29 May 2016

একটি দুঃস্বপ্নের এক নিযুতাংশ

আমরা যারা মনে করতাম, বিশ্ববিদ্যালয়ের রাস্তায় সক্রেটিসরাহাটেন আমাদের স্বপ্নগুলো ঘুরে বেড়াতো কল্পিত পাঠকক্ষে, যেখানে ক্লাস নেবেন এরিস্টটল আমরা যারা দিবাস্বপ্নে বিভোর ছিলাম, বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার খুঁজলে হয়তো এখনো কয়েকজন মার্ক্সপাওয়া যাবে আফসোস! এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথাগত শিক্ষাস্তরের শেষ সীমায় এসে আমরা জানি, এখানে শুধু পাওয়া যায় ছাত্রদের বিষাক্ত ফুসফুস

যে বিশ্ববিদ্যালয়কে মনে করা হয়, জ্ঞানের সর্ব্বোচ্চ বিদ্যাপিঠ এখনো প্রত্যন্ত অঞ্চলের লোকেরা মেপে কথা বলে, বিশ্ববিদ্যালয় ফেরত বলে যে বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য, জাতি বা মানবজাতির উন্নতি সাধন, তার হাকিকত কেমন এখন?

সারা বাংলাদেশের বাদবাকী বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্হা সম্পর্কে কানাঘুষা শুনলেও, আমি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা পরিস্থিতি বিষয়ে কিছুটা ওয়াকিবহাল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত বিভাগ বিষয়ে কিছুটা জানলেও, লোক প্রশাসন বিভাগের ব্যাপারে আমি বেশি সচেতন (এই বেশি সচেতনতা আবার ক্ষয়ক্ষতির কারন হবে নাতো!)

মনে সন্দেহ নিয়ে বলি, একটি মধ্যবর্তী সময়ের কথা তার আগের বা পরের লোক প্রশাসন বিভাগ, ভালো বা খারাপ বা অতি ভালো বা অতি খারাপ, সে বিচারের ভার আমার নয় কিন্তু সে মধ্যবর্তী সময়, যে কোনো মধ্যবর্তী অবস্থার মতই দু:স্বপ্নের জন্মদাত্রী

কল্পনা করি, লোক প্রশাসন বিভাগে একজন নতুন শিক্ষিকা এসেছেন, যার নাম নছিমন চৌধুরী প্রথম দেখাতেই বিভাগের ছাত্ররা তাকে পছন্দ করে ফেললো তার কানের দুলের সাথে ম্যাচিং জুতা, তার হাঁটা, তার চাহনীতে ছাত্ররা মুগ্ধ তারা ধারনা করলো, শিক্ষিকা নিশ্চয় মহান নিশ্চয় তিনি মাতৃস্নেহে গড়ে তুলবেন কোমল হৃদয় গড়বেন ছাত্রদের, বহি:জগত সম্পর্কে শক্ত ভিত দিয়ে আমার মতো সবাই তখন স্বপ্নে মত্ত হলো (কিন্তু ম্যাচিং জুতো দিয়ে কি আর শিক্ষকতা হয়!)

প্রায় দিন দশেক পর ছাত্ররা ঘুম থেকে জেগে উঠতে বাধ্য হলো তাও প্রবল বর্বর ঝাঁকুনিতে তারা তাদের চিন্তা বদলাতে বাধ্য হলো তারা জানতোনা তাদের সামনে কি অপেক্ষা করছে! হুট করে একদিন ক্লাসে ঢুকতে গিয়ে দেখি, ক্লাসের দরজা বন্ধ বহুবার ভেবেছি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা ক্লাসে ঢুকে বলবেন, ‍‍‍‍‍‍‍‌‌“দুই দরোজাই খোলা যার ইচ্ছা বের হয়ে যাবা, যার ইচ্ছা আসবা শুধু আমার চিন্তায় আর কথায় ব্যাঘাত ঘটাবানাতারপর দেখতে দেখতে ক্লাস ভর্তি মুগ্ধ হয়ে ছাত্ররা শিক্ষকের কথা গিলছে গিলছে আর গিলছে শিক্ষকও আপন মনে বলে চলেছেন তার উত্তরসূরীরা আরও জ্ঞানী হবে এই তিনি চান

কি?” ভেতর থেকে চিৎকারের আওয়াজ শুনি অবশ্য একটু আগেই আমি দরোজায় নক করেছিলাম যাই হোক দরজা খোলা হলো ক্লাসে গিয়ে বসলাম পরে শুনি, নছিমন চৌধুরীনতুন নিয়মনতুন করে বানানোর মহান দায়িত্ব নিজ কাধে তুলে নিয়েছেন প্রথম নিয়ম- ‘তিনি ক্লাসে ঢুকলেই, ক্লাসের দরজা বন্ধ ছাত্রতো বটেই, একটা অক্সিজেন অনুও বিনা অনুমতিতে ক্লাসে ঢুকতে পারবে না, বেরও হতে পারবে না ক্লাসে ঢুকতে স্বামর্থ হলেও, এটেন্ডেন্সের মার্ক্স পাবে না
আমরা যারা তারপরো শিক্ষিকাকে মমতাময়ী ভাবতে চাইতাম, তারা ক্লাসে উনার আগেই উপস্থিত হতাম এটেন্ডেন্সের মার্কসের লোভে নয় বটেই, ক্লাস করার লোভে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস, জ্ঞানীদের আলোচনার খোলা ময়দান সে ময়দানে আলোচনার লোভও বাদ দিতে হলো বন্ধু নাহিদ পাশ থেকে জিজ্ঞাসা করলো- “কিন্তু এখানে আমার আপত্তি আছে কেনো আমরা প্রশাসনকে জনমুখী করে তোলার বিপরীতে, প্রশাসনবাজার করতে চাচ্ছি? এটা কি আমাদের প্রশাসনে ঔপনিবেশিক ফলাফল নয়?” শিক্ষক বলবেন- “তোমার আপত্তি ঠিকই আছে, নাহিদ তবে তুমি ব্যাপারটা ভিন্নভাবে দেখতে পারো তুমিতো এভাবেও দেখতে পারো, প্রশাসন বাজার না হয়ে, সেবা নিয়ে জনগনের কাছে পৌছাচ্ছে এবং প্রশাসনযন্ত্র সচল রাখার জন্য অর্থ নিচ্ছে তবে আমার মনে হয় কি…” বাক্যটা আপাতত থাক নছিমন চৌধুরীর দ্বিতীয় নিয়ম- ‘ক্লাস লেকচারের মাঝখানে কোনো প্রশ্ন করা যাবে না তাতে আলোচনার বিরাট ব্যাঘাত ঘটবে একবার মনোযোগ নষ্ট হলে তার দায়দায়িত্ব কে নেবে?! এতো সব দায়দায়িত্বের চেয়ে আমরা প্রশ্ন না করাটাকেই উত্তম মনে করলাম পুরো ক্লাস আমরা শুধু শুনতাম আর শুনতাম

আমরা কি শুনতাম? আপনারা নিশ্চয় এতোক্ষনে ভাবছেন, এতো সুন্দর সুন্দর নিয়ম যে শিক্ষকের মস্তিষ্কে বসবাস করে, তিনি নিশ্চয় আরো সুন্দর ক্লাস নিবেন আমি তোমাদের আজকে বোঝাবো, অফিস ব্যবস্থাপনায় সজ্জার গুরুত্ব তোমরা প্রত্যেকটি শব্দের সাথেই পরিচিত অফিস, ব্যবস্থাপনা, সজ্জা, গুরুত্ব সজ্জার সাথে নান্দনিকতার সম্পর্ক নিগুঢ় আবার নান্দনিকতা ব্যাখ্যা করার কোনো উপায় নেই তবে যেটা সবার চোখে ভালো ঠেকবে, সেটাই নান্দনিক যেটা হুট করে সবার চোখে…’ আপনারা যা ভাবছেন মোটেই তা নয় নছিমন চৌধুরী ক্লাসে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে দিয়ে আঙুল তুলে শাঁসাতে আরম্ভ করতেন তারপর একটু বিশ্রাম নিয়ে বলতেন- ‘তোমরা কিছু বোঝো না, তোমরা কিছু জানো নাতোমরানাক্লাসের সময়কে দুই দিয়ে ভাগ করে, এক ভাগ তিনি অফিস ব্যবস্থাপায় চিৎকার করতেন আর বাকী এক ভাগ তিনি এটাই প্রমান করতেন যে, আমরা মূর্খ, ভন্ড, জোচ্চোর, জালিয়াত, প্রতারক, লম্পট, অশিক্ষিত, অসংস্কৃত, অকালপক্ক, অপরিনামদর্শী এবং আরো অন্যান্য তবে আমরা মোটেই অসহায় বোধ করতাম না ক্লাসের বাইরেই দেখা যেতো, সবুজ আর সাদা
আমরা শিক্ষিকার এরকম আচরনে মোটেই বিচলিত হই নি তবু আমরা আশায় বুক বাঁধি বারবার যে এক ভাগ তিনি আমাদের অফিস ব্যবস্থাপনা পড়াতেন বা অফিস ব্যবস্থাপনায় চিৎকার করতেন, সেটাই এখন আলোচ্য কোনো গলিঘুপচিতে না গিয়ে মন যদি সেই ক্লাসে যোগ হতো, তবে আমরা অবশ্যই শুনতে পেতাম-‘আমাদের দেশেড় অফিস ম্যাইনেজমেন্টেড় তো খুব বাজে অবস্থা হড়িবল! টেড়িবল! বট্, আশা হচ্ছে, কেএফসিড় গুলশান ব্রাঞ্চ যে ডেকোড়েইশন কড়ে তাদেড় ইম্প্রুভ কড়েছে সেটা ইউ নো, কেএফসিড় কোন ব্রাঞ্চে সবচেয়ে বেশি সেইল? গুলশান ব্রাঞ্চে বট্ হোয়াই? বিকজ দে হেভ নাইস ডেকোড়েইশন … … আমাদেড় গভমেন্ট অফিসগুলোড় উচিত, বাংলালিংকেড় কাস্টমাড় কেয়াড়কে ফলো কড়া তাতে পাবলিকেড় ডিপেন্ডেন্সি গভমেন্টেড় দিকে যাবে তোমড়া কি বলো?’

আমরা আর কি বলবো? আমাদের মনে তখন ভেসে আসতো হিটলারের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের চিত্র কি বিভৎস, অমানবিক, পাশবিক বর্বরতা! তারপর নিজেকে সান্ত্বনা দিয়ে বলতাম, সেখানে তো আর নেই মাত্র তো পঞ্চাশ মিনিট মুক্তি পঞ্চাশ মিনিট পরেই তবে হ্যা, কাজের কাজ একটাই, গোটা সংঞ্জা মুখস্ত করতে হয়েছে আমাদের সংঞ্জা মুখস্ত করা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্যের সাথে খাপ খায় না, তখন সংঞ্জা মুখস্ত করতে গিয়ে আমরা প্রায়ই সংঞ্জাহীন হয়ে পরতাম ‘‍‍‍‍‌‌‌অফিস ব্যবস্থাপনায় সজ্জার গুরুত্ব সম্পর্কে মহান সজ্জাবিদ কে. আই. জেড. এইচ. বাটলার বলেন যে- “অফিস ব্যবস্থাপনায় সজ্জার গুরুত্ব অপরিসীম দোকানের বিক্রী বৃদ্ধিতে এটি সহায়ক তবে অন্যান্য গুরুত্বকে অস্বীকার করলে চলবে না কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এটাই যে, বিক্রীর মাধ্যমে দোকানের বা অফিসের বা সংগঠনের আর্থিক অবস্থার আরো উন্নতি সম্ভব” ’

আর কি কিছু বলার দরকার আছে? জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের মধ্যবর্তীকলীন জনৈকা কল্পিত শিক্ষিকা নছিমন চৌধুরী কি শুধুই কল্পনা? আমি চাই এটা কল্পনাই হোক তবে কল্পনা বা দু:স্বপ্ন যাই হোক না কেনো, একটা ধারনায় হয়তো আমি পৌছাতে চাই বিশ্ববিদ্যালয়ের চরিত্র কেমন হবে, তা আমার এক্তিয়ারভুক্ত নয় বা আমার পর্যাপ্ত সুযোগও নেই এখন অন্তত, সেগুলো নিয়ে আলোচনা করার আমার মনে হয়, কোনো মহান শিক্ষক বা শিক্ষিকা যদি এসব ব্যাপারে ছাত্রবাদী হন, তবেই সম্ভব বিশ্ববিদ্যালয়ের আসল উদ্দেশ্য পূরণ হওয়া

এই ভাঙা ভেলা নিয়ে জাতি কতদিন নৌকাবাইচ খেলবে?

No comments:

Post a Comment