28 March 2020

ক্ষুধাতান্ত্রিক শরীরদেশ


নাফি বড় হয়ে ডিরেক্টর হতে চায়। এখন থেকেই তাই টুকটাক ক্যামেরায় কাজ করার চেষ্টা করে। শর্টফিল্ম বানায়, ইউটিউবের কন্টেন্ট বানায়, বড়ভাইদের কাজে এসিস্ট করে।
সেদিন ভার্সিটির বারান্দায় বসে আড্ডা দিচ্ছিলো বন্ধুবান্ধবদের সাথে। বেশি কেউ না, ওরা তিন-চার জনই একসাথে আড্ডা দেয়। নাফি, রাফসান, সিঁথি আর আনায়রা। সিঁথি কোনো কারণে আসেনি। ওরা তিনজন ছিলো। গল্প করতে করতে রাফসান বলে উঠলো-
‘নাফি, তুই ফিল্মের জন্য স্টোরি খুঁজছিস না! আমার কাছে একটা মাইন্ডব্লোয়িং স্টোরি আছে।’
‘বল কি স্টোরি...’
‘ঠিক আমার কাছে না... আমাদের এলাকায় একটা পাগলি আছে, তার কাছে স্টোরি... রাস্তায় রাস্তায় ঘোরে... কাউকে তেমন কিছু বলে না... হার্মলেস পাগলি... শুধু লোকজনকে ধরে ধরে জিজ্ঞেস করে, আমার সুমনরে দেখছোনি... তাকে খুজে বের করে আস্ক করতে হবে জাস্ট, ঢাকায় আসার পর কি হয়েছিলো? ব্যাস...’
‘মানে কি...! বললি তোর কাছে স্টোরি... আবার বলিস পাগলির কাছে স্টোরি... তাকে আবার খুঁজে বের করতে হবে... ঠিক করে বল...’
‘মানে টানে না... কাল তো ছুটি... কাল আয় আমাদের এলাকায়... তোকে স্টোরি দিচ্ছি...’
‘ওকে... কাল আসছি... কিন্তু এতোদিন ধরে তোদের বাসায় যাই... বলিসনিতো কখনো...’
‘ওটা আজ হঠাৎ করে মনে পরলো...’

ছুটির দিন সিঁথি আসতে পারবেনা। নাফি আর রাফসানই এলাকা ঘুরতে বের হলো। নাফির বিশ্বাস হচ্ছে না। পাগলির কাছে আবার কি গল্প থাকবে! ম্যাড পার্সন! আবার রাফসান এতো জোর দিয়ে বলছে অবিশ্বাস ও করা যাচ্ছে না। বেশি খুঁজতে হলো না। আধাঘণ্টার মধ্যেই একটা রেস্তোরাঁর সামনের ফুটপাথে বসে থাকতে দেখা গেলো পাগলিকে।
রাফসানের মুখে হাসি ফুটে উঠলো।
'চল তোর স্টোরির কাছে...'
নাফি ভয় পাচ্ছে একটু একটু। ও কখনো এরকম লোকদের সাথে সামনাসামনি কথা বলেনি। যতোটা সম্ভব এড়িয়ে চলেছে। দেখা যাক আজ কি হয়। কি বলবে, কিভাবে কথা শুরু করবে, এখনো ভাবেনি কিছু। রাফসানই কথা শুরু করলো-
'হ্যালো...'
পাগলি বুড়ি মুখ ঘুরিয়ে ওদের দুইজনের দিকে তাকালো। তারপর আরেকদিকে তাকালো।
'হ্যালো... আপনাকেই হ্যালো বলেছি...'
পাগলি আবার তাকালো। আশপাশের দুইএকজনও ওদের দিকে তাকাচ্ছে। নাফির অস্বস্তি হচ্ছে। রাফসানের হাতা টেনে বললো-
'আজকে বোধহয় কথা বলার মুডে নেই... চল। আরেকদিন আসবো...'
'আরে দাড়া... কথা বলা শুরু করলেই দেখবি কি বলে... দাড়া চুপ করে...'
'হ্যালো... আম্মা...'
এবার ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো পাগলি।
'আম্মা কইলো কেডা... তুই কি আমার সুমন...!'
'না আম্মা... আমি সুমন না... সুমনের বিষয়ে জানতে আসছি... আপনি ঢাকা আসার পর কি হইছিলো বললে আমরা সুমনরে খুইজা দিতাম...'

‘খুইজা দিবি... তরা খুইজা দিবি... সুমনতো এইটুক... দুই বছর বয়েস...’ নিজের কোলের দিকে দেখায় পাগলি।
‘কতোজনেই ত কয় খুইজা আনবো... কতো জনরে কইছি... কেউ আইন্না দেয় না... আমার সুমনরে... সুমন বাপ আমার...’ বলে বিলাপের সুর তোলে পাগলি।

‘আমাদের বলেন আরেকবার... আমরা দেখি খুইজা...’ বলে রাফসান ফুটপাথেই বসে। নাফিকেও ইশারা দেয় বসতে। নাফি কিছুক্ষন ইতস্তত করে বসে পরে। একটা ভালো স্টোরির জন্য ও ফুটপাথে পাগলির পাশেও বসতে পারে। পাগলি কথা বলা শুরু করেছে-
‘সেইটা দুর্ভিক্ষের পরের সন... ঘরে খাওন নাই... পেটে ক্ষুধা... আমার কোলে সুমন... আমার উনি ঢাকায় রিশকা চালাইতেন। খুব ভালো মানুষ আছিলেন... পরাশোনা জানা লোক... ক্লাশ ফোর পর্যন্ত পরছে। বাজে নিশাপানি আছিলো না... টিভিতে খবর দেখতো... সংসার চালানির লেইগা রিকশা চালান ধরছিলো... বিয়ার পর খরচ বাইরা গেছিলোগা... তখন ঢাকায় আইসা রিশকা চালাইতো... ইদেচান্দে বাড়িত যাইতো... আমারে আদর করতো... আমারে একটা ফোন কিন্না দিছিলো... আমি সেইটা দিয়া কথা কইতাম তার লগে।’
বলে হাসলো পাগলি। মনে মনে ভাবছে নাফি, দুর্ভিক্ষের পরের সন, সে তো অনেক আগে, সেই ২০২১। ২০২০ এ একটা দুর্ভিক্ষ হয়েছিলো দেশে। এইটুকু জানে ও। পাগলি বলে চলেছে-
‘আমার কোলে তহন সুমন আসে... তহনি দেশে একটা রোগ আহে... কতো লোক যে মরছে তহন আল্লায়ই জানে... সুমনের বাপের লগে আমার কথা হইতো প্রত্যেকদিন... আমি তারে সাবধানে থাকতে কইতাম... বারিতেও আইয়া পরতে কইছিলাম... সে কয়- আইয়া পরলে খামু কি... আমার কি ব্যাংকে জমান ট্যাকা আছে... তোমরা খাইবা কি... আমার কি একটা প্যাট... কয়জনের প্যাট চলে এই রিশকায়... তুমি চিন্তা কইরো না... গরিবের আল্লা আছে... এডি বড়লোকের রোগ... আমাগো এই রোগ হইবো না...’

বলে কেমন কাঁদো কাঁদো হয়ে গেলো পাগলি। ভালো পাগল তো, এই হাসে, এই কাঁদে। নাফি আর রাফসান গভীর মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে ছিলো পাগলির দিকে। ১০ সেকেন্ড পরেই চোখ মুছতে মুছতে আবার বলতে শুরু করলো,
‘কিন্তু আল্লায় গরিবেরেও এই রোগ দিছিলো... আল্লার কাছে ধনী-গরিব বিভেদ নাই... সবাই মরলো... লাশ কবর দেওনের জায়গা নাই... জানাজা পরানোর লোক নাই... লাশ নাকি ধরনও যায় না... গোসলো নাকি দেওন যায় না... এ কেমন মউত আল্লায় জানে... কয়দিন খুব কথা হইতো সুমনের বাপের লগে... কয় রাস্তায় লোক নাই... আর কয় দিন... আর কয়টা ট্যাকা হউক... বাড়িত আইয়া পরুম... সমিতিরতে লোন লইয়া নিজের ব্যবসা শুরু করুম... হঠাৎ একদিন কয় গলায়-বুকে ব্যাথা... গায়ে জ্বর... শ্বাস নিতে নাকি কষ্ট হয়... আমি কইছিলাম রিকশা চালানির দরকার নাই আর... মানুষ না বাচলে এতো ট্যাকা খাইবো কে... লোকটা রাজিও গেছিলো... কয় জ্বরটা ছাড়লেই আইতাছি... সেই জ্বর আর ছাড়ে নাই... শেষের তিন দিন নাকি গলা ব্যাথায় খাইতেও পারে নাই... শ্বাস কষ্টে কষ্টে মরছে লোকটা... হায়... সুমনের বাপ... সুমনের বাপ...’

আবার বিলাপ করে কাঁদছে পাগলি। কিছুক্ষণ সুমনের বাপ সুমনের বাপ করে কাঁদলো... কিছুক্ষণ আল্লা আল্লা করে কাঁদলো... তারপর পরনের পুরাতন নোংরা কাপড়ে চোখ মুছে আবার বলতে শুরু করলো-
‘সেই থেইকা আমার কষ্ট শুরু... সুমনের বয়েস দুই... চাইরপাশে মড়ক... দোকানে খাওন নাই... পেটে ক্ষুধা... কারো কাছে কোনো কাম নাই... কতো লোকের কাছে গেছি আমারে একটু কাম দেন... আমারে একটু খাওন দেন... আমার সুমনরে একটু খাওন দেন... দুধের বাচ্চা, না খাইয়া মইরা যাইবোগা... দুধ দরকার নাই... একটু ভাতের মার দেন...’

নাফি আর রাফসানের চোখও করুণ হয়ে আসছিলো। পাগলি বলে চলেছে-
‘তহন হাসিনা গবমেন্ট আছিলো... অর মন্ত্রীরা সব দেশ ছাইরা পালাইলো... আমরাতো আর দেশ ছারতে পারি না... মরতেও পারি না... যারা বাইচা গেছিলো এগো কষ্ট আছিলো বেশি... সুমনরে কোলে নিয়া ঢাকা আইলাম তহন... কোলে নিয়া নিয়া ঘুরি... কাম চাই... কাম নাই... ভিক্ষা চাই... ভিক্ষাও নাই... ফুটপাতে থায়ি... এমন সময় এক লোক আইলো... আইয়া কয় তর বাচ্চাডা আমাগোরে দে... তরে কিছু ট্যাকা দিমু... বাড়িতে গিয়া গরু পালবি... খামার করবি... রাজি থাকলে ক... পেটে এমন ক্ষুধা, রাজি হইয়া গেলাম... লোকটা আমারে সাথে সাথে খাইতে দিলো... সুমনের লেইগা দুধ ও দিলো... মনে অইলো... আহা কতো ভালো মানুষ... খাওন দিছে... আমার সুমনরে দুধ কিন্না দিছে... পেট ভইরা মায়ে পুতে খাইলাম... যাওয়ার আগে লোকটা কইয়া গেলো তুই এহানেই থাকিস... আমি আমার বৌরে নিয়া আসি... কিছুক্ষণ পরেই ঐ লোকটা আরেকটা মহিলারে নিয়া আইলো... মহিলাটা সুমনরে কোলে নিলো... আদর করলো... আমারে কইলো, তাগো বাচ্চা হয় না, অনেকদিন হইছে বিয়া হইছে... অনেক চেষ্টা-তদবির করছে... আমারে নগদ ২০ হাজার ট্যাকা দিবো... বিনিময়ে আমি আর কহনোই সুমনরে চাইতে পারুম না... ওরে দেখতেও চাইতে পারুম না... ওরে এক্কেবারে দিয়া দেওন লাগবো... আমি ভাবলাম, আমার লগে থাকলেতো খাওন নিয়া কষ্ট... এরা ট্যাকাপয়সাঅলা লোক... সুমনের খাওনের কষ্ট অইবো না... সুমন... বাপ আমার... সুমন...’

বলে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে আবার পাগলিটা। কিছুক্ষণ পর আবার বলতে শুরু করলো-
‘আমি বুদ্ধি কইরা মহিলার পিছে পিছে গিয়া বাসাডা দেইখা আসছিলাম... অরা নগদ ২০ হাজার ট্যাকাই দিছিলো... আইসা আর ভালো লাগে না... বুকটা খালি খালি লাগে... রাইতে ভালো কইরা খাইলাম... সুমনরে ছারাতো আর ঘুম আহে না... কোনোদিন কাছছারা করি নাই... কোলে কোলে রাখছি... আমার কোল খালি হইয়া গেলোগা... সারা রাইত ঘুমাই নাই... পরের দিন সকালেই ঐ বাসায় গেলাম। জানালা দিয়া উঁকি দিলাম... দেহি সুমনের গায় নতুন জামা... অয় ঘুমায়... বাপ আমার ঘুমায়... আইসা পরলাম... আবার দুপুরে গেলাম... সুমন কেমন মনমরা... আমারে খুজে মনে অয়... অই মহিলা অরে বিছানায় বসায়া কথা কইতাছিলো... হাসতাছিলো... বিকালে আরেকবার গেলাম... লুকায়াই গেছিলাম... মহিলা আমারে দেইখা ফেললো... ঘরের ভিত্রে ডাকলো... ডাইকা কয়, তুমি বাসা চিনলা কেমনে? তোমারেনা আইতে না করছি... এই বাচ্চা এহন আমাগো... তুমি আর এদিকে আইবানা... ঘুরাঘুরি করবানা... আমি কইলাম- কোনোদিন অরে ছাড়া থাকি নাই তো... দেখতে মনে চায় খালি... খালি মনে অয় হাতে কি যেন নাই... কয়- যাই হোক... আর আইবানা... এইটাই লাস্ট... আমি মাথা নাইরা আইয়া পরলাম... বুঝছস তরা, আমি আইয়া পরছিলাম সেইখান থেইকা...’

নাফি আর রাফসান মাথা নাড়লো। পাগলি আবার বলে যেতে থাকলো-
’২০ হাজার থেইকা আমি ৫শ খরচ করছিলাম... বাকি ট্যাকা আস্তাই আছিলো... সারা রাইত ভাবলাম... আমার তো কোল খালি অইয়া গেলো... আমার তো সুমন ছাড়া কেউ নাই... আমার ট্যাকা লাগবো না... মরিবাচি মায়ব্যাটা একলগে... আবার সকালে গেলাম অই বাসায়... মহিলারে ডাইকা কইলাম... আমার সুমনরে দিয়া দেন... ট্যাকাও ফেরত দিলাম... কইলাম ৫শ ট্যাকা খাইছি আমি... অইটা আমি কাম কইরা শোধ দিমু... নাইলে ভিক্ষা কইরা আইনা শোধ দিমু... খালি আমার সুমনরে ফেরত দেন... আমার কোল খালি অইয়া গেছেগা... আমার এই দুনিয়ায় সুমন ছাড়া কেউ নাই... সুমন বাপ আমার... কেন যে তরে দিছিলাম... কেন যে এতো খিধা লাগে... এই মরার প্যাট... খালি খিধা লাগে... বুঝছস তরা...’

মাথা দোলায় নাফি আর রাফসান। পাগলি বলে যেতে থাকে-
‘পরে আমারে মহিলায় কইলো- তুমি বিকালে আসো... আমি জামাইয়ের লগে পরামর্শ কইরা দেহি... ট্যাকা তোমার কাছেই রাহো... অরে নিয়া ট্যাকা দিও... আর যা খরচ অয় সেইটা আর দেওন লাগবো না... আমি দুই দিন ঘুমাই নাই... ভাবলাম আইচ্ছা আগে পরামর্শ কইরা লউক... আইসা খাইয়া পার্কে শুইয়া এমন ঘুম দিলাম... মরার ঘুম... এমন মরার ঘুম দিলাম উইঠা দেহি রাইত... উইঠাই আমার বুকে ধুকপুকানি শুরু হইলো... আমার সুমনরে আনতে যাইতে হইবো... পার্কের লোকগরে জিগাইলাম কয়টা বাজে... কয়টা জানি কইলো- ৭টা না ৮ টা... আমি দৌরায়া দৌরায়া গেলাম... আমার সুমনরে নিয়া আমু... আমার কোলে রাহুম... গিয়া দেহি অই বাসায় তালা... ভিত্রে অন্ধকার... কেউ নাই... ডাকলাম কতক্ষন... পাশের বাসারতে আরেক মহিলা আইলো... কয় কি দরকার... এরা তো আজকে দুপুরেই বারিতে গেছেগা... জিগাইলাম লগে কোনো বাচ্চা আছিলো... কয়- হ... আছিলো... অগো নাকি বইনের পোলা... আরে অইটা বইনের পোলা না... অইটা আমার সুমন আছিলো... আমার সুমন... আল্লা... আমার সুমন আছিলো... আমার সুমন এইটুক... এইটুক দুধের বাচ্চা... আমার কোল ছাড়া থাকে নাই... অরে এক হাতে নিয়া ঢাকা আইছিলাম আমি... এহন মরলে আমি ওর বাপরে কি কমু... ওর বাপেতো আমারে জিগাইবো, সুমন কই... সুমনরে না তোমার কাছে রাইখা আইলাম... আমি কি কমু... ওরে বেইচা দিছি... খিদার জ্বালায় ওরে বেইচা দিছি... ২০ হাজার ট্যাকায় অরে বেইচা দিছি... তারপর থেইকা খুজতাছি অরে আমি... আল্লা এইডা কেমন পরিক্ষা দিলা আমাগো... আমরাতো গরিব মানুষ... আমাগো কি দোষ আছিলো... জামাইরে শেষ দেখাও দেখলাম না, কই কবর তাও জানিনা... বাচ্চা দিলা... তাও রাখতে পারলাম না... আল্লা... সুমন বাপ আমার...’

আবার কাঁদতে শুরু করেছে পাগলিটা। নাফি পাগলির চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। 
আর পাগলির চোখ খুঁজে বেড়াচ্ছে দুই বছরের কোনো বাচ্চাকে... 

No comments:

Post a Comment