16 February 2021

দৈনন্দিন আলাপ ৩৮


বর্তমানে বাংলাদেশের বেশিরভাগ রাজনৈতিক দলই পরিণত হয়েছে স্মৃতিচারণ মূলক রাজনৈতিক দলে। হয় তারা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির স্মৃতিচারণ করে; নেতাজী সুভাষ বসু, মওলানা ভাসানী। অথবা বিশেষ কোনো দিনের স্মৃতিচারণ করে; ৫২, ৬৬, ৬৯, ৭১, ৯০। অথবা অতীতের গৌরবজ্জ্বল রাজনীতিকে মনে মনে স্মরণ করে বছর শেষ করে।

রাজনীতি কি এটা না জেনেই দিনের পর দিন রাজনীতি করে চলার কুফল হাড়েহাড়ে টের পাচ্ছে বাংলাদেশের জনতা। রাজনীতি করার জন্য এখন আর মানুষের কথা ভাবা লাগে না, মানুষের মঙ্গল চিন্তা করা লাগে না। রাজনীতিতে তাই ব্যবসায়ী আর পুঁজিপতিরা জায়গা করে নিয়েছে। রাজনীতিকে তারা ব্যবহার করছে তাদের ব্যবসা বৃদ্ধির একটি অন্যতম মাধ্যম হিসেবে।

রাজনীতি আসলে কি? রাজনীতি হচ্ছে এমন একটা উপায় যাতে মানুষের কথা ভাবা হয়। কিভাবে সামগ্রিক জনতার আজকের দিনের চেয়ে কালকের দিন ভালো কাটবে, তা ভেবে বের করা। কি করলে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর উন্নতি হবে। কি করলে, জনতা মর্যাদার সাথে আরেকটা দিন বাঁচতে শিখবে। অথচ বাংলাদেশের দিকে তাকালে এর উলটো চিত্র দেখা যাবে প্রচুর।

এখানে একটি বৃহৎ অংশ রাজনীতিকে ঝুকিপূর্ণ মনে করে এর থেকে দূরে থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। হয় তারা নিরপেক্ষতা অবলম্বন করে অথবা বাধ্য হয়। আরেক পক্ষ রাজনীতিকে নিজের ও নিজের পরিবারের উন্নয়নের উপায় হিসেবে ব্যবহার করে। যেকোনো উপায়ে নিজের সম্পদ বৃদ্ধি করতে গিয়ে এমন কোনো হীন কাজ নেই যা তারা করে না। মজুতদারী, চোরাকারবারী, জাতীয় সম্পদ চুরি করা, জাতীয় সম্পদ নষ্ট করা, লুটপাট, দূর্নীতি ইত্যাদি।

কেবল একটি ছোট্ট অংশ সচেতনভাবে স্রোতের বিপরীতে গিয়ে জনতার মঙ্গলের উদ্দেশ্যে রাজনীতি করে যাচ্ছেন। তারাও যদি দিবস পালন, ব্যক্তি পূজা, বাদ-বিবাদের তত্ত্বে বিভক্ত হয়ে পরেন, জনতার কথা ভাববে কে!

রাজনীতি মানে পলিসি মেকিঙের গুণগত মান পরিবর্তন করা। অর্থাৎ পলিসিতে এমন কিছু বাস্তবায়ন করা যেটাতে বৃহত্তর জনগোষ্টীর মঙ্গল হবে। অথবা এমন কোনো পলিসি হতে না দেয়া যেটাতে জনতার অমঙ্গল হবে। উদাহরন হিসেবে বলা যায় বর্তমান শেখ হাসিনা সরকারের (২০০৯-২০২১) সুন্দরবন ধ্বংস করে বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করার সিদ্ধান্ত।

সুন্দরবন বাংলাদেশের জাতীয় সম্পদ। বাংলাদেশের সকল নাগরিক এর মালিক। এমনকি যে ব্যক্তি তেতুলিয়া থাকে এবং জীবনে একবারও সুন্দরবন দেখে নি, সেই বাংলাদেশী নাগরিকও এর মালিক। তারচেয়েও বড় কথা সুন্দরবন প্রকৃতির দান, আমরা এটা বানাই নি। প্রকৃতি যে দান আমাদের হাজার বছর ধরে দিয়েছে, আমরা সেটা এক অবিবেচক সরকারের অন্যায় ইট-পাথরের উন্নয়নের স্লোগান তুলে ধ্বংস করে ফেলতে পারি না। একদিন হাসিনা সরকার থাকবে না। কিন্তু বাংলাদেশের উপকূলবর্তী জনতা আর বঙ্গোপসাগরের ভয়াল জলোচ্ছ্বাস থাকবে। সরকারের কোন বংশধর উন্নয়নের প্ল্যাকার্ড হাতে সেই জলোচ্ছ্বাস ঠেকাবে।

যাই হোক, রাজনীতি হতে হবে পলিসি মেকিং বিষয়ে। ক্ষমতায় যাওয়ার পরে একজন জনতাবাদী রাজনীতিবিদ যেমন জনতাবাদী পলিসি করবে, তেমনি ক্ষমতায় না থাকলেও বিদ্যমান সরকারকে জনতাবিরোধী পলিসি করতে দিবে না। মানে রাজনীতিতে জনতাবাদ ক্ষমতায় থাকা বা না থাকার সাথে সম্পর্কিত নয়।

এই সহজ বিষয়টা রাজনীতিবিদরা বুঝতে পারছে না। সরকারের চাপে যদি আপনি হক কথা বলতে ভয় পান, তাহলে রাজনীতি আপনার জন্য না। সরকার তো চাইবেই জনতাকে অন্ধকারে রেখে, সৎ রাজনীতিবিদদের চাপের উপর রেখে, নিজের লুটপাট নিষ্কন্টক করতে। আপনার দুর্নীনিবিরোধী আন্দোলন তার পেটে লাত্থি। সে এটা বরদাশত করবে কেন?

যারা বিভিন্ন রাজনীতিবিদদের দিয়ে প্রভাবিত, তারা নেতাদের জন্মদিন-মৃত্যুবার্ষিকি পালনের পাশাপাশি একবার ভেবে দেখতে পারেন; ঠিক এই সময়ে, ঠিক এই দুর্যোগে, সুভাষ থাকলে কি করতেন, ভাসানী থাকলে কি করতেন। তারা থাকলে যেটা করতেন, সেটা যদি বুঝতে পারেন, সেটা যদি করতে পারেন, তাহলে সেটাই হবে তাদের প্রতি সবচেয়ে বড় সম্মান।

সুভাষ আর ভাসানীর নাম নিচ্ছি কারন তারা এমন নেতা, যারা জনতার মঙ্গলের সাথে কোনোদিন আপোষ করেননি। নিজের ব্যক্তিস্বার্থে জনতার বৃহৎ স্বার্থ বিসর্জন দেননি। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত মানুষের কল্যান কামনা করে গেছেন। তাদের সারা জীবন আমাদের কাছে সেই বার্তা দেয়। জনতার মঙ্গল কামনার রাজনীতি তাই তাদের স্মৃতির প্রতি সবচেয়ে বড় সম্মান প্রদর্শন, দিবস পালন নয়।

প্রত্যেক মানুষের অধিকার আছে সম্মানের সাথে ভালোভাবে জীবন যাপন করার। সরকার ও রাষ্ট্রের কাজ তাদের সেই জীবন যাপনকে সহজ করা, নির্বিঘ্ন করা। কিন্তু সরকার ও রাষ্ট্রব্যবস্থা যদি জনতার অজ্ঞতার সুযোগে অকল্যানকামী পলিসি চাপিয়ে দেয়, তাহলে জনতা সেই সরকার ও রাষ্ট্র দিয়ে কি করবে!

স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও আমাদের এসব নিয়ে কথা বলতে হচ্ছে এটা আমাদের দুর্ভাগ্য। কিন্তু তারচেয়েও বড় বিপর্যয় হবে যদি আমরা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য একটি বাসযোগ্য স্বনির্ভর বাংলাদেশ রেখে যেতে না পারি।

 

 

No comments:

Post a Comment