আমরা চারিদিকে
কেবল শুনি এ সহীহ না, ও সহীহ না। সহীহ মুসলমান আসলে কে? কালকে বিল্লাল মামার চায়ের
দোকানে বসেছিলাম। বাংলাদেশের আর দশটা চায়ের দোকানের মতো এখানেও সুই থেকে মহাকাশযান
সব বিষয়ে আলোচনা চলে। আমি সাধারণত চা খেয়ে চলে আসি, এইসব আলোচনায় অংশগ্রহণ করি না।
কালকের আলোচনা ঘুরছিলো, মহানবীকে কটুক্তি করা, হিন্দুদের বেশি বাড় বেড়ে যাওয়া, ধর্মীয়
অনুভূতিতে আঘাত, পুলিশ কর্তৃক তৌহিদি জনতার উপর নির্বিচার গুলিবর্ষণ, সহীহ মুসলমান
কে ইত্যাদি বিষয় নিয়ে।
আমি
মুরুব্বিদের জিজ্ঞাসা করলাম, যে আইডি থেকে মহানবীকে কটুক্তি করা হয়েছে, সেটা হ্যাক
হয়েছিলো, ঐ হিন্দু জানেই না কে কাকে কি মেসেজ পাঠাচ্ছে, ২ জন মুসলমান মহানবীকে
গালি দিয়ে মেসেজ দিয়েছে, এইগুলো তারা জানেন কিনা? কয়েকজন জানে আর কয়েকজন জানেনা।
আমি বললাম, তো ঐ মুসলমানদের বাড়িঘরে তো আক্রমণ করলোনা, তৌহিদি জনতা। নাকি মুসলমান
হলে তার আর অপরাধ থাকেনা।
বললাম,
গলা উচায়া বলেন ৯০% মুসলমানের দেশ। ৯০% মুসলমানের দেশের এই অবস্থা কেন? যে দেশে
রোজা আসলে জিনিশপত্রের দাম বাড়ে, যে দেশে দুই ঈদে সব টাকা রাস্তায় ভাড়া দিতে দিতে
চলে যায়, এইটা মুসলমানের দেশ? বিল্লাল মামার দোকানের সামনের রাস্তাটা দেখায়া
বললাম, এইটা কোনো ৯০% মুসলমানের দেশের রাস্তা হইতে পারে? ধুলাবালি, নোংরা, ময়লা।
তারা রাস্তার দিকে বললেন- না এইটা মুসলমানের রাস্তা না। মুসলমানের রাস্তাঘাট হবে
পরিচ্ছন্ন। একজন মুসলমান জায়গামতো ময়লা ফেলবে।
হিন্দুদের
নিয়ে এতো মাথাব্যথা, হিন্দু কয়জন দেশে? কয়জন হিন্দু দেশে জোরগলায় কথা বলে? একজন
হিন্দুরে ডাইকা আইনা তার দেবদেবতা, মন্দির, ধর্ম নিয়া কথা বলেন, দেখেন কোনো এন্সার
দেয় কিনা? মাথা নিচু করে সব শুনবে, তারপর হেটে চলে যাবে। হিন্দুরা জানে তারা
এইদেশে সংখ্যালঘু। তারা মহানবী বা ইসলাম ধর্মের কটুক্তি কোনোদিন করবেনা। কটুক্তি
কে করবে বলেন? কটুক্তি করবে মুসলমানরাই। দেশে দাঙ্গা-ফ্যাসাদ বাঁধানো, সেখান থেকে
সুবিধা নেয়ার জন্য রাজনীতি করা, এগুলো মুসলমানরাই করবে।
এরআগেও
এরকম হয়েছে। নাসিরনগর, রামু ইত্যাদি জায়গায় মুসলমানরাই দাঙ্গা-ফ্যাসাদ করেছে।
অভিযুক্ত মুসলমানদের বলা হয়েছে পাগল। কাবা শরীফের উপর শিবের ছবি বসানোর জন্য
কতোটুকু মানসিক সুস্থতা জরুরি, বলেন? সম্পূর্ণ সুস্থ মস্তিষ্কে এই কাজ করে, পরে
ধরা খেলে বলে পাগল। এর মধ্যে হিন্দু-বৌদ্ধদের বাড়িঘর ভেঙ্গে, মন্দির-মঠ ভেঙ্গে
শেষ।
যাই
হোক, সহীহ মুসলমানের কাজ গুজবে কান দিয়ে মন্দির ধ্বংস করা না। সহীহ মুসলমান সে, যে
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা করে চলবে। মহানবী মুসলমানদের প্রধানতম শত্রু
ইহুদীদের সাথেও বন্ধুত্ব রক্ষা করে চলতেন, তাদের বাড়িতে দাওয়াত খেতেন, যতক্ষণ না
পর্যন্ত তারা রাজনৈতিকভাবে ইসলাম ধর্মের বিরোধিতা না করে। আমরা মহানবীর চেয়েও বড় মুসলমান, হিন্দুদের পূজার
লাড্ডু খেলেও আমাদের ধর্ম থাকে না।
ধর্মীয়
অনুভূতি আরেক বায়বীয় অনুভূতি! ইসলাম ঠিক মতো বুঝি না, কিন্তু আমাদের ধর্মীয়
অনুভূতি টনটনা। ইসলাম ধর্ম, কোরআন আর মহানবীর সম্মানের গ্যারান্টি নিয়েছে আল্লাহ স্বয়ং।
এরপর আর আমাদের কোনো কাজ বাকি থাকে?
আমাদের
যে কাজ করার কথা সেগুলো করলেই ধর্মের সবচেয়ে বেশি উপকার হবে। মুরুব্বিদের জিজ্ঞাসা
করলাম- এইযে দেশে দুর্নীতি এইটা নিয়া কাউকে কিছু বলছেন? কাউকে বলছেন- দুর্নীতি
ইসলাম ধর্মে হারাম? ৯০% মুসলমানের দেশ দুর্নীতিতে ছাইয়া গেছে কেন? একজন ওয়ার্ড
কাউন্সিলরের সামনে দাড়ায়া হককথা বলতে ভয় পান, আল্লাহর সামনে কেমনে দাড়াবেন? কি
জবাব দিবেন আল্লাহর কাছে?
সহীহ
মুসলমান সে, যে হককথা বলতে ভয় পায় না। হককথা যতো কঠিনই হোক না কেন, যার সামনেই হোক
না কেন, সে সেটা বলবেই। সহীহ মুসলমান সে যে অন্যায়ের প্রতিবাদ করবে, অনাচার রুখে
দাঁড়াবে। সহীহ মুসলমান নিজে রাষ্ট্রীয় দুর্নীতির সাথে যুক্ত হবে না, কেউ দুর্নীতি
করলে তাকে ছেড়ে কথা বলবেনা।
সহীহ
মুসলমানের অনুভূতি এতো কোমল হবে না যে, যে কেউ আল্লাহ বা মহানবীকে গালি দিলে তার
উপর ঝাপিয়ে পরবে। সহীহ মুসলমান হবে পরমতসহিষ্ণু, অন্যের মতে প্রতি সহানুভূতিশীল।
সহীহ মুসলমান হবে প্রগতিশীল, জ্ঞানের প্রতি ভালোবাসা থাকবে তার। ফেসবুকের একটা
বেনামী মেসেজ বা মসজিদের মাইকের ২ লাইনের আহবানকে সে যাচাই করবে। সে বাছাই করবে
কোনটা গুজব আর কোনটা খবর।
সহীহ
মুসলমান কখনই সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণ করবে না, বরং তাদের নিরাপত্তা দিবে,
প্রয়োজনে তাদের বাড়িকে-মন্দিরকে নিজের বাড়ি, মসজিদের মতোই নিরাপত্তা দিবে।