27 May 2019

দৈনন্দিন আলাপ ১২

দেশের কৃষকদের কথা একবার চিন্তা করেন। এরা না জানে বেশিদূর লেখাপড়া, না করে সেমিনার, না রাস্তা আটকায়া সভা-সমাবেশ করে, না অফিস আটকায়া স্মারকলিপি দেয়। বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ, অথচ কৃষকরাই সবচেয়ে বঞ্চিত। 

কৃষকদের স্বার্থ নিয়া কথা বলবে এইরকম কোনো সংগঠন নাই, কোনো আওয়াজ নাই। কৃষকলীগ নামে একটা কিছু আছে, যারা কৃষকদের স্বার্থ দেখা তো দূরের কথা, চাদাবাজি এবং ব্যক্তিগত ব্যবসাবাণিজ্য নিয়া ব্যস্ত আছে। আরেকটা গ্রুপ আছে ক্ষেতমজুর সমিতি, যাদের নিয়ত ঠিক আছে কিন্তু কোনো কর্মপরিকল্পনা নাই। কৃষকদের স্বার্থ রক্ষায় এই দুইটাই অচল। 

আচ্ছা কৃষক কয় প্রকার। সবাইকে গড়পরতা কৃষক কইলা ফেলা হয়, সবার অবস্থা কি এক? নিচ থেকে শুরু করি। 

সবার নিচে ক্ষেতমজুর। মানে অন্যের ক্ষেতে শ্রম দেয় যে, না আছে নিজের জমি, না আছে বর্গা নেয়ার মতো অবস্থা। উত্তরবঙ্গে ধান কাটার সময় হইলে ময়মনসিংহ অঞ্চল থেকে লোকেরা ট্রাকে করে ধান কেটে দিয়ে আসতে যায়। ক্ষেতে খায়, গৃহস্তের বাড়িতে ঘুমায়। দিনচুক্তি বা ক্ষেতচুক্তি মজুরির বিনিময়ে ধান কেটে দেয়। কাটা শেষ হলে এলাকায় আসে, হাসমুরগি পালে, বাড়ির পাশের মাচায় কুমড়া-শিম তুলে দেয়, মাটি কাটে, পাশের এলাকায় ইটভাটার শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে যায়। মানে এরা অস্থায়ী কৃষি-শ্রমিক। জীবননির্বাহের জন্য পেশা পরিবর্তন করে প্রায়ই। এদের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। 

এর উপরে ভূমিহীন বর্গাচাষী কৃষক। এদের নিজের জমি নাই বা অল্প পরিমান আছে। এরা অন্যের জমিতে চাষ করেন। জমির মালিকের সাথে এদের বিভিন্নরকম চুক্তি হয়। হয় অর্ধেক ফসল, অথবা নির্দিষ্ট টাকা। এরা ক্ষুদ্রঋণ এর বৃহৎ ভোক্তা। ঋণ নিয়ে সার কিনেন, বীজ কিনেন, পানি দেন। ফসল উঠলে সেই ঋণ পরিশোধ করে সংসারের জন্য কিছু রাখবেন ভেবে ঋন নেন। সামনে ভালো দিন আসবে ভেবে ঋণ নেন। ভালো দিন আসে না। একসময় এলাকা থেকে পালিয়ে এসে ঢাকার রাস্তায় পলিথিন বিছিয়ে শুয়ে পরেন আর পরদিন থেকে রিক্সা চালান। 

এরপর আসে নিজের জমি আছে এবং নিজেই চাষ করেন এমন কৃষক। এদের অবস্থা ভূমিহীন কৃষকের চে কিছুটা ভালো। কিন্তু সবসময় প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভয়ে থাকতে হয় তাদের। বৃষ্টি বেশি হলে ফসল শেষ, আবার কম হলেও শেষ। তার উপর এই জনগোষ্ঠীর বেশিরভাগ হাতআন্দাজে অথবা পারিবারিক ঐতিহ্য হিসেবে চাষাবাদ করেন। চাষাবাদ বিষয়ে কিছুটা পড়াশোনা বা ট্রেনিং বা পরামর্শ তাদের পরিশ্রম আর কর্মদক্ষতাকে আরো বেশি আউটপুট দিতে পারতো। 

এর উপর জোতদার কৃষক। এরা ভূস্বামী টাইপ কৃষক। প্রচুর জমির মালিক এরা, জমিতে কি চাষ হয় নিজেরা জানে না, কিন্তু জমি থেকে প্রচুর ইনকাম। যেমন সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদের কৃষি জমি থেকে বছরে আয় প্রায় ৩ কোটি টাকা। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফের কৃষি জমি থেকে আয় বছরে প্রায় ১.৫ কোটি টাকা। ইত্যাদি। 

কৃষি পণ্যের সাথে সরাসরি জড়িত কিন্তু কৃষিকাজ করেন না, তাদের কৃষক বলা যায় না। মজুতদার, সবজির পাইকারি-খুচরা ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে, বীজবিক্রেতা, সার বিক্রেতা, ভাড়ায় ট্রাক্টর দেন এমন ব্যক্তিরা কৃষক নয়। আর কৃষির ভোক্তা মানবজাতির সকল সদস্য, এমনকি বাংলাদেশীরাও। 

কৃষকের দুঃখের জায়গা একটাই ন্যায্যমূল্য না পাওয়া। ৩-৪ মাস পর যখন ফসল উঠে আর সেটার দাম না পাওয়া যায়, তার চেয়ে বড় দুঃখ আর হয় না। হয়তো আগামী ফসলের বীজ কেনার টাকা হবেনা, হয়তো বাচ্চার স্কুলের খরচ দিতে পারবেনা, হয়তো মহাজনের ঋণ পরিশোধ করতে পারবে না। হয়তো স্ত্রীর ছোটো কোনো অসুখ, ফসল উঠলে ডাক্তার দেখানোর কথা, হবেনা। এইরকম অনেক হবেনার মধ্যে দিয়ে যেতে হয় কৃষককে। অপমান-গঞ্জনা তো আছেই। 
কি পরিমান অসহনীয় দিন যাপন করতে হয়, তা আমরা কল্পনাও করতে পারি না। 

লাভের গুড় কে খায়? উত্তরবঙ্গে মূলার কেজি যখন ১-১.৫ টাকা, ঢাকায় তখন ৪০-৬০ টাকা। কৃষক বেচে ১ টাকায়, আমরা ভোগ করি ৪০ টাকায়। কিভাবে? মজার সরল অংক। শুধু যোগ হবে। মূলা কৃষকের কাছ থেকে আড়তদাররা কিনে নেয়। কিনা মাত্র সেটা ৩-৪ টাকা হয়ে যায়। এর সাথে যোগ হয় আড়তদারের লাভ, জায়গার ভাড়া, আড়তের শ্রমিকের মজুরি ইত্যাদি নানান খাত। মূলার কেজি ৭-৮ টাকায় আসে। 

সেটা ট্রাকে ঢাকায় পাঠাতে হবে পাইকারের কাছে। সাথে যোগ হয় ট্রাকের ভাড়া আর রাস্তার চাদা। আড়ত মালিকের লাভ আর আড়ত শ্রমিকের মজুরি তো তাও সহনীয়, রাস্তার চাদাটা কেন? রাস্তায় চাদা দেয়া হয় যেন ট্রাকটা সহীসালামতে ঢাকা পৌছায়। চাদা না দিলে ট্রাক ঢাকায় ঢুকবেনা। 

চাদা গ্রহণের ক্ষেত্রে নিরাপত্তাপ্রদানকারীদের কোনো ব্যবস্থাপনা নাই। সবাই নিজ নিজ এলাকায় নিরাপত্তা দেন খালি। যমুনা নদীর এপাড়-ওপাড়, গাবতলী, পথের বড় বাজার সবগুলা পয়েন্টে নিরাপত্তা পেতে পেতে ট্রাকটাকে ঢাকায় আসতে হয়। পাইকারের হাতে যখন মূলা পৌছায় তখন সেটা ২৫-২৮ টাকা। যোগ হয় পাইকারের লাভ। খুচরা ব্যবসায়ীরা নেন সেখান থেকে। যোগ হয় খুচরা ব্যবসায়ীদের লাভ। ভোক্তাদের হাতে যখন মূলা পৌছায় তখন সেটা ৪০ টাকা। এতো দাম! মূলার এতো দাম! 

মধ্যসত্ত্বভোগী সব হয়তো বাদ দেয়া যাবেনা। কিছুটাতো সহনীয় করা যায়। রাস্তার নিরাপত্তাটাও যদি মাননীয় সরকার মহোদয় দেয় তাহলে মূলার দাম কমে ভোক্তাদের কাছে আসবে ২৫-৩০ টাকায়। আবার ভোক্তারা যদি তাও মূলা ৪০ টাকাতেই কিনে কৃষককে কিছু বেশি দেয়া যায়। রাস্তার চাদার অর্ধেক টাকাই কৃষককে দেন। দেখেন দেশের কৃষির অবস্থা কি হয়? 

কৃষক, শ্রমিক, আড়তদার, পাইকার, খুচরা ব্যবসায়ী, ভোক্তা-জনগণ, চাদাবাজ এই বিরাট কর্মযজ্ঞ দেইখা রাখা ব্যক্তি বা সংগঠনের কাজ না। মাননীয় সরকার মহোদয়ের কাজ। ব্যক্তি আর সংগঠনের কাজ সেই আওয়াজ সরকার পর্যন্ত পৌছায়া দেয়া, সরকাররে তার কর্তব্য ও দায়িত্ব মনে করায়া দেয়া। আমাদের ভুলে গেলে চলবেনা, মাননীয় সরকার মহোদয়ের কাজই- দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালন। 

26 May 2019

দৈনন্দিন আলাপ ১১

আচ্ছা, মহানবী কেমন মুসলমান চেয়েছিলেন? তার অনুসারীরা কেমন হোক তিনি চেয়েছিলেন? মহানবীকে ইদানীং স্বর্গীয় কোনো চরিত্রে বসানোর চেষ্টা করছেন কেউ কেউ, এই চেষ্টা গত দেড় হাজার বছর ধরেই চলছে। সাম্প্রতিক ওয়াজগুলোতে তাকে অবতার বানানোর মাধ্যমে মানুষের সমাজ থেকে দূরে সরানোর চেষ্টা চলছে। কিন্তু আসলে কি মহানবীর চাওয়া এইরকম৷ ছিলো? 

তিনি তার সময়ে চিন্তায় অগ্রসর একজন মানুষ ছিলেন। তিনি তার দেশ ও জাতি নিয়ে চিন্তিত ছিলেন। চিন্তিত ছিলেন বলেই কিভাবে জাতীয় একতা বাড়ানো যায়, কিভাবে মানুষের মঙ্গল হবে, কিভাবে মানুষ মুক্তির দিকে এগিয়ে যাবে এগুলা নিয়ে ভেবেছেন। তার সময় কি হাসিঠাট্টা করার লোকের অভাব ছিলো বলে আপনার ধারনা? যারা মহানবীর এই চিন্তা নিয়ে হাহুতাশ করেনি। 

মহানবী তার সময়ে স্রোতের বিপরীতে চলা একজন মানুষ। পুরো সমাজ যখন একদিকে তিনি তখন আরেকদিকে একলা দাড়িয়ে বললেন-বংশপরম্পরায় রক্তপাত বন্ধ কর। কয়জন তার কথা শুনেছিলো? হাতে গোনা কয়েকজন। ৪০ জনকে সাথে নিয়ে তিনি প্রচারকার্যে বেরিয়েছেন যেখানে পদেপদে বাধা। যেখানে কেউ তার কথা শোনার জন্য প্রস্তুত না। টিটকারি করা, পাগল বলা, অসুস্থ বলা এমনকি গায়ে পর্যন্ত হাত তোলা হয়েছিলো। এমন পর্যায়ে তিনি যদি তার প্রচারকাজ বন্ধ করে দিতেন, আপনার কাছ পর্যন্ত কি ইসলাম ধর্ম এসে পৌছাতো? সমস্ত বাধা অতিক্রম করে তিনি তার কাংখিত লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে গেছেন। তার সংগ্রামী জীবন মানুষের সামনে আনে না এখনকার হুজুরেরা। 

মহানবী ছিলেন তার সময়কার সবচেয়ে সাম্যবাদী একজন মানুষ। মানুষের সমতার অধিকারে বিশ্বাসী একজন মানুষ। নারী-শিশুদের অধিকার, এতিমের অধিকার, প্রতিবন্ধীদের অধিকার নিয়ে তিনি কথা বলেছেন। বর্তমান সময়ে তিনি থাকলে তার অনুসারীদের দেখে তিনি হতাশ হতেন। এইরকম পলায়নপর, ভীতু, কলহপ্রিয়, কর্মবিমুখ, সত্যবিমুখ, অন্ধ-অনুকরনপ্রিয় অনুসারী তিনি আশা করতেন না।

25 May 2019

দৈনন্দিন আলাপ ১০

গ্যালিলিও যখন চার্চের বিশ্বাসের বিরুদ্ধে গিয়ে বলেছিলেন ‘পৃথিবীই সূর্যের চাপপাশে ঘুরে’, কারণ দর্শানোর জন্য তাকে ডাকা হয়েছিলো। তাকে ব্লাসফেমি আইনে অভিযুক্ত করা হয়েছিলো। বয়সের বিবেচনায় তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়নি। তবে তাকে তার কথা তুলে নিতে হয়েছিলো, আগের ভুলভাল বক্তব্যের জন্য ক্ষমা চাইতে হয়েছিলো, এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত গৃহবন্দী হয়ে থাকতে হয়েছিলো। একই কথা বলার জন্য সমসাময়িক সময়ে, অপেক্ষাকৃত তরুণ বিজ্ঞানী জিওর্দিনো ব্রুনোকে পুরিয়ে মারা হয়েছিলো। গ্যালিলিও বলেছিলেন- ‘সত্য সত্যই। দুইটি পরষ্পর সাংঘার্ষিক সত্য, থাকতে পারেনা।’ গ্যালিলিও এর মৃত্যুর অনেক বছর পর কেউ একজন বলেছিলেন- ‘গ্যালিলিও এই কথাগুলোই যদি কবিতার ভাষায় বলতেন, তাকে হয়তো এই কোর্ট-চার্চে দৌড়াদৌড়ি করতে হতোনা।’ কেন? কারণ কবিতার ভাষা নির্দোষ। কবিতায় অনেকে অনেক সত্য আর তিতা কথা বইলা ফেললেও বাকিরা বলে, থাক, কবিতাই তো। 

কিন্তু কবিতার আলাদা একটা শক্তি আছে, যেটা অন্য কোনো মাধ্যমের নাই। কবিতার ছন্দ লোকের মনে থাকে, কবিতার ভাষা মুখে মুখে ছড়ায়া যায়। কাজী নজরুলের কবিতা এখনো আমাদের প্রতিবাদ-প্রতিরোধকে সার্ভিস দিয়ে যাচ্ছে। তিনি এমন এমন কবিতা লিখছেন, আজকাল যদি কাজী নজরুল বেঁচে থাকতেন অথবা তার সময়ে যদি ফেসবুক থাকতো, ধর্মান্ধ-উগ্রবাদীরা তাকে কোপায়া মারতো। কেবল কবিতা লেখার কারনে জেল খাটছে এইরকম কবির সংখ্যা অনেক। কেবল কবিতা লেখার কারনে দেশছাড়া হইছে এইরকম কবির সংখ্যাও প্রচুর। কবিতা আসলে ভাষাকে একটা পোশাক দেয়। কখনো কখনো পোশাক এতো ভারী হয় যে কবিতা তার মূল বক্তব্য হারিয়ে ফেলে। লোকেরা কবিতার ভাষার সাথে কানেক্ট করতে পারেনা, প্রতিবাদে কবিতা ব্যবহার তো দূরের বিষয়। 

তো যেখানে ছিলাম, সত্য সত্যই। আচ্ছা, গ্যালিলিও-ব্রুনো যখন জানতে পারলেন পৃথিবী সূর্যের চারপাশে ঘুরে, পৃথিবী কি তার পর থেকে সূর্যের চারপাশে ঘোরা শুরু করছে? কবে শুরু করেছে? আজকে যদি সবাই বিশ্বাস করা শুরু করে, নাহ, সূর্যই পৃথিবীর চারপাশে ঘোরে, পৃথিবী কি ঘোরা বন্ধ করে দেবে? বিষয়টা হচ্ছে পৃথিবী আর সূর্যের সিস্টেমটাই এমন। আপনার বিশ্বাস বা অবিশ্বাস বা জানা বা না জানার উপর নির্ভর করে না। সৃষ্টির শুরু থেকেই এই সিস্টেম, ব্রুনোরে পোরাইলে এই সিস্টেম, না পোরাইলেও এই সিস্টেম। আমাদের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার কারনে জানতে দেরী হয়, বুঝতে দেরী হয়, এই আরকি। 

আসলে জ্ঞান-বিজ্ঞানে মানবজাতি খুব বেশিদূর আগায় নাই। আরো অনেকদূর যাওয়া বাকি আমাদের। বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কারের সময়কালের কথা। ১৮২৫-৩০ হবে। তখনকার সবচেয়ে বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী ঘোষণা দিলেন- ‘আমরা বিজ্ঞানের শেষ ধাপে এসে পৌছেছি। পদার্থ বিজ্ঞানে আর কিছু আবিষ্কার করার নাই, যা ছিলো সব মানুষ জেনে গেছে।’ অথচ আমরা এখন জানি ঐটা শেষ ধাপ ছিলো না, ছিলো প্রথম ধাপ। এমনকি বাষ্পীয় ইঞ্জিনের আবিষ্কার থেকে মানবজাতির আধুনিককাল শুরু বিবেচনা করা হয়। মানে এর আগে মধ্যযুগে। এরপর কতো কিছু আবিষ্কৃত হয়েছে পদার্থ বিজ্ঞানে, কতোদূর এগিয়েছে গণিত, কতোটা সাফল্য লাভ করেছে প্রযুক্তি, তার হিসাব করা কঠিন। কিন্তু আসলে আমরা খুব বেশি দূর আগায়া যাইতে পারি নাই। এখনো অনেক আবিষ্কার বাকি। 

আমাদের মন খোলা রাখতে হবে। যেকোনো কিছু গ্রহণের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। প্রচুর প্রশ্ন করতে হবে। মানবজীবনের একটা জীবন জ্ঞানার্জনের জন্য যথেষ্ট নয়। কেউ হয়তো কিছু তথ্য বেশি জানতে পারে, কিন্তু পুরাটা কেউ জানে না। যে জানে তার কাছ থেকে দূরে থাকতে হবে। প্রাচীন গ্রীসের ডেলফির মন্দিরে সবচেয়ে জ্ঞানী লোক কে প্রশ্ন করায়, উত্তর আসে- সক্রেটিস। সক্রেটিসকে কেন জ্ঞানী বলা হইছিলো? সক্রেটিস এর জবাব দিছে- ‘কারন আমি জানি, যে আমি কিছু জানিনা।’ যতক্ষণ আপনি না জানবেন, আপনার জানার আগ্রহ থাকবে। 

আচ্ছা, জ্ঞান কি? জ্ঞান কিছু তথ্য, কিছু অভিজ্ঞতা, কিছু দক্ষতা। বইয়ে কি জ্ঞান থাকে? না বইয়ে জ্ঞান থাকে না। বইয়ে থাকে কেবল কিছু তথ্য। শুধুমাত্র তথ্য আলাদা কোনো জ্ঞান না। নির্জন কোনো দ্বীপে একলা আটকা পরলে বাইচা থাকার জন্য মাছশিকারের কলাকৌশল শিখাটা আপনার জন্য জ্ঞান, কিউবার রাজধানী কি, কোনো কাজে আসবে না। অভিজ্ঞতা জ্ঞান। অভিজ্ঞতা থাকে মানুষের কাছে, মানুষের গল্পের মধ্যে। কি শিখতে চান তার উপর নির্ভর করবে কিভাবে শিখতে চান।  

24 May 2019

দৈনন্দিন আলাপ ৯

আমরা এখন আছি এক হাহাকারের রাষ্ট্রে। কেবল উন্নয়নের গালগল্প, কয়েকজন স্বার্থপর লোকের সম্পদবৃদ্ধি, অন্ধ আনুগত্য আর নজিরবিহীন তোষামোদ-স্তুতি, চেতনা এবং অনুভূতির ব্যবসা দেশকে নিয়ে যাচ্ছে অন্ধকার কিনারায়। যেখান থেকে লোকেরা কেবল হতাশায় নিমজ্জিত হচ্ছে। কেউ কিছু করছেনা এখানে। একটা একটা করে দিন শেষ হয়ে যাচ্ছে, যেন দিন এভাবে শেষ হয়ে গেলেই হলো। গ্রামের বাংলাদেশ এখনো অন্ধকারে, শহরে নাই নাগরিক সুবিধা, ছাত্ররা পড়াশোনা করে চাকরীর জন্য, চাকুরেরা কাজ চালায়া নেয় দুইবেলা খাবারের জন্য আর ব্যবসায়ে মন্দা-স্থবিরতা। আমরা এমন রাষ্ট্র চাই নাই। এমন একটা বাংলাদেশের জন্য মুক্তিযুদ্ধ হয় নাই। 

৯৭ সালের একটা রাজনৈতিক প্রবন্ধের বই পড়তেছিলাম। সেখানে লেখক হাসাহাসি করছেন কারণ আমেরিকার তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশকে উন্নয়নের রোলমডেল বলছেন। কাকতালীয়ভাবে তখনো শেখ হাসিনার শাসনকাল ছিলো। এখনো বাংলাদেশ আধুনিক রাষ্ট্রের উন্নয়নের রোলমডেল, এই কিছুদিন আগে আবার আমেরিকার আরেক মন্ত্রী আইসা এটা বইলা গেছে। এখনো শেখ হাসিনা ক্ষমতায়। এইখানে দুইটা বিষয়, এক আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী এই কথা বইলা মস্করা করতে চাইছে, আবার সরকারপ্রধানকে খুশিও করতে চাইছে। আমাদের সরকারপ্রধানও এটা শুইনা খুশি হইছে। কিছু না কইরা যদি রোলমডেল হওয়া যায় তাইলে কিছু করার দরকার কি! ২য় বিষয়, রোলমডেল এইভাবে যে বাংলাদেশ যেভাবে রাষ্ট্র চালায় সেভাবে উন্নত বিশ্ব রাষ্ট্র চালাবে না, তাইলে দেশ আগাবে। 

মানুষের ইতিহাস সংঘবদ্ধতার ইতিহাস, মানুষের ইতিহাস একসাথে থাকার ইতিহাস। একসাথে থাকলে গেলে টুকটাক ঝামেলা হয়, সেগুলা কমায়া নিয়া আসাই রাষ্ট্রের কাজ। জমিজমা নিয়া প্রতিবেশীর সাথে বিরোধ। আমি বললাম- আমি ঠিক, প্রতিবেশী বললো- ও ঠিক। মারামারি হওয়ার অবস্থা। রাষ্ট্রের কাজ এই বিষয়টার নিষ্পত্তি করা। রাষ্ট্র এইখানে নিরপেক্ষ থাকবে, রাষ্ট্র এইখানে সৎ থাকবে। 

আচ্ছা রাষ্ট্র কি? রাষ্ট্র তো একটা বায়বীয় বিষয়, একটা আইডিয়া। কিছু মানুষের একটা নির্দিষ্ট জায়গায় একসাথে থাকাই রাষ্ট্র। রাষ্ট্রে যেহেতু অনেক লোক থাকতে পারে, তাই তাদের চালানোর জন্য আর দুইটা বিষয় লাগে, সার্বভৌমত্ব আর সরকার। বাংলাদেশ রাষ্ট্র বেশ বিশাল ১৬-১৭ কোটি লোক। সেইজন্য আধুনিক রাষ্ট্রে ক্ষমতা আর সরকার ডিসেন্ট্রালাইজ করা হয়। সরকার যতো কম লোক ডিল করবে তত দ্রুততার সাথে সেবা পৌছাই দিতে পারবে। সেইজন্য গড়ে উঠে লোকাল গভমেন্ট। সিটি কর্পোরেশন, তার মধ্যে ওয়ার্ড। জেলা, তার মধ্যে উপজেলা, তার মধ্যে ইউনিয়ন। যেন ওয়ার্ড আর ইউনিয়ন পর্যায়ে লোকেদের কাছে সেবা নিয়া যাওয়া যায়। 

রাষ্ট্রীয় সেবা কি? আমার বাসার সামনের রাস্তা নাহয় আমি বানায়া রাখতে পারি। একটা কাজে আমার দিনাজপুর যাওয়া দরকার। দিনাজপুর পর্যন্ত কি আমি রাস্তা বানাইতে বানাইতে যাবো? না, সরকারের কাজ দিনাজপুর পর্যন্ত রাস্তা বা ট্রেনলাইন বানায়া রাইখা আমার কাজটারে সহজ করা। যেন আমি সহজে দিনাজপুর যাইতে পারি, দিনাজপুরের লোকটা সহজে আমার কাছে আসতে পারে। এইরকম রাষ্ট্রীয় সেবা খাত কয়েকটা আছে, যোগাযোগ, শিক্ষা, বাণিজ্য, স্বাস্থ্য, অর্থ ইত্যাদি। কয়েকটা সেক্টর ঠিক কইরা ফেললেই ঠিকঠাক চলতে থাকবে রাষ্ট্রীয় সেবা। 

কথা হচ্ছে যারা ক্ষমতায় আছে, তারা সরকারের কাজটারে সেবা হিসেবে দেখা কিনা? এইটা পুরাপুরি দৃষ্টিভঙ্গি। ক্ষমতা হিসেবে দেখলে শাসন করতে চাইবেন, সেবা হিসেবে দেখলে সেবা করতে চাইবেন। আমরা কেমন রাষ্ট্র চাই? 

আমরা এরকম এক রাষ্ট্র চাই যেখানে দুর্নীতি বলতে কিছু থাকবেনা। দুর্নীতিরকে ঘৃণা করবে সরকারের কর্মকর্তারা। বিশেষ সুবিধা দিতে চাইলেও নিবে না। যেখানে লুটপাট বলতে কিছু থাকবেনা। রাষ্ট্র হবে জনতার কল্যাণকামী। জনগণের কিসে কল্যান, কোথায় সবচেয়ে ভালো হবে সেটা বের করবে তারা। জনগণের মতের মূল্য দিবে, চাহিদার মূল্য দিবে। জনতার শ্রম আর আকাঙ্ক্ষার সর্বোচ্চ প্রতিদান দিবে রাষ্ট্র। একটা রাষ্ট্র যেখানে কেউ না খেয়ে থাকবে না। যেখানে সবাই নির্ভয়ে চলাচল করবে, কারণ সে জানে তার কিছু হলে তার পেছনে তার রাষ্ট্র আছে। যেখানে এতিম বাচ্চারা বিকালে খেলবে, রাতে শান্তিতে ঘুমাতে যাবে, কারণ সে জানে তার রাষ্ট্র তাকে দেখে রাখবে। 

মালয়েশিয়াতে একবার অবৈধ লোক ধরপাকড় শুরু হলো, অবৈধদের ধরে দেশে পাঠিয়ে দেয়া হবে। মালয়েশিয়া রাষ্ট্রের সুন্দর একটা পলিসি আছে। প্রথম ২ বছরের ভিসায় লোক কাজের জন্য নেয়। মোট ১০-১২ বছর দেয়ার কথা। ২ থেকে ৪ বছর ভিসা দেয়ার পর ভিসা রিনিউ করা বন্ধ করে দেয়। কাজের জন্য যাওয়া লোকেরা অবৈধ হয়ে যায়। অবৈধ শ্রমিকদের কাছ থেকে পুলিশ টাকা খায়, শিল্পপতিরা কম টাকায় তাদের খাটায় নেয়। ধরা পরলে দেশে পাঠায়া দেয়। সে আবার বৈধভাবে আসে। সরকার আবার টাকা পায়। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, ফিলিপাইন আর ইন্দোনেশিয়ার লোক অবৈধ হয় বেশি। 

তো সেবার একটা ফ্লাইটে ভারতের প্রায় ৪০০ অবৈধ লোক দেশে ফেরত পাঠায় তারা। ভারত রাষ্ট্র কি প্রতিক্রিয়া দেখায় তাতে? ভারতের বিমানমন্ত্রী ফিরতি ফ্লাইটে মালয়েশিয়া আসে ২০ টা বিমান সাথে নিয়ে। এসে বলে মালয়েশিয়ায় কতজন ভারতীয় আছে বৈধ-অবৈধ মিলিয়ে? ১০-১২ লাখ। সবাইকে দেশে নিয়ে যেতে এসেছি। আপনাদের দেশে আর কোনো ভারতীয় আসবে না কাজ করার জন্য। এতো সংখ্যাক লোক একবারে চলে গেলে মালয়েশিয়ার অর্থনীতিতে প্রভাব পরবে। মালয়েশিয়ার পুনর্গঠনে এইসব শ্রমিকদের মূল্য জানে মালয়েশিয়া সরকার। -কি করা লাগবে? –অবৈধ করছেন আপনারা, বৈধও করবেন আপনারা। আপনাদের কাজের ভিসা দেয়া আপনাদের দায়িত্ব, ভারত সরকারের না। ফলাফলে সেই ৪০০ জন আবার মালয়েশিয়া ফেরত আসে। ভিসা পায়। ভারতীয় অবৈধদের জন্য ভিসা প্রসিডিউর সহজ করা হয়। 

আর বাংলাদেশের বিদেশ মিশনগুলোতে জুনিয়ার অফিসারদের সাথেও কথা বলা যায় না। কার সাথে কথা বলবে, এই অশিক্ষিত, নিজের নাম লেখতে পারে না, আগে কৃষক ছিলো পরে শ্রমিক হয়েছে, এর সাথে? বড় কোনো অফিসারকে সমস্যা খুলে বলা তো অসম্ভবই। বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশীরা একলা। কোনো আত্মীয়-স্বজন-বন্ধু থাকলে সে আছে আর নাইলে ঐ শ্রমিক একদম একা। রাষ্ট্র তার পাশে নাই। ঐটাতো বিদেশ, দেশেই রাষ্ট্র জনগণের পাশে নাই।

আচ্ছা, জনগণ সরকার বিরোধী হয়, নাকি সরকার জনগণ বিরোধী হয়? জনগণ তখনি সরকারের বিরুদ্ধে যায় যখন সরকার জনগণের বিপক্ষে থাকে। এর আগের আলাপে বলেছিলাম, দেশে যে আইনের শাসন নাই দুইএকটা উদাহরণ দেখলেই তা বোঝা যায়। আপনি জানেন না দিনের বেলা কাজে বের হয়ে সন্ধ্যায় ঠিকঠাক মতো বাসায় এসে পৌছাতে পারবেন কিনা? আপনার মেয়েটা সন্ধ্যায় টিউশনিতে গিয়ে রাত্রে বাসায় ফিরবে কিনা আপনি জানেন না। যদি কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে তার কি বিচার হবে আপনি জানেন। এইরকম বিচারহীন রাষ্ট্র কে চায়? এইরকম রাষ্ট্রে কে থাকতে চায়?

রাষ্ট্রের এই অবস্থা থেকে উত্তরনের জন্য কাজ করা লাগবে। অনেক কাজ করা লাগবে একসাথে হয়ে। মানুষের জোটবদ্ধতাই মানুষের শক্তি। রাজনীতি খারাপ রাজনীতি খারাপ বলে, আই হেইট পলিটিক্স বলে, রাজনীতি থেকে দূরে থেকে আপনি নিজেও এই নৈরাজ্য প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখছেন। এইরকম অথর্ব দেশ প্রতিষ্ঠায় আপনারও অবদান আছে। রাজনীতি খারাপ এই ধারনা থেকে আমাদের বের হতে হবে। সমস্ত অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ হতে হবে। 

তার আগে মনঃস্থির করতে হবে আপনি কেমন রাষ্ট্র চান? আপনার রাষ্ট্র আপনার সাথে, জনগণের অধিকারের সাথে কেমন আচরন করুক আপনি চান? দেশ আপনার, দেশ ভবিষ্যৎ এ কেমন হবে এটা ঠিক করার অধিকারও আপনার। চেষ্টা না করে কেবল হাহুতাশ করলে ভবিষ্যৎ ঠিক হবে না, এটা আপনি খুব ভালো করেই জানেন। ভবিষ্যতের মঙ্গলের জন্য আলাপে অংশ নিন। চাইলে কমেন্টে আলাপে অংশ নিতে পারেন। না চাইলে ইনবক্সেও আলাপ করতে পারেন। 

23 May 2019

দৈনন্দিন আলাপ ৮

ভারতে নির্বাচনের ফল দিয়েছে। বড় জয় পেয়েছে ভারতীয় জনতা পার্টি- বিজেপি। বিজেপিকে অনেকে সাম্প্রদায়িক শক্তি হিসেবে উল্লেখ করেন। বিজেপির রাজনীতির মূল হাতিয়ারই ধর্ম। আর ধর্ম সবসময়ই একটি স্পর্শকাতর হাতিয়ার, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে যার বহুল ব্যবহার। বিজেপি এর ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ ভোট দিয়ে বিজেপিকে ক্ষমতায় আনছেন এটা মেনে নিতে হবে। তবুতো ভারতে নির্বাচন হয়! বাংলাদেশে তো তাও হয় না। 

নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার ক্ষমতায় আসলে জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা থাকে। সরকার তো আসলে জনগণের প্রতিনিধি। আর বহুদলীয় গণতন্ত্রে বিরোধীদল থাকলে সরকারের জবাবদিহিতা বজায় থাকে। ভারতে বেশ কয়েকটা বড় বিরোধীদলের কারনে বিজেপি নিরঙ্কুশ ক্ষমতায় আসলেও জবাবদিহিতার মধ্যে থাকবে। ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস যতো কম আসনই পাক না কেন, এরা সর্বভারতীয় পার্টি। প্রত্যেকটা প্রদেশ থেকে এরা আওয়াজ তুলতে পারে। আঞ্চলিক দলগুলোর মধ্যে তৃণমূল কংগ্রস, ওয়াইএসয়ার কংগ্রেস পার্টি, আম আদমি পার্টি, দ্রাবিড়া মুন্নেত্রা কাঝাঘাম- ডিএমকে, সমাজবাদী পার্টি, বহুজন সমাজ পার্টি, কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়া- সিপিআই, সিপিআই (এম) সহ বেশকয়েকটি দল বেশ শক্তিশালী অবস্থানে আছে। এরা শেষ পর্যন্ত জনতার বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে কথা বলে যায়। বাংলাদেশের কয়টা রাজনৈতিক দল আছে যারা ক্ষমতায় না থাকলেও জনতার পক্ষ নিয়ে কথা বলে? 

22 May 2019

দৈনন্দিন আলাপ ৭

২০১০ সালের ১৭ ডিসেম্বর, তিউনিসিয়ার রাজধানী তিউনিস। ৮ টার সুন্দর সকাল। প্রতিদিনকার মতো মোহাম্মদ বোয়াজিজি তার ফলের ঠ্যালাভ্যান নিয়ে বের হয়েছে। বোয়াজিজির বয়স ২৬, তিউনিসের দরিদ্রতম এলাকা সিদি বুজিদে তার বাসা। মা, সৎ বাবা, ৬ ভাইবোনের বিশাল সংসারের উপর ব্যাংকের ঋণের বোঝা। বোয়াজিজির বাবা লিবিয়াতে কনস্ট্রাকশন শ্রমিকের কাজ করতেন। বোয়াজিজির ৩ বছর বয়সে তিনি মারা যান, তার মা তার চাচাকে বিয়ে করেন। বোয়াজিজি ১০ বছর বয়স থেকে বিভিন্ন রকম কাজ করা শুরু করেন। ফুলটাইম কাজ পাবার জন্য কৈশোরেই পড়াশোনা ছেড়ে দেন। বোয়াজিজি ঋণ করে ফলের ব্যবসা শুরু করেন। দোকান নেয়ার মতো যথেষ্ট পুঁজি না থাকায় ঠ্যালাভ্যানের উপরেই ফল বেচা শুরু করেন। ঠ্যালাভ্যান নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে ফল বেচা লাগে, তার উপর পুলিশের উৎপাত। পুলিশ একে রাস্তায় বসতে দেয় না, দিলেও চড়া ঘুষের বিনিময়ে। 

তার আগের দিনই বোয়াজিজি প্রায় ২০০ আমেরিকান ডলার সমপরিমান অর্থ ঋণ করে ফল কিনেছে, পরের দিনের ব্যবসার জন্য। সকাল ১০.৩০ এ যথারীতি পুলিশ আসে, টাকা চায়। বোয়াজিজির কাছে তখন টাকা ছিলোনা। পুলিশ তার কোনো কথা না শুনে তাকে রাস্তা থেকে তুলে দেয়, তার ওজন পরিমাপের মেশিন থানায় নিয়ে যায়। তাকে আইন দেখানো হয়, তিউনিসের রাস্তায় ঠ্যালাভ্যান নিষিদ্ধ। বোয়াজিজি তৎক্ষণাৎ গভর্নরের অফিসে যায়, বিষয়টা নিয়ে সংশ্লিষ্ট কোনো কর্মকর্তার সাথে কথা বলার জন্য। সেখানে প্রথমে তার সাথে কেউ কথা বলতে চায় নি। পরে কথা বলার সময় যথেষ্ট পরিমান অপমান করে। এবং শেষে মারধর করে অফিস থেকে বের করে দেয়। 

সকাল ১১.৩০। ঋনগ্রস্থ, অপমানিত, বিধ্বস্ত মোহাম্মদ বোয়াজিজি গভর্নরের অফিস থেকে বের হয়ে এসে রাস্তার সামনে দাঁড়ায়। পাশের গ্যাস-পাম্প থেকে ১ বোতল পেট্রোল চেয়ে নেয়। গভর্নর অফিসের সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলে- ‘বেঁচে থাকার জন্য তোমরা আমার কাছ থেকে কি আশা করো?’ তারপর নিজের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। সেই আগুন জ্বলে উঠে পুরো তিউনিসিয়ায়। 

বোয়াজিজির আগুন দেয়ার ঘটনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। বেকারত্ব, লাগামহীন দুর্নীতি, প্রশাসনিক স্বেচ্ছাচারিতা আর স্বৈরাচারে তিউনিসিয়া আগেই বারুদ হয়ে ছিলো। বোয়াজিজি সেই বারুদে যেন আগুন দিলেন। বিক্ষোভে ফুসে উঠলো পুরো তিউনিসিয়া। তিউনিসিয়ায় বেকারত্বের হার তখন ৩০%। তার উপর রাষ্ট্রপতি বেন আলী ২৩ বছর যাবত ক্ষমতায়। গুটিকয়েক ব্যক্তি-পরিবার ছাড়া আর কারো তেমন কোনো উন্নতি হয় নাই। এর সাথে যোগ হয়েছে প্রশাসনের সর্বস্তরে দুর্নীতি। সেটা দেখারও কেউ নাই। বিচার দেয়ার মতো কেউ নাই, বিচার করার মতো কেউ নাই। 

বোয়াজিজিকে হাসপাতালে নেয়া হয়, সেখানে তিনি মৃত্যুবরন করেন ২০১১ সালের ৪ জানুয়ারি। বোয়াজিজি গায়ে আগুন দেয়ার পরই তিউনিসিয়া জুড়ে ব্যাপক বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। লক্ষ লক্ষ লোক রাস্তায় নেমে আসে। রাষ্ট্রপতি বেন আলী তিউনিসিয়ায় জরুরি অবস্থা জারী করেন, রাস্তায় সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়। জরুরি অবস্থা উপেক্ষা করে রাস্তায় অবস্থান করে সাধারণ লোকেরা। বেন আলী আশ্বাস দেন দুর্নীতির বিচার হবে, কর্মসংস্থান তৈরী হবে, প্রশাসন জনমুখী হবে, চাইলে নির্বাচনও দেয়া হবে। কিন্তু লাগাতার বিক্ষোভ-আন্দোলনের মুখে ২০১১ এর ১৪ জানুয়ারি বেন আলী পদত্যাগ এবং দেশত্যাগ করতে বাধ্য হয়। 

ভাসমান ফলবিক্রেতা বোয়াজিজির গায়ের আগুন কেবল তিউনিসিয়ায় সীমাবদ্ধ ছিলোনা। সেই আগুন ছড়িয়ে পরতে থাকে পুরো আরব অঞ্চলে। মিসরে ২০১১ এর ২৫ জানুয়ারি, সিরিয়ায় ২৬ জানুয়ারি, ইয়েমেনে ২৭ জানুয়ারি, ইরাকে ১২ ফেব্রুয়ারি, বাহরাইনে ১৪ ফেব্রুয়ারি, লিবিয়ায় ১৭ ফেব্রুয়ারি, মরোক্কোয় ২০ ফেব্রুয়ারি, সৌদি আরবে ১১ মার্চ থেকে আন্দোলন শুরু হয়। এই আন্দোলন স্বৈরতন্ত্র-রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে আন্দোলন, এই আন্দোলন গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন। জনগণের আধিকার আদায়, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, দুর্নীতি দমন এবং একটি বাসযোগ্য রাষ্ট্র গড়ে তোলার জন্য এই আন্দোলন। সারা পৃথিবীর রাজনীতিতে এর প্রভাব পরে। আরবের জনগণের স্বতঃস্ফুর্ত এই আন্দোলনের নাম দেয়া হয়- ‘আরব বসন্ত’। 

উপরে উল্লেখিত দেশগুলোতে বড় আকারে আন্দোলন হয়। এছাড়া প্রত্যেকটি আরব দেশে মাঝারি বা ছোটো আকারে আন্দোলন অনুষ্ঠিত হয়। প্রত্যেকটি দেশে আন্দোলন আর তার ফলাফলের আলাদা আলাদা রূপ দেখা যায়। এখন পর্যন্ত সবচেয়ে ভালো ফলাফল দেখা গেছে তিউনিসিয়াতেই।  বেন আলীর পতনের পর ২০১১ আর ২০১৪ তে দুইটি শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনের মাধ্যমে জনতা তাদের রাষ্ট্রপতি বাছাই করে নিচ্ছে। তিউনিসিয়ার সরকার ও প্রশাসন ব্যাপক সংস্কারের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। দুর্নীতি-স্বেচ্ছাচার আগের চেয়ে কমেছে। 

আরব দেশগুলোতে আন্দোলনের প্রধান কারণ মূলত কয়েকটা। ১. স্বৈরতন্ত্র বা রাজতন্ত্র। আরব দেশগুলোতে কেউ একবার ক্ষমতায় এসে পরলে আর কোনোভাবেই নামতে চায় না। ক্ষমতায় থাকার জন্য যা যা করা দরকার তাই করে। দুর্নীতিতে নিমজ্জিত এক বিচারহীন সমাজে স্বৈরাচার টিকে থাকে কিছুকাল, এটা তারা জানে। আন্দোলনের সময়ে মিসরের রাষ্ট্রপতি হোসনী মোবারকের শাসনকাল ৩০ বছর, লিবিয়ার মুয়াম্মার গাদ্দাফীর শাসনকাল ৪২ বছর, সিরিয়ায় রাষ্ট্রপতি বাশার আল আসাদ আর তার পিতা হাফিজ আল আসাদ মিলিয়ে ৪০ বছর। রাজতন্ত্রে আর বয়স হিসাব করে কি লাভ! 

২. লাগামহীন দুর্নীতি। দুর্নীতি স্বৈরতন্ত্র আর রাজতন্ত্র টিকিয়ে রাখার একটা গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র। কোনো ব্যক্তি, পরিবার বা গোষ্ঠীবিশেষকে আলাদা সুবিধা দিয়ে বাকীদের জুলুম করার নামই দুর্নীতি। যার আছে তাকে আরও সুযোগ করে দেয়া, যার নাই তাকে আরো শোষনের মধ্যে রাখাই দুর্নীতি। প্রশাসনিক দুর্নীতিতো প্রত্যেকটা স্তরে। রাজাদেরতো ব্যক্তিগত আরাম আয়েশ আর প্রোটোকল পেলেই মিটে যায়। ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয় এক জায়গায়। স্বৈরাচারের ইচ্ছাই দেশের আইনে পরিণত হয়। তাই দেশ থেকে আইনের শাসন বিলুপ্ত হতে থাকে। 

৩. বেকারত্ব ও ধনী-গরীবের বৈষম্য বৃদ্ধি। দুর্নীতি ও অপশাসন প্রতিষ্ঠা হওয়া মাত্র বেকারত্ব ও বৈষম্য বৃদ্ধি পায়। কেবল সরকারের অনুগত চাকুরে আর উচ্ছ্বিষ্টভোগীরা ধনী হতে থাকে। রাজনীতিবিদ, শিল্পপতি আর মজুতদার ব্যবসায়ীরা ধনী হতে থাকে। অপরদিকে বেকারত্ব বৃদ্ধি পায়। গরীব আরো গরীব হতে থাকে। গরীবের ক্রয়ক্ষমতা কমতে থাকে, ঋণের দায়ে জর্জরিত হতে থাকে তারা। মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধি পায়, দেশের অর্থনীতি ক্রমশ ভেঙে পরতে থাকে, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। কিন্তু শাসকগোষ্ঠীর সেদিকে নজর থাকেনা। 

৪. মানবাধিকার ও মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন। স্বৈরতন্ত্র ও রাজতন্ত্র টিকিয়ে রাকতে হলে মানবাধিকার লঙ্ঘন করতেই হবে। কেউ না কেউ সত্য বলবেই, তাকে আটকাতে হবে। প্রথমে হুমকি-ধামকি-ভয়, এরপর জেল-জুলুম-জরিমানা, এরপর অর্থদণ্ড বা নির্বাসন বা পরিবারের উপর নির্যাতন এবং সবশেষে মৃত্যুদণ্ড। স্বৈরতন্ত্র টিকিয়ে রাখতে হলে মানুষের কথা বলা আটকাতে হবে। এর পাশাপাশি মিডিয়ায় নিয়ন্ত্রণ আরোপ, বিরোধী রাজনৈতিকদের উপর নির্যাতন, জনগণের সাধারণ সমাবেশে হস্তক্ষেপ এগুলো করে মূলত স্বৈরতন্ত্রকে শক্তিশালী করা হয়। 

কারণ যাই হোক, প্রথমদিকে আন্দোলন শান্তিপূর্ণই থাকে। এগুলোকে সাধারণ জমায়েত বা বড়জোড় কয়েক হাজার লোকের মিটিং বলা যেতে পারে। শাসকগোষ্ঠী দমনপীড়নের মাধ্যমে আন্দোলনকে ধামাচাপা দিতে গিয়ে লোকেদের আরো উস্কে দেয়। কোথাও জরুরি অবস্থা, কোথাও কার্ফিউ বা সেনাবাহিনী মোতায়েন একটা ন্যায্য আন্দোলনকে হিংসার দিকে ঠেলে দেয়। জনগণ অসন্তুষ্ট হয়। জনতার মবে পরিণত হতে থাকে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনগুলো। কিছু দেশে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়, যা এখনো চলছে। গৃহযুদ্ধের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য- সিরিয়া আর ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধ। 

আরব বসন্তের আন্দোলনগুলোতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর খুব বড় ভূমিকা ছিলো। আন্দোলনের ধরণ, সময়, গতি-প্রকৃতি, করণীয় ঠিক করতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন গ্রুপ সক্রিয় ছিলো। প্রিন্ট ও ইলেকট্রিক মিডিয়া সরকারের অধীনে থাকায়, কোথায় কি হচ্ছে জানতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর উপর বেশি নির্ভরশীল হয় তখনকার মানুষ। বাংলাদেশ দিয়ে বোঝাতে গেলে, বিটিভিতে যখন বাতাবী লেবুর চাষ হচ্ছিলো, ফেসবুকে তখন জনতা দেখছিলো ধানের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেনা কৃষক। পৃথিবীর ৯৯% মিডিয়ার কাজ আসলে সরকারের গুনকীর্তন করা আর সফলতাগুলো ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে সাধারণ জনগণের কাছে পৌঁছে দেয়া। 

যেসব কারনে লোকজন আন্দোলন করতে রাস্তায় নামছিলো, সেগুলা আসলে সরকারের এমনি করা উচিত। যেমন- কথা বলার অধিকার, সমাবেশ করার অধিকার, গণতন্ত্র চর্চার অধিকার, নিজের মতপ্রকাশের অধিকার, বিরোধী মতাদর্শের রাজনীতিবিদদের রাজনীতি করার অধিকার, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালন, রাষ্ট্রের সর্বস্তরে দুর্নীতি দমন, প্রশাসনকে জনগণমুখী করা, সরকারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা, গুটিকয়েক কতিপয়কে বিশেষ সুবিধা না দেয়া, শাসকপরিবারের ভোগবিলাসে মত্ত না থাকা ইত্যাদি। 

যাই হোক, ঘটনা আর সময়ের সাথে সাথে আরব বসন্ত পরিণত হয় এক বিরাট মহীরুহে। এক শাখা তার থেকে ১০ টা প্রশাখা। মিসর, সিরিয়া, ইরাক, ইয়েমেন আর আরব বসন্ত নিয়ে বাদবাকি প্রাসঙ্গিক আলাপ সামনে আরো আসবে আশা করি। শেষ করতে চাই বোয়াজিজির শেষ কথা দিয়ে। ‘বেঁচে থাকার জন্য তোমরা আমার কাছ থেকে কি আশা করো?’

21 May 2019

নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু

নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু 

বাংলাদেশ স্বাধীন হয় ১৯৭১ সালে। কিন্তু বাঙালীর স্বাধীনতার সংগ্রাম শুরু হয় আরো অনেক আগে, ১৮৫৭ সালে, সিপাহী বিদ্রোহের পরপর। ১৯৭১ এ বাংলাদেশ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পারে কারণ পাকিস্তান ১৯৪৭ এ স্বাধীন হতে পেরেছিলো। উপমহাদেশে ভারত আর পাকিস্তান দুইটা দেশ স্বাধীন হতে পেরেছিলো কারণ বৃটিশরা ভারত ছেড়ে গিয়েছিলো। ভারত ছাড়ার আগে ধর্মের ভিত্তিতে দুইটা দেশ করে দিয়ে গিয়েছিলো। ১৯৪৭ এ বৃটিশরা ভারত ছেড়ে গিয়েছিলো কারণ তারা অর্থনৈতিক আর সামাজিক মারাত্মক প্রতিরোধের মুখে পরেছিলো। এইরকম একটা প্রতিরোধের নাম নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু। সুভাষ উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের এক মহাকাব্যের নাম। তার পুরো জীবনটাই এক সাস্পেন্স থ্রিলার।

সুভাষ খুবই মেধাবী ছাত্র ছিলেন। ছাত্রজীবন শেষ করে তিনি আইসিএস (ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস) পরীক্ষায়ও উত্তীর্ন হন। কিন্তু ততদিনে যুবক সুভাষ, মহাত্মা গান্ধীর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে গেছেন। তিনি বুঝতে পেরেছেন, স্বাধীনতার চেয়ে বড় কোনো উপহার মানুষের জীবনে থাকতে পারে না। ভারতবাসীকে স্বাধীন করতে হবে, এরচেয়ে বড় কোনো ব্রত হতে পারে না সুভাষের জীবনে। তিনি চাকরীতে যোগদান করলেন না। যোগদান করলেন কংগ্রেসের রাজনীতিতে। কিন্তু রাজনীতিতে এসে ধীরে ধীরে বুঝতে পারলেন গান্ধীবাদী রাজনীতির মাধ্যমে ভারতকে স্বাধীন করতে আরো ২০০ বছর লাগবে। গান্ধী যেখানে অহিংসায় বিশ্বাস রাখতেন, সুভাষ সেখানে আস্থা রাখতেন চাপপ্রয়োগের মাধ্যমে অধিকার আদায়ের। যতক্ষণ অধিকার আদায় না হবে ততক্ষণ চাপপ্রয়োগ।

১৯২৮ সালে তিনি কলকাতায় ইউনিফর্ম পরিহিত প্রায় ২,০০০ যুবকের সমাবেশ করেন। সুভাষকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯৩০ সালে জেল থেকে বের হয়ে তিনি কলকাতা সিটি কর্পোরেশনের মেয়র নির্বাচনে জয়ী হন। এর মধ্যে বেশ কয়েকবার জেল খেটেছেন, গৃহবন্দী হয়েছেন, দেশ ত্যাগে বাধ্য হয়েছেন। আবার লুকিয়ে দেশে ফিরে কারাবরণ করেছেন। কোনো কিছুই সুভাষকে তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য থেকে দূরে সরাতে পারেনি। ১৯৩৫ সালে লন্ডন থেকে প্রকাশিত হয় তার বই- দ্যা ইন্ডিয়ান স্ট্রাগল। ১৯২০ থেকে ১৯৩৪ সালের ঘটনাগুলোর বিবরন ও সুভাষের ভাষ্য বইটিকে ইতিহাসের একটি প্রামান্য দলিলে পরিণত করে। বইটি বৃটিশ সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ হয়।

বইটি যখন লেখেন তখন তিনি অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় নির্বাসনে। বইটির লেখার কাজে সাহায্য করার জন্য এমিলি শেঙ্কল নামে একজন শর্টহ্যান্ডরাইটারের সাহায্য নেন তিনি। পরবর্তীতে এমিলিকে বিয়ে করেন তিনি। তাদের এক কন্যাসন্তান হয়। কন্যার নাম রাখা হয় অনিতা বসু।

১৯৩৮ সালে তিনি কংগ্রেসের সভাপতি নিযুক্ত হন। কিন্তু গান্ধীপন্থী উদারবাদীরা তার কাজে বারবার বাঁধা সৃষ্টি করে। ১৯৩৯ সালে তিনি কংগ্রেস থেকে বের হয়ে প্রতিষ্ঠা করেন নতুন রাজনৈতিক দল- ফরোয়ার্ড ব্লক। এর মধ্যে শুরু হয় ২য় বিশ্বযুদ্ধ। সুভাষ ভাবেন বিশ্বযুদ্ধকে কাজে লাগিয়ে বৃটিশদের দেশছাড়া করা যায় কিনা? সুভাষের উপর বৃটিশ সরকারের কড়া নজরদারী, তিনি কার্যত গৃহবন্দী। সেই অবস্থা থেকে তিনি পলায়ন করেন। তার বিশ্বাস ছিলো রাশিয়ার (সোভিয়েত ইউনিয়ন) সমাজতান্ত্রিক সরকার ভারতকে বৃটিশমুক্ত করতে তাকে সাহায্য করবে।

তিনি কলকাতা থেকে পালিয়ে যান একদম বৃটিশ ভারতের পশ্চিম সীমান্তের পেশোয়ার শহরে (বর্তমানে পাকিস্তান)। সেখান থেকে তিনি ফরোয়ার্ড ব্লকের একজন কর্মীকে সাথে নিয়ে আফগানিস্তান প্রবেশ করেন। তিনি পশতু ভাষা জানতেন না। ফলে পুরো আফগানিস্তান তিনি বোবা-কালার বেশ ধরে পাড়ি দেন। কিছুদিন পর তিনি রাশিয়া প্রবেশ করেন। কিন্তু ভারতের স্বাধীনতার বিষয়ে রুশ সরকারের অনাগ্রহে তিনি মানসিকভাবে আহত হন এবং মস্কোর জার্মান দূতাবাসে যোগাযোগ করেন। মস্কো থেকে এক ইতালিয় ব্যবসায়ীর ছদ্মবেশে তিনি জার্মানি প্রবেশ করেন। জার্মানিতে তিনি ‘আজাদ হিন্দ রেডিও’ এর কার্যক্রম শুরু করেন। জার্মানদের হাতে ধরা পরা বৃটিশ ভারতীয় সৈনিকদের সাথে নিয়ে শুরু করেন ‘ফ্রি ইন্ডিয়া সেন্টার’।

তিনি হিটলারের সাথে দেখা করে ভারতের স্বাধীনতার বিষয়ে কথা বলেন। কিন্তু জার্মানি থেকে ভারত এতো দূরে যে সাহায্য করা অসম্ভব বলে হিটলার তার মত জানান। সুভাষ কলকাতা থেকে বার্লিন গিয়েছেন ভারতের স্বাধীনতার জন্য, গাড়িতে, ট্রেনে এবং অবশ্যই অনেকখানি পথ পায়ে হেঁটে। বার্লিন তাকে জানায় তবে জাপান তাকে বেশি সাহায্য করতে পারবে। সুভাষ চাইলে তারা তাকে জাপানগামী একটা সাবমেরিনে তুলে দিতে পারে। সুভাষ রাজি হন। সাবমেরিন করে জাপান আসেন। জাপানের কর্মকর্তাদের সাথে দেখা করে ভারতের স্বাধীনতার বিষয়ে কথা বলেন। জাপান থেকে সিঙ্গাপুর আসেন। সিঙ্গাপুর বৃটিশদের থেকে জাপানের দখলে আসে। সেখানে ভারতের কিছু সৈনিক জাপানের হাতে বন্দী হয়। বন্দী ভারতীয় সৈনিকদের মাধ্যমে গড়ে তোলা হয় ‘আজাদ হিন্দ ফৌজ’, স্বাধীন ভারতের সেনাবাহিনী। ফৌজ গড়ে তোলেন আরেক বাঙালী বিপ্লবী রাসবিহারী বসু, নেতাজী সিঙ্গাপুর আসলে ফৌজের নেতৃত্ব তার হাতে দেয়া হয়।

নেতাজী সুভাষ আজাদ হিন্দ ফৌজকে সাথে নিয়ে বার্মা পৌঁছান। আজাদ হিন্দ ফৌজের সেনাসংখ্যা তখন প্রায় ৮০ হাজার। বার্মা থেকে তারা বৃটিশ ভারতের মনিপুরে প্রবেশ করেন ১৯৪৪ সালের জুলাই মাসের ৪ তারিখ। স্বাধীন ভারতের প্রথম পতাকা উড়ে। মনিপুর এবং আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ তখন আজাদ হিন্দ ফৌজের অধীনে।৬ জুলাই আজাদ হিন্দ রেডিও এর সিঙ্গাপুর শাখা থেকে নেতাজীর ভাষণ সম্প্রচারিত হয়। সেখানে ভারতকে মুক্ত ঘোষনা করা হয়, মহাত্মা গান্ধীকে ভারতীয় জাতির জনক আখ্যা দেয়া হয়। নেতাজী ভেবেছিলেন ফৌজ ভারতে প্রবেশ করলে দলে দলে ভারতীয় যোগদান করে ভারতকে পুরোপুরি বৃটিশ মুক্ত করবে।

কিন্তু এর মধ্যেই বিশ্বযুদ্ধের মোড় ঘুরতে শুরু করে। জাপান বার্মা ত্যাগ করে। নেতাজীও পিছু হটেন সিঙ্গাপুরে। সিঙ্গাপুর থেকে জাপানগামী এক প্লেনে তিনি উঠেন। কিন্তু প্লেন বর্তমানের তাইওয়ানের নিকট বিধ্বস্ত হয়, নেতাজী মৃত্যুবরন করেন। তার মৃত্যুর খবর নিয়ে বেশ সংশয় এবং সন্দেহ আছে। কারণ এর আগেও তিনি বেশকয়েকবার শত্রুর চোখে ধূলা দিয়ে পলায়ন করেন। দেশবাসী এবং এমনকি তার শত্রুরাও মনে করে, সুভাষ জীবিত এবং যেকোনো সময় যেকোনো স্থান থেকে বের হয়ে আসতে পারে। জীবিত সুভাষের চেয়ে অজ্ঞাত সুভাষ ভারতের মাটিতে আরো বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠে।

২য় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর বৃটিশরা আর কোনোভাবেই ভারত শাসন করতে পারছিলো না। একে অর্থনৈতিক অবক্ষয়, তার উপর সুভাষের বিপ্লবী ছায়া। ফলস্বরূপ বৃটিশরা ভারতকে স্বাধীনতা দিয়ে ভূমিত্যাগ করে ১৯৪৭ সালে ১৫ আগস্ট। যাওয়ার আগে ধর্মের ভিত্তিতে দুইটি দেশে জমিভাগ করে দিয়ে যায়, ভারত ও পাকিস্তান।

নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু মৃত্যুবরণ করেছেন। কিন্তু তিনি হাজার বছর জীবিত থাকবেন, সারা পৃথিবীর অধিকার আদায়ের সংগ্রামে রত মুক্তিকামী মানুষের মনে।

20 May 2019

দৈনন্দিন আলাপ ৫

মানুষ বাঁচে গল্পে। বীরত্বের গল্পে, সফলতার গল্পে, আশাপূরণের গল্পে। মানুষের ইতিহাসের বইয়ে সেই গল্পগুলো ছড়ানো-ছিটানো থাকে। এখন কেউ আর ইতিহাস বই থেকে গল্প শিখতে চায় না। গল্প লোকে দেখতে চায় সিনেমা থেকে। ৩০০ নামে একটা সিনেমার গল্প করতে চাই। ঘটনা খ্রিষ্টপূর্ব ৪৮০ সালের প্রাচীন গ্রীসের। তখনকার ইরানিয় সম্রাট জারজেস গ্রীস আক্রমণ করেন। কিন্তু গ্রীস দখলের পথে প্রধান বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় গ্রীক-নগররাষ্ট্র স্পার্টার রাজা লিওনাইডাস। স্পার্টানরা যোদ্ধা জাতি। একমাত্র যোদ্ধা হওয়াই ছিলো সকল স্পার্টানের জীবনের লক্ষ্য। রাজা লিওনাইডাস মাত্র ৩০০ সৈন্য নিয়ে পথ আগলে দাঁড়ান, সম্রাট জারজেসের প্রায় ৩ লক্ষ সৈন্যের সামনে। ৩ লাখ সৈন্যের সামনে ৩০০ সৈন্য সংখ্যায় কিছুই না। কিন্তু স্পার্টান সৈন্যরা কেবল সাহস আর কৌশলকে সাথে নিয়ে সামনে বাঁধা দিতে দাঁড়িয়ে গেলো। কৌশল হচ্ছে মূল ভূমিতে প্রবেশের আগে পারস্যের সৈনিকদের একটা সরু গিরিপথ পার হয়ে আসতে হবে। স্পার্টান সৈন্যরা সেই গিরিপথটাই আটকাবে। আর সাহস হচ্ছে, স্পার্টান সৈন্যরা মরার জন্যই এসেছে। রাজা লিওনাইডাস প্রতিরোধ শুরু করার আগের ভাষণে বলে নেন- নো রিট্রিট, নো সারেন্ডার। শুরু হয় থার্মোপাইলের যুদ্ধ।

পুরা ছবির যে বিষয়টা আমারে সবচেয়ে বেশি নাড়া দিছে সেটা আরেকটা ঘটনা। তৎকালীন গ্রীসেও বেইমান ছিলো। থার্মোপাইলের যুদ্ধের বেইমানের নাম এফিয়াল্টেস। সে জারজেসের কাছ থেকে কিছু সুবিধা আর নগদ অর্থকড়ির বিনিময়ে নিজের জাতির স্বাধীনতার বিপক্ষে দাড়িয়েছিলো। সম্রাট জারজেসের পক্ষে সে রাজা লিওনাইডাসকে বোঝাতে গিয়েছিলো- কয়দিন আর বাচবা? জারজেসের কথা শোনো আর সুখেশান্তিতে বসবাস করো। স্পার্টার রাজা তো থাকবাই, পুরা গ্রীসই তোমারে দেয়া হইবো। লিওনাইডাস কেবল বাঁচতে চায় নাই, স্বাধীনতার সাথে বাঁচতে চাইছে। উনি বুঝতে পারছে জারজেসের অধীনে পুরা গ্রীসের রাজা হওয়ার চেয়ে, স্পার্টার মৃত কিন্তু স্বাধীন রাজা হওয়া বেশি সম্মানের। লিওনাইডাস কেবল একটা কথাই জিজ্ঞাসা করছিলো এফিয়াল্টেসরে। ‘এফিয়াল্টেস, ইউ লিভ ফরেভার?’ ‘এফিয়াল্টেস, তুমি সবসময় বাচবা?’ ছবিতে এফিয়াল্টেসকে প্রতিবন্ধী কুষ্ঠ রোগী হিসেবে দেখানো হয়েছে।

এখন যারা গা বাচায়া চলতে চান তাদের প্রতি আমার প্রশ্ন, আপনারা চিরদিন বাঁচবেন? মানুষ কয় বছর বাঁচে? ৫০, ৬০, ৭০। আমার সাথের অনেকে জীবনের ৩০ বছর কাটায়া ফেলছে। আর ৩০ বছর বাঁচবে কিনা জানিনা। তারপরো কতো রকম ভয়। পাছে লোকে কিছু বলে ভয়, কেমন কেমন দেখা যায় ভয়, ৫৭ ধারার ভয়, গ্রামের বাড়িতে পুলিশ যাওয়ার ভয়, জেল খাটার ভয়। আরে বাঁচবেন আর কয়দিন? ভয় পাইয়া পাইয়া সত্য বলা থেকে বিরত থাকলে হবে? যে সত্য জাতির বৃহত্তর স্বার্থে, যে সত্য গোটা জাতির মঙ্গলের স্বার্থে, সে সত্য লুকায়া আপনার বাইচা থাইকাই কি আর মইরাই কি?

আমরা যেমন আমাদের আগের প্রজন্মকে দোষারোপ করি, আমাদের পরের প্রজন্ম যেনো আমাদের দোষ দিতে না পারে, এমন কি করছি আমরা? আপনার কি মনে হয় আপনার মেয়ে আপনাকে কোনোদিন জিজ্ঞাসা করবেনা যে দেশে ধর্ষনের বিচার নাই, ধর্ষনের বিচারের জন্য আপনি আপনার যৌবনে কি করছেন? আপনার ছেলে আপনাকে কোনোদিন বলবেনা, সড়কে ট্রাফিক আইন না মানার কারনে মৃত্যু, আপনি আপনার যৌবনে সড়কে অকাল মৃত্যু ঠেকানোর জন্য কি করছেন? আসলে আপনি আপনার যৌবনে কি করছেন? ৩ বেলা খাইছেন, ১ বেলা ঘুমাইছেন, চাকরি করছেন, বিয়া করছেন, আমাদের পয়দা করছেন। ব্যাস। এই দেশে পয়দা করছেন, তাও। তারচে জার্মানি গিয়া আমাদের জন্ম দিতেন। আমাদের বন্ধু রহিমরে ওর বাপ জার্মানি নিয়া জন্ম দিছে। ওরতো বেওয়ারিশ লাশ হইয়া রাস্তায় মরার ভয় নাই।

বাসযোগ্য দেশ চাওয়া অপরাধ না। কিছুই না করে নিজের ভাগ্যকে দোষারোপ করা কোনো কাজের কথা না। দেশে কোনো পরিবর্তন না আনা যাক, পরের প্রজন্মকে বলতে তো পারবেন, চেষ্টা করছি। কৃষকদের দিকে তাকান। তিন মাস কষ্ট করছে এক সিজনের ধান তোলার জন্য। বীজ, সার, পানি, নিড়ানি, কতো আয়োজন। এতো কষ্ট কইরা দেখলো ধানের দাম নাই, ১২ টাকা কেজি বেচা লাগবো। ধানে আগুন দিয়া দিলো। তারপরো তারা কোনো মিছিল-মিটিং করে নাই, কারো বাসা ঘেরাও দিতে যায় নাই, কারো রাস্তা আটকায় নাই। কেবল ধানের ন্যায্য দাম চাইছে। এই ধান অতি কম দামে মজুতদাররা কিনবে, চাল ভাঙ্গাবে, অতি বেশি দামে শহরের মধ্যবিত্তদের কাছে বেচবে। দুইদিকে লাভ। লাভ করা ভালো, কিন্তু অতি লাভ করা?

কৃষকরে বাঁচাইয়া রাখার দায় কার? ১. সরকারের আর ২. যারা ২-৩ বেলা ভাত খাইতেছে তাদের। আমরা কি করতেছি, ধান কাইটা দিতে যাইতেছি, ধান কাইটা দিয়া কৃষকরে সাহায্য করা অবশ্যই ভালো। কিন্তু এইটা কি সমাধান? না, অবশ্যই সমাধান না। আগামী বছর আবার কাস্তে নিয়া রেডি থাকবেন ধান কাইটা দেয়ার জন্য? কয়জন কৃষকের ধান কাটবেন? তারচেয়ে আসল জায়গায় নাড়া দেন। আপনার জিনিস লুকানো আছে ৩ তলায়, আপনি ২ তলা খুইজা শেষ! জিনিস পাবেন? সরকারকে চাপ দিতে হবে যেন যথাসময়ে কৃষকের ধান প্রাপ্য দামে কেনে, মজুতদারদের চাপ দিতে হবে যেন দুই পাশেই তারা লাভ কমায়া আনে।

আপনার আশপাশের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করুন। সেগুলো নিয়ে কথা বলুন। আপনার পাশের মানুষের সাথে কথা বলুন, আপনার বন্ধুর সাথে বলুন, স্ত্রীর সাথে বলুন। সমস্যার সমাধান কি হবে সেটা ভেবে বের করুন। সেটা নিয়ে কথা বলুন। কথা বলাই সমস্যা সমাধানের প্রথম স্টেপ। আপনি যখন কথা বলা শুরু করবেন, দেশ একপা একপা করে হাঁটতে শুরু করবে। সমস্যা হয়তো শেষ হবে না। এরপর হয়তো আরো বড় সমস্যা আসতে পারে। কিন্তু ছোটো সমস্যাগুলো নিয়ে কথা না বলে বড় সমস্যার দিকে কিভাবে যাবেন? এবং কথা বলাই অন্যায় প্রতিরোধের প্রথম ধাপ। আপনার সামনে যখন অন্যায় হচ্ছে, আর আপনি চুপ করে আছেন, তার মানে আপনি অন্যায় কাজকে সমর্থন করছেন। আপনি চুপ না থাকলে হয়তো অন্যায়টি হতো না।

আমাদের বাবামায়েরা আমাদের খুব ছোটোবেলাতেই খুব যত্ন নিয়ে শেখান কিভাবে সমস্যা এড়িয়ে চলতে হয়, কিভাবে একগলিতে সমস্যা দেখলে আরেক গলি দিয়ে বাসায় চলে আসতে হয়, কিভাবে মুখ বুজে অন্যায় সহ্য করতে হয়। এখন সবাই যৌবনের দ্বারপ্রান্তে এসে বুঝতে শিখছেন এই তরিকায় গলদ আছে। প্রত্যেক আলাদা মানুষ তার নিজের বুদ্ধি অনুযায়ী চলেন। কেবল জায়গা মতো সেটার ব্যবহার করা। বিবেক আর মেধার একটা সুন্দর সমন্বয় আপনাকে, আপনার সন্তানকে উপহার দিবে একটা সুন্দর দেশ। একটা সুন্দর বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখা শুরু করুন সবাই। সবাই স্বপ্ন দেখুন আগামি ১০ বছর পর আপনি বাংলাদেশকে কোথায় দেখতে চান? আগামি ২০ বছর পর আপনি বাংলাদেশকে কোথায় দেখতে চান।

আমি আমার কিছু স্বপ্নের কথা বলি- আমি স্বপ্ন দেখি এমন এক বাংলাদেশের যেখানে বিদেশ থেকে মানুষ কেবল প্রকৃতি দেখতে আসবে, নদী দেখতে আসবে। সমদ্রের মতো বিশাল মেঘনায় নৌকায় ভ্রমণের জন্য তারা বাংলায় আসবে। বৃষ্টির আওয়াজ শোনার জন্য তারা বাংলাদেশে আসবে। একটা পরিষ্কার সবুজ বেহেস্তের মতো বাংলাদেশ দেখার জন্য তারা দলে দলে আসবে। বাংলাদেশের মানুষ যে সৎ, কর্মঠ আর পরিশ্রমী, এইটা তাদের কাছে উদাহরনের মতো মনে হবে। তারা বাংলাদেশকে অনুকরণ করতে চাইবে। তারা তাদের বাচ্চাদের বলবে, বড় হও, বড় হয়ে বাংলাদেশ গিয়ে ঘুরে দেখে এসো।

স্বপ্নের বাস্তবায়ন একটু কঠিন, কিন্তু অসম্ভব না। ভারতের রাষ্ট্রপতি আব্দুল কালাম আজাদের একটা কথা আছে স্বপ্ন নিয়ে। মানুষ যা ঘুমিয়ে দেখে তা তার স্বপ্ন না, যা তাকে ঘুমাতে দেয়না তাই তার স্বপ্ন।

৩০০ মুভির ইতিহাসের মধ্যে কৃষক ঢুইকা গেলো। কথা বলা শুরু করলে হয়তো অনেক অসুবিধা হবে। কিন্তু কথা না বইলাও কি খুব সুবিধা হইতেছে? যারা কথা বলতেছেন না তারা কি খুব সুখে আছেন? জীবনে আর কয়দিন বাঁচবেন? অন্তত আগামি প্রজন্মের জন্যই হোক, স্বপ্ন দেখা শুরু করুন। আপনি আপনার দেশকে কোথায় দেখতে চান?

19 May 2019

দৈনন্দিন আলাপ ৪


দেশে যাই ঘটুক না কেন ঘুরেফিরে আইনের শাসনের কথা চলে আসে। আইনের শাসন থাকলে এমন হতো না! আইনের শাসন রক্ষায় এইটা এইটা হওয়া দরকার! ইত্যাদি। আইনের শাসন আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। রাষ্ট্র আছে কিন্তু সেখানে আইনের শাসন নাই, তার সোজা মানে রাষ্ট্র চলতেছেনা, রাষ্ট্র অকার্যকর। রাষ্ট্রব্যবস্থা টিকায়া রাখতে হইলে অবশ্যই সেখানে আইনের শাসন থাকতে হবে। আজকে না কেবল, প্রাচীন সুমেরিয় সভ্যতায় রাজা হাম্মুরাবির শাসনামলে পৃথিবীর সর্বপ্রথম আইন যখন লিখিত হয়েছিলো, তখনো আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছিলো। সেই আইনে বলা ছিলো যদি কোনো বাসা তার স্থপতির দোষে ধ্বসে পরে, এবং সেখানে বাসার মালিক মৃত্যুবরণ করে, স্থপতিকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে। যদি বাসার মালিকের ছেলে মৃত্যুবরণ করে, স্থপতির ছেলেকে মেরে ফেলা হবে। এমনটা হয়েছিলো যেন স্থপতি তার কাজে গাফেলতি না দেয়, মনোযোগ দিয়ে কাজটা সম্পন্ন করে। কারণ তার কাজের উপর একটা পরিবারের নিরাপত্তা নির্ভর করছে।  

অথচ তার প্রায় ৪,০০০ বছর পর এই আধুনিক রাষ্ট্রে আমাদের রানা প্লাজা ধ্বসে পরে। সেখানে প্রায় ৩,০০০ লোক মৃত্যুবরণ করে। ৩,০০০ লোক মানে কেবল ৩,০০০ লাশ না। ৩,০০০ কর্মক্ষম ব্যক্তি, ৩,০০০ পরিবার। ৩,০০০ পরিবার ধ্বংস করে ফেলার জন্য রানার কি হইছে? কি করছে সরকার? আইন তো লোকজনের হাতে না, আইন সরকার আর আদালতের হাতে। এমনকি তাকে ধরতেও স্থানীয় পুলিশ গরিমসি করছে, কারণ সে সাভারের যুবলীগ কর্মী, তৎকালীন সাভারের এম্পি মুরাদ জং এর খাস লোক, খুব পাওয়ার। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লোকজন প্রচণ্ড চাপ তৈরী করলে শেষে রানাকে গ্রেফতার করা হয়। ৬ তলা বিল্ডিঙের অনুমতি নিয়া ৯ তলা বিল্ডিং কি রানা একলা বানাইছে? এইটা করতে ইঞ্জিনিয়ার লাগছে, ঠিকাদার লাগছে, সরকারী অনুমতি লাগছে। তো সেই দ্বায়িত্বশীলরা কই? সেই রানারে আবার জামিনে মুক্তিও দিছে স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থা। এর মাধ্যমে কি বোঝা যায়? বোঝা যায় দেশে রাজা হাম্মুরাবি ক্ষমতায় নাই।  

যে বিচার দেশে একটা স্বাধীন বিচারব্যবস্থা আছে বইলা জানান দিতে পারতো, যে বিচার লোকজনকে আইন ও সরকারের প্রতি আরো শ্রদ্ধাশীল করতে পারতো, সেখানেও কারা কারা যেন গাফেলতি করছে। রানার জামিন একটা উদাহরণ তৈরী করছে দেশে। যে যুবলীগ করলে, ছাত্রলীগ করলে, শ্রমিকলীগ করলে ছাড় পাওয়া যায়। ভাইরাল না হইলে তো পুলিশ ধার দিয়াও যায়না, ভাইরাল হইলে জেলে নিয়া দুয়েকদিন রাখে। ক্রমেই লোকেরা ইস্যু ভুইলা গেলে ছাইড়া দেয় বা জামিন দিয়া দেয় ইত্যাদি।

ভাত হইছে কিনা এইটা ২-৩ টা ভাত টিপ দিয়া দেখে। দেশে যে আইনের শাসন নাই এইটা বোঝার জন্যও দুইএকটা ঘটনাই যথেষ্ট। রানা প্লাজা সাভারে হওয়ায় সাভারের অধিবাসী আর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেকের মনে সেই স্মৃতি এখনো জ্বলজ্বলে।  

এরপর বিশ্বজিৎ হত্যা যেটার বিচার হয় নাই, তনু হত্যা থেকে শুরু করে হালের নুসরাতের হত্যা। এই তালিকা অনেক দীর্ঘ। এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগ পর্যন্ত এই লিস্ট দীর্ঘ হইতেই থাকবে। যে বিচারগুলা অতিদ্রুত হওয়ার কথা সেগুলাই পিছায়া যায়। কারণ সেই অপরাধগুলা এমন লোকেরা করে যাদের বিচার করা যায় না। হয় খুনির আত্মীয় বাহির হয় মন্ত্রী, নাইলে ধর্ষকের দুলাভাই বাইরায় এম্পি, নাইলে সে নিজে ছাত্র-যুব-শ্রমিক লীগ করে। 

আচ্ছা সারা দেশে নগর, মহানগর, জেলা, উপজেলা, ওয়ার্ড, ইউনিয়ন মিলায়া কয়টা আছে যুবলীগের ইউনিট? ধরি ৫ হাজার। প্রতি ইউনিটের ক্ষমতাবান মেম্বার গড়ে ২০ জন কইরা হইলেও ১ লাখ। এইরকম ছাত্রলীগ, শ্রমিকলীগ, স্বেচ্ছাসেবকলীগ, পেশাজীবীলীগ, তাঁতিলীগ, মাঝিলীগ, মহিলালীগ, তরুণলীগ, বৃদ্ধলীগ সব মিলায়া ধরি আরো ৪ লাখ। এইরকম প্রায় ৫ লাখ লোকের হাতে জিম্মি দেশের আইন আর বিচার ব্যবস্থা! এইরকম মাত্র ৫ লাখ লোকের ক্ষমতার কাছে ঠোক্কর খায় ১৭ কোটি লোকের অধিকার? এই ৫ লাখ লোক কম বা বেশি হইলে এই ১৭ কোটি লোকের কিচ্ছু আসবে যাবে না। ১৭ কোটি লোক সংখ্যায় একটুও কমবে না। বিএনপি ক্ষমতায় থাকার সময় ক্ষমতা ছিলো এইরকম আর ৫ লাখ লোকের হাতে। এরা জাস্ট রিপ্লেস হইছে। আওয়ামী লীগ সরকার আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার নামে যা করছে, তা স্রেফ বিএনপির ৫ লাখ লোক সরায়া নিজের ৫ লাখ লোকের পুনর্বাসন।  

আইন শাসন প্রতিষ্টা করার জন্য আশপাশের অনেক দেশ অনেক উদ্যোগ নিছে। সেগুলা কোনো গোপন উদ্যোগও না। ইরানের আইনে আল্লাহর দুনিয়ায় সবচেয়ে বড় দুনিয়াবী অপরাধ- রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে দুর্নীতি। এইক্ষেত্রে ইরান সরকারের জিরো টলারেন্স নীতি। কোনো ওজর-আপত্তিই গ্রহণযোগ্য না। একবার ইরানে ফ্লাইওভার ভাইঙ্গা পরছিলো। বেশ কয়েকজন সাধারণ জনগণ যারা নিচে দিয়ে যাচ্ছিলো মারা গিয়েছিলো। তদন্ত কমিটি ইরান সরকারও করেছিলো। কিন্তু তারপরো ফলাফল- ইরান সরকার দ্রুততম সময়ে তদন্ত শেষ করে। তদন্তে ইঞ্জিনিয়ার আর ঠিকাদারের দুর্নীতি বেরিয়ে আসে। দুইজনকেই প্রকাশ্য দিবালোকে ফাঁসি দেয়া হয়। ফলে আর যারা দুর্নীতি করতো তারা সাবধান হয়ে যায়। কি মনে হয় ইরানি ঠিকাদারের কাছে টাকা কম ছিলো? আর বাংলাদেশে ভেতরে রডের বদলে বাঁশ দেয়া হয়, সেটার ছবি পত্রিকায় ছাপা হয়। সরকার বাঁশ খুজে পায় না।  

আচ্ছা ইরান বাদ, সিঙ্গাপুরের কথা বলি, আমাদের এক পা তো সিঙ্গাপুরে চলেই গেছে। সিঙ্গাপুরের স্বাধীনতার পর তাদের সরকারী কর্মকর্তারাও দুর্নীতিগ্রস্থ ছিলো। সিঙ্গাপুরের সরকারপ্রধান তো ভেবে পান না কি করলে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্নীতি কমবে। শেষে তাদের বেতন ডাবল করে দিলেন। টাকা-পয়সার যে অভাব ছিলো তা মিটে গেলো। অভাবে যারা দুর্নীতি করতো তারা দুর্নীতি করা বাদ দিলো। কিন্তু যাদের স্বভাব তাদেরটা? তাদের দিলেন টাইট। স্বচ্ছতা আর জবাবদিহিতার কঠোর নিয়ম করলেন। সরকার তো আপনাকে বেতন দিচ্ছেই, তাহলে ভূমি জরিপ করতে পয়সা লাগবে কেন? পাসপোর্ট করতে পয়সা লাগবে কেন? লাইসেন্স বের করতে পয়সা লাগবে কেন? কারণ তো দর্শাতে হতোই, সরকারী কর্মকর্তাদের চাকুরিচ্যুত করারও বিধান ছিলো। ফলাফল- সিঙ্গাপুর আজকে সিঙ্গাপুর, আজকে তাকে নিয়ে কথা হচ্ছে এইখানে।  

আর বাংলাদেশে শুধুমাত্র বেতনই বাড়ানো হয়েছে। কোনোপ্রকার জবাবদিহিতা নাই। স্বচ্ছতা নাই, দক্ষতা বৃদ্ধি করার জন্য তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো পদক্ষেপ নাই। পদেপদে ঘুষ, ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি। আমাদের সরকারের ধারনা অবকাঠামোগত উন্নয়নই উন্নয়ন। না; জনগণের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন হলো প্রকৃত উন্নয়ন। অবকাঠামোগত উন্নয়নটাও ঠিকমতো হচ্ছে না। একটা পুঁজিবাদী দেশ কতোটুকু পুঁজিবাদী তা নির্ভর করে তার যোগাযোগব্যবস্থার উপর। ১০০ কিলোমিটার পথ যেতে আপনার কয় মিনিট লাগে তার উপর। এই কারনে আমেরিকা সরকার ১৯৫০-৬০ সালেই পলিসি তৈরী করে একদম গ্রামের বাসাবাড়ির সামনের রাস্তা পর্যন্ত পাকা করে গুছিয়ে আনে।  

মালয়েশিয়াতে মাহাথির যখন ক্ষমতায় আসেন ১৯৮১ তে, এসেই রাস্তাঘাটের উপর মনোযোগ দেন। দশ বছর কেবল রাস্তাঘাটই ঠিক করেন। এখন মালয়েশিয়া কোথায়? বাংলাদেশের কে বলতে পারবেন তার বাড়ির সামনের রাস্তা ঠিক আছে? কে বলতে পারবেন গাবতলী থেকে গুলিস্তান মাত্র ১৪ কিলোমিটার রাস্তা যেতে আপনার কয় মিনিট সময় লাগবে? কে বলতে পারবেন ঠিক ৩ টায় দেখা করার জন্য সময় দিয়ে সময়মতো পৌছাতে পেরেছেন?  

যাই হোক, এই বিষয়গুলো পরষ্পর সম্পর্কিত। রাস্তা ঠিক হলে সময় বাঁচবে। বেঁচে যাওয়া কর্মঘন্টায় মানুষ কাজ করবে বা বিশ্রাম নেবে। পন্যের যোগান ও চাহিদার মধ্যে সামঞ্জস্যতা রক্ষা হবে। দেশ পুঁজিবৃদ্ধির দিকে এগিয়ে যাবে। আবার আমরা বাস করছি এক অসামাজিক দুষ্টচক্রে। যেখানে দুর্নীতি বন্ধ না হলে রাস্তা ঠিক হবে না। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত না হলে দুর্নীতি কমবেনা। আর আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য কেবল সরকারপ্রধানের সদিচ্ছাই যথেষ্ট নয়। সবাইকে যার যার জায়গা থেকে এগিয়ে আসতে হবে। এই দুষ্টচক্র আমাদের ভাঙতে হবে।  

কোথাও না কোথাও তো এই দুষ্টচক্র ভাঙার রসদ মজুদ আছে। সেটা কোথায়?  

18 May 2019

দৈনন্দিন আলাপ ৩

আমি তখন ক্লাস টেনে পড়ি। নিয়মিত নামাজ পড়ি, কোরান পড়ি। আর মাথাভর্তি রাজ্যের প্রশ্ন নিয়া ঘুইরা বেড়াই। আব্বা আমার প্রত্যেক জন্মদিনে বই গিফট করতেন। ক্লাস সিক্সে উঠার পর দিছিলেন- বিষাদসিন্ধু। হাইস্কুলে উঠছি, বড় হইছি, এইটা বোঝানোর জন্য বড় বই, বিষাদসিন্ধু। ক্লাস টেনে দিছিলেন- তিরমিযী শরীফ। বুখারী, মুসলিম আগেই বাসায় ছিলো। আমি মনোযোগ দিয়া তিরমিযী শরীফ পড়া শুরু করি। একদিন একটা হাদীস পাইলাম নামাজে আমীন বলা বিষয়ে। হাদীসটা এইরকম- ‘আমি রসুলকে (স.) দোয়াল্লিন পাঠের পর আমিন বলতে শুনেছি। আর তিনি দীর্ঘস্বরে তা পাঠ করেছেন।’ এর নিচে ইমাম তিরমিযী টীকা দিয়েছেন- জোরে আমিন বলার এই হাদিসটি সহীহ। 

আমি আব্বাকে জিজ্ঞাসা করলাম- ‘মহানবী জোরে আমিন বলতেন, মসজিদে বলেনা কেন?’ আব্বা বললেন- ‘এরা হানাফি তাই।’ আমি বলি- ‘হানাফি কি?’ আব্বা বলেন- ‘সুন্নিদের একটা মাজহাব।’ -‘আমি কি করবো তাইলে?’ -‘তোমার যেইটা ভালো লাগে।’ আমার জোরে আমিন বলা পছন্দ হইলো। মসজিদে গিয়ে জামাতে নামাজের সময় সুরা ফাতেহার পর জোরে আমিন বলি। ইমাম তো আর পেছন থেকে দেখেনা কে জোরে আমিন বলে। পুরা মসজিদে একজনই জোরে আমিন বলে। পরের জুম্মার নামাজের খুতবায় ইমাম এইটা নিয়া আলাপ পারলেন। বললেন- ইদানিং কেউ কেউ জোরে জোরে আমিন বইলা বেশি ধর্ম ফলানোর চেষ্টা করতেছে। এরা ইমাম আবু হানিফার চেয়ে বেশি জানে। এরা লা-মাজহাবি... আরো কতো কথা মনে নাই। একটা কথা মনে রয়া গেলো সেখান থেকে। এরা গোমরাহ। আমি বুঝতে পারলাম না জোরে আমিন বইলা কেমনে গোমরাহ হয়? লা-মাযহাবি কি বস্তু? প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে ঐ মসজিদে যাওয়া বাদ দিলাম। 

এরপর শুরু করলাম খোঁজখবর। তখন বাজারে গুগল জনপ্রিয় হয় নাই। নিজের পিসিও নাই। কিন্তু প্রশ্ন থামে নাই। পরে জানতে পারলাম, মুসলমানদের মধ্যে দুইটা বড় ভাগ আছে। সুন্নি আর শিয়া। শিয়া শব্দটা আসছে শিয়াতে আলী থেকে, মানে আলীর পার্টি। এরা হজরত আলীকে ইমাম মনে করে। এরা মনে করে মহানবীর মৃত্যুর পর আলীই বৈধ খলিফা হওয়ার দাবীদার। কিন্তু আগের তিন খলিফা অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে। আর সুন্নিরা মনে করে চার খলিফাই বৈধ এবং উত্তম- রাশিদিন। শিয়ারা মনে করে, সুন্নিদের হাতে লেগে আছে নবী পরিবারের হত্যার রক্তের দাগ। এরা মূলত মুয়াবিয়ার অনুসারী। আবুবকর, ওমর এদের সময়তো কোনো ভাগবিভাগ ছিলো না। আলীর খেলাফতের বিরোধিতাকারী মুয়াবিয়াপন্থীরা পরে সুন্নি নাম ধারন করে বিপথগামী হয়ে যায়। 

মালয়েশিয়াতে পাকিস্তানী এক শিয়া আমাকে একদিন আক্ষেপ করে বলেছিলেন- তাকে কেউ একজন জিজ্ঞাসা করেছিলো, সে কি মুসলমান নাকি শিয়া? আমারে বলে- বলেন শিয়ারা মুসলমান না? যাইহোক আলী এবং মুয়াবিয়ার দ্বন্দ্ব যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে তখন খারিজি নামে আরেকটা শাখা বের হয়। এরা মনে করে শিয়া-সুন্নি দুইদলই বিপথগামী। এরা মুসলমানদের প্রায় অতিবিপ্লবী অংশ। এদের হাতেই পরবর্তীতে আলী মৃত্যুবরন করেন, ঘটনাচক্রে মুয়াবিয়া বেঁচে যান। 

যাই হোক। সুন্নিদের মধ্যে প্রধান ৫ টা মাজহাব। হানাফি, মালেকি, শাফেয়ী, হাম্বলী এবং জহিরি। এর মধ্যে হানাফিরা বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, মিসর, তুরস্কে সংখ্যাগরিষ্ঠ। মালেকিরা উত্তর ও পশ্চিম আফ্রিকার মুসলিম দেশসমূহ, কুয়েত এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতে সংখ্যাগরিষ্ঠ। শাফেয়ীরা মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, সোমালিয়া, ইয়েমেনে সংখ্যাগরিষ্ঠ। হাম্বলীরা প্রধানত সৌদি আরবে সংখ্যাগরিষ্ঠ। জহিরি মাজহাবের অনুসারী খুব সামান্য। এরা মূলত মরোক্কো, তিউনিসিয়া, মৌরিতানিয়ায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। আগে যখন স্পেন ও পর্তুগালে মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিলো, তখন জহিরি মাজহাব ঐ অঞ্চলে খুব শক্তিশালী অবস্থানে ছিলো। 

শিয়াদের মধ্যেও এইরকম ভাগবিভাগ আছে। এদের কেউ ১২ ইমামপন্থী। ১২ ইমামপন্থীদের মূলত ২ টি প্রধান ভাগ। জাফরি ও বাতিনিয়্যাহ। জাফরিদের আবার প্রধান ৩ টি ভাগ। উসুলপন্থী জাফরি, এরা ইরান ও ইরাক অঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ শিয়া। আখবারপন্থী জাফরি, এরা বাহরাইনে সংখ্যায় বেশি। শায়েখপন্থী জাফরি, ১৯ শতকের শুরুতে এদের একটা বৃহৎ অংশ বাহাউল্লাহকে নবী দাবী করে বাহা’ই ধর্মের প্রতিষ্ঠা করে। বাতিনিয়্যাহদেরও ৩ টি প্রধান ভাগ। আলভী, এরা সিরিয়া ও লেবাননে সংখ্যাগরিষ্ঠ। আলেভী, এরা তুরস্ক, আলবেনিয়ার শিয়াদের মধ্যে সংখ্যায় বেশি। বেকতেশি, এরা সংখ্যায় খুব সামান্য, সিরিয়া এবং লেবাননে সামান্য পরিমাণে আছে। 

১২ ইমামপন্থী ছাড়া আছে ইসমাইলি শিয়া। ইসমাইলি শিয়াদের প্রধান ২ টি ভাগ। নিজারি ও মুসতালি। মুসতালিদের বেশ কিছু শাখা থেকে এখন বোহরা নামে কেবল একটি শাখা টিকে আছে। বোহরাদের প্রধান তিনটি ভাগ দাউদি বোহরা, সুলাইমানি বোহরা এবং আলাভি বোহরা। এরা সংখ্যায় খুব সামান্য। ইসমাইলি শিয়াদের প্রায় ৯৫% ই নিজারি ইসমাইলি শিয়া। এদের বিশ্বাস ইমামত বংশপরম্পরায় এখনো চলছে। এই লাইনের ৪৯ তম ইমাম প্রিন্স আগা খান ৪র্থ। ১২ ইমামপন্থী ও ইসমাইলি ছাড়া শিয়াদের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা যাইদি। 

খারেজিদের একসময় ৪ টি প্রধান শাখা ছিলো। আজারিকা, নাজদাত, সুফরি এবং ইবাদি। কালের বিবর্তনে এখন কেবল ইবাদিরা টিকে আছে। ইবাদি খারেজিরা ওমানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান। এছাড়া আলজেরিয়াতে কিছু পরিমান ইবাদি আছে। 

উপমহাদেশের হানাফি সুন্নিদের মধ্যে দুইটি প্রধান ভাগ- দেওবন্দী ও বেরেলভি। হাম্বলী মাজহাবের এক অংশ নিজেদের দাবী করে সালাফি। সালাফ মানে পূর্বপুরুষ, সালাফি মানে পূর্বপুরুষপন্থী। সালাফিরা ইমাম ইবনে তাইমিয়ার অনুসারী। এদেরই খানিকটা আপডেটেড ভার্সন ওয়াহাবী। ওয়াহাবীরা আব্দুল ওয়াহাবের অনুসারী। সৌদি আরবের রাজপরিবারের সাথে আব্দুল ওয়াহাবের আত্মীয়তা ছিলো। 

সুন্নি-শিয়া-খারেজিদের ভাগাভাগির কারণ ফিকাহশাস্ত্র। এরা ছাড়াও ইসলামের আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ ধারা সূফীবাদ। সূফীবাদ ইসলামের আধ্যাত্মবাদী ধারা। সারা পৃথিবীতে বহুল প্রচলিত সূফীধারাগুলো হলো- চিশতিয়া, বেকতাশি, কুব্রাবিয়া, নকশাবন্দী, মুরিদিয়া, মৌলভিয়া, নিয়ামাতুল্লাহি, নুরবকশিয়া, উয়াইসি, সুহরাওয়ার্দিয়া, তিজানিয়াহ, সেনুসি, কাদিরিয়া প্রভৃত। এরমধ্যে উপমহাদেশে চিশতিয়া, কাদিরিয়া, নকশাবন্দী ধারা বেশ জনপ্রিয়। বেকতাশি সূফীধারা ১২ ইমামপন্থী। কুব্রাবিয়া ধারা উজবেকিস্তানে, মুরিদিয়া ধারা সেনেগাল-গাম্বিয়াতে, উয়াইসি ইয়েমেনে, তিজানিয়াহ মরোক্কো-আলজেরিয়াতে এবং সেনুসি মিসরে জনপ্রিয়। মওলানা জালালউদ্দিন রুমির অনুসারী সূফীদের বলা হয় মৌলভিয়া। নিয়ামাতুল্লাহি, নুরবকশিয়া এবং সুহরাওয়ার্দিয়া ধারা ইরানে জনপ্রিয়। এগুলো ছাড়াও আরো অনেক ছোটো ছোটো সূফী ধারা প্রচলিত আছে। প্রত্যাকটি ধারার আবার উপধারা-উপউপধারা আছে। 

ফিকাহ এবং আধ্যাত্মবাদী ধারার বাইরে ইসলামের আরেকটি অতিগুরুত্বপূর্ণ ধারা ছিলো দার্শনিক ধারা। দার্শনিকধারা সবগুলোই বর্তমানে বিলুপ্ত। তবে ইসলামের ইতিহাসে এদের অবদান অনস্বীকার্য। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য আশ’আরি, মাতুরিদি, মুরজিয়াহ, মু’তাজিলি এবং জাহমিয়াহ। 

এছাড়া আরো ৪ টি শাখা আছে যারা নিজেদের মুসলমান দাবী করে। কিন্তু বাকিরা তাদের মুসলমান হিসাবে স্বীকার করে না, আলাদা ধর্মের মনে করে। ১. আহমদিয়া কাদিয়ানী, ২. মাহদাভি, ৩. দ্রুজ এবং ৪. আহলে হক। কাদিয়ানিরা মনে করে মহানবী (স.) সর্বশ্রেষ্ঠ নবী। আর তার প্রতিনিধি হিসাবে প্রতিশ্রুত ইমাম মাহদি হলেন মীর্জা গোলাম আহমদ। কাদিয়ানীদের সংখ্যা প্রায় ২০ লাখ। আর মাহদাভিরা মনে করে ১৫ শতকের সৈয়দ মুহাম্মদ জৌনপুরীই ইমাম মাহদি।এরা সংখ্যায় খুবই কম। দ্রুজদের বসবাস প্রধানত লেবাননে। এরা ৪০ বছরের আগে ধর্মকর্ম শুরু করেনা। এরা প্লেটো, এরিস্টটল প্রভৃত গ্রীক দার্শনিককে ইসলামের নবী বলে মনে করে। এদের সংখ্যা প্রায় ১২-১৫ লাখ। এদের প্রধান গ্রন্থ- রাসায়েল আল হিকমাহ। আহলে হকরা ইয়ারসানি নামেও পরিচিত। তারা কালাম-এ-সারাঞ্জামকে শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ মনে করে। সুলতান সাহাক তাদের কাছে এই হাকিকত পৌঁছে দেন বলে তারা বিশ্বাস করে। তাদের বাস মূলত ইরাকের কুর্দিস্তানে। সংখ্যায় প্রায় ১৫-২০ লাখ। 

কই থেকে কই আসলাম? আচ্ছা আমি আসলে এখনো বুঝি নাই কিসে গোমরাহ হয়? জোরে আমিন বললে নাকি আস্তে আমিন বললে? 

একটা সম্পূরক প্রশ্ন, বাংলাদেশের যারা নাস্তিক তারা ইসলাম ধর্ম নিয়া এতো টানাহেঁচড়া করে কেন? 
উত্তর- বাংলাদেশের নাস্তিকরাতো ইসলাম ধর্ম নিয়াই টানাহেঁচড়া করবে। ইসরাইলের নাস্তিকরা টানবে ইহুদী ধর্ম, আমেরিকার নাস্তিকরা খ্রিস্টিয়ান ধর্ম, চীনের নাস্তিকরা বৌদ্ধ ধর্ম আর ভারতের নাস্তিকরা হিন্দু ধর্ম। কারণ বাংলাদেশের নাস্তিকরা সাংস্কৃতিকভাবে মুসলমান। সে না চাইলেও তার মৃত্যুর পর তার জানাজা হয়। যেমন ইহুদী নাস্তিক সিগমুন্ড ফ্রয়েড একটা বই লিখেছিলেন ‘মুসা ও একেশ্বরবাদ’ নামে। সেখানে তিনি দেখিয়েছিলেন মুসা কিভাবে প্রাচীন মিসর থেকে ইহুদীদের মধ্যে একেশ্বরবাদ আমদানি করেছিলেন। 

এরপর অন্যান্য ধর্মের ধারাগুলো নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করবো। 

17 May 2019

দৈনন্দিন আলাপ ২

গতকাল আলাপে দুর্নীতির কথা বলেছিলাম। আজকে তার জ্বলজ্যান্ত উদাহরণ হিসাবে সামনে চইলা আসছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের কর্মকর্তাদের চিত্র। একটা বালিশ কিনতে তারা খরচ করছেন ৫,৯৫৭ টাকা আর সেটা উপরে উঠানোর খরচ ৭৬০ টাকা। ইলেকট্রিক আয়রনের দাম বালিশের চে কম, মাত্র ৪,১৫৪ টাকা। কিন্তু ভারী বিধায় উপরে তুলতে একটু বেশি খরচ হয়ছে, মাত্র ২,৯৪৫ টাকা। জনগণের টাকার কি নিদারুণ অপচয়। কারন তারা জানে এর ফল কি হবে? খবর লিক হলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হালকা হইচই হবে, একটা তদন্ত কমিটি হবে। আগামীকাল আরেক জায়গার দুর্নীতির খবরে এইটা লোকেরা ভুলে যাবে। জবাবদিহিতার কোন জায়গা নাই। জবাবদিহিতার জায়গা তৈরী করাটাই সুশাসনের পূর্বশর্ত।

দেশে সুশাসন আছে কিনা এর যে কয়টা লক্ষণ আছে তার প্রায় সবকয়টায় বাংলাদেশ ফেল। কিছু কিছু জায়গায় প্রশ্নপত্র পাইয়া পাশ। লক্ষণগুলা কি কি? ১. প্রশাসনিক কাজে স্বচ্ছতা, একদমই নাই। যা মন চায় তাই। কিসের স্বচ্ছতা, কি বিষয়ে স্বচ্ছতা! পাবলিক সার্ভেন্টরা স্বচ্ছতা কাকে বলে এইটা জানে কিনা তাও জানিনা। যদিও পাবলিক সার্ভেন্ট বলে কিন্তু সামনাসামনি স্যার বলতে হয়। এইটাই স্বচ্ছতা কিনা কে জানে? এ প্রসঙ্গে এইচ টি ইমাম বলেন- ‘সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতি দমন অসম্ভব নহে, তবে কঠিন, জানলে খুবই সহজ।’

এরপরই জবাবদিহিতা। কার কাছে জবাবদিহিতা? কেন জবাবদিহিতা? জনগণের কাছে জবাব দিতে যে পাবলিক সার্ভেন্টরা বাধ্য, যতোবার প্রশ্ন করা হবে ততবার জবাব দিতে বাধ্য, যতক্ষণ বিষয়টা পরিষ্কার না হচ্ছে, ততক্ষন জবাব দিতে বাধ্য, এইটা তাদের কে বোঝাবে? যতদিন এই স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত না হচ্ছে ততদিন দেশে দুর্নীতি ঠেকানো যাবে না। দুর্নীতি ঠেকানোর একটা অস্ত্র হচ্ছে জবাব দিতে বাধ্য করা। জবাবদিহিতার একটা উদাহরণ তৈরী করা গেলেই অন্তত ২-৩ মাস দুর্নীতি কম হবে। আরেকটা উদাহরণ তৈরী করলে এই ডিউরেশনটা বাড়বে। দুর্নীতি হয়ত বিলুপ্ত হবে না। তবে কমবে, সহনীয় মাত্রায় দুর্নীতি হবে।

এরপর প্রশাসনিক দক্ষতা। প্রশাসনিক দক্ষতায় বাংলাদেশের সরকার পাবে ১০০ তে ১০-১৫। এইভাবে সুশাসনের প্রত্যেকটায় বাংলাদেশের প্রশাসন কার্যত অকার্যকর। আরেকটা বড় লক্ষণ আইনের শাসন। আইনের শাসনকে আধুনিক মানুষের সমাজে খুব গুরুত্ব দেয়া হয়। আইনের শাসনতো বলতে গেলে শূন্যের কোঠায়। অনেক আগেই বাংলাদেশ থেকে আইনের শাসন বিলুপ্ত হয়েছে, অথবা কোনোদিন বাংলাদেশে আইনের শাসন ছিলোই না। আইন অন্ধ। কিন্তু বাংলাদেশের আইন চোখ খুইলা দেখে কার কাছে টাকা আছে, অপরাধী এম্পির ছেলে কিনা, ছেলে ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠন বা শ্রমিক, কৃষক ও স্বেচ্ছাসেবক সংগঠন করে কিনা। অথবা আইনে কোনো ফাঁকফোকর আছে কিনা যেটা দিয়ে তারে নির্দোষ প্রমান করা যায়, অথবা জামিনে বের কইরা আইনা বিদেশ পাঠায়া দেয়া যায়।

যাই হোক, দুর্নীতি আর সুশাসন একসাথে চলেনা। দেশে যথেষ্ট পরিমান দুর্নীতি আছে, আবার বলবেন সুশাসনের জোয়ারে দেশ ভাইসা যাইতে আর দুই দিন বাকি। হবে না। প্রশাসন না হইলেও মানুষের চলতো। তাও প্রশাসন আছে, কেন? মানুষকে শাসন করার জন্য! এই ধারনা অনেক আগেই বিলুপ্ত হইছে। সেই সুদূর ঐতিহাসিক ইম্পেরিয়াল আর কলোনিয়াল যুগে প্রশাসনের কাজ ছিলো শাসন করা। এখন প্রশাসনের কাজ মানুষের সেবা করা। সেবার জন্য লোকাল গভমেন্ট, মিউনিসিপিলিটি, থানা, দপ্তর, অধিদপ্তর, বিভিন্ন রকম সরকারী-আধাসরকারী অফিস ইত্যাদি। তাদের কাজ মানুষের কাজকে সহজ করা। তাদের কাজ মানুষের যা দরকার তা হাতের কাছে নিয়া আসা। কেউ বিদেশ যাইতে চায়, পাসপোর্ট অফিসের কাজ তার কাছে থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য নিয়া তারে পাসপোর্ট যত দ্রুত সম্ভব দিয়ে দেয়া। কেউ উদ্যোক্তা হইতে চায়, তারে যুব অধিদপ্তরে প্রয়োজনীয় ট্রেনিং দিয়া, ব্যাংক থেকে সহজ শর্তে ঋণ দিয়া উদ্যোগ শুরু করতে সাহায্য করা।

আচ্ছা প্রশাসন চলে কেমনে? টাকা কই পায়? টাকা ত সাধারন মানুষের টাকা। একজন এম্পির বেতন কতো? তার ট্যাক্স কতো কাটে? এইযে প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা এতো বিদেশ যায় ট্রেনিং নিতে, মাসে এতো টাকা বেতন-ভাতা পায়, তার উপর চুরি করে, কার টাকা? যে বেকার যুবক বন্ধুর কাছ থেকে ঋণ নিয়া একটা সিগারেট খায়, সেই সিগারেটের টাকার ভ্যাট-ট্যাক্সে তাদের বেতন হয়। যে পতিতা মাসে একবার লাক্স সাবান কিনে, সেই সাবানের ভ্যাট-ট্যাক্সে আসে বিদেশভ্রমণ। যে রিক্সাচালক রোজার মাসে বাচ্চাদের জন্য একপোয়া খেজুর কিনে, সেই ইম্পোর্টেট খেজুরের ভ্যাট-ট্যাক্সে চলে আপনাদের অফিসের বিদ্যুবিল।

তাহলে সে প্রশাসন যদি সেবা দিতে না পারে, কি করা উচিত? সেবা আদায় করে নেয়া উচিত। দিবেন না কেন, দিতে হবে। করবেন না কেন, করতে হবে।

সুশাসন প্রশাসন অনেক হইছে। একটা গল্প বলি। হযরত ওমর তখন খলিফা। তার সময়ে মুসলিম সাম্রাজ্য আকারে আয়তনে বেশ বড় হয়। একপাশে মিসর, আরেকপাশে ইরান। ওমর তখন আরেক সাহাবিকে বলছিলেন- ‘যদি ফোরাত নদীর তীরে একটা কুকুরও না খেয়ে মরে, আল্লাহর দরবারে এই ওমরকে জবাব দিতে হবে।’ বাংলাদেশের মানুষতো মানুষ, কুকুর বেড়াল, ডাইনোসররাও উন্নয়নের জোয়ারে ভেসে যাচ্ছে।

আল্লাহকে জবাবদিহি করতে চাইলেও আসলে প্রাথমিক জবাবদিহিতাটা তিনি একজন সাহাবীর সামনেই করেছিলেন। এখন না মানুষের সামনে জবাবদিহিতা, না পরকালের জবাবদিহিতার কোনো ভাবনা। এমনকি এই বিষয় নিয়া ন্যূনতম চিন্তাও করে কিনা সন্দেহ। এমনকি আধুনিককালেও আমাদের কয়েকঘর ঐপাশে মালয়েশিয়ায়, প্রধানমন্ত্রী নাজিব বিন রাজ্জাক রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে কিছু টাকা সরিয়ে বৌ-ছেলেকে বিদেশে বাড়ি কিনে দেন, বৌকে কাপড়-ব্যাগ-জুতা কিনে দেন। জবাব চাওয়ার জন্য দেশের তরুণ-যুবক-ব্যবসায়ীদের সাথে নিয়ে রাস্তায় নামেন ৯২ বছরের বৃদ্ধ মাহাথির বিন মুহাম্মদ। নাজিব জবাব দিতে ব্যর্থ হয়, নির্বাচনে হারে, তাকে বিচারের মুখোমুখি করা হয়। কারণ টাকাটা জনগণের কষ্টের টাকা।

বাংলাদেশ নিয়ে অনেকে হতাশ। আমি এখনো হতাশ না। আমি জানি দেশে দুর্নীতি বন্ধ করতে পারলে দেশ আসলেই আগায়া যাবে। দুর্নীতি মিষ্টি কথায় বন্ধ হবে না। দুর্নীতি আসলে করতেছে খুব কম লোক। কিন্তু তারা এমন এমন জায়গায় বসে দুর্নীতি করতেছে যে সেটা সামাল দেয়া মুশকিল। দুর্নীতি হয়ত তাদের বিলাসীতার উৎস, তাদের অন্যতম রুটিরুজি। তো তাদের রুটিরুজি আপনি বন্ধ করে দিবেন, তাদের পেটে লাথি দিবেন, এতো সহজ? একজন রিক্সাওয়ালা এক খ্যাপে কয় টাকা বাড়ায়া দিতে বলে- ৫ টাকা, ১০ টাকা। একজন মুদি দোকানদার খুচরা চালে নিজে কয় টাকা বাড়ায়া বেচে? ২-৩ টাকা। আর শেয়ার বাজার থেকে উধাও হয় কতো কোটি টাকা? ব্যাংক থেকে উধাও হয় কতো কোটি টাকা? আর খেলাপি শিল্পপতিদের ঋণ মওকুফ করা হয় কতো কোটি টাকা?

প্রশাসনের যেখানেই অন্যায় দেখা যাবে, অনিয়ম-দুর্নীতি দেখা যাবে সেখানেই জবাব চাইতে হবে। জবাব আবার একলা চাইলে হবে না। একলা জবাব চাইতে গেলে দেখা গেলো ৫৭ ধারা দিয়া বইসা আছে, অথবা পকেটে ইয়াবা দিয়া বললো বদির ছোটো ভাই পাইছি একটা। কয়েকজন মিল্লা চাইতে হবে। কারণ আপনার একার শক্তির চেয়ে অনেকের সম্মিলিত শক্তি, বেশি শক্তিশালী। যারা দেশ নিয়া আশাবাদী তারা ত জবাব চাইবেনই, যারা হতাশ ও বিরক্ত তারা আরো বেশি বেশি চাইবেন। দেশের প্রতি হতাশা ও বিরক্তিকে পরিণত করুন পজিটিভ শক্তিতে। দেশ আগায়া যাবে আপনার ছোট্ট পদক্ষেপে।

অনেক কথা বললাম। কালকে কি হবে জানিনা। ভবিষ্যৎ সর্বদা অনিশ্চিত। কিন্তু আশা রাখতে দোষ কি? আপনার জবাব চাওয়া থেকেই হয়ত শুরু হবে দেশের অগ্রযাত্রা। গৌতম বুদ্ধ বলে গেছেন- ‘লাইফ ইস এ ওয়ান-টাইম অফার, ইউজ ইট ওয়েল’। এই এক জীবনে বসবাসোপযোগী একটা দেশ আশা করা নিশ্চয় আকাশকুসুম কল্পনা না। 

16 May 2019

দৈনন্দিন আলাপ ১

বাংলাদেশের একটা বৃহৎ জনগোষ্ঠী এখন সহজে বেহেস্তে যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর। এর অধিকাংশই নিম্নবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্ত। সমাজের এই অংশই সবচেয়ে ধার্মিক-ধর্মভীরু বা ক্ষেত্রবিশেষে ধর্মান্ধ। নিম্ন বা নিম্ন-মধ্যবিত্তদের ধার্মিক হওয়ার পেছনের মূল কারণ- অপ্রাপ্তি। কারো সংসারে হয়তো ৪ টা বাচ্চা। জীবনের টানাপড়েনে ডাল-ভাতের ব্যবস্থা করতেই হিমশিম খেতে হয়। হয়তো বাচ্চাদের মাসে- ২ মাসে একবার তুলনামূলক কিছুটা ভালো খাবার দিতে পারে বা তাও পারেনা। তখন তারা হিসাব করে বের করে এই জীবনে ত পেলাম না, পরের জীবনে বেহেস্তে গেলে মাংস খাবো, দুধের নদীতে গোসল করবো, যা চাইবো তাই পাবো, টাকার জন্য কিছুই আটকাবেনা। গরীবের সম্পদ কম, তাই তার হিসাব কম, তাই তার বেহেস্তে যাওয়াও সোজা। 

ধার্মিক হওয়ার জন্য কিছু খরচ করা লাগে। কিছু পড়াশোনা করা লাগে। নিম্নবিত্ত ধার্মিকরা হয়তো জীবনে একবারও বাংলা কোরান-হাদীন পড়েন নাই। কিন্তু বেসিক কিছু বিষয় জানেন, পারিবারিক ঐতিহ্য আর স্থানীয় ইমাম থেকে। এর পর ভরসা করেন ওয়াজে। কিন্তু ওয়াজে যখন ভুলভাল বলা হয়, নতুন কিছু না শিখিয়ে কেবল দোষারোপ করা হয়, পুরো পরিবার বেহেস্তে যাওয়ার উপায় হিসেবে সন্তানকে মাদ্রাসায় দেওয়ার কথা বলা হয়, তখন ডান-বাম চিন্তা করার উপায় থাকেনা তাদের। 

হয়ত সন্তানকে এমন মাদ্রাসায় দেন যেখানে খরচ খুব কম, অথবা ১ বেলা খাবার দানের টাকা থেকে আসে, তখন পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তির উপর চাপ কিছুটা কমে আসে। কিন্তু সেই সন্তানটিই যখন ধর্ষন বা বলাৎকারের শিকার হয়ে গাছের ডালে ঝুলে থাকে বা মাদ্রাসার জানালায় ঝুলে থাকে বা বস্তাবন্দী বেওয়ারিশ লাশ হয়ে মর্গে যায়, পিতামাতার তখন কি করার থাকে। ইদানীং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিষয়গুলো কিছুটা সাহসের সাথে উঠে আসে। কিন্তু কয়টা আসে? কয়টার বিচার হয়? বিলম্বিত বিচার, বিচারহীনতার নামান্তর। 

বেহেস্তে যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর জাতি! অথচ এর আগে এরা যে জায়গাটায় থাকতেছে সেটাকে দোযখ বানায়া ফেলতেছে। প্রায় কেউই নিজের ময়লা নির্দিষ্ট জায়গায় ফেলে না। ফেলবে কোত্থেকে নির্দিষ্ট জায়গাই ত নাই। ময়লা ফেলার নির্দিষ্ট জায়গা দেয়া স্থানীয় প্রশাসনের কাজ। কিন্তু সেই নির্দিষ্ট জায়গা দেয়া আর সেখান থেকে ময়লা নিয়মিত নিষ্কাশন করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্থানীয় প্রশাসন চূড়ান্তরকম ব্যর্থ। স্থানীয় প্রশাসন জানেইনা ময়লাগুলো দিয়ে কি কি করা যায়? সাভার পৌরসভা উপায়ন্তর না দেখে একটা যুগান্তকারী আইডিয়া গ্রহণ করে। আইডিয়াটা বেশ মজার। সেটা হলো সাভার থেকে গাবতলী হাইওয়ের দুইপাশে ময়লা স্তুপ করে রাখা। 

তাতে বেশ কিছু উপকার হচ্ছে যেমন- দুইপাশের খালি জমি ভরাট হচ্ছে। মাটিতে পলিথিনের স্তুপ জমে মাটিদূষণ চমৎকারভাবে সম্পন্ন হচ্ছে। বৃষ্টিতে বা গরমে ময়লাগুলো পচে গিয়ে মানুষের কৃতকর্মের ফলস্বরূপ দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। সেই দুর্গন্ধ গায়ে মেখে প্রতিদিন হাজার হাজার লোক ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক ব্যবহার করছে। 

মজা যে কেবল সাভার পৌরসভা করেছে তা না, ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের মেয়ররাও করেছে। তারা রাস্তার মধ্যে কিছু ডিব্বা দিছে ময়লা ফেলার জন্য। ডিব্বা দিয়েই খালাশ। ডিব্বা দিতে বলছেন, দিছি। ডিব্বা পরিষ্কার ত করতে বলেন নাই। সেই ডিব্বা যে পরিষ্কার করা লাগে, সেই ডিব্বা থেকে ময়লা প্রত্যেকদিন সরায়া নেয়া লাগে, ডিব্বাটা আবার ব্যবহারের উপযোগী কইরা রাখা লাগে সেইটা এই প্যারিসের মেয়ররা জানেননা। ফলাফল সবাই হাতে হাতে তের পাইতেছে। সবাই দেশ ছাইড়া ভাগার জন্য অস্থির হইয়া আছে। কেউ সুযোগ পাইতেছে, কেউ সুযোগের অভাবে যাইতে পারতেছেনা। 

অথচ এই লোকেরাই দেশের বাইরে গিয়ে জায়গা মতো ময়লা ফেলবে। আর আক্ষেপ করবে ইশ! কেন এইরকম একটা জাহান্নামে জন্মাইছিলাম। জন্মায়া যখন ফেলছেনই কিছু দায়িত্ব পালন করেন। এই বিষয়ে মহানবীর হাদীসও আছে। সেই ব্যাক্তি উত্তম যার হাত ও মুখ থেকে তার প্রতিবেশি নিরাপদ। অথচ দেখেন আমাদের ব্যক্তিগত ময়লা দিয়া আমরা প্রতিবেশিদের কষ্ট দেই, তার প্রতিবেশিদের কষ্ট দেই। যার সাথে জীবনে একবার কথাও হইবোনা তারেও কষ্ট দেই। আমরা নিজেরা জায়গামত ময়লা ফেলবো এবং স্থানীয় প্রশাসনকে চাপ দিবো ময়লা ফেলার নির্দিষ্ট জায়গা দেয়ার জন্য, ময়লা যথাসময়ে যথাযথ জায়গায় সরায়া নেয়ার জন্য। 

মানুষের জন্য দেশ, না দেশের জন্য মানুষ? 
মানুষের জন্য সরকার, না সরকারের জন্য মানুষ? 
মানুষের জন্য ধর্ম, না ধর্মের জন্য মানুষ? 

আরে, সবার আগে ত মানুষ। মানুষ আছে এই বইলাইতো এতো আয়োজন। ধর্ম, সরকার, দেশ, প্রশাসন। মানুষ যদি ভালো না থাকে এই জিনিসগুলা দিয়া আমরা কি ফালাবো? 

আচ্ছা, আমরা আবার ধর্ষনে ফিরা যাই। ধর্ষন নিয়া দুইটা কথা। ধর্ষন যে কেউ যে কোনো সময় যে কোনো বয়সে করতে পারে। একপাক্ষিক কেবল হুজুরদের দোষ দিয়া লাভ নাই। তবে এইটা সত্য হুজুরদের মধ্যে ধর্ষন, শিশুকামীতা এবং সমকামিতার প্রকোপ বেশি। এর কারনে পরিষ্কার। হুজুররা একটা দীর্ঘসময় যৌন-অবদমনের মধ্যে বসবাস করে। ফলে তারা হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে পরে। শুধু হুজুররা না। যেকোনো ধর্মের যাজক-পুরোহিতদের মধ্যে এই প্রবনতা লক্ষণীয়। একসময় গীর্জা ছিলো শিশুকামিতার আখড়া, এখন মাদ্রাসাগুলা। আরেকটা বড় কারণ পরিবার থেকে দূরে থাকা। পরিবারের ছায়ায় থাকলে, স্ত্রী-সন্তানাদি পাশে থাকলে ধর্ষন-বলাৎকার কিছুটা কমবে হয়ত। কিন্তু পুরোপুরি বন্ধ হবে না। ধর্ষন-বলাৎকার, শিশুকামিতা ইত্যাদি মানবপ্রজাতির মৌলিক খারাপ গুণ (মানবপ্রজাতির মৌলিক খারাপ গুণ নিয়া আলাপ আরেকদিন)। পুরোপুরি বন্ধ হবে না, কিন্তু কমায়া আনা সম্ভব। 

ধর্ষন নিয়া আরেকটা কথা হচ্ছে, ধর্ষনের বিচার করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ করা লাগবে কেন? কেন বলা লাগবে ঐ ধর্ষকরে গ্রেফতার করো। পুলিশ বা অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাজটা কি? ৫৭ ধারায় গ্রেফতারের সময় যতো দ্রুত কাজ হয়, সেটাতো প্রথম হওয়ার কথা খুন-ধর্ষন-খাদ্যে ভেজাল এইসব ক্ষেত্রে। 

না কান্না করলে মা বাচ্চারে দুধ দেয় না। আর আমাদের ধারনা আমাদের অধিকার সরকার ঘরে আইসা দিয়া যাবে। যেটা দরকার সেটা চাইয়া নিতে হবে। যতবার ধর্ষন হবে, ততবার লোকেরা রাস্তায় নামবে, বিচার চাইবে। বিচারকাজ যেন দ্রুত হয় সেটা চাইবে, বিচারে দোষী যেন অর্থ বা ক্ষমতার জোরে নির্দোষ হইতে না পারে সেটার জন্য চাপ দিবে। লোকেরা খাদ্যে ভেজাল নিয়ে কথা বলবে। আল্লাহর দুনিয়ায় সবচেয়ে বড় দুনিয়াবি অপরাধ মানুষের খাদ্যে বিষ দেয়া। গুটিকয়েক সুবিধাবাদী, মুনাফাখোর, বেঈমানের জন্য কষ্ট পাইতেছে পুরা জাতি। অপরাধ হইলে জাতি প্রতিবাদ করবে। অন্যায় হইলে, দুর্নীতি হইলেও করবে। আসলে দুর্নীতিরে আরো ভালোভাবে ব্যাখ্যা করা দরকার। কেবল দুর্নীতি এই শব্দটা দিয়া দুর্নীতির যে ব্যপক চিত্র সেটা দৃষ্টিগোচর হয়না। 

দুর্নীতি মানে নীতিহীনতা। আমি সরকারি ডাক্তার। জনগণের টাকায় সরকারি মেডিকেল কলেজে পইড়া, বিসিএস দিয়া সরকারি ডাক্তার হইছি। সরকার আমারে সেবা দিতে পাঠাইতে চায় কুড়িগ্রামের রৌমারি। কিন্তু আমি সেখানে না গিয়া তদবির করতেছি যেন ঢাকায় দেয়, ঢাকায় দেয়। ঢাকায় টাকা উড়ে। প্রাইভেট ক্লিনিক, ডিসপেনসারি, নিজের চেম্বার। ঢাকায় থাকার জন্য কিছু ঘুষও দিলাম। এই তদবির, এই ঘুষ এগুলা দুর্নীতি। এইযে ধানের ন্যায্যমূল্য পাইতেছেনা কৃষক। অথচ বাজারে চালের দাম কমে নাই। মাঝখানের টাকাটা যাইতেছে কই? সবাই জানে। হাতে গোনা যাবে এই পরিমান মজুতদার-মধ্যসত্ত্বভোগীর পকেটে লাভের টাকাটা যাচ্ছে। এই দেখভাল যার করার কথা কিন্তু করতেছেনা, এইটাই দুর্নীতি। কিছু সামান্য নিজের লাভের কারণে বৃহৎ জাতীয় স্বার্থের দিকে না তাকানোই দুর্নীতি। 

দুর্নীতি করতেছে হয়ত খুব কম লোক, কিন্তু ভুক্তভোগী পুরো জাতি। কারণ খারাপ লোকের খারাপ কাজের জন্য সমাজ নষ্ট হয়না, হয় ভালো মানুষদের চুপ থাকার কারণে। জাতীয় স্বার্থে অনুগ্রহ করে চুপ না থেকে নিজের অনুভূতিগুলো প্রকাশ করেন। বিশ্বাস করেন, আপনারাই সংখ্যাগুরু। 

15 May 2019

মালয়েশিয়ার ডায়েরি : পর্ব- ১


আমি আর জুসি যখন মালয়েশিয়া পৌছাই তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। আমরা থাকবো তরিকুল মামার বাসায়। উনি প্রায় ২০ বছর সেখানে থাকেন। উনি বিয়ে করেছেন এক ইন্দোনেশিয়ানকে। সেখানে তাদের ৩ বাচ্চাও হয়েছে। ১ ছেলে, ২ মেয়ে। প্লেনে উঠার আগে তরিকুল মামার সাথে কয়েকবার কথা হয়েছিলো।
তিনি বেশ কিছু ডিরেকশন তখন দিয়েছিলেন। এরমধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলো ছিলো মালয় ভাষা সম্পর্কে। মালয়রা লেখায় রোমান লিপি ব্যবহার করে, তাই ভাষা পড়তে কোনো অসুবিধা নাই।
দুইটা মালয় শব্দ প্রথম শিখিয়ে দিয়েছিলেন মামা। এক Keluar মানে বাহির বা এক্সিট, আরেকটা Tandas বা টয়লেট। বলেছিলেন, এই দুইটা শব্দ বিমানে উঠার পর থেকে কাজে লাগবে। তখন শব্দদুইটা মুখস্ত করতে পারি নাই।
মামা বলেছিলেন, সমস্যা নাই, দুইএকবার কাজে লাগলেই মুখস্ত হয়ে যাবে। এরপর অনেক মালয় শব্দ শিখেছি, তান্দাস এর মত জরুরি কোনোটাই ছিলোনা।
আমাদের কাছে যেমন মালয় ভাষা অবাক করা ছিলো, কাজিনদের কাছে আবার বাংলা ভাষা তেমন ছিলো। আমরা মামাকে ডাকতাম মামা, মামার বউ মামি। ওরা মামা বা মামি ডাকতো ওদের মাকে।
ইজুল (তরিকুল মামার ছেলে) ২য় দিনেই ওদের বাবাকে প্রশ্ন করেছিলো- আইয়া (বাবা), ভাইয়া তোমাকে মা ডাকে কেন? মামার বোঝাতে বেশ কিছুক্ষণ লেগেছিলো যে বাহাসা (ভাষা) বাংলায় পাচি (Pakcik-চাচা/মামা/খালু/ফুফা) কে মামা বা কাকা ডাকে।
ইজুল জিজ্ঞাসা করে কিন্তু কাকা মানে তো বোন। মামা আবার বোঝায় আরে মালয় ভাষায় কাকা মানে বোন আর বাংলায় পাচি।
ইজুলকে আমাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়েছিলো ভাইয়া-আপু বলে। ও মনে করেছিলো আমাদের নামই ভাইয়া আর আপু। জুসিকে ও ডাকতো আপু বলে। পরে ও যখন জানতে পারে আমাদের আলাদা নাম আছে তখন খুব অবাক হয়।
ও জানতে পারে জুসির নাম জুসি, আর ও কাকা মানে বড়বোন। আর আমি আসলে আবাং মানে বড় ভাই। কিন্তু পুরা সময়ই ও আমাদের ভাইয়া আর আপু বলেই ডাকে। ওর ২ বোনই ওর ছোটো ছিলো। একজনের নাম মেমে আরেকজন ফেলা। ওরা ওর আডে মানে ছোটো।
মালয় ভাষায় ছোটো বোঝাতে আডে বলে, তা সে ভাই হোক বা বোন।
মামার বাসা যে জায়গায় ছিলো তার নাম কাম্পুং পাসির, কাম্পুং মানে গ্রাম, পাসির মানে বালু। অর্থাৎ বালুর গ্রাম। গ্রামের মাঝখান দিয়ে চলে গেছে ট্রেন লাইন। ট্রেনলাইনের এপাশে পাসির পুতেহ, মানে সাদা বালু। ওপাশে পাসির মেরাহ, মানে লাল বালু।
এভাবে আমাদের মালয় ভাষা শিক্ষা শুরু হয়। অন্তত কাজিনদের কথা বোঝার জন্য হলেও মালয় জানা দরকার ছিলো। আর রেস্তোরাঁয় খাবারের জন্য। এছাড়া মালয় তেমন দরকার পরে না।
মালয়েশিয়া বহুভাষাভাষীর দেশ। এখানে মালয়দের পরেই চাইনিজ আর তামিল। এরা প্রায়ই নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করে ইংরেজিতে।
ইংরেজিও মালয়রা নিজেদের মতো উচ্চারন করতো এবং লিখতো। যেমন- স্তেসান-Stesan (Station), সেকোলাহ-Sekolah (School), কম্পুতার-Komputer (Computer), সাইন্স-Sains (Science) ইত্যাদি।