আমার বন্ধু মেরাজ, যারা তাকে চিনেন, তারা ত চিনেনই। আর যারা চিনেন না, তাদের জন্য আজকের দুটি কথা।
মেরাজ আমার স্কুলের বন্ধু, এলাকার বন্ধু,
বাল্যবন্ধু (আমাদের এলাকায় এটাকে বলা হতো, ন্যাংটাকালের বন্ধু, যদিও আমরা ততোটা
ন্যাংটাকালের বন্ধু না।) যার সাথে আমার প্রচুর স্মৃতি। যারা আমাকে চিনেন তারা
জানেন ছোটবেলা থেকে আমি অত্যন্ত শান্ত, আজ আমি যা কিছু চঞ্চল তা এই মেরাজের জন্য।
এমনকি আমার ফেসবুক একাউন্টের জন্য তোলা প্রথম প্রোফাইল পিকচারটাও মেরাজের বাসার
ছাদে ওর ফোনের ক্যামেরায় তোলা। যাই হোক, ঘটনায় যাই...
তখন আমরা ক্লাস টেনে, অনেক বড় হয়ে গেছি।
কিন্তু বড় হয়ে গেছি এটা বোঝানোর উপায় কি? আমরা বড় হয়েছি এটা বোঝানোর জন্য আমাদের
কিছু করতে হবে। তখন রোজার মাস, হালকা শীত, রাতে মসজিদে তারাবীর নামাজ চলে। এরকম
সময়ে মেরাজ বাসার নিচে এসে ডাক দিলো। আমি নিচে নেমে দেখি মেরাজ লুঙ্গি পড়ে এসেছে।
মেরাজ সাধারণত লুঙ্গি পরে রাস্তার এইপাড় আসে না। রাস্তার এইপাড় মানে তখনো
গুলিস্তান-যাত্রাবাড়ি ফ্লাইওভার হয়নি। এখন ফ্লাইওভারের যাত্রাবাড়ি অংশ যে জায়গায়
নেমেছে তার নাম কাজলা। কাজলার হাইওয়ের এপাশে আমার বাসা, ওপাশে মেরাজের বাসা। এই
হাইওয়ের দুইপাশেই আমাদের কৈশোর সময়ের একটা বড় অংশ কেটেছে।
মেরাজ লুঙ্গি পরে আসায় আমি একটু অবাক হলাম।
'কি রে লুঙ্গি পইরা আয়া পরলি!' মেরাজ বললো- 'হ... বাইত্তে তারাবি পরমু কইয়া
বাইরাইছি...' তারপর আমরা শনির আখড়ার রাস্তার দিকে হাটতে থাকলাম। শনির আখড়া থেকে
ভেতরে আরেকটা রাস্তা গেছে গোবিন্দপুরের দিকে। সেই রাস্তার অবস্থা ভয়াবহ, বর্ষায়
হাটু পর্যন্ত কাদা, শীতে-গরমে হাটু পর্যন্ত ধুলা। স্থানীয় এম্পির বিশেষ সুনজর পড়ায়
ঐ এলাকার তখন এই অবস্থা, এলাকার লোকজনও তেমন গা করে না, তারা এভাবেই অভ্যস্ত। আমরা
এমনভাবে হাটছি যেনো এই এলাকায় আমরা নতুন এসেছি। বেশ কয়েকজন ঘাড় ঘুরিয়ে আমাদের
দেখছেও। আমরাও ডানে-বামে সন্দেহজনকভাবে তাকাতে তাকাতে গোবিন্দপুরের রাস্তায় হাটছি।
কিছুক্ষন হাটার পর রাস্তা কিছুটা নির্জন হয়ে
এলো। লোকজনের আনাগোনা কিছুটা কম, রাস্তায় আলোও কম। মেরাজ একটা দোকানের সামনে
দাড়ালো। আমি একটু দূরে দাড়িয়ে ডানে বামে খেয়াল করছি। মেরাজ সেই দোকান থেকে দুইটা
ক্যাসেল সিগারেট, একটা ম্যাচ কিনলো। আমরা অন্ধকার গলিতে ঢুকে গেলাম।
তখন ক্যাসেল সিগারেট পাওয়া যেতো, ২ টাকা
দাম। গোল্ডলিফ ও ২ টাকা ছিলো, বেন্সন ছিলো ৩ টাকা। প্রথম কয়েকটা ম্যাচের কাঠি নষ্ট
হলো। কিভাবে সিগারেটে আগুন ধরাতে হয় দেখেছি, কিন্তু শিখিনি। সিগারেট ধরানোর সাথে
সাথে কাশি হলো, মাথা কেমন কেমন ঘুরলো। বেশ কয়েকটান দেয়ার পরই সিগারেট ফেলে দিয়ে
অন্ধকার গলি থেকে বের হয়ে হলাম। বের হলাম আরো তাড়াহুড়ো করে দ্রুত পায়ে। কে যেনো
গলির ভেতর আসছিলো। সে যদি জিজ্ঞাসা করে, কিরে পোলাপান কি করস!
গলি থেকে বের হয়ে খেয়াল পরলো সিগারেট খাওয়ার
পর কেমন যেনো গন্ধ আসছে। আমরা দুইটা চুইংগাম কিনলাম। সেটা কিছুক্ষন চাবিয়ে দেখলাম
গন্ধ যায় কিনা। তারপর হাতে-মুখে পানি দিলাম, চা-পানি এসব খেলাম। তবু মনে হচ্ছিলো
গন্ধ যাচ্ছে না। বাসায় ধরা পরলে ত কড়া পিটনি! পরে হাটতে হাটতে আমি আর মেরাজ
অনেকক্ষণ পরামর্শ করলাম, বাসায় গিয়েই আগে বাথরুমে চলে যাবো। সাবান দিয়ে হাত মুখ
ধুয়ে, জামা-কাপড় বদলে পড়তে বসে যাবো। রাতে শোয়ার আগ পর্যন্ত হু-হা দিয়ে কাজ
চালাবো, পারতপক্ষে মুখ খুলবো না। আর যদি নিদেনপক্ষে ধরা খাই-ই; বলবো চা খেতে
দোকানে বসেছিলাম, সেখানে কিছু খারাপ লোক সিগারেট খেয়ে ধোয়া ছেড়েছে, সেগুলো বাতাসে
ভেসে ভেসে আমাদের জামা-কাপড়ে লেগেছে, তাই এই গন্ধ; জীবনে আর চায়ের দোকানে বসবো না।
দেখা যাক কি হয়!
আমি তো ধরা খাইনি।
মেরাজ ধরা খেয়েছিলো কিনা সেটা জানার জন্য আমাকে অপেক্ষা করতে হয়েছে পরেরদিন বিকাল
পর্যন্ত। বিকালে আমরা আড্ডা দিতে বের হতাম। জিজ্ঞাসা করলাম- 'কিরে আন্টি টের
পাইছে?' 'নাহ...' আমরা হাসলাম। হাসলাম কারন আমরা এখন বড় হয়ে গেছি। আমরা আর নাইনের
বাচ্চাদের মতো ছোটো নেই।
No comments:
Post a Comment