8 March 2021

তুরস্কের ইতিহাস ও রাজনীতি। পর্ব ৫। আনাতোলিয়ার মঞ্চে বাইজেন্টাইন থেকে সেলজুক


মুসলিম বিশ্বে ক্ষমতার পালাবদলের সুযোগে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য আবার তার শক্তি বৃদ্ধি করতে সচেষ্ট হয়। বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য বলকান ফ্রন্টে সাম্রাজ্য বিস্তার করে তারপর আনাতোলিয়ার দক্ষিণে মনোযোগ দেয়। সম্রাট নিকেফোরাস ২য় ফোকাস (৯৬৩-৯৬৯) বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের হারানো গৌরব ফিরে পেতে সচেষ্ট হন। তিনি আলেপ্পো ও ক্রিট দখল করে নেন। তার উত্তরসূরী সম্রাট জন জিমিসকেস (৯৬৯-৯৭৬) দামেস্ক, বৈরুত, আক্রে, সিডন ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ শহর ও বন্দর দখল করে নেন। তারপর সম্রাট বাসিল ২য় (৯৭৬-১০২৫) বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের ক্ষমতাকে আরো সুসংহত করেন। সম্রাট বাসিল ২য় কে শেষ শক্তিশালো বাইজেন্টাইন সম্রাট বলা চলে।

১০২৫ সালে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য 

এদিকে মুসলিম বিশ্বে অন্তর্কোন্দল ও বহিঃআক্রমন চললেও ইরাক ও মিসরের শহরগুলো বাইজেন্টাইন আক্রমন থেকে নিরাপদ থাকে। মুসলিম বিশ্বের ক্ষমতা এক হাত থেকে আরেক হাতে যেতে যেতে শেষপর্যন্ত সেলজুকদের হাতে পৌছায়। ১০৪০ এর মধ্যেই সেলজুকরা মধ্যপ্রাচ্যের গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। সেলজুকরা বাগদাদ কেন্দ্রীক রাজনীতি করলেও তাদের রাজধানী থাকে বর্তমান নিশাপুর ও রে শহর। এসময় নামমাত্র ক্ষমতা আব্বাসিয় খলিফার হাতে থাকে।

১০৪৮ সালে রাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য ও সেলজুক সাম্রাজ্য যুদ্ধে জড়িয়ে পরে। ঐ বছরের কাপেত্রুর যুদ্ধে সেলজুকরা জয়লাভ করলে সীমান্তের কিছু বাইজেন্টাইন এলাকা তাদের হস্তগত হয়। এরপর ১০৬৭ সালে সেলজুকরা কাইসারি (সিজারিয়া) ও ১০৬৯ সালে কোনিয়া (আইকোনিয়াম), দুইটি গুরুত্বপূর্ণ বাইজেন্টাইন শহর দখল করে নেয়। বাইজেন্টাইনরা হারানো শহর পুনর্দখল করতে চেষ্টা করতে থাকে। ১০৭১ সালের মাঞ্জিকার্তের যুদ্ধে বাইজেন্টাইনদের পরাজয় আনাতোলিয়ায় তাদের শক্তিকে নিঃশেষ করে ফেলে। মাঞ্জিকার্তের যুদ্ধ আনাতোলিয়ার পরবর্তী ইতিহাস তৈরীতে ভূমিকা রাখে।

সেলজুক সুলতান আল্প আরসালান ১০৭১ সালে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের সাথে শান্তিচুক্তি করতে চান। এক সীমান্তে শান্তিচুক্তি করে তিনি চেয়েছিলেন অপর সীমান্তে ফাতেমিয় খিলাফতের অধিকারে থাকা সিরিয় শহর আলেপ্পো আক্রমন করবেন। তিনি যখন সৈন্যবাহিনী নিয়ে আলেপ্পোর দিকে রওনা দেন তখন বাইজেন্টাইন সম্রাট রোমানস ৪র্থ মাঞ্জিকার্তের দিকে আসতে থাকেন। সম্রাট রোমানস ভেবেছিলেন আল্প আরসালান যখন আলেপ্পো অবরোধের ব্যস্ত থাকবেন, তখন তিনি মাঞ্জিকার্ত সংলগ্ন পূর্ব আনাতোলিয়া অধিকার করবেন।

কিন্তু আল্প আরসালানের কাছে খবর আসে, সম্রাট রোমানস মাঞ্জিকার্তের দিকে যাচ্ছেন। তিনি দ্রুত আলেপ্পো থেকে তার সৈন্য সরিয়ে মাঞ্জিকার্তের দিকে রওনা দেন। সম্রাট রোমানস আল্প আরসালানের এই সিদ্ধান্তের খবর তখনও পাননি। ১০৭১ সালে ২৬ আগস্ট বেইজেন্টাইন-সেলজুক দুই পক্ষ মুখোমুখী হয়। যুদ্ধে সম্রাট রোমানসের পক্ষে ছিলো ৪০-৫০ হাজার সৈন্য এবং সুলতান আল্প আরসালানের ছিলো ২০-৩০ হাজার সৈন্য। যুদ্ধ শুরুর আগে সুলতানের পক্ষ থেকে আবারো শান্তিচুক্তি করার প্রস্তাব দেয়া হয়। সম্রাট রোমানস শান্তিচুক্তি করতে অস্বীকৃতি জানান। সুলতান আল্প আরসালান কাফনের সাদা কাপড় পরে যুদ্ধের ময়দানে হাজির হন। যুদ্ধে পরাজয়ের পর সম্রাট রোমানসকে হাজির করা হলে আল্প আরসালানের সাথে তার কথোপকথন নিয়ে কিংবদন্তী তৈরী হয়।

রক্ত ও কাদামাখা বিদ্ধস্ত সম্রাটকে আল্প আরসালানের সামনে আনলে তিনি প্রথমে বিশ্বাস করতে চান নি, এটাই সম্রাট রোমানস। পরে তার পরিচয় নিশ্চিত হলে, তিনি জিজ্ঞাসা করেন-

আমি যদি আপনার সামনে বন্দী হিসেবে হাজির হতাম, আপনি কি করতেন?

হয়তো হত্যা করতাম, অথবা কন্সট্যান্টিনোপোলের রাস্তায় আপনাকে প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করতাম।

আমার শাস্তি এরচেয়ে অনেক ভারী। আমি আপনাকে ক্ষমা করলাম এবং মুক্ত করলাম।

এরপর সুলতান সম্রাটকে বিপুল পরিমান উপহার সহ মুক্তি দেন। তাকে সসম্মানে কন্সট্যান্টিনোপোল পৌছে দেয়ার জন্য ২জন আমির ও ১ হাজার সৈন্যকে নির্দেশ দেন। যুদ্ধের ক্ষতিপূরন হিসেবে সুলতান আল্প আরসালান ১৫ লক্ষ স্বর্ন্মুদ্রা দাবী করেন। সমগ্র পূর্ব আনাতোলিয়ার অধিকার সুলতানের হাতে আসে এবং দুই সাম্রাজ্যের মধ্যে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।

ইতিহাসে মাঞ্জিকার্তের যুদ্ধের প্রভাব সুদূরপ্রসারী। যুদ্ধে পরাজয়ের পর বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। শুরু হয় সম্রাট রোমানসের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। ১০৭১ সালেই সম্রাট রোমানস মৃত্যুবরণ করলে পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে হয়ে উঠে। পূর্ব ও মধ্য আনাতোলিয়ার গ্রীকরা পশ্চিম দিকে সরে যেতে থাকে। সেলজুকদের হাত থেকে বাইজেন্টাইন জমি পুনরোদ্ধারকে কেন্দ্র করে শুরু হয় ১ম ক্রুসেড।

ক্ষমতাকে কেন্দ্র করে সেলজুক সাম্রাজ্যেও শুরু হয় গৃহবিবাদ। সুলতান মালিক শাহের (১০৭২-১০৯২) সময়ে সেলজুক সাম্রাজ্য তার সর্বোচ্চ সীমান পৌছায়। পশ্চিমে আফগানিস্তান-তুর্কমেনিস্তান থেকে পুর্বে আনাতোলিয়া। মালিক শাহের মৃত্যুর পর সেলজুক সাম্রাজ্য ভাগ হয়ে যায়। আনাতোলিয়ার ক্ষমতায় আসেন কিলিজ আরসালান। কিলিজ আরসালানের পিতা সুলাইমান বিন কুতালমিশ সেলজুক রুম সালতানাতের প্রতিষ্ঠাতা।

No comments:

Post a Comment