উপজাতি তুচ্ছার্থে বা হীনার্থে ব্যবহৃত একটি কলোনিয়াল টার্ম। একটি জাতিকে জাতি হিসেবে গড়ে ওঠার জন্য
‘সংস্কৃতি’ একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান
(সংস্কৃতি আবার বিভিন্ন উপ-উপাদানে বিভক্ত। যেমন- ভাষা,
খাদ্যাভ্যাস, পোশাকআশাক, আচার-আচরণ,
বিভিন্ন রকম কলা, যেমন-
চিত্রকলা, নৃত্যকলা, সংগীত, সাহিত্য ইত্যাদি।)। অর্থাৎ প্রত্যেকটি জাতির নিজস্ব সংস্কৃতি আছে বা সংস্কৃতির কারনেই এক জাতি অপর জাতি থেকে আলাদা। অর্থাৎ আলাদা সংস্কৃতির কারণে হয় সে আলাদা জাতি অথবা নিজস্ব সংস্কৃতি না থাকার কারণে সে কোনো আলাদা জাতি নয়। এর মাঝামাঝি কোনো জায়গা আদতে নেই,
যেমন- উপজাতি বা অর্ধেক জাতি।
কলোনিয়াল যুগে নিজের জাতি কতো মহান আর অপর জাতি কতোটা নীচ তা বোঝানোর জন্য উপজাতি শব্দটা প্রয়োগ করা হতো। যেমন বৃটিশরা নিজেদের বলতো কালচারড বা সভ্য, আর ভারতীয় জাতিগুলোকে বলতো নেটিভ বা লোকাল-আনকালচারড বা অসভ্য। অর্থাৎ তখনকার বৃটিশ চোখে বৃটিশরা ছিলো পূর্ণাঙ্গ জাতিসত্তা আর ভারতীয় বিভিন্ন জাতিগুলো, যেমন- তামিল,
তেলুগু, মারাঠি, পাঞ্জাবি বা বাঙালীরা ছিলো উপজাতি। এখন আমরা বুঝি যে তাদের কালচার তাদের আর বাঙালীদের কালচার বাঙালীদের। দুইটা আলাদা সভ্যতা। দুইজন নিজেদের মতো সভ্য, কেউ অসভ্য নয়।
সম্প্রতি রাষ্ট্রের ভিত্তিতে জাতীয়তাবাদ শক্তিশালী হয়ে ওঠায়,
সংখ্যাগরিষ্ঠ নৃগোষ্ঠীর জনগণ বা ক্ষমতাবান নৃগোষ্ঠীর জনগণ নিজেদের দাবী করে জাতি হিসেবে। আর রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে বাদবাকী নৃগোষ্ঠীদের অধিকারবঞ্চিত রাখতে চায় উপজাতি বলে। মূলত এধরণের আচরণ পুরোপুরি কলোনিয়াল, পর্যাপ্ত শিক্ষা ও সুশাসনের অভাবই এর জন্য দায়ী।
নৃগোষ্ঠী বিষয়ক আলোচনা
নৃগোষ্ঠী বলতে জাতিই বোঝানো হয়। যাদের আলাদা সংস্কৃতি আছে, যাদের নিজস্ব ভাষা আছে,
নিজস্ব পোশাকের ঐতিহ্য আছে,
আচার-আচরণ, খাদ্যাভ্যাসে যারা অন্যদের তুলনায় ভিন্ন; তারাই ভিন্ন নৃগোষ্ঠী। এখন যদি পৃথিবীতে দুই জন মানুষও আলাদা ভাষায় কথা বলে এবং অন্য জাতিগুলোর তুলনায় আলাদা পরিচয় বহন করে,
তবে তারা আলাদা নৃগোষ্ঠী। তবে তারা আলাদা জাতি। যেমন বাংলাদেশে বাঙালী, চাকমা, মারমা,
ম্রো, খাসিয়া, গারো, সাওতাল,
রাখাইন, তঞ্চঙ্গা, পাংখোয়া বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর বাস।
এখানে বৃহৎ নৃগোষ্ঠী বা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বলা প্রকারান্তরে অন্যায়। তবে শিক্ষাদীক্ষায় অনগ্রসর রাষ্ট্রসমূহ,
যেমন বাংলাদেশে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী পরিচয়ের প্রয়োজন আছে। এই প্রয়োজন সুশাসন নিশ্চিত করার জন্য। তবে সরকার সুশাসন নিশ্চিত করতে সক্ষম হলে এই পরিচয়ের আর দরকার হবে না। রাষ্ট্রের ভিতরে নৃগোষ্ঠী বিষয়ক আলোচনার আর দরকার হবে না,
যদি রাষ্ট্র জাতি, ধর্ম,
বর্ণ, পরিবার নির্বিশেষে সকলের অধিকার নিশ্চিত করতে পারে। নৃগোষ্ঠী বিষয়ক আলোচনা তখন কেবল পরিসংখ্যানে পরিণত হবে।
আদিবাসী কারা?
পৃথিবীতে যতো বিবাদ তার বেশিরভাগই জমিজিরাত সম্পর্কিত,
তা ভাইয়ে ভাইয়ে হোক বা রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে। যেহেতু বর্তমান রাষ্ট্রগুলো সীমানা ছাড়া আর কিছু নয় তাই সীমানার অভ্যন্তরের সকল নাগরিকের দেখভাল করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। অর্থাৎ রাষ্ট্রের সকল অধিবাসীর অধিকার নিশ্চিত করবে রাষ্ট্র। এবং যেহেতু রাষ্ট্র বিষয়টা অতি-আধুনিক তাই রাষ্ট্রের ভেতরে কে আদিবাসী বা কে আদিবাসী না এটা নির্ণয় করা অসম্ভবপ্রায়। আধুনিক রাষ্ট্রের ধারণা কিছুদিন আগেও ছিলো না। তখন ছিলো রাজ্য,
আর রাজ্যগুলোর সীমানা আধুনিক রাষ্ট্রের মতো এতো সুগঠিত ছিলো না।
সাধারণ হিসাবে রাজ্যগুলোতে যারা
প্রথম আবাদ করতো, তারাই রাজ্যের আদিবাসী। তারা সংখ্যায় বেশি হলেও আদিবাসী, কম হলেও আদিবাসী। তারা ক্ষমতায় থাকলেও আদিবাসী, না থাকলেও আদিবাসী। তবে রাজ্য এবং রাষ্ট্রগুলোতে একটাই
জাতি বাস করেছে, এই উদাহরণ খুব বিরল। সাধারণত বিভিন্ন জাতির অবস্থান সব রাজ্যেই ছিলো। রাষ্ট্র যতো আধুনিক হতে থাকলো, নাগরিক অধিকার যতো বঞ্চিত হতে থাকলো, বিভিন্ন রকম অবান্তর টার্ম সমাজে
আসতে থাকলো। আদিবাসী বলে এখন সমাজে কিছু মানুষকে
আলাদা করা হয়, তাদের অধিকার আরো বেশি করে কমিয়ে রাখা হয়। তাদের চোখে আঙুল দিয়ে বলা হয়, তোমরা আলাদা।
বাংলাদেশ রাষ্ট্রে আদিবাসী কারা?
বাংলাদেশ রাষ্ট্রে আদিবাসী কারা এটা একটা জটিল প্রশ্ন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হতে পারে এখানে বাঙালীরাই আদিবাসী। বাঙালীরা আসলে মিশ্র জাতি। এখানে তিনটি মহানৃগোষ্ঠীরই মিশ্রণ ঘটেছে। অস্ট্রালয়েড, মঙ্গোলয়েড ও নিগ্রোয়েড এই তিন মহাজাতির মিশ্রণে বাঙালী জাতির উদ্ভব। ৬০০ যিশুসনের আগে বাঙালী বলে কোনো জাতি আছে এটা বাঙালীরাও জানতো না। তখন বাঙালীদের আসামিয়, বিহারী, ভোজপুরী এবং নেপালী সমতলিদের থেকে আলাদা করা যেতো না। তিন মহাজাতির মধ্যে বাংলা অঞ্চলে সবার আগে আসে নিগ্রোয়েডরা। এমনকি আর্যদের আগে তো বটেই,
দ্রাবিড়দেরও আগে। সম্প্রতি গবেষনায় দেখা গেছে, কিছু নিগ্রোয়েড জনগোষ্ঠী দ্রাবিড়রা আসার আগেই এই অঞ্চলে ছিলো। তাদের বংশধররা আজো বাংলা অঞ্চলে আছে। তাদের বলা হয়-
সাঁওতাল। এরপর এখানকার আদিম আদিবাসী হয়-
কোল, মুন্ডা, ওরাও, সদরি ও মাহালিরা। আদিবাসের ভিত্তিতে অধিকার নিশ্চিত হতে হলে আধুনিক বাংলাদেশ ও ভারত রাষ্ট্রে সবার আগে অধিকার নিশ্চিত হওয়া উচিত সাঁওতালদের। তারাই এই অঞ্চলের প্রথম ভূমিপুত্র।
আধুনিক বাংলাদেশ রাষ্ট্রে পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি এলাকা, মূল সমতল থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন। বাঙালীরা জাতিগতভাবে সমতলের জাতি। তারা সাধারণত বসবাসের জন্য পাহাড় এড়িয়ে চলতো। পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকাগুলোর ভূমিরূপ ও জলবায়ুর সাথে বর্তমান ভারত রাষ্ট্রের মিজোরাম রাজ্য ও মায়ানমার রাষ্ট্রের চিন ও রাখাইন রাজ্যের কোনো পার্থক্য নেই। একসময় এলাকাগুলো এক বা একাধিক রাজা দ্বারা শাসিত হয়েছে। এখানকার বিভিন্ন মঙ্গোলয়েড জাতিসমূহ এখানকার আদিবাসী। প্রথমে তারা যাযাবরভাবে এই পাহাড় থেকে সেই পাহাড় ঘুরে ঘুরে আবাদ করতো। এক পাহাড়ে খাবারের যোগান শেষ হলে আরেক পাহাড়ে যেতো। যাযাবর হলেও তারাই পাহাড়ে প্রথম বসতি স্থাপনকারী, তারাই পাহাড়ের ভূমিপুত্র। বাংলাদেশে পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ের ভূমিপুত্ররা হলো- চাকমা,
মারমা, ম্রো, তঞ্চঙ্গা,
বম, লুসাই, পাংখোয়া, চাক,
খুমি, খিয়াং এবং ত্রিপুরা।
বাঙালীরা প্রায় ১৭০০ যিশুসনের পর অল্পমাত্রায় পাহাড়ে বসতি স্থাপন শুরু করলেও পুরোপুরি শুরু করে পাকিস্থান রাষ্ট্রের আমলে (১৯৪৭-১৯৭১)। ১৯৭১ যিশুসনে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠিত হলেও এই প্রক্রিয়া চালু থাকে। বিশেষত পাহাড়ে বসতি স্থাপন সবচেয়ে বেশি হয়েছে পাকিস্থান এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সামরিক সরকারগুলোর আমলে। পাকিস্থানের সময়ে আইয়ুব খান আর ইয়াহিয়া খান এবং বাংলাদেশ আমলে জিয়াউর রহমান আর হুমো এরশাদের সময়ে।
আধুনিক রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের ব্যার্থতা, সে তার ভূমিপুত্রদের অধিকার রক্ষা করতে পারছে না। বরং ভূমিপুত্ররাই হয়ে পরছে পিছিয়ে পরা জনগোষ্ঠী। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের পক্ষে তখনই উন্নতি করা সম্ভব যখন সমতল-পাহাড় নির্বিশেষে সুশাসন, আইনের শাসন এবং জনগণের অধিকার নিশ্চিত হবে। তখনি সমস্ত বাংলাদেশী নিজেকে বাংলাদেশী বলে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করবে।
No comments:
Post a Comment