8 March 2017

আগুন আনা মাউই

পানির তল থেকে তেইকা-মাউইকে টেনে তুলছে মাউই
[নিউজিল্যান্ড এর আদিবাসী মাউরিদের উপকথা]
কিছু দেশ পানির উপরে, আর কিছু দেশ পানির নিচে তেইকা-মাউই (নিউজিল্যান্ড) এখন যে পানির উপরে আছে, সেটা বীর মাউই গুণে সেইই দেশকে টেনে এখানে তুলেছে মাছ ধরার বর্শার মাথায় যে বড়শী তা বুদ্ধি খাটিয়ে বের করেছে মাউই বাইন মাছ ধরার জ্ঞান সেই শিখিয়েছে মাউই- ঘুড়ি বের করেছে আগুন কি করে বানাতে হয়, মাউই তা মানুষকে শিক্ষা দিয়েছে মানুষ যাতে অনেক কাজ করতে পারে সেজন্য মাউই দিনকে বড় করেছে মানুষের ভালোর জন্য মাউই অনেক অনেক কাজ করেছে

মাউই যখন জন্ম হয়, তখন সে আকারে ছিলো ছোট্ট আর দেখতেও ছিলো বিচ্ছিরি কাজেই তার মা তাকে নদীপাড়ের এক জঙ্গলে ফেলে দিয়ে এলো

কিন্তু নদীর দেবতারা মাউইকে মরতে দিলো না, তারা তাকে আদরে যত্নে বড় করে তুললো আর তার পূর্বপুরুষ তামা-নুই-কি-টি-রঙ্গি তো আসমানে থাকতো সেখান থেকে এসে সে মাউইকে অনেক বিষয়ে জ্ঞান শিক্ষা দিলো

বড় হয়ে মাউই দেশে ফিরে এলো। গ্রামে এসে সে দেখলো, তার ভাইয়েরা বর্শা নিয়ে খেলা করছে। কে কতদূরে বর্শা ছুঁড়ে ফেলতে পারে, এই তাদের চেষ্টা। তারা এই বিচ্ছিরি চেহারার মানুষটাকে দেখে হাসতে লাগলো। মাউই চিৎকার করে বললো- ‘আমি তোমাদের ছোটো ভাই... আমি তোমাদের ছোটো ভাই...’ তারা তার কথা মোটেই বিশ্বাস করলো না। তার মা কাছে এসে বললো- ‘ওহে, তুমি আমার ছেলে নও...’ মাউই বললো- ‘মা, তুমি যে আমাকে নদীপাড়ের জঙ্গলে ফেলে এসেছিলে, তা মনে নাই...’ তখন মায়ের সব কথা মনে পরলো। সে খুশি হয়ে বললো- ‘হ্যা, বাবা, আমি ভুলে গিয়েছিলাম। তুমি আমার ছেলে...’ তখন মাউই তার ভাইদের সাথে বাস করতে লাগলো। কিন্তু এতে তার ভাইয়েরা খুশি হলো না।

একদিন মাউই’র ভাইয়েরা ডোঙ্গায় চড়ে মাছ শিকারে চললো। মাউই বললো- ‘আমিও তোমাদের সাথে যাবো...’ কিন্তু তার ভাইয়েরা এতে রাজি হলো না। তারা বললো- ‘না। আমরা তোমাকে চাই না...’ তারা মাউইকে রাখে নদীতে গেলো। কিন্তু তারা খালি হাতে ফিরে এলো। তাদের বর্শার মাথায় তো বড়শী ছিলো না, তাই তারা মাছ আটকাতে পারলো না। মাউই তামা-নুই-কি-টি-রঙ্গির কাছ থেকে অনেক জ্ঞান শিখেছিলো তো, এখন সে তার ভাইদের সে জ্ঞান কিছু কিছু শিক্ষা দিলো। বর্শার আগায় বড়শীর মতো বাঁকা হুক কেমন করে বসাতে হয়, সে ভাইদের তা দেখিয়ে দিলো। এখন বর্শায় মাছ একবার গাঁথলে আর তা খসে পড়ে না। এতদিন বাইন মাছ পাতিলে ঢুকত, আর পাতিল তুলতে গেলে পাতিলের মুখ দিয়ে বের হয়ে যেতো। পাতিলের মুখ ঢাকনা দিয়ে কি করে বন্ধ করতে হয়, মাউই তা শিখিয়ে দিলো। কিন্তু এতো বিদ্যা শিখানোর পরও মাউই’র ভাইয়েরা তার উপর খুশি হলো না। বললো- ‘যাই বলো, তোমাকে সাথে নিয়ে আমরা মাছ শিকারে যাবো না...’

একদিন মাউই নিজেকে ডোঙ্গার পাটাতনের নিচে লুকিয়ে রাখলো। ভাইয়েরা সমুদ্রের ভেতর অনেক দূর চলে গেলো। তখন এক ভাই বললো- ‘মাউইকে সাথে না এনে বড় ভালো হয়েছে...’ মাউই পাটাতনের নিচ হতে বললো- ‘কিন্তু আমি আছি এখানে...’ বলে পাটাতন সরিয়ে বেরিয়ে এলো সেভাইয়েরা সমুদ্রের কিনারার দিকে দেখলো। দেখলো, অনেকদূর এসে পড়েছে, আর কিনারে গিয়ে মাউইকে রেখে আসার সময় নাই। কিন্তু ভাইয়েরা তাকে মাছ ধরার বড়শী দিলো না।

মাউই রাগ করলো না। পূর্বপুরুষদের এক জনের চোয়ালের হাড় দিয়ে বানানো একটি মায়া-বড়শী মাউই’র কোমরে কাপড়ের নিচে ছিলো। সে সেটা বের করে হাতে নিলো। তখন ভাইয়েরা তাকে টোপ দিতে অস্বীকার করলো। তখন মাউই নিজের নাকের উপর জোরে কিল মারলো, নাক থেকে দর দর করে রক্ত পরতে লাগলো। সে তার বড়শীর গায়ে এই রক্ত মাখিয়ে গভীর পানিতে বড়শী নামিয়ে দিলো। ভাইদের বড়শীতে কোনো মাছ আটকালো না। তারা ভাবলো মাউই’র কপালেও তাই ঘটবেমাউই তার বড়শী আরো গভীর পানিতে ফেললো। ভাইয়েরা বললো- ‘এ গোঁয়ারতুমিতে লাভ কি, মাউই? এখানে কোনো মাছ নাই। চলো অন্য খানে যাই...’ কিন্তু মাউই কেবল হাসলো আর স্থিরভাবে বসে রইলো।

এরপর তার সূতায় লাগলো এক বিষম টান। সে সূতা কষে ধরে রইলো। তার ভাইয়েরা এসে তার সঙ্গে সূতা টেনে ধরলো। আস্তে আস্তে সূতার টানে সমুদ্রের সে বিরাট জীব ভেসে উঠলো।

মাউই’র ভাইয়েদের ভয়ে আর বিস্ময়ে তাক লেগে গেলো! এতো বড় জীব! যতদূর চোখ যায় তারও ওপার পর্যন্ত যে ছড়িয়ে আছে! এই জীবই হচ্ছে- তেইকা মাউই, নিউজিল্যান্ড দ্বীপ! ভাইয়েরা এর পিঠের উপর লাফিয়ে পরলো, মাছের কিছু অংশ কেটে নিতে। কিন্তু মাছ দুলতে লাগলো। মাছের চামড়া কুচকে গেলো, সেইখানে পয়দা হলো পাহাড়-পর্বত। এমনিভাবে পানির নিচ থেকে উঠল নিউজিল্যান্ড, আর তা হলো মাউরিদের আবাসভূমি।

দিন যায়, রাত আসে; রাত যায়, দিন আসে; মাউই’র দিন সুখে কাটে। একদিন মাউই লক্ষ্য করলো, দিনগুলি বড় ছোট। কারণ তামানুইটেরা অর্থাৎ কিনা সূর্য, আকাশপথে এতো জোরে চলে যান যে, লোকেরা তাদের ভিজা কাপড় পর্যন্ত শুকানোর সময় পায় না। খাবার, জিনিসপত্র জোটান তো দূরের কথা। মানুষের সুবিধা-অসুবিধার কথা কিছু চিন্তা না করেই সূর্য ওঠেন, মাথার উপর দিয়ে ধা—ধা করে চলেন, তার পর ডুবে যান। মাউই ভাবলো- ‘ও হো, এভাবে চলবে না, সূর্যকে ধীরে চলতে হবে...’  

মাউই ভাইদের ডেকে বললো- ‘চলো... আমরা সূর্যকে বেঁধে ফেলি আর তাকে আস্তে চলতে বাধ্য করি। যাতে দেশের লোকেরা কাজ-কর্ম করার সময় পায়...’

ভাইয়েরা ভীষণভাবে মাথা নেড়ে বললো- ‘না, না... তা হয় না। তামানুইটেরা মানে সূর্যের কাছে যারা যাবে, তাদের সবাইকে উনি পুড়িয়ে মারবেন...’

মাউই বললো- ‘আমি কি কাজ করতে পারি তা তোমরা নিজের চোখে দেখলে... এতো বড় দেশ- তেইকা মাউই, একে তো আমিই সমুদ্রের গহীন তল থেকে টেনে তুলেছি। এর চেয়েও বড় কাজ আমি করতে পারি...’

এমনিভাবে বলে-কয়ে মাউই তার ভাইদের রাজি করালো। মাউই তার বোন হিনার মাথা থেকে চুল নিলো, তারপর সে যোগাড় করলো শন। এরপর ভাইদের দিয়ে সে চুল আর শন দিয়ে পাকিয়ে নিলো এক মজবুত দড়ি। মাউই তার সেই আকাশের পূর্বপুরুষের কাছ থেকে পাওয়া যাদুশক্তিতে দড়িটাকে ভীষণ শক্ত করে তুললো। এরপর ভাইয়েরা মিলে এক জাল বুনতে লেগে গেলো। জাল বোনা শেষ হলে ভাইয়েরা মিলে রওয়ানা হলো পৃথিবীর সেই দূর কিনারের পানে, যেখানে সূর্য রোজ ভোরে দেখা দেন। চলতে—চলতে—চলতে, অনেক মাস পর তারা পৃথিবীর সেই কিনারে এসে হাজির হলো। তারা পৌছালো রাতের অন্ধকারে। আর যে ফাঁক দিয়ে রোজ সূর্য উঠেন, তার উপর জাল পেতে রাখলো।

তামানুইটেরা ভোরে উঠতে এসে জালে জড়িয়ে পড়লো। সে ধ্বস্তাধ্বস্তি শুরু করলো। ভাইয়েরা জাল খুব জোরে টেনে ধরলো। কোনো কোনো ভাই তামানুইটেরার গায়ে দড়ি ফেলে ফেলে তাকে কষে বেঁধে ফেললো। তামানুইটেরা অনেকক্ষণ টানাটানি করে হয়রান হয়ে পড়লো। বহুকাল আগের এক পূর্বপুরুষের চোয়ালের হাড়ে গড়া একটি জাদুর লাঠি মাউই’র কাছে ছিলো। সে সেই লাঠি হাতে নিয়ে গিয়ে তামানুইটেরাকে বেদম পিটুনি দিতে শুরু করলো। তামানুইটেরা ভয়ঙ্কর তাপের ঝাপটা দিয়ে পালটা হামলা করলো। মাউই’র ভাইয়েরা অবস্থা বেগতিক দেখে পালিয়ে গেলো, কিন্তু মাউই তার জায়গা থেকে একটুও নড়লো না। উভয়ের মধ্যে তুমুল সংগ্রাম চললো। অবশেষে সূর্য চিৎকার করে বললো- ‘আমি মহা শক্তিশালী তামানুইটেরা... আমাকে কেনো মার-ধর করছো?’

সূর্যদেব তামানুইটেরার সঙ্গে সংগ্রামরত মাউই ও তার ভাইয়েরা


মাউই বললো- ‘মার-ধর করবো না? তুমি আকাশের পথে এতো জোরে তোমার রথ চালিয়ে যাও যে, লোকে তাদের খাবার জোটানোর সময় পায় না... তারা না খেয়ে মরতে বসেছে...’

তামানুইটেরা বললো- ‘কিন্তু ধীরে চলার ফুরসৎ কোথায় আমার?’ ফের তাদের মধ্যে মারামারি শুরু হলো। তামানুইটেরার শরীরের নানা স্থানে বড় বড় জখম হয়ে পড়লো। সে হয়রান হয়ে অবশেষে বললো- ‘আচ্ছা ভাই, আর নয়... এই বার তোমার মার-ধর বন্ধ করো... আমি এর পর ধীরে চলবো...’ তামানুইটেরার কাছ থেকে এই কথা আদায় করার পর মাউই তাকে ছেড়ে দিলো।

তামানুইটেরা তার দেয়া কথা ভোলে নাই। সেই দিন থেকে আজ পর্যন্ত সে ধীরে চলছে। আর দেশের লোকেরা কাপড় শুকাতে ও খাবার জোটাতে সময় পাচ্ছে। তবে মাউই তাকে যে সব দড়ি দিয়ে বেঁধেছিল, তার কতোগুলি দড়ি তার গায়ে আজো লেগে আছে। মেঘের ভেতর দিয়ে যখন তার আলো চলে সেই সময় উজ্জ্বল কিরণের মতো সেগুলি চোখে পড়ে।

এমনিভাবে মাউই অনেক বড় বড় কাজ করলো। কিন্তু তখন পর্যন্ত লোকে আগুন জ্বালানোর বিদ্যা জানত না। মাউই ঠিক করলো, সে পাতালপুরীতে গিয়ে এই বিদ্যা শিখে আসবে।

মাউই একটা বড় ফাটল দিয়ে পাতালপুরীতে চলে গেলো। সেখানে আগুনের দেবী মাফুইকের সাথে তার দেখা হলো। সে মাফুইকের কাছে একটা জ্বলন্ত কয়লা চাইলো। মাফুইক তার আঙ্গুলের একটা জ্বলন্ত নখ দিলো, মাউই তাই নিয়ে ছুটলো। মাফুইকের নজরের বাইরে এসে সে ভাবলো- ‘এই ই তো আগুন; কিন্তু মানুষ যে এ আগুন জ্বালাতে জানে না...’ তখন সে একটা নদীর পানিতে আগুন নিভিয়ে ফের মাফুইকের কাছে গেলো। মাফুইক আবার তাকে তার আঙ্গুলের একটা জ্বলন্ত নখ দিলো। সে ফের নদীর কাছে এসে আগুনটুকু নিভিয়ে ফেললো এবং আবার মাফুইকের কাছে গেলো। মাফুইক তাকে আবার তার এক আঙ্গুলের জ্বলন্ত নখ দিলো। এমনিভাবে ক্রমে নয়টি  নখ আনার পর যখন সে শেষ নখের জন্য গেলো তখন মাফুইক ভয়ঙ্কর রেগে উঠে মাউইকে পাতালপুরী থেকে তাড়িয়ে দিলো। মাউই দৌড়াতে দৌড়াতে মাফুইককে ঠাট্টা করে বললো- ‘তুমি যত বড় দেবীই হও মাফুইক, মাউইকে ধরে ফেলা তোমার বাপের সাধ্য নয়...’ মাফুইক রাগে তার শেষ জ্বলন্ত নখ মাউই’র দিকে ছুঁড়ে ফেললো। সে নখের আগুনে মাঠের ঘাস আর জঙ্গলের গাছ জ্বলে উঠলো। মাউই পুড়ে মরে আর কি! সে তখন বৃষ্টির দেবতাকে ডেকে বললো- ‘দোহাই তোমার... তুমি বৃষ্টি দাও... নইলে দুনিয়া পুড়ে খাক হয়ে যাবে...’ তার কাঁদনে বৃষ্টি নামলো আর সেই বৃষ্টিতে আগুন নিভতে লাগলো। মাফুইক দেখলো, পৃথিবীর সব আগুনই তো নিভে যায়। সে তখন কতগুলি জ্বলন্ত কয়লা কুড়িয়ে নিয়ে গাছে ভেতর লুকিয়ে রাখলো।

সেই দিন থেকে আজ পর্যন্ত আগুন গাছের মধ্যে লুকিয়ে আছে। এখন মানুষ দরকার মতো একটা কাঠের উপর আর একটা কাঠ ঘষেই আগুন জ্বালাতে পারে।

No comments:

Post a Comment