29 March 2020

দৈনন্দিন আলাপ ২৯


রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দুইটি সেক্টর পুরোপুরি ভেঙে পরেছে এটা টের পেতে আমাদের আর কয়েকদিন অপেক্ষা করা লাগবে। বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে অনেকে বলার চেষ্টা করেছেন, সামনে আরো প্রকটভাবে এই সংকট টের পাওয়া যাবে।


প্রথমে আসি স্বাস্থ্যসেবা সেক্টর। চিকিৎসা মানুষের মৌলিক অধিকার। যে কয়েকটা বিষয়কে সামনে রেখে আমরা স্বাধীন দেশ করার জন্য যুদ্ধ করেছি তার একটা, এই চিকিৎসা নিশ্চিত করবে সরকার। কিন্তু সরকার এই পথে হাঁটে নি। এর ফল এখন সামনে পাবো আমরা।



আমাদের কতোজনের বিপরীতে একজন ডাক্তার? কতোজনের বিপরীতে ১ জন হওয়া উচিত? স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয় আর তার বিভিন্ন অধিদপ্তর সারা বছর কি কাজ করে আমরা জানিনা। এখন একটা ইমার্জেন্সি চলে। কিছুদিনের মধ্যেই করোনা মহামারী রূপে প্রকাশিত হবে। সারা বাংলাদেশে এটা খুব ভালোভাবেই ছড়িয়ে গেছে। এখন লক্ষণ প্রকাশিত হতে যে কয়দিন লাগে।


দেখেন, এর মধ্যেও লুকোচুরি। সরকার হয়তো জানেই না মোট কতোজন করোনা আক্রান্ত আছে দেশে! কি একটা দপ্তর আছে না, মহামারী কন্ট্রোল করার জন্য, ফ্লোরা আপা বসেন, তাদের ন্যুনতম প্রস্তুতিও নেই। কিট বা পিপিই বাদ দিলাম। তারা জানেই না কি করতে হবে।

গণস্বাস্থ্য বিষয়ে সঠিক পলিসি না থাকলে আর সিদ্ধান্ত গ্রহণের জায়গায় অযোগ্য লোক বসিয়ে রাখলে এমন হবেই। বাংলাদেশ এমন একটা সিস্টেম ডেভেলপ করেছে যে এখানে কারও যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার অধিকার নেই, আপা যে সিদ্ধান্ত নেন তাই। সারা বাংলাদেশে এমন ৪০ জন যোগ্য ব্যক্তি নাই, যাদের মন্ত্রী বানানো যায়? আপা কি বেছে বেছে এমন লোকদেরই কাছে আনেন, যারা তাকে ভুল বোঝাবে?

শুধু শ্বাসকষ্টে ভুগে কতোজন এবার মারা যায় সে পরিসংখ্যানটা রাখবেন, তাহলেই হিসাব পরিষ্কার হয়ে যাবে। করোনার সংখ্যা নিয়ে সরকার নিজেই গুজব উৎপাদন করছে। বিভিন্ন চ্যানেল আর মিডিয়াহাউজে গুজব নিয়ন্ত্রণে সরকার যতোটা সোচ্চার, তার ১০ ভাগ সোচ্চার আর সচেতন যদি করোনা মোকাবিলায় থাকতো, তাহলেও দেশের চেহারা অন্যরকম হতে পারতো।

সীমাহীন দুর্নীতি আর লুটপাট আমাদের বাংলাদেশকে নিয়ে গেছে খাদের একদম কিনারায়। এখানকার ২য় সেক্টর যেটা নিয়ে আমরা কখনো ভাবিনি তা হলো শিক্ষা। শিক্ষা নিয়ে সরকারের তেমন কোনো পলিসিই নেই। ২০ বছর পর আমরা কেমন জেনারেশন চাই, ১০০ বছর পর বাংলাদেশীদের পৃথিবী কিভাবে চিনবে, তার পরিকল্পনা করা ছাড়াই কিছু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অবকাঠামোগত পরিবর্তন আর ২-৪টা ল্যাপটপ ধরিয়ে দিয়ে দেশকে ডিজিটাল করে ফেলার এক অসম্ভব স্বপ্নরাজ্যে বাস করেছেন তারা। 

বিজ্ঞানমুখী শিক্ষা কি বস্তু এটা তারা কখনো ভাবেনও নাই। যে যার যা মনে চায়, করছে। একটা দেশে তিন-চার প্রকার শিক্ষাব্যবস্থা, বাংলা মিডিয়াম, ইংলিশ মিডিয়াম, ইংলিশ ভার্সন, কওমি মাদ্রাসা, ইবতেদায়ী মাদ্রাসা, ক্যাডেট মাদ্রাসা ইত্যাদি নানান ভাগে তারা দেশের আগামী প্রজন্মকে শিক্ষা দিচ্ছে কিভাবে ভালো আমলা-কামলা প্রসব করা যায়! তার উপর সৃজনশীল নাহিদ কাক্কু, সর্বস্তরের পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস, ভর্তির সময় তদবির, নিয়োগের সময় পরিবারের আওয়ামীসম্পৃক্ততার প্রত্যয়ন সব মিলিয়ে মনে হচ্ছে নিহত একটা সেক্টরকে কবর থেকে উঠিয়ে আবার গলার দড়ি পরিয়ে দেয়া হচ্ছে। এভাবে হবে দেশের উন্নয়ন?


শিক্ষাব্যবস্থার এই বেহাল দশার মধ্যে তাই সুযোগ খুঁজবে ধর্মব্যবসায়ী ওয়াজপার্টির লোকেরা। যতো লোক অশিক্ষিত থাকবে তাদের রুটিরুজি সংস্থানের তত বেশি সুবিধা হবে। তারা ১০ জনের সামনে আবোলতাবোল বকবে, লোকজন সেটা নিয়া আলোচনা করবে, মনোযোগ সেদিকে থাকবে আর সরকার সুযোগ পাবে বড় বড় চুরিগুলো করার।


শিক্ষা মানুষের চিন্তাচেতনার বিকাশ ঘটাবে। যখন কোনো পড়াশোনা চিন্তার বিকাশ ঘটাবে না, তখন তা আর শিক্ষা না, তথ্য স্থানান্তর। বাংলাদেশের মানুষদের চিন্তাভাবনা দেখলেই বুঝা যায় শিক্ষা বলতে এখানে বুঝানো হয় সার্টিফিকেটের সংখ্যা। যেমন উন্নয়ন বলতে বুঝানো হয় কয়েকটা বিল্ডিং বা কয়েকটা পিলার।

যাই হোক, করোনা হোক বা দুর্ভিক্ষ, বাংলাদেশের গরিব মানুষের উপর দিয়ে যাবে এই দুর্যোগ। গরিব, খেটেখাওয়া দিনমজুর, কৃষক-শ্রমিক; যারা বাংলাদেশী সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ লোক তারা বের না হয়ে থাকতে পারবেনা। বাঁচার জন্য কাজ করতে হবে, কাজ করতে গেলে রোগাক্রান্ত হবে; আবার কাজ না করলে না খেয়ে থাকবে। যে কোনো দুর্যোগের ধাক্কাটা এদের উপর দিয়েই যাবে। দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে দেখবেন, কিছু লোক আবার কোন প্রকল্পের কতো পার্সেন্ট সরিয়েছে সেটা বেরুতে থাকবে।

এ এক অসম্ভব দুষ্টচক্র। বাংলাদেশী সমাজ অনেক আগে থেকেই এই দুষ্টচক্রে পরে আছে। কিভাবে এই দুষ্টচক্র ভেঙে আধুনিক বাংলাদেশী সমাজ গড়বে আমরা জানি না।

28 March 2020

ক্ষুধাতান্ত্রিক শরীরদেশ


নাফি বড় হয়ে ডিরেক্টর হতে চায়। এখন থেকেই তাই টুকটাক ক্যামেরায় কাজ করার চেষ্টা করে। শর্টফিল্ম বানায়, ইউটিউবের কন্টেন্ট বানায়, বড়ভাইদের কাজে এসিস্ট করে।
সেদিন ভার্সিটির বারান্দায় বসে আড্ডা দিচ্ছিলো বন্ধুবান্ধবদের সাথে। বেশি কেউ না, ওরা তিন-চার জনই একসাথে আড্ডা দেয়। নাফি, রাফসান, সিঁথি আর আনায়রা। সিঁথি কোনো কারণে আসেনি। ওরা তিনজন ছিলো। গল্প করতে করতে রাফসান বলে উঠলো-
‘নাফি, তুই ফিল্মের জন্য স্টোরি খুঁজছিস না! আমার কাছে একটা মাইন্ডব্লোয়িং স্টোরি আছে।’
‘বল কি স্টোরি...’
‘ঠিক আমার কাছে না... আমাদের এলাকায় একটা পাগলি আছে, তার কাছে স্টোরি... রাস্তায় রাস্তায় ঘোরে... কাউকে তেমন কিছু বলে না... হার্মলেস পাগলি... শুধু লোকজনকে ধরে ধরে জিজ্ঞেস করে, আমার সুমনরে দেখছোনি... তাকে খুজে বের করে আস্ক করতে হবে জাস্ট, ঢাকায় আসার পর কি হয়েছিলো? ব্যাস...’
‘মানে কি...! বললি তোর কাছে স্টোরি... আবার বলিস পাগলির কাছে স্টোরি... তাকে আবার খুঁজে বের করতে হবে... ঠিক করে বল...’
‘মানে টানে না... কাল তো ছুটি... কাল আয় আমাদের এলাকায়... তোকে স্টোরি দিচ্ছি...’
‘ওকে... কাল আসছি... কিন্তু এতোদিন ধরে তোদের বাসায় যাই... বলিসনিতো কখনো...’
‘ওটা আজ হঠাৎ করে মনে পরলো...’

ছুটির দিন সিঁথি আসতে পারবেনা। নাফি আর রাফসানই এলাকা ঘুরতে বের হলো। নাফির বিশ্বাস হচ্ছে না। পাগলির কাছে আবার কি গল্প থাকবে! ম্যাড পার্সন! আবার রাফসান এতো জোর দিয়ে বলছে অবিশ্বাস ও করা যাচ্ছে না। বেশি খুঁজতে হলো না। আধাঘণ্টার মধ্যেই একটা রেস্তোরাঁর সামনের ফুটপাথে বসে থাকতে দেখা গেলো পাগলিকে।
রাফসানের মুখে হাসি ফুটে উঠলো।
'চল তোর স্টোরির কাছে...'
নাফি ভয় পাচ্ছে একটু একটু। ও কখনো এরকম লোকদের সাথে সামনাসামনি কথা বলেনি। যতোটা সম্ভব এড়িয়ে চলেছে। দেখা যাক আজ কি হয়। কি বলবে, কিভাবে কথা শুরু করবে, এখনো ভাবেনি কিছু। রাফসানই কথা শুরু করলো-
'হ্যালো...'
পাগলি বুড়ি মুখ ঘুরিয়ে ওদের দুইজনের দিকে তাকালো। তারপর আরেকদিকে তাকালো।
'হ্যালো... আপনাকেই হ্যালো বলেছি...'
পাগলি আবার তাকালো। আশপাশের দুইএকজনও ওদের দিকে তাকাচ্ছে। নাফির অস্বস্তি হচ্ছে। রাফসানের হাতা টেনে বললো-
'আজকে বোধহয় কথা বলার মুডে নেই... চল। আরেকদিন আসবো...'
'আরে দাড়া... কথা বলা শুরু করলেই দেখবি কি বলে... দাড়া চুপ করে...'
'হ্যালো... আম্মা...'
এবার ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো পাগলি।
'আম্মা কইলো কেডা... তুই কি আমার সুমন...!'
'না আম্মা... আমি সুমন না... সুমনের বিষয়ে জানতে আসছি... আপনি ঢাকা আসার পর কি হইছিলো বললে আমরা সুমনরে খুইজা দিতাম...'

‘খুইজা দিবি... তরা খুইজা দিবি... সুমনতো এইটুক... দুই বছর বয়েস...’ নিজের কোলের দিকে দেখায় পাগলি।
‘কতোজনেই ত কয় খুইজা আনবো... কতো জনরে কইছি... কেউ আইন্না দেয় না... আমার সুমনরে... সুমন বাপ আমার...’ বলে বিলাপের সুর তোলে পাগলি।

‘আমাদের বলেন আরেকবার... আমরা দেখি খুইজা...’ বলে রাফসান ফুটপাথেই বসে। নাফিকেও ইশারা দেয় বসতে। নাফি কিছুক্ষন ইতস্তত করে বসে পরে। একটা ভালো স্টোরির জন্য ও ফুটপাথে পাগলির পাশেও বসতে পারে। পাগলি কথা বলা শুরু করেছে-
‘সেইটা দুর্ভিক্ষের পরের সন... ঘরে খাওন নাই... পেটে ক্ষুধা... আমার কোলে সুমন... আমার উনি ঢাকায় রিশকা চালাইতেন। খুব ভালো মানুষ আছিলেন... পরাশোনা জানা লোক... ক্লাশ ফোর পর্যন্ত পরছে। বাজে নিশাপানি আছিলো না... টিভিতে খবর দেখতো... সংসার চালানির লেইগা রিকশা চালান ধরছিলো... বিয়ার পর খরচ বাইরা গেছিলোগা... তখন ঢাকায় আইসা রিশকা চালাইতো... ইদেচান্দে বাড়িত যাইতো... আমারে আদর করতো... আমারে একটা ফোন কিন্না দিছিলো... আমি সেইটা দিয়া কথা কইতাম তার লগে।’
বলে হাসলো পাগলি। মনে মনে ভাবছে নাফি, দুর্ভিক্ষের পরের সন, সে তো অনেক আগে, সেই ২০২১। ২০২০ এ একটা দুর্ভিক্ষ হয়েছিলো দেশে। এইটুকু জানে ও। পাগলি বলে চলেছে-
‘আমার কোলে তহন সুমন আসে... তহনি দেশে একটা রোগ আহে... কতো লোক যে মরছে তহন আল্লায়ই জানে... সুমনের বাপের লগে আমার কথা হইতো প্রত্যেকদিন... আমি তারে সাবধানে থাকতে কইতাম... বারিতেও আইয়া পরতে কইছিলাম... সে কয়- আইয়া পরলে খামু কি... আমার কি ব্যাংকে জমান ট্যাকা আছে... তোমরা খাইবা কি... আমার কি একটা প্যাট... কয়জনের প্যাট চলে এই রিশকায়... তুমি চিন্তা কইরো না... গরিবের আল্লা আছে... এডি বড়লোকের রোগ... আমাগো এই রোগ হইবো না...’

বলে কেমন কাঁদো কাঁদো হয়ে গেলো পাগলি। ভালো পাগল তো, এই হাসে, এই কাঁদে। নাফি আর রাফসান গভীর মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে ছিলো পাগলির দিকে। ১০ সেকেন্ড পরেই চোখ মুছতে মুছতে আবার বলতে শুরু করলো,
‘কিন্তু আল্লায় গরিবেরেও এই রোগ দিছিলো... আল্লার কাছে ধনী-গরিব বিভেদ নাই... সবাই মরলো... লাশ কবর দেওনের জায়গা নাই... জানাজা পরানোর লোক নাই... লাশ নাকি ধরনও যায় না... গোসলো নাকি দেওন যায় না... এ কেমন মউত আল্লায় জানে... কয়দিন খুব কথা হইতো সুমনের বাপের লগে... কয় রাস্তায় লোক নাই... আর কয় দিন... আর কয়টা ট্যাকা হউক... বাড়িত আইয়া পরুম... সমিতিরতে লোন লইয়া নিজের ব্যবসা শুরু করুম... হঠাৎ একদিন কয় গলায়-বুকে ব্যাথা... গায়ে জ্বর... শ্বাস নিতে নাকি কষ্ট হয়... আমি কইছিলাম রিকশা চালানির দরকার নাই আর... মানুষ না বাচলে এতো ট্যাকা খাইবো কে... লোকটা রাজিও গেছিলো... কয় জ্বরটা ছাড়লেই আইতাছি... সেই জ্বর আর ছাড়ে নাই... শেষের তিন দিন নাকি গলা ব্যাথায় খাইতেও পারে নাই... শ্বাস কষ্টে কষ্টে মরছে লোকটা... হায়... সুমনের বাপ... সুমনের বাপ...’

আবার বিলাপ করে কাঁদছে পাগলি। কিছুক্ষণ সুমনের বাপ সুমনের বাপ করে কাঁদলো... কিছুক্ষণ আল্লা আল্লা করে কাঁদলো... তারপর পরনের পুরাতন নোংরা কাপড়ে চোখ মুছে আবার বলতে শুরু করলো-
‘সেই থেইকা আমার কষ্ট শুরু... সুমনের বয়েস দুই... চাইরপাশে মড়ক... দোকানে খাওন নাই... পেটে ক্ষুধা... কারো কাছে কোনো কাম নাই... কতো লোকের কাছে গেছি আমারে একটু কাম দেন... আমারে একটু খাওন দেন... আমার সুমনরে একটু খাওন দেন... দুধের বাচ্চা, না খাইয়া মইরা যাইবোগা... দুধ দরকার নাই... একটু ভাতের মার দেন...’

নাফি আর রাফসানের চোখও করুণ হয়ে আসছিলো। পাগলি বলে চলেছে-
‘তহন হাসিনা গবমেন্ট আছিলো... অর মন্ত্রীরা সব দেশ ছাইরা পালাইলো... আমরাতো আর দেশ ছারতে পারি না... মরতেও পারি না... যারা বাইচা গেছিলো এগো কষ্ট আছিলো বেশি... সুমনরে কোলে নিয়া ঢাকা আইলাম তহন... কোলে নিয়া নিয়া ঘুরি... কাম চাই... কাম নাই... ভিক্ষা চাই... ভিক্ষাও নাই... ফুটপাতে থায়ি... এমন সময় এক লোক আইলো... আইয়া কয় তর বাচ্চাডা আমাগোরে দে... তরে কিছু ট্যাকা দিমু... বাড়িতে গিয়া গরু পালবি... খামার করবি... রাজি থাকলে ক... পেটে এমন ক্ষুধা, রাজি হইয়া গেলাম... লোকটা আমারে সাথে সাথে খাইতে দিলো... সুমনের লেইগা দুধ ও দিলো... মনে অইলো... আহা কতো ভালো মানুষ... খাওন দিছে... আমার সুমনরে দুধ কিন্না দিছে... পেট ভইরা মায়ে পুতে খাইলাম... যাওয়ার আগে লোকটা কইয়া গেলো তুই এহানেই থাকিস... আমি আমার বৌরে নিয়া আসি... কিছুক্ষণ পরেই ঐ লোকটা আরেকটা মহিলারে নিয়া আইলো... মহিলাটা সুমনরে কোলে নিলো... আদর করলো... আমারে কইলো, তাগো বাচ্চা হয় না, অনেকদিন হইছে বিয়া হইছে... অনেক চেষ্টা-তদবির করছে... আমারে নগদ ২০ হাজার ট্যাকা দিবো... বিনিময়ে আমি আর কহনোই সুমনরে চাইতে পারুম না... ওরে দেখতেও চাইতে পারুম না... ওরে এক্কেবারে দিয়া দেওন লাগবো... আমি ভাবলাম, আমার লগে থাকলেতো খাওন নিয়া কষ্ট... এরা ট্যাকাপয়সাঅলা লোক... সুমনের খাওনের কষ্ট অইবো না... সুমন... বাপ আমার... সুমন...’

বলে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে আবার পাগলিটা। কিছুক্ষণ পর আবার বলতে শুরু করলো-
‘আমি বুদ্ধি কইরা মহিলার পিছে পিছে গিয়া বাসাডা দেইখা আসছিলাম... অরা নগদ ২০ হাজার ট্যাকাই দিছিলো... আইসা আর ভালো লাগে না... বুকটা খালি খালি লাগে... রাইতে ভালো কইরা খাইলাম... সুমনরে ছারাতো আর ঘুম আহে না... কোনোদিন কাছছারা করি নাই... কোলে কোলে রাখছি... আমার কোল খালি হইয়া গেলোগা... সারা রাইত ঘুমাই নাই... পরের দিন সকালেই ঐ বাসায় গেলাম। জানালা দিয়া উঁকি দিলাম... দেহি সুমনের গায় নতুন জামা... অয় ঘুমায়... বাপ আমার ঘুমায়... আইসা পরলাম... আবার দুপুরে গেলাম... সুমন কেমন মনমরা... আমারে খুজে মনে অয়... অই মহিলা অরে বিছানায় বসায়া কথা কইতাছিলো... হাসতাছিলো... বিকালে আরেকবার গেলাম... লুকায়াই গেছিলাম... মহিলা আমারে দেইখা ফেললো... ঘরের ভিত্রে ডাকলো... ডাইকা কয়, তুমি বাসা চিনলা কেমনে? তোমারেনা আইতে না করছি... এই বাচ্চা এহন আমাগো... তুমি আর এদিকে আইবানা... ঘুরাঘুরি করবানা... আমি কইলাম- কোনোদিন অরে ছাড়া থাকি নাই তো... দেখতে মনে চায় খালি... খালি মনে অয় হাতে কি যেন নাই... কয়- যাই হোক... আর আইবানা... এইটাই লাস্ট... আমি মাথা নাইরা আইয়া পরলাম... বুঝছস তরা, আমি আইয়া পরছিলাম সেইখান থেইকা...’

নাফি আর রাফসান মাথা নাড়লো। পাগলি আবার বলে যেতে থাকলো-
’২০ হাজার থেইকা আমি ৫শ খরচ করছিলাম... বাকি ট্যাকা আস্তাই আছিলো... সারা রাইত ভাবলাম... আমার তো কোল খালি অইয়া গেলো... আমার তো সুমন ছাড়া কেউ নাই... আমার ট্যাকা লাগবো না... মরিবাচি মায়ব্যাটা একলগে... আবার সকালে গেলাম অই বাসায়... মহিলারে ডাইকা কইলাম... আমার সুমনরে দিয়া দেন... ট্যাকাও ফেরত দিলাম... কইলাম ৫শ ট্যাকা খাইছি আমি... অইটা আমি কাম কইরা শোধ দিমু... নাইলে ভিক্ষা কইরা আইনা শোধ দিমু... খালি আমার সুমনরে ফেরত দেন... আমার কোল খালি অইয়া গেছেগা... আমার এই দুনিয়ায় সুমন ছাড়া কেউ নাই... সুমন বাপ আমার... কেন যে তরে দিছিলাম... কেন যে এতো খিধা লাগে... এই মরার প্যাট... খালি খিধা লাগে... বুঝছস তরা...’

মাথা দোলায় নাফি আর রাফসান। পাগলি বলে যেতে থাকে-
‘পরে আমারে মহিলায় কইলো- তুমি বিকালে আসো... আমি জামাইয়ের লগে পরামর্শ কইরা দেহি... ট্যাকা তোমার কাছেই রাহো... অরে নিয়া ট্যাকা দিও... আর যা খরচ অয় সেইটা আর দেওন লাগবো না... আমি দুই দিন ঘুমাই নাই... ভাবলাম আইচ্ছা আগে পরামর্শ কইরা লউক... আইসা খাইয়া পার্কে শুইয়া এমন ঘুম দিলাম... মরার ঘুম... এমন মরার ঘুম দিলাম উইঠা দেহি রাইত... উইঠাই আমার বুকে ধুকপুকানি শুরু হইলো... আমার সুমনরে আনতে যাইতে হইবো... পার্কের লোকগরে জিগাইলাম কয়টা বাজে... কয়টা জানি কইলো- ৭টা না ৮ টা... আমি দৌরায়া দৌরায়া গেলাম... আমার সুমনরে নিয়া আমু... আমার কোলে রাহুম... গিয়া দেহি অই বাসায় তালা... ভিত্রে অন্ধকার... কেউ নাই... ডাকলাম কতক্ষন... পাশের বাসারতে আরেক মহিলা আইলো... কয় কি দরকার... এরা তো আজকে দুপুরেই বারিতে গেছেগা... জিগাইলাম লগে কোনো বাচ্চা আছিলো... কয়- হ... আছিলো... অগো নাকি বইনের পোলা... আরে অইটা বইনের পোলা না... অইটা আমার সুমন আছিলো... আমার সুমন... আল্লা... আমার সুমন আছিলো... আমার সুমন এইটুক... এইটুক দুধের বাচ্চা... আমার কোল ছাড়া থাকে নাই... অরে এক হাতে নিয়া ঢাকা আইছিলাম আমি... এহন মরলে আমি ওর বাপরে কি কমু... ওর বাপেতো আমারে জিগাইবো, সুমন কই... সুমনরে না তোমার কাছে রাইখা আইলাম... আমি কি কমু... ওরে বেইচা দিছি... খিদার জ্বালায় ওরে বেইচা দিছি... ২০ হাজার ট্যাকায় অরে বেইচা দিছি... তারপর থেইকা খুজতাছি অরে আমি... আল্লা এইডা কেমন পরিক্ষা দিলা আমাগো... আমরাতো গরিব মানুষ... আমাগো কি দোষ আছিলো... জামাইরে শেষ দেখাও দেখলাম না, কই কবর তাও জানিনা... বাচ্চা দিলা... তাও রাখতে পারলাম না... আল্লা... সুমন বাপ আমার...’

আবার কাঁদতে শুরু করেছে পাগলিটা। নাফি পাগলির চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। 
আর পাগলির চোখ খুঁজে বেড়াচ্ছে দুই বছরের কোনো বাচ্চাকে... 

24 March 2020

দৈনন্দিন আলাপ ২৮

আমাদের এক ছোটভাই কোভিড-১৯ (করোনা) ভাইরাসের সাস্পেক্ট। সে বিদেশফেরত কারো সংস্পর্ষে আসে নাই। কেবল করোনা যখন ছড়াচ্ছিলো তখন বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের কারো সাথে মিটিং করে এসেছিলো। মিটিংএর পর থেকেই করোনার লক্ষণ প্রকাশিত হতে থাকে। তো সে বেশ কয়েকদিন বাসায় কোয়ারেন্টাইন্ড ছিলো। কুর্মিটোলায় করোনার জন্য আলাদা করে রাখা হাসপাতালে ভর্তি হয় অবশেষে গতকাল। এই পাচ-ছয়দিনের মধ্যে এখনো ওর টেস্ট করা হয় নি। ও কি পজিটিভ নাকি নেগেটিভ জানে না। ও কি হাসপাতালেই ভর্তি থাকবে না কি বাসায় কোয়ারেন্টাইনে থাকবে তাও জানে না।

রোগী প্যানিকে আছে তার করোনা আছে কিনা? রোগীর আত্মীয়-স্বজন-বন্ধুবান্ধব প্যানিকে আছে তার করোনা আছে কিনা? করোনা করোনা করে প্যানিক অ্যাটাকে কতো জন আছে তার তো কোনো হিসাবই নেই। কারণ সরকারের প্রস্তুতি তারা জানে। সরকার কতোদূর কি করতে পারে সেটাও তারা জানে। কেউ মারা গেলে ক্ষতি যে কেবল ব্যক্তি আর তার পরিবারের সেটাও তারা জানা। তার উপর সরকার সব খবরাখবর জনতার সামনে সঠিক সময়ে আনছেনা। যেখানে দেখি সরকার শুধু পিছলে পিছলে যায়।

ডাক্তারের কি দোষ দিবো? মাস্ক নাই, প্রোটেকশন নাই; বাংলাদেশের ডাক্তার। এরা ভয়েই কাছে আসে না। দূর থেকে রোগীর আলামত জিজ্ঞাসা করে। তো টেস্ট কেন করানো হয় নাই জিজ্ঞাসা করলে বলা হয়- টেস্টের কিট এসে পৌছাতে দেরী আছে। এখনি সব কিট ইউজ করতে চাচ্ছে না কর্তৃপক্ষ। কোনো কিট যেন অযথা নষ্ট না হয় সেদিকে আমাদের কর্তৃপক্ষের কড়া নজর।

এরই মধ্যে দুইজন নবজাতক শ্বাসকষ্ট আর নিউমোনিয়ার লক্ষণ নিয়ে কুর্মিটোলা আসে। কিন্তু কোনো টেস্ট নাই, কোনো পরীক্ষানিরীক্ষা নাই, কিছুক্ষণের মধ্যেই দুই জন মারা যায়। এখন যেহেতু টেস্ট করা হয়নি তাই করোনা ছিলো বলা যাচ্ছে না। বলতে হবে নিউমোনিয়া বা শ্বাসকষ্ট। কুর্মিটোলার ভেতরেই এই অবস্থা; সারা দেশ জুড়ে এরকম কতোটা হবে? ভাবতে থাকেন...

সরকার যথাসম্ভব চেষ্টা করবে মৃতের পরিসংখ্যান হাতের নাগালে রাখতে। এটাতে দুইটা ফজিলত। এক, করোনায় মৃত্যু কম হচ্ছে বলে আমরা একপ্রকার আত্মতুষ্টিতে ভুগবো, এতো কম মৃত্যু, আমরা মৃত্যু ঠেকিয়ে দিয়েছি। বাংলাদেশের সরকার আগেই জানতো করোনা এখানে এসে হালে পানি পাবে না ইত্যাদি। বয়স্ক আর বাচ্চারা; যাদের ইম্যুন সিস্টেম দুর্বল বা অন্য রোগ আছে তারা মারা যাবে শ্বাসকষ্টে বা নিউমোনিয়ায় বা হার্ট অ্যাটাকে। দ্বিতীয় ফজিলত বাংলাদেশ করোনা সফলভাবে মোকাবিলা করেছে বলে বাইরে দেশের ভাবমুর্তি উজ্জ্বল থাকবে। পরনে কাপড় নাই, ভাবমুর্তি টনটনা।

যেখানে সারা দেশ লকডাউন করে দেয়ার কথা সেখানে সরকার অবিবেচকের মতো দিয়েছে ছুটি। ছুটি শব্দটাই তো কেমন আরাম আরাম! লোকজন তো গাট্টিবোচকা গোল করবে, বাচ্চাকাচ্চা সাথে নিয়ে গ্রামে যাবে। যাদের ভাইরাস আছে দিয়ে আসবে, যাদের নাই নিয়ে আসবে। বাংলাদেশের সামনের বিপর্যয়ের দায় কেবলমাত্র সরকারের। এর জন্য বর্তমান সরকারকে জবাবদিহি করতে হবে।

লকডাউন করলেও আরেক বিপদ। বাংলাদেশের লক্ষ-লক্ষ লোক দিনমজুর, যারা প্রত্যেকদিন কামাই করে, প্রত্যেকদিন খরচ করে। দুই দিন বাসায় থাকলে তিন দিন না খেয়ে থাকা লাগবে। সাধারণ বাংলাদেশীদের এই গরিবির দায় কার? আমার আগে ধারণা ছিলো একই লোক দুই দফায় মানে ১০ বছর ক্ষমতায় থাকলে দেশ পরিবর্তিত হয়ে যাবে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এই সরকার ১০০ বছর থাকলেও দেশ এরকমই থাকবে।

সাধারণ জনতা, দীর্ঘ সংগ্রামের প্রস্তুতি নেন। বিপদ এতো সহজে আমাদের পিছু ছাড়তেছে না। যতো বেশি প্রস্তুতি থাকবে ততো বেশি আমাদের জন্য টিকে থাকা সহজ হবে। কেবল খাদ্য মজুত এই সংকটের সমাধান নয়। এই সংকটের জন্য আমাদের যুথবদ্ধ হতে হবে। ব্যক্তিগত উদ্যোগে স্বেচ্ছাসেবার কিছু কার্যক্রম শুরু হয়েছে, সেগুলো আরো বাড়ানো লাগবে। নিজে সচেতন হতে হবে, আরেকজনকে সচেতন করতে হবে। প্রয়োজনে গ্রামে গ্রামে গিয়ে প্রয়োজনীয় বিষয়ে লোকজনকে সচেতন করতে হবে।

তরুন-যুবক যারা আছে তারা স্বেচ্ছাসেবা আর সচেতনতার এই কার্যক্রমে অংশগ্রহনের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুতি গ্রহন করেন। শিক্ষার কি বেহাল দশা তো দেখাই যাচ্ছে! কেবল পত্রিকা পড়তে পারা আর নাম স্বাক্ষর করতে পারাই শিক্ষা নয়। অশিক্ষা-কুশিক্ষা এমনভাবে ছেয়ে আছে যে গুজব সামাল দেয়া যাচ্ছে না, পানিপরা খাওয়া সামাল দেয়া যাচ্ছে না, ওয়াজপার্টির বর্বর-ব্যবসায়ীরাই এখানে শিক্ষক।

প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ আজ এক গভীর সংকটে নিমজ্জিত। দেশের প্রয়োজনে আমরা এখন ঘরে আছি। দেশের যখন প্রয়োজন হবে আমরা রাস্তায় নামবো, গ্রামে যাবো, শহরে আস্তানা গাড়বো। ছাড় দেয়ার সময় ফুরিয়ে এসেছে। এখন সময় জবাব চাওয়ার। এখন সময় নতুন বাংলাদেশ গড়ার।

23 March 2020

দৈনন্দিন আলাপ ২৭


কোভিড-১৯ (করোনা) ভাইরাসকে অনেকে মনে করছেন আমাদের দুর্যোগের শেষ পর্যায়। আমার তা মনে হয় না। অনেকেই এখন সচেতনভাবে অনেককিছু খেয়াল করছেন। তারা দেখতে পাচ্ছেন এই ভাইরাস ও মহামারী আসলে শেষের শুরু। আগামী এপ্রিল-মে মহামারীর পাশাপাশি চলবে ডেঙ্গু। একই সাথে থাকবে পঙ্গপালের আক্রমণ। সাথে থাকবে দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি, মজুতদারি, কালোবাজারি। যার হাতে টাকা আছে সে বাজার থেকে কিনে ফ্রিজ ভরবে, যার নাই সে রাস্তায় না খেয়ে মরে পড়ে থাকবে, চুরি বা ডাকাতির সাথে যুক্ত হবে।

আইনশৃংখলা পরিস্থিতি একদম ভেঙে পরবে, এখন যে আছে তা বলা যায় না। কিন্তু এখনো দেখে মনে হচ্ছে প্রশাসনের কিছুটা নিয়ন্ত্রন আছে। আর মাত্র কয়েকদিন, তারপরই তা পুরোপুরি ভেঙে পরবে। বাংলাদেশের সরকার ও বর্তমান মন্ত্রীপরিষদ যে একদম অথর্ব তা ইতিহাসে জ্বলজ্বল করবে, আর তার সাক্ষী হয়ে রবে যারা এই মহামারী ও দুর্ভিক্ষ প্রত্যক্ষ করে বেঁচে যেতে পারবে।

আমাদের জেনারেশন দুর্ভিক্ষ দেখে নাই। শেষ দুর্ভিক্ষের গল্প শুনেছি আব্বা-আম্মার মুখে। লঙ্গরখানায় একবেলা খিচুড়ি খাওয়ার জন্য ৩ মাইল হেঁটে যাওয়া, ভাতের মাড়গালা পাওয়ার জন্য প্রতিযোগিতা করা, মারামারি করা; বাচ্চাদের খেতে দিয়ে নিজেরা খালি প্লেটে হাত নাড়াচাড়া করে খাওয়ার অভিনয় করা; কাঁচামরিচের সাথে চার গ্লাস পানি খাওয়া, কারণ ঝাল লাগলে বেশি পানি খাওয়া যায়। ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করেন আর মাত্র কয়েকদিন। চোখের সামনে দেখতে পাবেন এগুলো।

বাংলাদেশের প্রশাসন আর সরকার অনেক আগেই ভেতর থেকে ক্ষয়ে ক্ষয়ে গিয়েছে। এখন তা হাতেনাতে টের পাওয়ার বিষয়। সরকারে বসে আছে মারাত্মকভাবে দুর্নীতিগ্রস্থ চাটুকারের দল, ভালোমন্দের বিবেক অনেক আগেই বিসর্জন দিয়ে ব্যক্তিগত স্বার্থে এরা যে কোনো কিছু করতে পারে। একারণেই মহামারীর এমন সময়েও এরা বলতে থাকে সব প্রস্তুতি নেয়া আছে, আমরা অনেক আগেই এই হয়েছি সেই হয়েছি, তিনি আছেন বলেই এগুলো সম্ভব হয়েছে, ইত্যাদি ইত্যাদি। লোকজন আর এগুলো বিশ্বাস করেনা, আমার মনে হয় তারা নিজেরাও আর এগুলো বিশ্বাস করে না। আফসোস এই আপদকালে এরা পরিবার-পরিজন নিয়ে দেশ থেকে ভাগতে পারছেনা।

এখন ভয় পাওয়ার সময় নয়। এখন আমাদের সাহস আরো বাড়ানোর সময়। আলাদা থেকে আমরা মহামারী মোকাবিলা করবো। একসাথে হয়ে আমরা দেশ গড়বো। এটা সবাই টের পাচ্ছেন যে, যখন সবার এক হয়ে দেশের জন্য কাজ করা দরকার ছিলো, তখন আমরা আলাদা ছিলাম, আমাদের মাথার উপর তাই চেপে বসেছে দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদরা। আমরা প্রশ্ন করা ভুলে গিয়েছিলাম, তাই তারা যা মন চায় তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমরা জবাব চাইতে ভুলে গিয়েছিলাম, তাই তারা যা মন চায় বলে গিয়েছে।

আপনি জানেন যে বর্তমান সরকার কিছুই করবেনা, কিছুই করার স্বামর্থ তাদের নেই। তাই যার যা স্বামর্থ আছে সে অনুযায়ী কাজ করেন। যার পক্ষে ঘরে থাকা সম্ভব, তিনি ঘরে থাকবেন। যার ঘরে থাকা সম্ভব না, তিনি সাবধান থাকবেন। যে কোনো প্রকার জনসংযোগ এড়িয়ে চলবেন। তা রাজনৈতিক হোক, সামাজিক বা সাংস্কৃতিক হোক। মসজিদে নামাজ পড়া নিয়ে বেশ বিতর্ক চলছে। মসজিদে আপদকালীন সময়ে নামাজ পড়ার বিষয়ে নিজের বিবেকবুদ্ধি কাজে লাগান।

আপনি জানেন না আপনি ভাইরাসের বাহক কিনা? আপনি এ কারণে মসজিদ বা অন্য যে কোনো ধর্মীয় উপাসনালয় বা কম্যুনিটি সেন্টার বা চায়ের দোকান বা খেলার গ্যালারি বা অনেক লোক সমাগম হয় এমন যে কোনো জায়গায় যাবেন না; কারণ সেখানে আপনার নিজের ভাইরাস আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। আবার আপনি নিজে ভাইরাসের বাহক হলে আপনার মাধ্যমে সেটা ছড়ানোর সম্ভাবনা আছে। মহামারীকালীন সময়ে যে যে জায়গায় আছে সেখানেই থাকার বিষয়ে মহানবীর সুস্পষ্ট নির্দেশনা আছে।

আরেকটা বিষয় খেয়াল করলাম, ওয়াজপার্টির লোকেরা ক্রমাগত মিথ্যাচার করে যাচ্ছে, মুসলমানের করোনা হবে না। তার মানে কি যারা করোনায় আক্রান্ত হবে, তারা আর মুসলমান থাকছে না। মুসলমানিত্ব তাদের বাপদাদার সম্পত্তি, তারা সেটা দেখে রাখছে! এদের পড়াশোনা কম নাকি লোকজন সামনে থাকলে মাথা ঠিক থাকেনা, বুঝিনা। বাংলাদেশের অশিক্ষিত আর কুশিক্ষিত জনগণ এদের কথাই শুনছে আর মানছে। শিক্ষার এতো বেহাল দশা!

রসূলের (স.) সাহাবীদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একজন, আশয়ারে মুবাশশারা আবু উবাইদাহ (র.) মারা গিয়েছিলেন এমন এক মহামারীতে। যারা অসভ্যের মতো মনে করছে, মুসলমানের মৃত্যু ভাইরাসে হবে না, তারা কি আবু উবাইদাহের চেয়েও বড় মুসলমান? আল্লাহর উপর ভরসা করেন, কিন্তু উটটাও বেঁধে রাখেন।

জাতি এখন এক করোনা ভাইরাসেই দিশেহারা অবস্থা, এরপর ডেঙ্গু, এরপর পঙ্গপাল, এরপর মূল্যবৃদ্ধি ও বাজারধ্বস; সবশেষে মহামারী ও দুর্ভিক্ষ; কিভাবে সামাল দিবে জানিনা এখনো। অসহায় মনে হয় খুব। কিছুক্ষণ পরেই আবার মনে হয় সব ঠিক হয়ে যাবে। পতনের পরেই তো উত্থান। ধ্বংসস্তুপ থেকেই শুরু হবে নতুন বাংলাদেশের। সেই বাংলাদেশ দেখে যেতে পারবো কিনা জানি না। আমাদের বন্ধু-শত্রু কতোজনের সাথে শেষমেশ দেখা হবে তাও জানি না। এ এক অনিশ্চিত যাত্রা।

সবাই এক না থাকলে এই বিপদ আমাদের আরো জাপটে ধরবে। আমাদের এখন আর আলাদাভাবে ভাবার সুযোগ নেই। পুরুষ-মহিলা-তৃতীয় লিঙ্গ, বাঙালী-আদিবাসী, বাংলাদেশী-প্রবাসী-বিদেশী, মুসলমান-হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান, ছোট-বড়, চাকুরিজীবি-ব্যবসায়ী সবাইকে একসাথে এই বিপদের মোকাবিলা করতে হবে।

সামনেই দেশ অর্থনৈতিক সংকটে পড়বে। শেয়ার বাজারে ইতিমধ্যে ধ্বস। বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের ঘাটতি ও মূল্যবৃদ্ধি। যাদের স্বামর্থ আছে তারা মজুত করছে। কিন্তু যারা মজুত করছে তারা কখনো ক্ষুধা দেখে নাই। ক্ষুধায় পরলে মানুষের হিতাহিত জ্ঞান শূন্যের ঘরে নেমে আসবে। তখন এই পরিমাণ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আইন নিয়ন্ত্রনে রাখার জন্য যথেষ্ট হবে না। চুরি এবং ডাকাতি বেড়ে যাবে। আর এই ক্ষুধার্ত মানুষের খাবার চুরির দায়ভার নিতে হবে এখনকার সীমাহীন লুটপাটকারীদের।

এমন কোনো সেক্টর নেই, যেটা নিয়ে আপনি সন্তুষ্ট থাকতে পারবেন। এখন দুর্যোগকালে তা একটু একটু করে খুলতে থাকবে আপনার সামনে। আর আপনি চলে যাবে হতাশার শেষ সীমায়। এমন এক জায়গায় আমরা আছি, এমনো হতে পারে, আজ থেকে ৬ মাস পর প্রত্যেক পরিবারেই থাকবে স্বজন হারানোর শোক। সেই সাথে ক্ষুধা। আমরা এরই মধ্যে টের পেয়েছি এই সরকার এই বিপদ সামাল দিতে সম্পূর্ণ অপারগ। এরা যেকোনো মুহুর্তে প্রথম সুযোগটা পাওয়া মাত্র এই দেশ ছাড়বে। জনতার ভাগ্য ভালো যে পৃথিবি জুড়েই মহামারী, তাই আপাতত পালাচ্ছে না। কিন্তু মহামারীটা সামাল যে দেশ দিবে তারা সেখানেই সপরিবারে চলে যাবে। আমি-আপনি যাদের স্বামর্থ নেই, তাদের বাচ্চাকাচ্চা সহ এই দেশেই থাকতে হবে। মহামারী আসুক আর চলে যাক, দুর্ভিক্ষ থাকুক আর থামুক। ব্যাংকে টাকা থাক আর না থাক।

জবাব চাওয়ার সময় এসেছে। আপনার ট্যাক্সের টাকায় কেনো হাসপাতাল হলো না, জবাব চান; কেনো ডাক্তারদের নিরাপত্তা দেয়ার মতো সরঞ্জাম কেনা হলো না, জবাব চান; আপনার ট্যাক্সের টাকা কেনো লুটপাট করে বিদেশে নিয়ে যাওয়া হলো; জবাব চান; আপনার মেহনতের টাকায় কেনো তার ছেলেমেয়েরা বিলাসী জীবন যাপন করবে, জবাব চান। এখনি চিন্তা করেন আপনি আপনার বাচ্চাদের জন্য কেমন বাংলাদেশ রেখে যেতে চান?

লেখা আর চিন্তাভাবনা কেমন অগোছালো লাগছে। সময়টা ঠিক হোক আবার, গুছিয়ে চিন্তা করা যাবে তখন। ততক্ষণ সবাই সুস্থ থাকেন, নিরাপদ থাকেন।

জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক।