24 May 2019

দৈনন্দিন আলাপ ৯

আমরা এখন আছি এক হাহাকারের রাষ্ট্রে। কেবল উন্নয়নের গালগল্প, কয়েকজন স্বার্থপর লোকের সম্পদবৃদ্ধি, অন্ধ আনুগত্য আর নজিরবিহীন তোষামোদ-স্তুতি, চেতনা এবং অনুভূতির ব্যবসা দেশকে নিয়ে যাচ্ছে অন্ধকার কিনারায়। যেখান থেকে লোকেরা কেবল হতাশায় নিমজ্জিত হচ্ছে। কেউ কিছু করছেনা এখানে। একটা একটা করে দিন শেষ হয়ে যাচ্ছে, যেন দিন এভাবে শেষ হয়ে গেলেই হলো। গ্রামের বাংলাদেশ এখনো অন্ধকারে, শহরে নাই নাগরিক সুবিধা, ছাত্ররা পড়াশোনা করে চাকরীর জন্য, চাকুরেরা কাজ চালায়া নেয় দুইবেলা খাবারের জন্য আর ব্যবসায়ে মন্দা-স্থবিরতা। আমরা এমন রাষ্ট্র চাই নাই। এমন একটা বাংলাদেশের জন্য মুক্তিযুদ্ধ হয় নাই। 

৯৭ সালের একটা রাজনৈতিক প্রবন্ধের বই পড়তেছিলাম। সেখানে লেখক হাসাহাসি করছেন কারণ আমেরিকার তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশকে উন্নয়নের রোলমডেল বলছেন। কাকতালীয়ভাবে তখনো শেখ হাসিনার শাসনকাল ছিলো। এখনো বাংলাদেশ আধুনিক রাষ্ট্রের উন্নয়নের রোলমডেল, এই কিছুদিন আগে আবার আমেরিকার আরেক মন্ত্রী আইসা এটা বইলা গেছে। এখনো শেখ হাসিনা ক্ষমতায়। এইখানে দুইটা বিষয়, এক আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী এই কথা বইলা মস্করা করতে চাইছে, আবার সরকারপ্রধানকে খুশিও করতে চাইছে। আমাদের সরকারপ্রধানও এটা শুইনা খুশি হইছে। কিছু না কইরা যদি রোলমডেল হওয়া যায় তাইলে কিছু করার দরকার কি! ২য় বিষয়, রোলমডেল এইভাবে যে বাংলাদেশ যেভাবে রাষ্ট্র চালায় সেভাবে উন্নত বিশ্ব রাষ্ট্র চালাবে না, তাইলে দেশ আগাবে। 

মানুষের ইতিহাস সংঘবদ্ধতার ইতিহাস, মানুষের ইতিহাস একসাথে থাকার ইতিহাস। একসাথে থাকলে গেলে টুকটাক ঝামেলা হয়, সেগুলা কমায়া নিয়া আসাই রাষ্ট্রের কাজ। জমিজমা নিয়া প্রতিবেশীর সাথে বিরোধ। আমি বললাম- আমি ঠিক, প্রতিবেশী বললো- ও ঠিক। মারামারি হওয়ার অবস্থা। রাষ্ট্রের কাজ এই বিষয়টার নিষ্পত্তি করা। রাষ্ট্র এইখানে নিরপেক্ষ থাকবে, রাষ্ট্র এইখানে সৎ থাকবে। 

আচ্ছা রাষ্ট্র কি? রাষ্ট্র তো একটা বায়বীয় বিষয়, একটা আইডিয়া। কিছু মানুষের একটা নির্দিষ্ট জায়গায় একসাথে থাকাই রাষ্ট্র। রাষ্ট্রে যেহেতু অনেক লোক থাকতে পারে, তাই তাদের চালানোর জন্য আর দুইটা বিষয় লাগে, সার্বভৌমত্ব আর সরকার। বাংলাদেশ রাষ্ট্র বেশ বিশাল ১৬-১৭ কোটি লোক। সেইজন্য আধুনিক রাষ্ট্রে ক্ষমতা আর সরকার ডিসেন্ট্রালাইজ করা হয়। সরকার যতো কম লোক ডিল করবে তত দ্রুততার সাথে সেবা পৌছাই দিতে পারবে। সেইজন্য গড়ে উঠে লোকাল গভমেন্ট। সিটি কর্পোরেশন, তার মধ্যে ওয়ার্ড। জেলা, তার মধ্যে উপজেলা, তার মধ্যে ইউনিয়ন। যেন ওয়ার্ড আর ইউনিয়ন পর্যায়ে লোকেদের কাছে সেবা নিয়া যাওয়া যায়। 

রাষ্ট্রীয় সেবা কি? আমার বাসার সামনের রাস্তা নাহয় আমি বানায়া রাখতে পারি। একটা কাজে আমার দিনাজপুর যাওয়া দরকার। দিনাজপুর পর্যন্ত কি আমি রাস্তা বানাইতে বানাইতে যাবো? না, সরকারের কাজ দিনাজপুর পর্যন্ত রাস্তা বা ট্রেনলাইন বানায়া রাইখা আমার কাজটারে সহজ করা। যেন আমি সহজে দিনাজপুর যাইতে পারি, দিনাজপুরের লোকটা সহজে আমার কাছে আসতে পারে। এইরকম রাষ্ট্রীয় সেবা খাত কয়েকটা আছে, যোগাযোগ, শিক্ষা, বাণিজ্য, স্বাস্থ্য, অর্থ ইত্যাদি। কয়েকটা সেক্টর ঠিক কইরা ফেললেই ঠিকঠাক চলতে থাকবে রাষ্ট্রীয় সেবা। 

কথা হচ্ছে যারা ক্ষমতায় আছে, তারা সরকারের কাজটারে সেবা হিসেবে দেখা কিনা? এইটা পুরাপুরি দৃষ্টিভঙ্গি। ক্ষমতা হিসেবে দেখলে শাসন করতে চাইবেন, সেবা হিসেবে দেখলে সেবা করতে চাইবেন। আমরা কেমন রাষ্ট্র চাই? 

আমরা এরকম এক রাষ্ট্র চাই যেখানে দুর্নীতি বলতে কিছু থাকবেনা। দুর্নীতিরকে ঘৃণা করবে সরকারের কর্মকর্তারা। বিশেষ সুবিধা দিতে চাইলেও নিবে না। যেখানে লুটপাট বলতে কিছু থাকবেনা। রাষ্ট্র হবে জনতার কল্যাণকামী। জনগণের কিসে কল্যান, কোথায় সবচেয়ে ভালো হবে সেটা বের করবে তারা। জনগণের মতের মূল্য দিবে, চাহিদার মূল্য দিবে। জনতার শ্রম আর আকাঙ্ক্ষার সর্বোচ্চ প্রতিদান দিবে রাষ্ট্র। একটা রাষ্ট্র যেখানে কেউ না খেয়ে থাকবে না। যেখানে সবাই নির্ভয়ে চলাচল করবে, কারণ সে জানে তার কিছু হলে তার পেছনে তার রাষ্ট্র আছে। যেখানে এতিম বাচ্চারা বিকালে খেলবে, রাতে শান্তিতে ঘুমাতে যাবে, কারণ সে জানে তার রাষ্ট্র তাকে দেখে রাখবে। 

মালয়েশিয়াতে একবার অবৈধ লোক ধরপাকড় শুরু হলো, অবৈধদের ধরে দেশে পাঠিয়ে দেয়া হবে। মালয়েশিয়া রাষ্ট্রের সুন্দর একটা পলিসি আছে। প্রথম ২ বছরের ভিসায় লোক কাজের জন্য নেয়। মোট ১০-১২ বছর দেয়ার কথা। ২ থেকে ৪ বছর ভিসা দেয়ার পর ভিসা রিনিউ করা বন্ধ করে দেয়। কাজের জন্য যাওয়া লোকেরা অবৈধ হয়ে যায়। অবৈধ শ্রমিকদের কাছ থেকে পুলিশ টাকা খায়, শিল্পপতিরা কম টাকায় তাদের খাটায় নেয়। ধরা পরলে দেশে পাঠায়া দেয়। সে আবার বৈধভাবে আসে। সরকার আবার টাকা পায়। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, ফিলিপাইন আর ইন্দোনেশিয়ার লোক অবৈধ হয় বেশি। 

তো সেবার একটা ফ্লাইটে ভারতের প্রায় ৪০০ অবৈধ লোক দেশে ফেরত পাঠায় তারা। ভারত রাষ্ট্র কি প্রতিক্রিয়া দেখায় তাতে? ভারতের বিমানমন্ত্রী ফিরতি ফ্লাইটে মালয়েশিয়া আসে ২০ টা বিমান সাথে নিয়ে। এসে বলে মালয়েশিয়ায় কতজন ভারতীয় আছে বৈধ-অবৈধ মিলিয়ে? ১০-১২ লাখ। সবাইকে দেশে নিয়ে যেতে এসেছি। আপনাদের দেশে আর কোনো ভারতীয় আসবে না কাজ করার জন্য। এতো সংখ্যাক লোক একবারে চলে গেলে মালয়েশিয়ার অর্থনীতিতে প্রভাব পরবে। মালয়েশিয়ার পুনর্গঠনে এইসব শ্রমিকদের মূল্য জানে মালয়েশিয়া সরকার। -কি করা লাগবে? –অবৈধ করছেন আপনারা, বৈধও করবেন আপনারা। আপনাদের কাজের ভিসা দেয়া আপনাদের দায়িত্ব, ভারত সরকারের না। ফলাফলে সেই ৪০০ জন আবার মালয়েশিয়া ফেরত আসে। ভিসা পায়। ভারতীয় অবৈধদের জন্য ভিসা প্রসিডিউর সহজ করা হয়। 

আর বাংলাদেশের বিদেশ মিশনগুলোতে জুনিয়ার অফিসারদের সাথেও কথা বলা যায় না। কার সাথে কথা বলবে, এই অশিক্ষিত, নিজের নাম লেখতে পারে না, আগে কৃষক ছিলো পরে শ্রমিক হয়েছে, এর সাথে? বড় কোনো অফিসারকে সমস্যা খুলে বলা তো অসম্ভবই। বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশীরা একলা। কোনো আত্মীয়-স্বজন-বন্ধু থাকলে সে আছে আর নাইলে ঐ শ্রমিক একদম একা। রাষ্ট্র তার পাশে নাই। ঐটাতো বিদেশ, দেশেই রাষ্ট্র জনগণের পাশে নাই।

আচ্ছা, জনগণ সরকার বিরোধী হয়, নাকি সরকার জনগণ বিরোধী হয়? জনগণ তখনি সরকারের বিরুদ্ধে যায় যখন সরকার জনগণের বিপক্ষে থাকে। এর আগের আলাপে বলেছিলাম, দেশে যে আইনের শাসন নাই দুইএকটা উদাহরণ দেখলেই তা বোঝা যায়। আপনি জানেন না দিনের বেলা কাজে বের হয়ে সন্ধ্যায় ঠিকঠাক মতো বাসায় এসে পৌছাতে পারবেন কিনা? আপনার মেয়েটা সন্ধ্যায় টিউশনিতে গিয়ে রাত্রে বাসায় ফিরবে কিনা আপনি জানেন না। যদি কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে তার কি বিচার হবে আপনি জানেন। এইরকম বিচারহীন রাষ্ট্র কে চায়? এইরকম রাষ্ট্রে কে থাকতে চায়?

রাষ্ট্রের এই অবস্থা থেকে উত্তরনের জন্য কাজ করা লাগবে। অনেক কাজ করা লাগবে একসাথে হয়ে। মানুষের জোটবদ্ধতাই মানুষের শক্তি। রাজনীতি খারাপ রাজনীতি খারাপ বলে, আই হেইট পলিটিক্স বলে, রাজনীতি থেকে দূরে থেকে আপনি নিজেও এই নৈরাজ্য প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখছেন। এইরকম অথর্ব দেশ প্রতিষ্ঠায় আপনারও অবদান আছে। রাজনীতি খারাপ এই ধারনা থেকে আমাদের বের হতে হবে। সমস্ত অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ হতে হবে। 

তার আগে মনঃস্থির করতে হবে আপনি কেমন রাষ্ট্র চান? আপনার রাষ্ট্র আপনার সাথে, জনগণের অধিকারের সাথে কেমন আচরন করুক আপনি চান? দেশ আপনার, দেশ ভবিষ্যৎ এ কেমন হবে এটা ঠিক করার অধিকারও আপনার। চেষ্টা না করে কেবল হাহুতাশ করলে ভবিষ্যৎ ঠিক হবে না, এটা আপনি খুব ভালো করেই জানেন। ভবিষ্যতের মঙ্গলের জন্য আলাপে অংশ নিন। চাইলে কমেন্টে আলাপে অংশ নিতে পারেন। না চাইলে ইনবক্সেও আলাপ করতে পারেন। 

No comments:

Post a Comment