10 October 2022

শাকিবকে নিয়ে মানুষের আগ্রহের ৪টি কারণ

কয়েকদিন আগে এক বড়ভাইয়ের সাথে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা হচ্ছিলো। তো কথা তার স্বাভাবিক নিয়ম মতে এক ডাল থেকে আরেক ডালে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। হঠাৎ আমরা দুজনেই খেয়াল করলাম, আমাদের আলোচনায় শাকিব খান চলে এসেছে। আলাপ শেষ করার আগে আমি বললাম- আরেহ শাকিব খান এতো গুরুত্বপূর্ণ টপিক না! ওই ভাই বললেন, শাকিব অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, নাহলে আমাদের ১ ঘন্টার আলাপে ৫ মিনিট শাকিব খান থাকবে কেন?

আসলেই তাই! আমাদের কারও কারও ক্ষেত্রে এই সময়টা আরও অনেক বেশি। বাসে, মাঠে, চায়ের দোকানে, বন্ধুদের আড্ডায়, ফেসবুকে সব জায়গায় শাকিব খানের কথা। কেউ জানতে চাইছেন, কেউ জানাতে চাইছেন, কেউ মিম করে মজা নিতে চাইছেন; যে ফরম্যাটেই হোক না কেন, আলোচনা কিন্তু শাকিবকে নিয়েই। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না, তিনি এই মুহূর্তে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের সবচেয়ে জনপ্রিয় নায়ক!

শাকিব খানকে নিয়ে মানুষের এতো আগ্রহ কেন? আমরা মানুষের এই আগ্রহের পেছনের ৪টি কারণ এখানে খুঁজে বের করার চেষ্টা করবো।

কারণ ১: শাকিব রোমান্টিক হিরো!

বাংলাদেশের মানুষের মাঝে চরম জনপ্রিয় রোমান্টিক হিরো ছিলেন সালমান শাহ। সালমান শাহের অকাল মৃত্যুর পর বাংলাদেশের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে নিজেকে প্রমানের জন্য অনেক হিরো ছিলেন- রিয়াজ, ফেরদৌস, আমিন খান, অমিত হাসান, আলেকজান্ডার বো প্রমুখ। কিন্তু তারা কেউই নিজেকে মাস-পিপলের কাছে রোমান্টিক হিরো হিসেবে তুলে ধরতে পারেননি। এই শূন্যস্থান পূরণ করেছেন শাকিব। তিনি নিজেকে মাস-পিপলের কাছে রোমান্টিক হিরো হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন।

আর এক্ষেত্রে হয়ত মাস-পিপলের অবচেতনে ‘এস’ ফ্যাক্টর কাজ করেছে। সালমান শাহের নামের সাথে শাকিব খানের নামের ‘এস’ ধ্বনির মিল সম্ভবত দর্শকদের অবচেতনে এই জায়গা তৈরি করেছে। দর্শক ভেবে থাকতে পারেন, সালমান শাহ যা দিতে পারতেন, তা হয়ত শাকিবের কাছ থেকে পাওয়া যাবে। এই অতৃপ্তি শাকিবের একের পর এক হিট ছবির পেছনে আরেকটি কারণ হতে পারে।

কারণ ২: শাকিব ফ্যাশন আইকন!

শাকিব হয়ত শহুরে মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্তের কাছে তার ফিল্ম নিয়ে ততোটা পৌঁছাতে পারেননি। কিন্তু আসলে বাংলাদেশে এমন মানুষ পাওয়া কষ্টকর হবে যে তার নাম শোনেনি। দীর্ঘদিন বাংলাদেশের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি এবং এফডিসির প্রতিনিধিত্ব করেছেন তিনি। বাংলাদেশের মুভির আকালের সময়েও তিনি কিছু সিনেমা নিয়ে মানুষের সামনে হাজির ছিলেন। বিশেষ করে এই কারণেই বাংলাদেশের মফস্বল ও গ্রামাঞ্চলে এখনও তুমুল জনপ্রিয় তিনি।

গ্রামাঞ্চলে জনপ্রিয়তার কারণেই শাকিব খান বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান ফ্যাশন আইকনে পরিণত হয়েছিলেন। তিনি ছেঁড়া-ফাটা জিন্স পরলে, সেটা গ্রামের তরুণরা ফলো করা শুরু করতো। তিনি চুলে সিলভার কালার করালে, গ্রামের সেলুনগুলোতে তরুণদের ভিড় পড়ে যেতো চুল রঙ করাতে। তার নাম্বার ওয়ান শাকিব খান লেখা হলুদ রঙের টিশার্ট, বাংলাদেশের গ্রাম-মফস্বলে আসলে কি পরিমাণ বিক্রি হয়েছে, তার কোনো পরিসংখ্যান নেই। আপনি স্বীকার করেন আর না করেন, শাকিব খান বাংলাদেশের মফস্বলের তরুণদের ফ্যাশন আইকন।

কারণ ৩: অর্থনীতিতে শাকিবের অবদান!

বাংলা সিনেমার খড়ার সময় শাকিব খান ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিকে জীবিত রেখেছেন। হোক অনেকে পরিবার নিয়ে সিনেমা হলে যাওয়া বন্ধ করেছে, অনেক জায়গায় সিনেমা হলই বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু শাকিবের বেশ ভালো পরিমাণ ফ্যান-ফলোয়ার আছে যারা তার সব ছবি দেখেছে। সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে সরাসরি অবদান রেখেছেন তিনি, এ কথা কোনো সন্দেহ না রেখেই বলা যায়। পাশাপাশি একজন ফ্যাশন আইকন হিসেবে তিনি দেশের অর্থনীতিতে পরোক্ষ ভূমিকাও রেখেছেন।

শাকিবের নতুন চুলের কাট, চুলের কালারের সাথে তাল মিলাতে গিয়ে গ্রামের সেলুনগুলোকে তুলনামূলক আধুনিক হতে হয়েছে। তার মতো প্যান্ট, শার্ট, টিশার্ট, চশমা ইত্যাদি উৎপাদন ও বিক্রি করে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে কতজন ব্যবসায়ী, দোকানদার বা হকার কয় টাকার ব্যবসা করেছেন তারও কোনো হিসাব নেই। তার নতুন একটি মুভি বাজারে আসার পর নানান সেক্টরে ঠিক কতো টাকার ব্যবসা হয়, বাংলাদেশে অর্থনীতি বিষয়ক ভালো কোনো প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলে এ হিসাব করা যেত। যাই হোক, আপনি আপনার পরিচিত গ্রামের মানুষদের কাছ থেকে ব্যক্তি পর্যায়ের হিসাবটা জেনে নিতে পারেন।   

কারণ ৪: গসিপ মানুষের পছন্দের টপিক!

এ বিষয় নিয়ে সমাজবিজ্ঞানীদের বিস্তর গবেষণা আছে। মানুষ না কি আদতে গসিপ করা পছন্দ করে, তা সে যেই ফরম্যাটেই হোক না কেন! নিন্দা, পরচর্চা, গিবত, চোগলখোরি ইত্যাদি আসলে মানুষ যুগ যুগ ধরে করে আসছে। আপনি খেয়াল করে দেখুন- বাসে, চায়ের দোকানে বা অফিসের বারান্দায় কি নিয়ে কথা হচ্ছে? আরেকজনের বিষয়ে নিন্দাসূচক কিছু বলে অপরকে আনন্দ দেয়া বিষয়টি খোলা চোখে নির্দোষ মনে হলেও, এটি আসলে মানুষের মৌলিক নেতিবাচক বৈশিষ্ট্য। অনেক মানুষের তো জীবনের একটা বড় অংশই কেটে যায় আরেকজন কি করলো তা আলোচনা করে!

যাই হোক, শাকিব খান পাবলিক ফিগার হিসেবে দেশের সবার কাছে পরিচিত, আবার সিনেমার হিরো হিসেবে রাজনীতিবিদদের তুলনায় নির্বিষ। তার ওপর ফ্যাশন আইকন হিসেবে তার লাইফস্টাইল নিয়ে মানুষের মধ্যে স্বাভাবিক আগ্রহ আছে। এর মানে তিনি যা করবেন তা মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রে থাকবে এটাই স্বাভাবিক। আর মানুষের এই গসিপ রান্নায় মসলার জোগান দেন বিনোদন সাংবাদিকরা। দিনশেষে তো তাদের নিউজ থেকে কামাই করা লাগে! ফলে এখানে একটা উইন-উইন অবস্থা তৈরি হয়। যেখানে মানুষ যা দেখতে চায়, তা মিডিয়াওয়ালারা দেখায়; আবার অপর পাশে মিডিয়া যা দেখায় মানুষ তা দেখে। আর এক্ষেত্রে মানুষের হাজার বছরে গড়ে ওঠা ন্যাচারের বলির পাঠা- শাকিব খান।

লেখাটা শেষ করতে করতে আমিও ওই বড়ভাইয়ের মতো ভাবতে শুরু করেছি, শাকিব আসলে গুরুত্বপূর্ণ! 

4 June 2022

মাটির চুলা

 


অনেক ছোটবেলায় রোজার ঈদ করতে নানাবাড়ি যেতাম আমরা। রোজার ঈদ নানাবাড়ি আর কোরবানির ঈদ দাদাবাড়ি। তখন নানাবাড়ি যেতে খুব ভালো লাগতো। আমরা তিন ভাই সারা বছর অপেক্ষা করে থাকতাম কখন নানাবাড়ি রোজার ঈদ হবে, আর কখন নানাবাড়ি যাবো! অন্তত ক্লাস টেন পর্যন্ত এই ছিলো আমাদের ঈদের ছুটির রুটিন। ঐ সময় মনে হতো নানাবাড়ির দিককার আত্মীয়স্বজনেরাও রোজার ঈদে আমাদের জন্য অপেক্ষা করে আছেন।

কতো স্মৃতি সেই সময়ের! কতো মানুষ, খোলা উঠান, শুকনো চরা, সমবয়সী কাজিনেরা মিলে গ্রাম আর গ্রামের হাট-বাজার ঘুড়ে বেড়ানো, দিনভর খেলাধুলা, আব্বা-আম্মার শাসনহীন সাতদিন। কিন্তু এর মধ্যে আজকে বলবো একদম ছোটবেলাকার একটা স্মৃতি। আমি পড়ি ক্লাস টু বা থ্রিতে, ঠিক মনে নেই। নানাবাড়িতে আম্মার এক চাচাত বোন ছিলেন, আমাদের খালা, নাম হাসিনা। তিনি তখন পড়তেন ক্লাস নাইন বা টেনে। তিনি আমাদের খুবই আদর করতেন।

হাসিনা খালা খুবই হাসি-খুশি মানুষ ছিলেন। আমার যতোদূর মনে পড়ে খুবই চঞ্চল ছিলেন তিনি। দৌড়াদৌড়ি করতেন, খেলতেন, আশপাশের সবার সঙ্গে হেসে কথা বলতেন, দুষ্টামি করতেন। চানরাতে আমাদের হাতে মেহেদী দিয়ে দিতেন। আমার নাকের নিচে কলম দিয়ে গোঁফ এঁকে দিতেন। তারপর সবাইকে দেখাতে নিয়ে যেতেন; পুশকিনে বড় হইয়া গেছে, দেখেন অর মোচ হইছে! তখন বাড়িতে আম্মার বেশ কয়েকজন চাচাত বোন ছিলেন, যারা স্কুলে পড়তেন। মাইনূর, কোহিনূর, হাসিনা খালার এক বড় বোন; নাম মনে নেই, তার সাথেই পড়তেন। সবার চেয়ে বেশি প্রাণোচ্ছল ছিলেন হাসিনা খালা।

হাসিনা খালা আমাকে কোলে নিয়ে ঘুড়ে বেড়াতেন। খেতের মাঝখানের আইল ধরে আমাকে কোলে নিয়ে ঘুড়ে বেড়াতেন তিনি। আশপাশের বাড়িতে নিয়ে যেতেন, বলতেন- আমাদের মুশফিকা আপার ছেলে, ঢাকা থাকে। নানাবাড়ির পেছনের দিককার খেতগুলোর মাঝখানে তখন দুইটা বড় তাল গাছ ছিল। সেই তাল গাছের ছায়ায় আমাকে নিয়ে বসে থাকতেন তিনি। তার স্কুলের বান্ধবীরা আমাকে দেখতে একবার তার বাড়িতে এসেছিলেন।

তখন মাটির চুলায় রান্না হতো। আমারও একদিন শখ হলো নিজের জন্য একটা মাটির চুলা লাগবে। হাসিনা খালারা প্রথমে আমাকে বোঝাতে চেষ্টা করলেন, এগুলো মেয়েদের খেলা; চুলা, হাঁড়ি-পাতিল, রান্না-বান্না। ছেলেদের খেলা হলো ফুটবল, ক্রিকেট, গোল্লাছুট, হাডুডু। আমি যখন নাছোড়বান্দা, তখন তিনি রাজি হলেন, ঠিক আছে তোকেও একটা চুলা বানিয়ে দিবো। সেই দুই তাল গাছের নিচে আমার জন্য চুলা বানাতে বসলেন তিনি। খেতের পাশের খাল থেকে কাদা তুলে আনলেন। সেগুলো আকার দিয়ে, লেপে, রোদে দিয়ে, দুই দিনেই বানিয়ে ফেললেন মাটির চুলা। সেই চুলার ওজন একটু বেশি হলেও তিনি সেটা ধরে এদিক-ওদিক সরাতে পারতেন।

এই ছিল হাসিনা খালার সাথে আমার স্মৃতি। আত্মীয় এবং কাছের লোকদের খোঁজখবর না নেওয়ার বিষয়ে আমার একটা দুর্নাম আছে। এর মধ্যে জীবন চলেছে জীবনের গতিতে। নানান কাজে ও অকাজে ব্যস্ত থেকেছি। এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার পর দীর্ঘদিন নানাবাড়ি যাইনি। এসময় ঢাকাতেই ঈদ করতাম। তখন চিটাগাং রোড-কাচপুর এলাকায় মারাত্মক যানজট হতো। যানজট ভালো লাগতো না বলে দাদাবাড়ি-নানাবাড়ি কোথাও যেতাম না। মাঝখানে শুধু আম্মার কাছ থেকে শুনেছিলাম, পাশাপাশি কোনো এক গ্রামে হাসিনা খালার বিয়ে হয়েছে।

এরপর কোনো এক কাজে নানাবাড়ি যাই মাস্টার্স পরীক্ষা দেওয়ার পর, ২০১৩ সালে। নানাবাড়ি আর আগেকার মতো নেই। নানাবাড়ির সেই খোলা উঠানে কোনো এক মামা বাড়ি বানিয়েছেন। নিজেদের মধ্যে ঝগড়াবিবাদ করে কেউ বেড়া দিয়েছেন; যাদের স্বামর্থ আছে তারা তুলেছেন ইটের দেয়াল। যাদের সাথে খেলতাম, ছেলেরা কাজের জন্য ঢাকা বা বিদেশবিভূইয়ে পাড়ি জমিয়েছেন, মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে। পিঠাপিঠি মামাতো ভাই শ্যামলও নেই তখন ৪ বছর হয়েছে। কেমন যেনো এক শূন্যতা! কেমন যেনো এক হাহাকার!

নানীকে জিজ্ঞাসা করলাম, হাসিনা খালা আসে না বাড়িতে? এই প্রশ্নটা না করলেই ভালো হতো। নানী বললেন, অয় তো এখানেই থাকে অনেকদিন। আমিতো জানি না কিছু। খুশি মনে বের হলাম, তিন ঘর পরেই হাসিনা খালাদের ঘর, গিয়ে দেখে আসি। গিয়ে দেখলাম, একটা খাটের সঙ্গে শিকল দিয়ে বাঁধা আছেন তিনি। উস্কুখুশকু জামা-কাপড়, চুল। চোখে-মুখে রাজ্যের বিষণ্নতা। সাথে সাথে আমি ধাক্কা খেলাম। হাসিনা খালা আমাকে দেখে চিনতে পারলেন। ‘পুশকিনে আইছে… কেমন আছস বাবা… এত দিন পর নানিবাড়ি আসে কেউ… কেমন আছস… কতো বড় হইছে আমাগো পুশকিনে…’

আমার সাথে খুব স্বাভাবিকভাবে কথা বললেন খালা। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, আপনার শরীর কেমন আছে, বললেন- ভালো। শিকলের কথাটা আর তাকে জিজ্ঞাসা করতে পারলাম না। খুব দ্রুত ভালো থাইকেন খালা, বলে সেখান থেকে চলে আসলাম আমি।
এসে নানিকে জিজ্ঞাসা করলাম, হাসিনা খালার কি হয়েছে, তাকে শিকল দিয়ে বেধে রাখা হয়েছে কেন? নানি যা বললেন তার সারসংক্ষেপ হলো এই যে, তার জামাইটা ভালো পড়ে নাই। খালি মারধর করতো, অত্যাচার করতো। একটা মেয়ে হয়েছিলো তার। মাথার সমস্যা নাকি আগেই টুকটাক দেখা দিয়েছিলো। একদিন কাউকে কিছু না বলে, মেয়েকে নিয়ে স্বামীর বাড়ি থেকে পালিয়ে, ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেন খালা। ঢাকায় গিয়ে মেয়েকে হঠাৎ হারিয়ে ফেলেন তিনি। তখন মাথা পুরোপুরি খারাপ হয়ে যায় তার।

মেয়েকে আর খুঁজে পান নি হাসিনা খালা। ঢাকায় পাগলের মতো কিছুদিন এই এলাকা ঐ এলাকা ঘোরাঘুরি করেন আর মেয়েকে খোঁজেন। একদিন তাদের গ্রামের এক লোক তাকে দেখে চিনতে পারেন। তিনি তার ভাইদের ফোন দেন। ভাইয়েরা গিয়ে তাকে ঢাকা থেকে বাড়িতে নিয়ে আসেন। এমনিতে কথাবার্তা স্বাভাবিক। শুধু যখন মেয়ের কথা মনে পড়ে তখন পাগল হয়ে যান খালা। মেয়েকে খুঁজতে তখন ঢাকার দিকে রওনা দিতে চান তিনি। এ জন্যই তাকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। জামাই আরেকটা বিয়ে করেছে, খোঁজখবরও নেয় না।

এরপর আমি আর নানাবাড়ি যাইনি। এখন হাসিনা খালার কি খবর তাও জানি না। তার সাথে আমার দুইটা স্মৃতি। আমি যতোই মাটির চুলার কথা মনে করতে যাই ততোই তা ঝাপসা হয়ে আসে। খেতের মাঝখানে দৌড়ানো হাসিনা খালাকে আমি দেখতে পাই শিকল দিয়ে বাঁধা। ঢাকায় আমি যখন কিছু না কিছু করছিলাম, খালা তখন তার হারিয়ে যাওয়া মেয়েকে পাগলের মতো খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন।

মানুষের জীবন তো আসলে কয়েকটা ঘটনা মাত্র; আসলে কিছু স্মৃতির সমষ্টি। আমার জীবন আর অন্য কারও জীবন এক বিন্দুতে মিলে যায়, যখন আমাদের দেখা হয়।

2 June 2022

সুইসাইড নোট


ইদানিং শুধু সুইসাইড হচ্ছে আশপাশে। মাঝে মাঝে মনে হয়, যারা সুইসাইড করছে তারা কি আমার চেয়েও বেশি বিষণ্ন? তারা কি আমার চেয়েও বেশি কষ্টে আর হতাশায় আছে? তাদের জীবন কি আমার জীবনের চায়েও ভারী যে তা আর বহন করা যাচ্ছে না? কখনো কখনো যে আমার নিজের মনে হয় নি যে সুইসাইড করে ফেলি, তা নয়। মাঝে মাঝে মনে হয়, এই জীবন থেকে ছুটি দরকার। কখনো মনে হয়, জীবনে যা দরকার ছিলো সব পেয়ে গেছে, নতুন করে আর কিছু পাওয়ার দরকার নেই। কখনো জীবনকে এতো ভারী মনে হয় যে, আর বহন করতে পারছি না।

এই যেমন, আজকেই ভাবছিলাম, জীবনটা যদি আবার শুরু করা যেতো, মন্দ হতো না। আবার শুরু থেকে শুরু করতাম! হয়তো শৈশবের সেই দুরন্ত সময়ে ফিরে যেতাম; কোনো চিন্তা নেই। শুধু স্কুলে ক্লাস করা, পড়াশোনা করা আর খেলা। অথবা বিশ্ববিধ্যালয় জীবনে; রাত জেগে আড্ডা দেওয়া আর ছবি দেখা, চা খাওয়া আর বই পড়া। কোনো চিন্তা নেই, অতীত নিয়ে কোনো অনুশোচনা নেই, ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনো দুশ্চিন্তা নেই। আসলেই কি তাই? এর পরেই ভাবনা এলো, জীবন তো একটাই। সুখদুঃখ, আনন্দ-বেদনা, দুশ্চিন্তা-অনুশোচনা সব এই এক জীবনকে ঘিরেই। যারা যায় আর ফিরে আসে না, আর ফিরে আসা সম্ভবও না। জীবন মাত্র একবারই আমাদের চেতনাকে এই সুযোগ দিচ্ছে। ভালো হলেও ভালো, খারাপ হলেও ভালো; আমাদের কাজ শুধু বর্তমানে বাঁচা।

আমি আমার জীবনের প্রথম সুইসাইড নোট লিখি ক্লাস সিক্সে। তখন আমি সুইসাইড শব্দটির সাথে পরিচিত, কিভাবে তা করে জানি না। কি এক কারণে যেন খুব অভিমান হয়েছিল আব্বার ওপর। বিতৃষ্ণা চলে এসেছিল নিজের জীবনের ওপর। কিন্তু ঠিক কি কারনে এমনটা হয়েছিল, এখন আর তা মনে পড়ে না। মনে হলো সুইসাইড করবো; কালকেই করবো। স্কুলের কোনো এক হোমওয়ার্ক খাতার পেছনের পৃষ্ঠায় গোটা গোটা হাতে কি লিখেছিলাম এখন তাও আর মনে নেই। শুধু মনে আছে মূল বিষয়টি। ‘আমি যদি মরে যাই, আমার যা আছে, তা ছোটো দুই ভাই আসিফ আর আবীরের মধ্যে সমান ভাগ করে দিও।’

আমার যা আছে বলতে, আমার আসলে তখন কিছুই ছিলো না। কয়েকটা কমিকসের বই আর কাপড়-চোপড়। ঐ সময় আমার দুই ভাই আমার খুব কাছে ছিলো। ভাগ কিভাবে করে তাও বুঝতাম না। তবে মনে হয়েছিল, সমান দুই ভাগ করে দিতে হবে; নাহলে খুব অন্যায় হয়ে যাবে। কিভাবে মরবো সে বিষয়েও কিছুটা ভেবেছিলাম। এটা আমার এখনো মনে পড়ে। তখন শুনতে পেতাম, কেউ বিষ খেয়েছে বা গলায় দড়ি দিয়েছে। কিন্তু আমি তখন এতো ছোটো ছিলাম যে, বিষ বা দড়ি কিভাবে জোগাড় করা যায়, তা ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি। তাই ভেবে বের করেছিলাম, ট্রাকের নিচে পড়ে মরে যাবো।

আমি তখন বেশ কয়েকজন সহপাঠীর সঙ্গে হেঁটে স্কুলে যাই। স্কুলে যাওয়ার রাস্তাটায় চলে ট্রাক। ট্রাককে আমার মনে হতো দানবীয় কোনো যানবাহন। এর সঙ্গে সামান্য গুঁতা খেলেও আর রক্ষা নেই। তখন ভেবে বের করেছিলাম, এরকম কোনো ট্রাক যাওয়ার সময় আস্তে করে এর নিচে পড়ে যাবো। সবাই মনে করবে এক্সিডেন্ট, কিন্তু আসলে সুইসাইড। আমার মরাও হবে আবার কেউ বুঝতেও পারবে না। হঠাৎ আবার আব্বা-আম্মা, আসিফ-আবীর, স্কুলের বন্ধু, খেলার মাঠ আর কমিক্স বইগুলোর জন্য কষ্ট হলো। কিন্তু কি আর করা কিছু পেতে হলে তো কিছু ছাড়তে হয়। মৃত্যুকে পেতে হলে এসব মায়া আমাকে ছাড়তে হবে। আমার এইটুকু মনে আছে সেদিন রাতে একাকী কেঁদে ঘুমাতে গিয়েছিলাম।

পরদিন উঠে পুরো বিষয়টা আমি একদম ভুলে যাই। পরদিন আবার স্কুলে যাই, স্কুলের মাঠে টিফিন পিরিয়ডে বরফ-পানি খেলি, স্কুল থেকে এসে নিজেদের গলিতে ক্রিকেট খেলি। মাগরিবের আজানের সঙ্গে সঙ্গে বাসায় ফিরে গিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে পড়তে বসি। রাতে টিভিতে সিন্দাবাদ বা হারকিউলিস দেখি, খাওয়া-দাওয়া করে ঘুমাতে যাই। ক্লাস সিক্সের পুরো বছর বিষয়টা আর আমার মনে পড়ে না।

এরপর ক্লাস সেভেনে বা এইটে, পুরোনো খাতা বিক্রি করার আগে একটু ঘেটে দেখছিলাম। তখন ঐ খাতাটা আবার আমার সামনে পড়ে। একটু ভয়ও পাই, তাও ভালো খাতাটা আম্মার হাতে পড়েনি, পড়লে তো অন্তত একদফা নিশ্চিত মাইর। আবার কষ্টও লেগেছিলো, ছোটোবেলায় কতো ছোটো মানুষ ছিলাম আমি। না হয় আব্বা কিছু একটা নিয়ে কিছু একটা বলেছে, বা কিছু একটা কিনে দেওয়ার কথা, বলেছে পড়ে কিনে দেবে, বা এরকমই কিছু একটা।

ঐ সময় আমি যদি মরে যেতাম, ক্লাস সেভেন বা এইটে ঘটা ঘটনাগুলো আমার সাথে আর ঘটতো না। তা ভালো হোক বা খারাপ, সব এখন আর মনে নেই, মনে থাকার কথাও না, নতুন ঘটনা। প্রত্যেকটা দিন নতুন হয়ে আমাদের কাছে আসে, প্রত্যেক দিন আমাদের সাথে ঘটে নতুন কোনো ঘটনা। যেদিন আমরা মরে যাবো, আমাদের সাথে ঘটতে পারে এমন সব সম্ভাব্য ঘটনাগুলোও থেমে যাবে। আমরা শুধু স্মৃতি হয়ে বেঁচে থাকবো, আরেকজনের মনে।

সব চাওয়া যদি এক জীবনেই পূরণ হয়, তাহলে তো এই জগতটাই বেহেশতো হয়ে উঠবে। তাই সব মানুষেরই কিছু অপূর্ণতা থাকবে, অপ্রাপ্তি থাকবে। শুধু পাওয়াই জীবন নয়, পাওয়া ও না পাওয়া মিলিয়েই জীবন।

21 March 2022

প্রেমের ফুল


আব্বু, তুমি যত দিন পেটের ভেতর আছো, ততদিনই আমি তোমাকে রক্ষা করতে পারবো। আমার মনে হয়, তুমি হাজার বছর আমার পেটের ভেতর থাকো। এখান থেকে আমি তোমাকে বের করবো না। তোমার নানু কি বলেছে জানো! তোমাকে দুনিয়ায় রাখা ঠিক হবে না।তুমি তো আমার পেটের মধ্যে এই দুনিয়াতেই আছো। আছো না।

ফুলে ওঠা ৯ মাসের পেঠে হাত বোলাতে বোলাতে এই কথাগুলো ভাবছিলো মেয়েটি। পাশের রুম থেকে মেয়েটির মা এসে বললো, ‌‘এতো মায়া বাড়াইয়া লাভ নাই… এই বাচ্চা থাকলে তরে আর বিয়া দেওন যাইবো না… আকাম করার টাইমে মনে আছিল না…’

‘আকাম কি আমি একলা করছি নাকি… তুমি খালি আমারে বকো…’

‘বকবো না… আদর করবো… কখন ব্যাথা উঠে লগে লগে জানাবি… একদম দেরি করবি না… আবার কান্দা শুরু করছে… খালি কান্দে… এহন কাইন্দা লাভ আছে আর…’ বলে আবার পাশের রুমে চলে যায় মেয়েটির মা।

দেখছো তোমার নানু তোমারে তাড়াতাড়ি বের করে ফেলতে চায়। আমি তো চাই না আব্বু। আমি চাই তুমি আমার পেটে হাজার হাজার বছর থাকো। তুমি আমার সাথে মারা যাও, আর নইলে আমাকে তোমার সাথে নিয়ে যাও।

পেটে হাত বোলাতে বোলাতে কাদতে থাকে মেয়েটি। কাদতে কাদতে ভাবে,

আব্বু, তোমাকে আমি কোনো নাম দিইনি। তুমি হয়তো এই দুনিয়ায় আসার পর ১০ মিনিট বাচবে। তুমি আমাকে ১০ মিনিট দেখবে। যে তোমাকে ১০ মাস পেটে রাখলো, তাকে তুমি দেখবে ১০ মিনিট। তুমি তোমার সারা জীবনেও আমাকে মা বলে ডাকতে পারবে না। যে তোমাকে পেটে রেখে বড় করলো, সেই তোমাকে নিজের কাছে রাখতে পারবে না। তোমাকে পেল-পুষে বড় করতে পারবে না। তোমাকে খাইয়ে দিতে পারবে না, ঘুম পাড়িয়ে দিতে পারবে না, কোলে নিতে পারবে না।

বিশ্বাস করো আব্বু, আমি সারা জীবন তোমার স্মৃতি বহন করবো। তোমার মাধ্যমেই আমি মা হতে যাচ্ছি। তুমি যখন আমার পেটে আসো, আমি প্রথমে বুঝিনি। তুমি আমার প্রথম প্রেমের ফুল, আমি কিভাবে লোকেদের বুঝাবো। তুমি যখন আমার ভেতরে বেড়ে উঠতে থাকলে, আমি টের পেলাম তুমি আমার ভেতর আছো, জানো আমি কতো ভয় পেয়েছিলাম। লোকলজ্জার ভয়ে আমি সারারাত কেদেছি। মানুষকে আমি কি বলবো, ভেবে দুশ্চিন্তা করেছি। অথচ দেখো, আমি তোমার মা, তুমি আমার সন্তান। আর আমাদের মাঝে এক ভারী দেয়ালের মতো এই পরিবার, সমাজ আর লোকজন।

আমার আব্বু, আমি জানি, তুমি আমার কথা বুঝতে পারো, তুমি আমার কথা শুনতে পাও। তুমি তোমার হাত-পা বুলিয়ে দেখো, বাইরের দুনিয়া ঠিক আছে কি না। আব্বু বাইরের এই দুনিয়া, বড়ই নিষ্ঠুর। তারা তোমাকে বাচতে দিতে চায় না। কারণ তোমার বাবা, তুমি পেটে আসার পর আর তোমাকে চায় না। তোমার বাবা বলেছে, আমাকে আর বিয়ে করবে না। আমার কোনো আফসোস নেই। তোমার বাবার মতো ভীরু লোকের সাথে সারা জীবন থাকা যায় না। তোমার বাবা আরও কি বলেছে জানো, তুমি না কি ভুল করে হয়েছো। তুমি কি ভুল করে হয়েছো আব্বু! ভুল নাহয় আমার আর তোমার বাবার হয়েছে। তোমার কি ভুল হয়েছে! তুমি তো আর বলোনি, আমাকে দুনিয়ায় আনো। তুমি তো আমাদের প্রেমের ফুল।

তুমি যখন আমার পেটের ভেতর নড়াচড়া করো, আমার ভালো লাগে। আবার কষ্ট লাগে। আমি যদি তোমাকে এভাবে সারা জীবন আগলে রাখতে পারতাম! আমি যদি তোমাকে সারা জীবন দুনিয়ার এসব মানুষের কথা আর চিন্তা থেকে বাচাতে পারতাম! আমাকে তুমি মাফ করে দিও আব্বু।

মানুষের পেটে যখন বাবু আসে তখন তারা কত্তো খুশি হয়! আমি কতো দেখেছি! আর দেখো আব্বু, আমি নিজে খুশি হতে পারছি না। আমি তোমাকে নিয়ে ভয় আর আশঙ্কায় আছি। রাতে রাতে আমার ঘুম আসে না। তুমি কখন নড়ে ওঠো, আর আমি যদি সেটা টের না পাই। আর কয়েকদিনের মধ্যেই আমি আর তুমি আলাদা হয়ে যাবো। এরপর আমি তোমাকে হারিয়ে ফেলবো। আব্বু আমি তোমাকে রাখতে না পারলে আমাকে মাফ করে দিও।

আর আব্বু শোনো, আল্লার কাছে ফিরে গিয়ে তোমার বাবার নামে বিচার দিবে। তোমার নানুর নামেও বিচার দিও। যারা তোমাকে এই দুনিয়ায় থাকতে দিতে চায় না, তাদের সবার নামে বিচার দিবা। আখিরাতে তুমি তাদের ডেকে ডেকে জিজ্ঞাসা করবে, জন্ম দেওয়ার মালিক আল্লাহ। তোমরা কারা, যারা আল্লার দুনিয়ায়, আল্লার সৃষ্টি উপহারকে রাখতে দিতে চাও না। আল্লার কাছে বিচার দিবে না আব্বু?

আর আমার ব্যাপারে আল্লার কাছে বলবে, আমার আম্মু আমাকে খুব ভালোবেসেছে। আমার আসার খবর পেয়ে খুশি হয়েছে। আবার লোকজনের কথা ভেবে ভয় পেয়েছে। আমার সাথে রাত জেগে কথা বলেছে। আমার জন্য চোখের পানি ফেলেছে। বলবে না, আব্বু?

সবকিছু বুঝতে পেরেই হয়ত পেটের ভেতর নড়াচড়া করা বন্ধ করে দিলো বাবুটা। ওর মা পেতে হাত দিয়ে শুয়ে থাকলো আর কিছুক্ষণ। সকাল বেলা ওর হাসপাতালে যাওয়ার কথা। কাঁদতে কাঁদতে ওর চোখের পানি শুকিয়ে গেছে। শূন্য চোখে তাকিয়ে আছে মেয়েটা।

পরদিন একটা সংবাদপত্রে খবর প্রকাশ হলো-

কিছু ছিন্নমূল শিশু খেলতে গিয়ে একটা শুকনো নালায় এক নবজাতকের গলা কাটা মরদেহ দেখতে পায়। ঐ নালাটি একটি সরকারি হাসপাতাল থেকে দুই মিনিটের হাঁটা দূরত্বেভ দূরে। পুলিশ এ ঘটনায় ঐ হাসপাতালের তিন নার্সকে গ্রেপ্তার করেছে। পুলিশ ঘটনাটি তদন্ত করছে। পুলিশ ধারনা করছে, কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারন থেকে এ ঘটনা ঘটে থাকতে পারে।


16 February 2022

ইউক্রেন সংকটে দায় কার?

২০২১ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি, বেলারুশের ইউক্রেন সীমান্তে রাশিয়া-বেলারুশ যৌথ মহড়া।
ছবি: এপি, রাশিয়ান ডিফেন্স মিনিস্ট্রি প্রেস সার্ভিস থেকে 


১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর যুক্তরাষ্ট্র একক পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। প্রতিদ্বন্দ্বীর অভাবে প্রাসঙ্গিকতা হারায় যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের সামরিক জোট ন্যাটো। কিন্তু এরপরও পৃথিবী যুদ্ধবিহীন হয়নি। যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর মিত্ররা নানা অজুহাতে অপেক্ষাকৃত দুর্বল রাষ্ট্র ইরাক ও আফগানিস্তানের ওপর চাপিয়ে দেয় একতরফা যুদ্ধ।

পরাশক্তির এ ভারসাম্য পরিবর্তিত হতে থাকে ২০১০ সালের পর। এ সময় চীনের অর্থনীতি ও সোভিয়েত ইউনিয়নের উত্তরসূরি রাশিয়ার কূটনীতি যুক্তরাষ্ট্রের একক পরাশক্তি হয়ে ওঠার লক্ষ্মণগুলোকে বাধা দিতে থাকে। এ সময় বেশ কয়েকটি ফ্রন্টে সংগঠিত হয় ছায়া যুদ্ধ (প্রক্সি ওয়ার)। ২০১০ থেকে ২০২০ এই সময়ে ছায়া যুদ্ধ হয় সিরিয়ায়। সেখানে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা বাশার আল আসাদের বিদ্রোহী গোষ্ঠীকে অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে সমর্থন জানায়। কিন্তু রাশিয়া বাশারের প্রতি তাদের সমর্থন অব্যহত রাখে। ছায়া যুদ্ধ চলে লিবিয়ায়, ইয়েমেনে।

এই সময়ের মধ্যে দুইটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। এক, ন্যাটো তার জোটের সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি করতে থাকে। পূর্ব ইউরোপে বিস্তৃতি ঘটে যুক্তরাষ্ট্র ও তার সামরিক মিত্র ন্যাটোর সম্প্রসারনবাদের। সাবেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র ও সমাজতান্ত্রিক ব্লকের দেশগুলো যোগ দিতে থাকে ন্যাটোতো। পোল্যান্ড, রুমানিয়া, বুলগেরিয়া, এস্তোনিয়া, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া একে একে যোগ দেয় ন্যাটোতে।

সোভিয়েত ইউনিয়ন ঠেকানোর জন্য যে সামরিক জোট, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর তার কাজ কি? প্রকারান্তারে ন্যাটো যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি অস্ত্র হয়ে উঠে। যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ববাসীকে বোঝাতে চায় যে, ন্যাটো ও অন্যান্য সহযোগীদের সঙ্গে নিয়ে তারা ‌‌‍‘গণতন্ত্র ও মানবাধিকার’ প্রতিষ্ঠা করবে। কিন্তু প্রকারান্তরে তারা জারি রেখেছে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার। আর বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের এই মিশনে তার সহযোগী ন্যাটো। তাই খুব স্বাভাবিকভাবে পূর্ব ইউরোপে ন্যাটোর বিস্তারকে রাশিয়া নিজের অস্তিত্বের জন্য হুমকি মনে করবে।

দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, ২০১০ সালের পর থেকে রাশিয়া তার সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে থাকে। নিজের সুবিশাল আয়তনের বাইরেও অস্তিত্ব জানান দিতে থাকে রাশিয়া। এ সময় চীন এবং ইরানের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ক ও সহযোগীতা বাড়তে থাকে। সাবেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রের কয়েকটিকে সঙ্গে নিয়ে গড়ে তোলা হয় অর্থনৈতিক জোট। এ সময় সাবেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রগুলোর মধ্যে জর্জিয়া ও ইউক্রেনের সঙ্গে দুরত্ব বাড়তে থাকে রাশিয়ার।

রাশিয়া নিজের স্বার্থে সাবেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রগুলোর রুশপন্থী সরকার ও বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সমর্থন দেওয়া অব্যহত রাখে। এর মধ্যে ২০০৮ সালের আগস্ট মাসে জর্জিয়ার স্বাধীনতাকামী অঞ্চল আবখাজিয়া ও দক্ষিণ ওশেতিয়ার সমর্থনে সৈন্য পাঠায় রাশিয়া। এর পর ২০১৪ সালের মার্চে ইউক্রেনের স্বশাসিত প্রজাতন্ত্র ক্রিমিয়া রাশিয়ায় যোগ দেয়। একই সঙ্গে পূর্ব ইউক্রেনের রুশপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদী অঞ্চল দোনেত্সক ও লুহান্সক ইউক্রেনের অখণ্ডতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র দাবি করেছে, ইউক্রেন সীমান্তে প্রায় ১ লাখ সৈন্যের সমাবেশ ঘটিয়েছে রাশিয়া। ইউক্রেন দখল করে রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা নষ্ট করতে চায় রাশিয়া, বলে অভিযোগের আঙুল তুলেছে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু এই বিষয়ে রাশিয়ার ভাষ্য, ইউক্রেনের ন্যাটোতে যোগ দেওয়া যাবে না এবং পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো থেকে ন্যাটোর সৈন্য সংখ্যা কমিয়ে আনার শর্তে চাপ প্রয়োগ করার জন্য এই সৈন্য সমাবেশ। মূলত রাশিয়া ইউক্রেনকে ঘিরে রেখেছে তিন দিক থেকে। পূর্ব দিকে ইউক্রেনের রুশ সীমান্ত ও দোনেত্সক-লুহান্সকের বিরোধপূর্ণ অঞ্চল, উত্তরে বেলারুশ সীমান্ত এবং দক্ষিণে ক্রিমিয়া ও মোলদাভিয়ার ট্রান্সনিস্ট্রিয়া অঞ্চলে রাশিয়ার সেনাদের উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে।

ন্যাটোর সম্প্রসারনের বিরোধীতা করতে গিয়েই আজকের এই সংকট। কিন্তু যদি রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে তাহলে মানবিক বিপর্যয় দেখা দিবে পুরো পূর্ব ইউরোপ জুড়েই। আর এই মানবিক বিপর্যয় সামাল দেওয়ার মতো মানসিক অবস্থা ইউরোপের আছে কি না তা ভেবে দেখতে হবে। আলোচনার মাধ্যমে যে সংকটের সমাধান করা সম্ভব; তা নিয়ে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়াটা হবে একেবারে অনুচিত একটি সিদ্ধান্ত।