দেশের কৃষকদের কথা একবার চিন্তা করেন। এরা না জানে বেশিদূর লেখাপড়া, না করে সেমিনার, না রাস্তা আটকায়া সভা-সমাবেশ করে, না অফিস আটকায়া স্মারকলিপি দেয়। বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ, অথচ কৃষকরাই সবচেয়ে বঞ্চিত।
কৃষকদের স্বার্থ নিয়া কথা বলবে এইরকম কোনো সংগঠন নাই, কোনো আওয়াজ নাই। কৃষকলীগ নামে একটা কিছু আছে, যারা কৃষকদের স্বার্থ দেখা তো দূরের কথা, চাদাবাজি এবং ব্যক্তিগত ব্যবসাবাণিজ্য নিয়া ব্যস্ত আছে। আরেকটা গ্রুপ আছে ক্ষেতমজুর সমিতি, যাদের নিয়ত ঠিক আছে কিন্তু কোনো কর্মপরিকল্পনা নাই। কৃষকদের স্বার্থ রক্ষায় এই দুইটাই অচল।
আচ্ছা কৃষক কয় প্রকার। সবাইকে গড়পরতা কৃষক কইলা ফেলা হয়, সবার অবস্থা কি এক? নিচ থেকে শুরু করি।
সবার নিচে ক্ষেতমজুর। মানে অন্যের ক্ষেতে শ্রম দেয় যে, না আছে নিজের জমি, না আছে বর্গা নেয়ার মতো অবস্থা। উত্তরবঙ্গে ধান কাটার সময় হইলে ময়মনসিংহ অঞ্চল থেকে লোকেরা ট্রাকে করে ধান কেটে দিয়ে আসতে যায়। ক্ষেতে খায়, গৃহস্তের বাড়িতে ঘুমায়। দিনচুক্তি বা ক্ষেতচুক্তি মজুরির বিনিময়ে ধান কেটে দেয়। কাটা শেষ হলে এলাকায় আসে, হাসমুরগি পালে, বাড়ির পাশের মাচায় কুমড়া-শিম তুলে দেয়, মাটি কাটে, পাশের এলাকায় ইটভাটার শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে যায়। মানে এরা অস্থায়ী কৃষি-শ্রমিক। জীবননির্বাহের জন্য পেশা পরিবর্তন করে প্রায়ই। এদের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ।
এর উপরে ভূমিহীন বর্গাচাষী কৃষক। এদের নিজের জমি নাই বা অল্প পরিমান আছে। এরা অন্যের জমিতে চাষ করেন। জমির মালিকের সাথে এদের বিভিন্নরকম চুক্তি হয়। হয় অর্ধেক ফসল, অথবা নির্দিষ্ট টাকা। এরা ক্ষুদ্রঋণ এর বৃহৎ ভোক্তা। ঋণ নিয়ে সার কিনেন, বীজ কিনেন, পানি দেন। ফসল উঠলে সেই ঋণ পরিশোধ করে সংসারের জন্য কিছু রাখবেন ভেবে ঋন নেন। সামনে ভালো দিন আসবে ভেবে ঋণ নেন। ভালো দিন আসে না। একসময় এলাকা থেকে পালিয়ে এসে ঢাকার রাস্তায় পলিথিন বিছিয়ে শুয়ে পরেন আর পরদিন থেকে রিক্সা চালান।
এরপর আসে নিজের জমি আছে এবং নিজেই চাষ করেন এমন কৃষক। এদের অবস্থা ভূমিহীন কৃষকের চে কিছুটা ভালো। কিন্তু সবসময় প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভয়ে থাকতে হয় তাদের। বৃষ্টি বেশি হলে ফসল শেষ, আবার কম হলেও শেষ। তার উপর এই জনগোষ্ঠীর বেশিরভাগ হাতআন্দাজে অথবা পারিবারিক ঐতিহ্য হিসেবে চাষাবাদ করেন। চাষাবাদ বিষয়ে কিছুটা পড়াশোনা বা ট্রেনিং বা পরামর্শ তাদের পরিশ্রম আর কর্মদক্ষতাকে আরো বেশি আউটপুট দিতে পারতো।
এর উপর জোতদার কৃষক। এরা ভূস্বামী টাইপ কৃষক। প্রচুর জমির মালিক এরা, জমিতে কি চাষ হয় নিজেরা জানে না, কিন্তু জমি থেকে প্রচুর ইনকাম। যেমন সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদের কৃষি জমি থেকে বছরে আয় প্রায় ৩ কোটি টাকা। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফের কৃষি জমি থেকে আয় বছরে প্রায় ১.৫ কোটি টাকা। ইত্যাদি।
কৃষি পণ্যের সাথে সরাসরি জড়িত কিন্তু কৃষিকাজ করেন না, তাদের কৃষক বলা যায় না। মজুতদার, সবজির পাইকারি-খুচরা ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে, বীজবিক্রেতা, সার বিক্রেতা, ভাড়ায় ট্রাক্টর দেন এমন ব্যক্তিরা কৃষক নয়। আর কৃষির ভোক্তা মানবজাতির সকল সদস্য, এমনকি বাংলাদেশীরাও।
কৃষকের দুঃখের জায়গা একটাই ন্যায্যমূল্য না পাওয়া। ৩-৪ মাস পর যখন ফসল উঠে আর সেটার দাম না পাওয়া যায়, তার চেয়ে বড় দুঃখ আর হয় না। হয়তো আগামী ফসলের বীজ কেনার টাকা হবেনা, হয়তো বাচ্চার স্কুলের খরচ দিতে পারবেনা, হয়তো মহাজনের ঋণ পরিশোধ করতে পারবে না। হয়তো স্ত্রীর ছোটো কোনো অসুখ, ফসল উঠলে ডাক্তার দেখানোর কথা, হবেনা। এইরকম অনেক হবেনার মধ্যে দিয়ে যেতে হয় কৃষককে। অপমান-গঞ্জনা তো আছেই।
কি পরিমান অসহনীয় দিন যাপন করতে হয়, তা আমরা কল্পনাও করতে পারি না।
লাভের গুড় কে খায়? উত্তরবঙ্গে মূলার কেজি যখন ১-১.৫ টাকা, ঢাকায় তখন ৪০-৬০ টাকা। কৃষক বেচে ১ টাকায়, আমরা ভোগ করি ৪০ টাকায়। কিভাবে? মজার সরল অংক। শুধু যোগ হবে। মূলা কৃষকের কাছ থেকে আড়তদাররা কিনে নেয়। কিনা মাত্র সেটা ৩-৪ টাকা হয়ে যায়। এর সাথে যোগ হয় আড়তদারের লাভ, জায়গার ভাড়া, আড়তের শ্রমিকের মজুরি ইত্যাদি নানান খাত। মূলার কেজি ৭-৮ টাকায় আসে।
সেটা ট্রাকে ঢাকায় পাঠাতে হবে পাইকারের কাছে। সাথে যোগ হয় ট্রাকের ভাড়া আর রাস্তার চাদা। আড়ত মালিকের লাভ আর আড়ত শ্রমিকের মজুরি তো তাও সহনীয়, রাস্তার চাদাটা কেন? রাস্তায় চাদা দেয়া হয় যেন ট্রাকটা সহীসালামতে ঢাকা পৌছায়। চাদা না দিলে ট্রাক ঢাকায় ঢুকবেনা।
চাদা গ্রহণের ক্ষেত্রে নিরাপত্তাপ্রদানকারীদের কোনো ব্যবস্থাপনা নাই। সবাই নিজ নিজ এলাকায় নিরাপত্তা দেন খালি। যমুনা নদীর এপাড়-ওপাড়, গাবতলী, পথের বড় বাজার সবগুলা পয়েন্টে নিরাপত্তা পেতে পেতে ট্রাকটাকে ঢাকায় আসতে হয়। পাইকারের হাতে যখন মূলা পৌছায় তখন সেটা ২৫-২৮ টাকা। যোগ হয় পাইকারের লাভ। খুচরা ব্যবসায়ীরা নেন সেখান থেকে। যোগ হয় খুচরা ব্যবসায়ীদের লাভ। ভোক্তাদের হাতে যখন মূলা পৌছায় তখন সেটা ৪০ টাকা। এতো দাম! মূলার এতো দাম!
মধ্যসত্ত্বভোগী সব হয়তো বাদ দেয়া যাবেনা। কিছুটাতো সহনীয় করা যায়। রাস্তার নিরাপত্তাটাও যদি মাননীয় সরকার মহোদয় দেয় তাহলে মূলার দাম কমে ভোক্তাদের কাছে আসবে ২৫-৩০ টাকায়। আবার ভোক্তারা যদি তাও মূলা ৪০ টাকাতেই কিনে কৃষককে কিছু বেশি দেয়া যায়। রাস্তার চাদার অর্ধেক টাকাই কৃষককে দেন। দেখেন দেশের কৃষির অবস্থা কি হয়?
কৃষক, শ্রমিক, আড়তদার, পাইকার, খুচরা ব্যবসায়ী, ভোক্তা-জনগণ, চাদাবাজ এই বিরাট কর্মযজ্ঞ দেইখা রাখা ব্যক্তি বা সংগঠনের কাজ না। মাননীয় সরকার মহোদয়ের কাজ। ব্যক্তি আর সংগঠনের কাজ সেই আওয়াজ সরকার পর্যন্ত পৌছায়া দেয়া, সরকাররে তার কর্তব্য ও দায়িত্ব মনে করায়া দেয়া। আমাদের ভুলে গেলে চলবেনা, মাননীয় সরকার মহোদয়ের কাজই- দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালন।