16 March 2017

ইগুয়ানার বিষের থলে

ইগুয়ানা 'মুন-গুন-গারলি'
[অস্ট্রেলিয়া এর আদিবাসী নারানদের উপকথা]

সে
অনেক অনেক দিন আগের কথা তখন পৃথিবী বয়সে ছিলো বাচ্চা আর তার বুকে যে সব জীবজন্তু বাস করতো, তারাও ছিলো সব বড় বড়উইয়ো-বু-লুইছিলো সে যুগের সাপের সর্দার কালো মিসমিসে ছিলো তার গায়ের রং, চেহারাও ছিলো ভয়ঙ্কর কিন্তু তার দাঁতে বিষ ছিলো না বিষের রাজা ছিলো মুন-গুন-গারলিনামক এক মস্ত ইগুয়ানা অর্থাৎ কিনা গিরগিটি

এখনকার ইগুয়ানার যে আকার, তখনকার ইগুয়ানার আকার এর চেয়ে বেশ বড় ছিলো তার ডরে সে যুগের সমস্ত মানুষের দিল দুরু দুরু কাঁপত সে যে দিকে যেতো সেখানেই মানুষ ধরে ধরে কামড়িয়ে দিতো আর মানুষ টপাটপ ঢলে পড়ে মরত

অবশেষে একদিন সমস্ত জীবজন্তু এক সভায় মিলিত হলো, আর পরামর্শ করতে লাগলো, কি উপায়ে মুন-গুন-গারলির জুলুম থেকে রেহাই পাওয়া যায় সভায় অনেক রকমের আলোচনা হলো কেউ প্রস্তাব করলো, কেউ সে প্রস্তাব করলো কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা কোনো পথই বের করতে পারলো না কাজেই সভা ভেঙে দিয়ে সবাই বাড়ি চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিলো

ঠিক এই সময় সাপের সর্দার উইয়ো-বু-লুই এসে হাজির জিজ্ঞাসা করলো- ‘এতো হৈচৈ করে কি আলোচনা হচ্ছিলো এখানে?’

উটপাখির আত্মীয় ইমুপাখিদিনেভানসেখানে ছিলো সে বললো- ‘ইগুয়ানা যেমন নির্দয়ভাবে মানুষ মেরে চলেছে, তাতে অল্পকাল পরেই দুনিয়া মানুষহীন হয়ে পরবে তাই আমরা আলোচনা করছিলাম যে, কি উপায়ে ইগুয়ানার বিষ থেকে মানবজাতিকে বাঁচানো যায়

ক্যাঙ্গারুবোরাবললো- ‘আমরা ইগুয়ানার সাথে লড়াই করতে যেতে রাজি আছি কিন্তু ওর থলিতে ভীষণ বিষ আছে তা দিয়ে যে আমাদের সবাইকে মেরে ফেলবে মানুষকে আমরা আমাদের ভাই বলে মনে করি কিন্তু ভাইকে রক্ষা করবার কোনো বুদ্ধিই আমরা বের করতে পারছি না

উইয়ো-বু-লুই বললো- ‘তা বেশ আমি মানুষকে বিপদ থেকে রক্ষা করবোসবাই জিজ্ঞাসা করলো- ‘তা ভাই, কেমন করে তুমি অসাধ্য সাধন করবে?’

কালো সাপ উইয়ো-বু-লুই

উইয়ো-বু-লুই বললো- ‘সে আমার এক গোপন বিষয় কিন্তু তোমরা সবাই নিশ্চিন্ত থাকো, আসছে কাল সূর্য মামা অস্তাচলে যাওয়ার আগেই আমি মুন-গুন-গারলির বিষের থলি তার কাছ থেকে কেড়ে নিবো...’

উইয়ো-বু-লুই কথা শুনে সবাই হাসলো বললো- ‘তা হলে মুন-গুন-গারলি বিষ কামড়ে তুমি মরবার আগে, আসছে কাল সূর্য অস্ত যাবে না মুন-গুন-গারলি সাথে যে লড়াই করতে যায় সেই মরে কিনা, তাই

উইয়ো-বু-লুই বললো- ‘কিন্তু আমি তো লড়াই এর কথা বলি নাই! লড়াই ছাড়া দুশমনকে হারিয়ে দেওয়ার কি আর কোনো পথ নাই? বেশ! যারা লড়তে যাবে, তারা মরুক আমি লড়তে যাবো না আমি বেঁচে থেকেই ওর বিষের থলে ছিনিয়ে আনবো আমি মুন-গুন-গারলিকে ডরাই না

কালো সাপ উইয়ো-বু-লুই সভা থেকে চলে গেলো পথে চলতে চলতে সে ভাবতে লাগলো, কি উপায়ে ইগুয়ানাটাকে পরাজিত করবে চালাকির পথ ছাড়া ষণ্ডামার্কা গিরিগিটিটাকে হারানো যাবে না কারণ, আকারে অনেক বড়, ওর গায়ে অনেক জোর, চলে ভীষণ বেগে একটুখানি পাতার খস খস শব্দও ওর কানে যায় আর তা ছাড়া ওর কাছে আছে বিষের থলে কালো সাপ ভাবলো, ‘একটু সবুর করে দেখা যাক... যখন পেট ভর্তি করে খাবে, সেই সময় কিছু করা যায় কিনা...’

কাজেই উইয়ো-বু-লুই আস্তে আস্তে মুন-গুন-গারলির আস্তানার কাছে গিয়ে ঘুমিয়ে পরলো সকাল বেলায় তার ঘুম ভাঙলো সে লক্ষ্য করে দেখতে লাগলো, ইগুয়ানা তা আস্তানা থেকে বের হয়ে কি করে? সে দূর থেকে তার পেছন পেছন চললো দেখলো, খানিক দূরে গিয়ে ইগুয়ানা তিনজন মানুষের উপর হামলা করলো ওর বিষ-কামড়ে লোক তিনটা মরে গেলো তখন সে আরামছে তার শিকার তিনটাকে গিলে ফেললো এরপর সে তার আস্তানায় ফিরে এলো এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পরলো

উইয়ো-বু-লুই ভাবলো, এই আমার সুযোগ সে চুপিচুপি ইগুয়ানার কাছে গেলো আর ইগুয়ানাকে মারবার জন্য তার লাঠি তুললো এমন সময় তার মনে হলো, ‘না’; এর উপর হামলা করার আগে জানতে হবে, বিষের থলেটা সে কোথায় রাখে? থলেটা দখল করার আগে এর সাথে লড়াইয়ে ফায়দা হবে না

কাজেই ইগুয়ানার উপর লাঠি না চালিয়ে উইয়ো-বু-লুই তার কাছে বসে রইলো অনেকক্ষণ ঘুমানোর পর ইগুয়ানা জেগে উঠলো উইয়ো-বু-লুইকে কাছে দেখে সে তৎক্ষণাৎ তার উপর লাফিয়ে পরতে তৈরী হলো কালো সাপ চিৎকার করে উঠলো- ‘দোহাই মহারাজ... আমাকে মারবেন না... আমাকে মারলে আমি আপনাকে যে গোপন খবর দিতে এসেছি, তা আপনি কখনোই জানতে পারবেন না... আপনার বিরুদ্ধে একটা ভীষণ ষড়যন্ত্র...’

ইগুয়ানা হুঙ্কার ছেড়ে জবাব দিলো- ‘আমি ওসব ষড়যন্ত্র-টড়যন্ত্রে ডরাই না যতোসব জীবজন্তু আছে, ওরা সবাই এক সাথে এলেই বা আমার কি করতে পারে? ওদের এতো জনকে মেরে আমি গিলে খেয়েছি, তবু ওদের মনে ভয় পয়দা হয় নাই? মানুষ ছাড়া অন্য প্রাণীরাও নিশ্চয় আমাকে ভয় করে চলে

কালো সাপ বললো- ‘যতদিন তুমি দুশমনদের কাজের কথা জানতে থাকবে ততদিন তোমার কোনো ভয় নাই কিন্তু তারা তোমার সর্বনাশের জন্য কে কোথায় কি করছে , তা না জানা থাকলে তো বিপদ

ইগুয়ানা বললো- ‘তা বেশ তবে তোমার কথাটা ঝটপট বলে ফেলো

উইয়ো-বু-লুই বললো- ‘তাই তো আমি তোমাকে জানাতে এসেছি কিন্তু তোমার মেজাজ দেখে আমি ভয় পেয়ে গেছি আমি তোমার কোনো লোকসান করি নাই। অথচ তুমি একটু আগেই আমাকে মেরে ফেলতে চেয়েছিলে। নিজের জীবনকে এমন বিপদে ফেলে আমি কেনো তোমার জীবন রক্ষার জন্য বলে দিবো!

ইগুয়ানা বললো- ‘আচ্ছা ষড়যন্ত্রের কথাটা বলে ফেলো আমি তোমার জীবন রক্ষা করবো এমনকি তোমার বংশের কারো উপরেও আর হামলা করবো না

কালো সাপ বললো- ‘কথা তো দিলে ভাই কিন্তু কথা যে তুমি রক্ষা করবে তা কি করে বুঝবো?’ ইগুয়ানা বললো- ‘বেশ তোমার বিশ্বাসের জন্য তুমি যা বলো আমি তাই করবো

কালো সাপ বললো- ‘তবে শোনো, তোমার বিষের থলেটা আমার হাতে দাও, আমি ষড়যন্ত্রের কথা তোমাকে বলে দেই ছাড়া আমি নিরাপদ বোধ করবো না সমস্ত জাতের জন্তুরা সভা ডেকে তোমার বিরুদ্ধে কি ভীষণ ষড়যন্ত্র করেছে, তা সব আমি তোমাকে বলে দিবো

ইগুয়ানা বললো- ‘ তোমার মস্ত দাবী ছাড়া আর যে কোনো বস্তু চাও, দিবোকালো সাপ বললো- ‘ তো তোমার দোষ ভাই আমি তোমার জান বাঁচানোর জন্য পথ বাৎলে দিতে এলাম, আর তুমি আমার মনের ভয় দূর করার জন্য সামান্য বস্তুটুকু আমার হাতে দিতে নারাজ তা বেশ; তোমার থলে তোমার কাছেই থাক আর আমার গোপন কথা আমার কাছে থাক

এই বলে কালো সাপ চলে আসতে তৈরী হলো ইগুয়ানা বললো- ‘আরে থামো ভাই, থামো অন্য কোনো শর্ত দাও, অন্য কোনো বস্তু চাও...’ কালো সাপ বললো- ‘ হো... তা হয় না আমি তবে চললামতখন ইগুয়ানা বললো- ‘আরে ভাই, এতো চটে যাচ্ছ কেনো? যখন ছাড়বেইনা, তখন এই রেখে দিলাম থলে; কিন্তু খবরদার, থলে হাত দিয়ে ছুঁয়ো না মরে যাবে...’ এই বলে তার মুখ হতে বিষের থলে বের করে পাশে রেখে দিলো সে

কালো সাপ বললো- ‘কিন্তু আমি বিষের থলে দেখে ডরাই না থলে আমার হাতে দাও, নইলে আমি চলে যাবোইগুয়ানা বললো- ‘আচ্ছা থামো এই নাও হাতে বিষের থলে এখন ষড়যন্ত্রের কথা বলো...’

কালো সাপ তার মুখের ভেতর বিষের থলেটা রাখতে রাখতে বললো- ‘এই হচ্ছে সে ষড়যন্ত্র... তোমার কাছ থেকে এই বিষের থলেটা আমাদের মধ্যে কেউ নিয়ে যাবে; যাতে তুমি আর মানুষ মারতে না পারো আজ সন্ধ্যা হওয়ার আগে আমিই সে কাজটা করবো বলে কথা দিয়েছিলাম... তুমি আমার চেয়ে গায়ের জোরে বড়; কাজেই আমি নাকি তোমাকে কাবু করতে পারবো না তাই আমি কৌশলে তোমার কাছ থেকে থলে নিয়ে নিলাম... আচ্ছা এখন তবে চলি; আর গিয়ে বাকী জীবজন্তুদের খবরটা দেই

মুন-গুন-গারলি বিষয়টা ভালো ভাবে বুঝবার আগেই কালো সাপ চম্পট দিলো ইগুয়ানা কালো সাপকে ধরতে ছুটলো কিন্তু অতিরিক্ত খাওয়ার কারণে সে জোরে দৌড়াতে পারলো না; কালো সাপ উধাও হয়ে গেলো

কালো সাপ উইয়ো-বু-লুই ছুটতে ছুটতে জানোয়ারদের কাছে গেলো এবং সব কথা খুলে বললো তারা বললো- তা হলে ভাই, বিষের থলেটা দাও; আমরা বিষ নষ্ট করে ফেলি কালো সাপ মাথা নেড়ে বললো- ‘ হো... তা দিবো কেন? থলে আমি এনেছি থলে আমার হেফাজতে থাকবে...’ জানোয়াররা উত্তর দিলো- ‘তুমি যদি বিষের থলে না দাও, তবে আর আমাদের আস্তানায় আসতে পারবে না

কালো সাপ বললো- ‘আমার যখন খুশি, তোমাদের আস্তানায় আসবোতারা বললো- ‘তা হলে তোমাকে আমরা খুন করবোকালো সাপ উত্ত দিলো- ‘তোমরা বিষের থলের কথা ভুলে যাচ্ছ আমি এখন এর মালিক এখন আমার সাথে কেউ লড়াই করতে এলে তার নির্ঘাৎ মরন

তারা কালো সাপের দাবীর কথা বুঝলো সেই জন্য তারা কালো সাপকে আর কিছু বললো না সে আপন পথে ধীরে চলে গেলো

সেই দিন থেকে আজ পর্যন্ত বিষের থলে কালো সাপের দখলেই আছে তাই এখন লোকে কালো সাপকে ভয় পায়, ইগুয়ানাকে আর ভয় পায় না ইগুয়ানা কিন্তু এখনো বিষের থলেটা ফিরে পাওয়ার আশা ছাড়ে নাই তাই কালো সাপের সাথে দেখা হলেই সে লড়াই শুরু করে দেয় কালো সাপ বিষের মালিক হলেও ইগুয়ানাকে মারতে পারে না; কারণ ইগুয়ানা এক মস্ত কবিরাজ সে বিষ থেকে বাঁচার ঔষধ জানে কালো সাপ তাকে কাটলে সে তখনি কোনো এক গাছের কাছে যায় তার পাতা খায় সাপের বিষ অমনি পানি হয়ে যায় ইগুয়ানাদের বংশ ছাড়া এই গোপন দাওয়াই আর কেউ জানে না

No comments:

Post a Comment