25 June 2019

দৈনন্দিন আলাপ ১৭

গ্রামের নাম রতনখালি। খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার শরাফপুর ইউনিয়নের একটা ছোটো গ্রাম। শরাফপুর বাজার থেকে ৪-৫ কিলোমিটার রাস্তা ভ্যানে যাওয়া যায়। তারপর পায়ে হাটা রাস্তা আরো ৩ কিলোমিটার প্রায়। অন্তত ৩ কিলোমিটার পায়ে হেটে পৌঁছাতে হয় রতনখালি গ্রামে।

বাইরে থেকে দেখে খুব ভালো লাগলো। বাংলাদেশের আর ৫ টা গ্রামের মতোই সুজলা সুফলা শষ্য শ্যামলা। গ্রামের ভেতরে গেলাম কথা বলতে। গ্রামে ৪০-৫০ ঘর হিন্দু পরিবারের বসবাস।

কথা বলতে বলতে জানলাম পাশের বয়ে যাওয়া খালটা নোনা পানির। টিউবওয়েল থেকেও নোনা পানি উঠে। গ্রামের লোক এই পানি খেয়েই অভ্যস্ত। টিউবওয়েল ডিপ হলে নোনা কিছুটা কম থাকে। অবশ্য উপকূলীয় অঞ্চলের অনেক উপজেলাতেই এই অবস্থা।

পুরো গ্রামে কোনো স্যানিটারি মানসম্পন্ন টয়লেট নাই। গ্রামে কোনো স্কুল নাই, হাসপাতাল নাই, দোকান নাই। বাজার করতে যাওয়া লাগে ৪ কিলোমিটার দূরে বানিয়াখালি বাজারে। পড়তে যাওয়া লাগে বানিয়াখালি, জ্বর, ডায়রিয়া হলেও বানিয়াখালি। জিজ্ঞাসা করলাম, কেউ গর্ভবতী থাকলে? লোকজন বললো- পরিস্থিতি খারাপ থাকলে ভ্যান খবর দিয়া রাখি।

পুরো গ্রামে একজনের মাত্র একটা যানবাহন আছে। একটা নছিমন। সেটায় প্রায় ১৫ জন মানুষ আটে। নসিমন চালক বেলা ৩ টার দিকে ১৫ জনকে নিয়ে বানিয়াখালি বাজারে যান বাজার করতে৷

পুরো গ্রামে মাত্র একজন নারী স্বাবলম্বী। তার স্বামী পরের জমি চাষ করেন, পুরো গ্রামের আর বাকি সবার মতো। তিনি নিজে টাকা বাচিয়ে গরু পালেন ৫ টা, ভেড়া পালেন ১৮ টা, ছাগল পালেন ৪ টা, হাস ১০৮ টা, মুরগি ২৬ টা। দুইটা পুকুরে মাছ। পুকুরে উনি তেলাপিয়া চাষ করেন।

সুমিত্রা দিদির বাড়িতে তখন কালি পুজার প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে, উনি সারা দিন উপোস। এর মধ্যে আমাকে উনার ছোটো খামারটা দেখালেন। দেবরকে দিয়ে আম পারিয়ে খাওয়ালেন। গ্রামের সুখদুঃখ নিয়ে আলাপ করার জন্য মেম্বারকে ডেকে আনলেন। উনি উপোস রেখেই অতিথি সামলাচ্ছেন, অতিথি নারায়ন।

মেম্বার আমার খোজখবর নিলেন। ঢাকা থেকে সাহায্য করতে আসছি কিনা জিজ্ঞাসা করলেন। বললেন- সাহায্য যদি করেন সরাসরি এদের হাতে দিয়েন। এরা কাম কইরা খায়। সরকারি দান সব ইউনিয়ন পরিষদ আইসা আটকায়া যায়। এদের হাত পর্যন্ত আসে না। আর বেসরকারি দান বছর বছর করে কিছু। লাভ হইতেছেনা। এঞ্জিওগুলা থাকে ঋণের ধান্ধায়।

গ্রামে ৮০-৯০ জন পড়াশোনা করার মতো বাচ্চাকাচ্চার মন্দিরভিত্তিক একটা শিক্ষা কার্যক্রম চালু আছে, সেখানে ক খ গ শেখানো হয়। ১৩-১৪ বছরে মেয়েদের আর ১৭-১৮ বছরে ছেলেদের বিয়ে হয়ে যায়। বংশপরম্পরায় এরা অন্যের ক্ষেতে মজুর দেয়। পুরুষ নারী নির্বিশেষে এরা অন্যের জমিতে মজুর দেয়। প্রত্যেক দিন কামাই করা লাগে। একদিন কামাই নাই তো খাবার নাই।

শহরগুলো যেখানে ডাস্টবিন হয়ে পরে আছে; উন্নয়নের জোয়ারে ভাসতে থাকা, এক সবপেয়েছির বাংলাদেশের একটা প্রত্যন্ত গ্রামে আমরা আর কি আশা করি!

No comments:

Post a Comment