রাষ্ট্র একটি রাজনৈতিক ধারণা। মানুষের ইতিহাস, মানুষের সংঘবদ্ধতার ইতিহাস। অতি প্রাচীন
কালের মানুষের ইতিহাসে রাষ্ট্রের ধারণা ছিলো না। সংঘবদ্ধতার প্রয়োজনে ক্রমেই
‘গ্রাম’ গড়ে উঠে। তারও পরে গড়ে উঠে ‘নগর’ এবং নগরকে কেন্দ্র করে ‘রাজ্য’। ক্রমেই
সেই রাজ্যগুলো সম্প্রসারিত হতে হতে গঠন করে সাম্রাজ্য। সাম্রাজ্য এবং রাজ্যগুলোর
উত্থান-পতনের গল্পই হয়ে উঠে ইতিহাস।
মূলত, রাজ্য বা রাষ্ট্র তার সীমানা ছাড়া আর কিছুই নয়। এই সীমানা তার ভেতরের
জীবিত মানুষদের আলাদা করে বাহিরের জীবিত মানুষ থেকে। সীমানা বহন করে, অন্তর্গত
জীবিত মানুষদের পরিচয়। সীমানা এমনকি ব্যক্তির অন্যান্য পরিচয় কেও কখনো কখনো
অস্বীকার করে। মানুষের ধর্মীয় পরিচয়, বর্ণ-গোত্র-পরিবারের পরিচয়, ভাষার পরিচয়
ইত্যাদি সবকিছু ছাপিয়ে; মানুষের জীবনে বড় হয়ে উঠে সীমানার পরিচয়। কখনো সীমানা
পেরিয়ে অভিবাসী হওয়ারও সুযোগ থাকে। প্রাচীন কাল এবং এই বর্তমান কাল থেকে, ইতিহাসের
মধ্যযুগে মানুষ অভিবাসী হয়েছে বেশি। তখন রাজ্যগুলোর সীমান প্রায়ই প্রাকৃতিক হতো। নদী,
পাহাড় বা জঙ্গল পাড়ি দিতে পারলেই অন্য রাজ্য। অতি প্রাচীন কালে যাতায়াত-ব্যাবস্থা
সুবিধার ছিলো না এবং এই বর্তমান কালে অতি-শক্ত সীমানার ব্যাবস্থা, অভিবাসনের
স্বাধীনতা বহুলাংশে কমিয়ে দিয়েছে।
রাজ্যগুলোর সীমানার অবস্থান পরিবর্তিত হতে থাকে ক্রমেই। এরই মধ্যে ইংল্যান্ডের
শিল্প-বিপ্লব এবং ফ্রান্সের প্রজাতান্ত্রিক বিপ্লব শুরু করে মানুষের ইতিহাসের
আধুনিক যুগ। আধুনিক যুগে ক্রমেই রাজ্যগুলো রাষ্ট্রে পরিনত হতে থাকে। ১৯৭০ যিশুসন
নাগাদ প্রায় বেশিরভাগ অঞ্চল স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিনত হয়। এর ক্রমবিকাশ এখনো চলছে।
রাষ্ট্রের উপাদানঃ
রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা রাষ্ট্র গঠনের জন্য চারটি মৌলিক উপাদান চিহ্নিত করেছেন।
এই চারটি উপাদান হলো- আয়তন (অর্থাৎ, নির্দিষ্ট সীমানা), জনসংখ্যা (অর্থাৎ,
নির্দিষ্ট সীমানার অন্তর্গত জীবিত মানুষ), সরকার (অর্থাৎ, নির্দিষ্ট সীমানার
অন্তর্গত জীবিত মানুষদের প্রতিনিধিত্বকারী দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান) এবং সার্বভৌমত্ব
(অর্থাৎ, নির্দিষ্ট সীমানার অন্তর্গত জীবিত মানুষদের প্রতিনিধিত্বকারী দায়িত্বশীল
প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা)। অনেক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এই চারটি
উপাদানের সাথে আরও একটি উপাদান যোগ করতে চান, তা হলো- স্বীকৃতি। অর্থাৎ, সার্বভৌম
হিসেবে, অন্য সার্বভৌম রাষ্ট্রদের স্বীকৃতি।
প্রথমত, আয়তন; অর্থাৎ নির্দিষ্ট সীমানার আয়তন। রাষ্ট্র হওয়ার জন্য তার একটি
নির্দিষ্ট সীমানার আয়তন থাকতে হবে। অথচ আয়তনের কোনো নির্দিষ্ট সীমা নেই। যেকোনো
সম্ভাব্য সীমার আয়তনেই রাষ্ট্র হওয়া সম্ভব। যেমন- আয়তন অনুসারে পৃথিবীর সবচেয়ে বড়
সার্বভৌম রাষ্ট্র ‘রাশিয়া’। এর আয়তন- ১,৭০,৯৮,২৪২ বর্গ কিলোমিটার। এবং আয়তন
অনুসারে পৃথিবীর সবচেয়ে ছোটো সার্বভৌম রাষ্ট্র ‘ভ্যাটিকান সিটি’। এর আয়তন- ০.৪৪
বর্গ কিলোমিটার। অর্থাৎ, আয়তন অনুসারে, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় রাষ্ট্রটি সবচেয়ে ছোটো
রাষ্ট্রটির- ৩,৮৮,৫৯,৬৪১ গুণ বড়। এবং পৃথিবীর বাদবাকী রাষ্ট্রগুলো এই দুই আয়তনের
মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত। অর্থাৎ রাষ্ট্রের আয়তনের কোনো নির্দিষ্ট সীমা নেই।
দ্বিতীয়ত, জনসংখ্যা; অর্থাৎ আয়তনের অভ্যন্তরীন জনসংখ্যা। রাষ্ট্র হওয়ার
জন্য নির্দিষ্ট আয়তনের অভ্যন্তরে নির্দিষ্ট সংখ্যক জনসংখ্যা থাকা অত্যাবশ্যকীয়।
এবং এই জনসংখ্যারও কোনো নির্দিষ্ট সীমা নেই। যেকোনো পরিমান জনসংখ্যাই একটি
নির্দিষ্ট সীমানার ভেতর রাষ্ট্র গঠন করতে পারে। যেমন- জনসংখ্যা অনুসারে পৃথিবীর
সবচেয়ে বড় সার্বভৌম রাষ্ট্র ‘চীন’। এর জনসংখ্যা- ১৩৭,২৫,১০,০০০ জন। এবং জনসংখ্যা
অনুসারে পৃথিবীর সবচেয়ে ছোটো সার্বভৌম রাষ্ট্র ‘ভ্যাটিকান সিটি’। এর জনসংখ্যা- ৮৩৯
জন। অর্থাৎ, জনসংখ্যা অনুসারে, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় রাষ্ট্রটি সবচেয়ে ছোটো
রাষ্ট্রটির- ১৬,৩৫,৮৮৮ গুণ বড়। এবং পৃথিবীর বাদবাকী রাষ্ট্রগুলো এই দুই জনসংখ্যার
মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত। অর্থাৎ রাষ্ট্রের জনসংখ্যার কোনো নির্দিষ্ট সীমা নেই।
তৃতীয়ত, সরকার; অর্থাৎ অভ্যন্তরীন জনসংখ্যার প্রতিনিধিত্বকারী দায়িত্বশীল
হিসেবে কর্তব্যরত প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো। নির্দিষ্ট আয়তনের ভেতরে জনগণকে দেখভালের
জন্যসরকার অত্যাবশ্যকীয়। সরকারেরও কোনো নির্দিষ্ট ধরন নেই অথবা বিভিন্ন রকম ধরন
আছে। যেমন; কোনো রাষ্ট্রে নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্র প্রচলিত। যেমন- সৌদী আরব, কাতার,
ব্রুনাই। কোনো রাষ্ট্রে প্রচলিত সাংবিধানিক রাজতন্ত্র। যেমন- থাইল্যান্ড,
যুক্তরাজ্য, মালয়েশিয়া। কোনো রাষ্ট্রে রাষ্ট্রপতিশাসিত গনতন্ত্র। যেমন- আমেরিকা,
রাশিয়া, ফ্রান্স। কোনো রাষ্ট্রে প্রধানমন্ত্রী শাসিত গনতন্ত্র। যেমন- বাংলাদেশ,
ভারত। কোনো রাষ্ট্রে এখনও ধর্মতন্ত্র। যেমন- ইরান, ভ্যাটিকান সিটি। কোনো রাষ্ট্রে
একদলীয় সমাজতন্ত্র। যেমন- চীন, ভিয়েতনাম, উত্তর কোরিয়া। কোনো রাষ্ট্রে বহুদলীয়
সমাজতন্ত্র। যেমন- ব্রাজিল, ভেনেজুয়েলা, চিলি। কোনো রাষ্ট্রে সামরিক শাসন। যেমন-
বুরকিনা ফাসো। অর্থাৎ, সরকারের কোনো নির্দিষ্ট ধরন নেই অথবা বিভিন্ন রকম ধরন আছে।
চতুর্থত, সার্বভৌমত্ব; অর্থাৎ সরকারের স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্তগ্রহণ ও তা
বাস্তবায়নের ক্ষমতা। সার্বভৌমত্ব মূলত নির্ভর করে সরকারের কাজের উপর। কিন্তু
সরকার, বিভিন্ন পরিস্থিতিতে বিভিন্ন শক্তি দ্বারা প্রায়শই প্রভাবিত হয়, এমনকি কখনো
কখনো তা সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘনও করে। যেমন- আমেরিকার সামরিক ঘাঁটি, দক্ষিন কোরিয়ায়।
যার প্রভাব দক্ষিন কোরিয়ার সামরিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক প্রতিটি ক্ষেত্রে পরেছে। একই কথা কাজাকস্তানে রাশিয়ার সামরিক
ঘাঁটির ব্যাপারেও বলা যায়। আফ্রিকার দেশ জিবুতিতে আমেরিকা, ইতালী, জাপান, পাকিস্থান এবং ফ্রান্সের সামরিক
ঘাঁটি রয়েছে। এমনকি একসময়কার পশ্চিম আফ্রিকীয়
কলোনীগুলোতে এখনও ফ্রান্সের সামরিক উপস্থিতি রয়েছে। শাদ, মালি, নাইজার এবং একই সাথে জিবুতি, দক্ষিন কোরিয়া ও কাজাকস্তানকে নিশ্চয়
কেউ অসার্বভৌম-পরাধীন রাষ্ট্র বলবে না।
এবং
সর্বশেষ, স্বীকৃতি; অর্থাৎ সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে অন্য সার্বভৌম রাষ্ট্রের
স্বীকৃতি। এটি একটি অতি বায়বীয় বিষয়। স্বীকৃতি নির্ভর করে মূলত, সম্পর্ক এবং
স্বার্থের উপর। যেমন- দক্ষিন কোরিয়া কখনই উত্তর কোরিয়াকে স্বীকার করে নি। এবং
নিজেকে একক কোরিয়ার একমাত্র দাবীদারের দাবী সে এখনও ছাড়েনি। উত্তর কোরিয়াও তেমনি
পুরো কোরীয় উপদ্বীপের একমাত্র উত্তরসূরী মনে করে নিজেকে এবং দক্ষিন কোরিয়াকে কখনই
স্বীকার করে নি। অথচ উভয় দেশই জাতিসংঘের সদস্য। অন্যান্য বিভিন্ন রাষ্ট্র তাদের
স্বীকৃতি দিয়েছে। এখনও আর্মেনিয়াকে স্বীকৃতি দেয় নি পাকিস্থান, ইসরায়েলকে স্বীকৃতি
দেয় নি বাংলাদেশ। অথচ সবাই স্বাধীন-সার্বভৌম। অর্থাৎ, স্বীকৃতি ক্ষমতাসীন সরকারকে
খুশি করতে পারে মাত্র, কিন্তু কখনোই সার্বভৌমত্বের মাপকাঠি নয়।
সুতরাং
উপরোক্ত আলোচনা থেকে আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, রাষ্ট্র গঠনের জন্য
কিছু মৌলিক উপাদান প্রয়োজন, কিন্তু তাদের কোনো নির্দিষ্ট সীমারেখা নেই। কিছু
জনসংখ্যা সহ কোনো নির্দিষ্ট সীমানা যদি একটি সরকারের অধীনে ঐক্যবদ্ধ হয় এবং সরকার
তার কার্যক্রম সার্বভৌমভাবে পরিচালনা করে এবং যাদের কিছু বহিঃরাষ্ট্রের স্বীকৃতিও
আছে, তাকেই আমরা ‘রাষ্ট্র’ বলতে পারি। কখনো কখনো বহিঃরাষ্ট্রের স্বীকৃতি ছাড়াও
রাষ্ট্র হওয়া সম্ভব।
কার্যত স্বাধীন রাষ্ট্র কি?
স্বাধীন
রাষ্ট্র দুই প্রকার। এক প্রকার আইনত স্বাধীন রাষ্ট্র এবং অপর প্রকার কার্যত
স্বাধীন রাষ্ট্র। যদি কোনো রাষ্ট্র তার রাষ্ট্রগঠনের মৌলিক শর্তগুলো পূরণ করার পর,
আন্তর্জাতিক আইনের মাধ্যমে অন্যান্য স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র দ্বারা স্বীকৃত হয়,
তবে সে আইনত স্বাধীন রাষ্ট্র। কিন্তু যদি কোনো রাষ্ট্র তার রাষ্ট্রগঠনের মৌলিক
শর্তগুলো পূরণ করার পর, আন্তর্জাতিক আইনের মাধ্যমে অন্যান্য স্বাধীন-সার্বভৌম
রাষ্ট্র দ্বারা স্বীকৃত না হয় অথবা সীমিত পরিমানে স্বীকৃত হয় অথবা আন্তর্জাতিক
অঙ্গন স্বীকৃতি নিয়ে দোলাচলে থাকে, তবে সে কার্যত স্বাধীন রাষ্ট্র।
আইনত
স্বাধীন রাষ্ট্র এবং কার্যত স্বাধীন রাষ্ট্রের মধ্যে উপাদানগত কোনো পার্থক্য নেই,
কেবল স্বীকৃতি বাদে। যেমন- ফিলিস্তিনের বর্তমান মর্যাদা- ‘জাতিসংঘের অ-সদস্য
পর্যবেক্ষক রাষ্ট্র’। কেবলমাত্র আমেরিকার ভেটো-ক্ষমতাই ফিলিস্তিনের
আইনত স্বাধীন রাষ্ট্র হওয়ার পেছনে একমাত্র প্রতিবন্ধকতা। জাতিসংঘের ১৯৩
সদস্যরাষ্ট্রের ১৩৬ টি রাষ্ট্রই স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে ফিলিস্তিনকে
স্বীকৃতি দিয়েছে; সেপ্টেম্বর ১৪, ২০১৫ এর হিসাব মোতাবেক যা ৭০.৫%। পাশাপাশি কসোভোর
আইনত স্বাধীন রাষ্ট্র হওয়ার পেছনে একমাত্র প্রতিবন্ধকতা রাশিয়ার ভেটো-ক্ষমতা। জুন
২৩, ২০১৫ এর হিসাব মোতাবেক জাতিসংঘের মোট সদস্য রাষ্ট্রের ১০৮ টি রাষ্ট্রই
স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে কসোভোকে স্বীকৃতি দিয়েছে, যা ৫৬%।
স্বীকৃতি
এবং কিছুটা আইনি জটিলতা বাদে, কার্যত স্বাধীন রাষ্ট্র, রাষ্ট্র হওয়ার সবগুলো মৌলিক
শর্তই পূরণ করে। তাদের নির্দিষ্ট সীমানার আয়তন আছে, অভ্যন্তরীন নির্দিষ্ট জনসংখ্যা
আছে, সরকার আছে, সার্বভৌমত্ব আছে, কমবেশি স্বীকৃতিও আছে। এবং কার্যত স্বাধীন
রাষ্ট্র, আইনত স্বাধীন রাষ্ট্রের মতোই বৈচিত্রে ভরপুর। কোনো কোনো কার্যত স্বাধীন
রাষ্ট্রের আয়তন বাংলাদেশের চেয়ে বেশি। যেমন- পশ্চিম সাহারা। কোনো কোনো কার্যত
স্বাধীন রাষ্ট্রের জনস্পংখ্যা কাজাকস্তানের চেয়ে বেশি। যেমন- তাইওয়ান। কেউ
রাষ্ট্রপতি-শাসিত গণতান্ত্রিক সরকারের অধীন। যেমন- আবখাজিয়া। কেউ
প্রধানমন্ত্রী-শাসিত গণতান্ত্রিক সরকারের অধীন। যেমন- কসোভো। কেউ একদলীয় শাসনের
অধীন, যেমন- পশ্চিম সাহারা। কেউ সমাজতান্ত্রিক শাসনের অধীন, যেমন-
ট্রান্সনিস্ট্রিয়া। এবং তাদের সবার সার্বভৌমত্ব আছে। তাদের সরকার সার্বভৌমভাবে
সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং তা বাস্তবায়ন করে। উপরোক্ত কারনে, কার্যত স্বাধীন
রাষ্ট্র, আইনত স্বাধীন রাষ্ট্রের মতোই স্বাধীন এবং সার্বভৌম।
কার্যত স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের কারনঃ
কার্যত
স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের বহুবিধ কারন বিদ্যমান। প্রধানতম কারন হলো- পরিচয় সংকট। যখন
একটি নির্দিষ্ট সীমানার মধ্যে একটি নির্দিষ্ট জাতি, ধর্ম-বর্ণ বা ভাষার কারনে অপর
জাতি কর্তৃক নিগৃহীত হতে থাকে তখন তারা মূলরাষ্ট্র হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে সার্বভৌম
রাষ্ট্র হয়ে উঠতে চায়। বিচ্ছিন্নতার বা স্বাধীনতার প্রথম ধাপ হিসেবে তারা কার্যত
স্বাধীন হয়ে পরে। যেমন- জর্জিয়ার আবখাজিয়া ও উত্তর ওশেটিয়া এবং সাইপ্রাসের উত্তর
সাইপ্রাস।
এর
সাথে যোগ হয়, নৃতাত্ত্বিক কারনে একসাথে না থাকতে পারার কারন। যেমন- ইসরাইল থেকে
ফিলিস্তিন বা সার্বিয়া থেকে কসোভো। কসোভানরা জাতিগত আলবেনিয়ান। যুগোস্লাভ
প্রজাতন্ত্র থেকে ভেঙে এর সবগুলো জাতি, জাতিরাষ্ট্র গঠন করলেও, সার্বরা কখনোই
কসোভানদের সার্বভৌমত্ব মেনে নেয় নি। সর্বশেষ ২০০৮ যিশুসনে তারা স্বাধীনতা ঘোষনা
করে, কার্যত স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিনত হয়।
আবার
যেমন, তাইওয়ানের ক্ষেত্রে কারন হলো, শাসনব্যবস্থা সংক্রান্ত সমস্যা। জাতিসংঘের
শুরু থেকে ১৯৭০ যিশুসন পর্যন্ত চীনের গণতান্ত্রিক সরকার ‘গণতন্ত্রী চীন’ নামে
জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্র ছিলো। কিন্তু চীনা মূল ভূখন্ডে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা
উৎখাত হয়, সমাজতন্ত্র আসে। ১৯৭১ যিশুসন থেকে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী চীন’ জাতিসংঘের সদস্য
হয়। গণতন্ত্রীরা হয়ে পরে তাইওয়ান ভিত্তিক ‘গণতন্ত্রী চীন’। এখনো তাইওয়ানের
দাপ্তরিক নাম- রিপাবলিক অব চায়না।
এবং
সর্বশেষ প্রধান কারন- গৃহযুদ্ধ। গৃহযুদ্ধের কারনে রাষ্ট্রীয় অখন্ডতা বিনষ্ট হয় এবং
বিভিন্ন অঞ্চল কার্যত স্বাধীন হয়ে পরে। সর্বশেষ সোমালিয়ার গৃহযুদ্ধে মাখির, হিরান,
গাল্মুডুগ, সোমালিল্যান্ড বিভিন্ন অঞ্চল কার্যত স্বাধীন হয়ে পরে। ২০০৬ যিশুসনে সোমালিয়রা মোগাদিসুতে একটি
অন্তর্বর্তীকালীন ঐক্যবদ্ধ সরকার (ট্রাঞ্জিশনাল ফেডারেল গভর্নমেন্ট- টিএফজি) গঠন করে।
বাদবাকী সবাই সেই সরকারে যোগদান করলেও সোমালিল্যান্ড করে নি। সোমালিল্যান্ড এখন
পর্যন্ত কার্যত স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বকীয়তা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে। এবং বর্তমান সময়ের ইরাক এবং সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে
সুন্নি খেলাফত ‘ইসলামিক স্টেট’ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর, দুটি রাষ্ট্রই তাদের কুর্দি
অধুষ্যিত অঞ্চলগুলোকে এককথায় স্বায়ত্ত্বশাসন দিয়ে চলে আসে। ইরাকের কুর্দিস্তান এবং
সিরিয়ার রোজাভা কুর্দিস্তান তো বটেই, ইরাক এবং সিরিয়ার বিস্তির্ণ সুন্নি-প্রধান
অঞ্চল নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কার্যত স্বাধীন রাষ্ট্র- ইসলামিক স্টেট।
অর্থাৎ,
একটি রাষ্ট্র, আইনত স্বাধীন রাষ্ট্র হওয়ার পূর্বে, কার্যত স্বাধীন হয়ে পরে। কার্যত
স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে তাকে কিছু সমস্যা মোকাবিলা করতে হয়। সমস্যার সমাধান হয়ে
গেলে, কার্যত স্বাধীন রাষ্ট্রও আইনত স্বাধীন রাষ্ট্র হয়ে পরে। অন্যথায়, কার্যত
স্বাধীন রাষ্ট্র অন্যান্য সার্বভৌম রাষ্ট্রের মতোনই স্বাধীনতা ভোগ করতে থাকে।
No comments:
Post a Comment