২০২১ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি, বেলারুশের ইউক্রেন সীমান্তে রাশিয়া-বেলারুশ যৌথ মহড়া। ছবি: এপি, রাশিয়ান ডিফেন্স মিনিস্ট্রি প্রেস সার্ভিস থেকে |
১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর যুক্তরাষ্ট্র একক পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। প্রতিদ্বন্দ্বীর অভাবে প্রাসঙ্গিকতা হারায় যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের সামরিক জোট ন্যাটো। কিন্তু এরপরও পৃথিবী যুদ্ধবিহীন হয়নি। যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর মিত্ররা নানা অজুহাতে অপেক্ষাকৃত দুর্বল রাষ্ট্র ইরাক ও আফগানিস্তানের ওপর চাপিয়ে দেয় একতরফা যুদ্ধ।
পরাশক্তির এ ভারসাম্য পরিবর্তিত হতে থাকে ২০১০ সালের পর। এ সময় চীনের অর্থনীতি ও সোভিয়েত ইউনিয়নের উত্তরসূরি রাশিয়ার কূটনীতি যুক্তরাষ্ট্রের একক পরাশক্তি হয়ে ওঠার লক্ষ্মণগুলোকে বাধা দিতে থাকে। এ সময় বেশ কয়েকটি ফ্রন্টে সংগঠিত হয় ছায়া যুদ্ধ (প্রক্সি ওয়ার)। ২০১০ থেকে ২০২০ এই সময়ে ছায়া যুদ্ধ হয় সিরিয়ায়। সেখানে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা বাশার আল আসাদের বিদ্রোহী গোষ্ঠীকে অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে সমর্থন জানায়। কিন্তু রাশিয়া বাশারের প্রতি তাদের সমর্থন অব্যহত রাখে। ছায়া যুদ্ধ চলে লিবিয়ায়, ইয়েমেনে।
এই সময়ের মধ্যে দুইটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। এক, ন্যাটো তার জোটের সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি করতে থাকে। পূর্ব ইউরোপে বিস্তৃতি ঘটে যুক্তরাষ্ট্র ও তার সামরিক মিত্র ন্যাটোর সম্প্রসারনবাদের। সাবেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র ও সমাজতান্ত্রিক ব্লকের দেশগুলো যোগ দিতে থাকে ন্যাটোতো। পোল্যান্ড, রুমানিয়া, বুলগেরিয়া, এস্তোনিয়া, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া একে একে যোগ দেয় ন্যাটোতে।
সোভিয়েত ইউনিয়ন ঠেকানোর জন্য যে সামরিক জোট, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর তার কাজ কি? প্রকারান্তারে ন্যাটো যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি অস্ত্র হয়ে উঠে। যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ববাসীকে বোঝাতে চায় যে, ন্যাটো ও অন্যান্য সহযোগীদের সঙ্গে নিয়ে তারা ‘গণতন্ত্র ও মানবাধিকার’ প্রতিষ্ঠা করবে। কিন্তু প্রকারান্তরে তারা জারি রেখেছে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার। আর বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের এই মিশনে তার সহযোগী ন্যাটো। তাই খুব স্বাভাবিকভাবে পূর্ব ইউরোপে ন্যাটোর বিস্তারকে রাশিয়া নিজের অস্তিত্বের জন্য হুমকি মনে করবে।
দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, ২০১০ সালের পর থেকে রাশিয়া তার সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে থাকে। নিজের সুবিশাল আয়তনের বাইরেও অস্তিত্ব জানান দিতে থাকে রাশিয়া। এ সময় চীন এবং ইরানের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ক ও সহযোগীতা বাড়তে থাকে। সাবেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রের কয়েকটিকে সঙ্গে নিয়ে গড়ে তোলা হয় অর্থনৈতিক জোট। এ সময় সাবেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রগুলোর মধ্যে জর্জিয়া ও ইউক্রেনের সঙ্গে দুরত্ব বাড়তে থাকে রাশিয়ার।
রাশিয়া নিজের স্বার্থে সাবেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রগুলোর রুশপন্থী সরকার ও বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সমর্থন দেওয়া অব্যহত রাখে। এর মধ্যে ২০০৮ সালের আগস্ট মাসে জর্জিয়ার স্বাধীনতাকামী অঞ্চল আবখাজিয়া ও দক্ষিণ ওশেতিয়ার সমর্থনে সৈন্য পাঠায় রাশিয়া। এর পর ২০১৪ সালের মার্চে ইউক্রেনের স্বশাসিত প্রজাতন্ত্র ক্রিমিয়া রাশিয়ায় যোগ দেয়। একই সঙ্গে পূর্ব ইউক্রেনের রুশপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদী অঞ্চল দোনেত্সক ও লুহান্সক ইউক্রেনের অখণ্ডতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র দাবি করেছে, ইউক্রেন সীমান্তে প্রায় ১ লাখ সৈন্যের সমাবেশ ঘটিয়েছে রাশিয়া। ইউক্রেন দখল করে রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা নষ্ট করতে চায় রাশিয়া, বলে অভিযোগের আঙুল তুলেছে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু এই বিষয়ে রাশিয়ার ভাষ্য, ইউক্রেনের ন্যাটোতে যোগ দেওয়া যাবে না এবং পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো থেকে ন্যাটোর সৈন্য সংখ্যা কমিয়ে আনার শর্তে চাপ প্রয়োগ করার জন্য এই সৈন্য সমাবেশ। মূলত রাশিয়া ইউক্রেনকে ঘিরে রেখেছে তিন দিক থেকে। পূর্ব দিকে ইউক্রেনের রুশ সীমান্ত ও দোনেত্সক-লুহান্সকের বিরোধপূর্ণ অঞ্চল, উত্তরে বেলারুশ সীমান্ত এবং দক্ষিণে ক্রিমিয়া ও মোলদাভিয়ার ট্রান্সনিস্ট্রিয়া অঞ্চলে রাশিয়ার সেনাদের উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে।
ন্যাটোর
সম্প্রসারনের বিরোধীতা করতে গিয়েই আজকের এই সংকট। কিন্তু যদি রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধে
জড়িয়ে পড়ে তাহলে মানবিক বিপর্যয় দেখা দিবে পুরো পূর্ব ইউরোপ জুড়েই। আর এই মানবিক বিপর্যয়
সামাল দেওয়ার মতো মানসিক অবস্থা ইউরোপের আছে কি না তা ভেবে দেখতে হবে। আলোচনার মাধ্যমে
যে সংকটের সমাধান করা সম্ভব; তা নিয়ে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়াটা হবে একেবারে অনুচিত একটি সিদ্ধান্ত।
No comments:
Post a Comment