আনো। তুমি তো আমাদের প্রেমের ফুল।
তুমি
যখন আমার পেটের ভেতর নড়াচড়া করো, আমার ভালো লাগে। আবার কষ্ট লাগে। আমি যদি তোমাকে এভাবে
সারা জীবন আগলে রাখতে পারতাম! আমি যদি তোমাকে সারা জীবন দুনিয়ার এসব মানুষের কথা আর
চিন্তা থেকে বাচাতে পারতাম! আমাকে তুমি মাফ করে দিও আব্বু।
মানুষের
পেটে যখন বাবু আসে তখন তারা কত্তো খুশি হয়! আমি কতো দেখেছি! আর দেখো আব্বু, আমি নিজে
খুশি হতে পারছি না। আমি তোমাকে নিয়ে ভয় আর আশঙ্কায় আছি। রাতে রাতে আমার ঘুম আসে না।
তুমি কখন নড়ে ওঠো, আর আমি যদি সেটা টের না পাই। আর কয়েকদিনের মধ্যেই আমি আর তুমি আলাদা
হয়ে যাবো। এরপর আমি তোমাকে হারিয়ে ফেলবো। আব্বু আমি তোমাকে রাখতে না পারলে আমাকে মাফ
করে দিও।
আর
আব্বু শোনো, আল্লার কাছে ফিরে গিয়ে তোমার বাবার নামে বিচার দিবে। তোমার নানুর নামেও
বিচার দিও। যারা তোমাকে এই দুনিয়ায় থাকতে দিতে চায় না, তাদের সবার নামে বিচার দিবা।
আখিরাতে তুমি তাদের ডেকে ডেকে জিজ্ঞাসা করবে, জন্ম দেওয়ার মালিক আল্লাহ। তোমরা কারা,
যারা আল্লার দুনিয়ায়, আল্লার সৃষ্টি উপহারকে রাখতে দিতে চাও না। আল্লার কাছে বিচার
দিবে না আব্বু?
আর
আমার ব্যাপারে আল্লার কাছে বলবে, আমার আম্মু আমাকে খুব ভালোবেসেছে। আমার আসার খবর পেয়ে
খুশি হয়েছে। আবার লোকজনের কথা ভেবে ভয় পেয়েছে। আমার সাথে রাত জেগে কথা বলেছে। আমার
জন্য চোখের পানি ফেলেছে। বলবে না, আব্বু?
সবকিছু
বুঝতে পেরেই হয়ত পেটের ভেতর নড়াচড়া করা বন্ধ করে দিলো বাবুটা। ওর মা পেতে হাত দিয়ে
শুয়ে থাকলো আর কিছুক্ষণ। সকাল বেলা ওর হাসপাতালে যাওয়ার কথা। কাঁদতে কাঁদতে ওর চোখের
পানি শুকিয়ে গেছে। শূন্য চোখে তাকিয়ে আছে মেয়েটা।
পরদিন
একটা সংবাদপত্রে খবর প্রকাশ হলো-
কিছু ছিন্নমূল শিশু খেলতে গিয়ে একটা শুকনো নালায় এক নবজাতকের গলা কাটা মরদেহ দেখতে পায়। ঐ নালাটি একটি সরকারি হাসপাতাল থেকে দুই মিনিটের হাঁটা দূরত্বেভ দূরে। পুলিশ এ ঘটনায় ঐ হাসপাতালের তিন নার্সকে গ্রেপ্তার করেছে। পুলিশ ঘটনাটি তদন্ত করছে। পুলিশ ধারনা করছে, কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারন থেকে এ ঘটনা ঘটে থাকতে পারে।
No comments:
Post a Comment