15 January 2020

আতুরঘরে মৃত্যু অথবা হিজলের লাল : পর্ব- ৯, ১০


.


প্লাবনের একবার মনে হলো কবিতা লিখবে। কিন্তু কবিতা কিভাবে লিখবে? কবিতা লেখার প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে ও নীলক্ষেত থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গীতবিতান আর কাজী নজরুল ইসলামের সঞ্চিতা কাব্যসংকলন কিনে নিয়ে আসলো। কবিতা লিখতে বসার আগে দুইটা বই খুলে নিয়ে বসতো ও। তারপর দুইটা বই থেকেই কিছু কিছু পড়তো। এক-দুই পাতা পড়ার পর ওর কবিতা লেখার বেগ চাপতো। ওর প্রথম লেখা কবিতার প্রথম লাইন এখনো মনে আছে আমাদের৷ 'বিষ ঢেলে দাও, বিষ ঢেলে দাও মম অন্তর মাঝে...' আমি, শাকিল, পুইয়ান সবার রুমে রুমে গিয়ে বলে আসলাম এই ঘটনা, সবাই হাসতে হাসতে শেষ।

আমাদের আরেক বন্ধু ছিলো পরিসংখ্যানের ফারুক। আমরা রুমমেট ছিলাম। একবার বিকালবেলা আমি, শাকিল, প্লাবন, হৃদয় এবং সৈকত হালকা ভেষজ দ্রব্যাদি সেবন করে রুমে আসলাম। রুমে এসে দেখি ফারুক পড়ছে। ও তখন তাবলীগ করা শুরু করেছে। দুনিয়ার দুষ্ট ফারুক তাবলীগ শুরু করলেও দুষ্টামি ছাড়তে পারেনি। আমি ওকে বললাম- 'আরবের ভূরাজনীতি বুঝস?' ও বললো' 'না...' আমি ওকে চেপে ধরলাম- 'না মানে? তাবলীগ করবি আর আরব সম্পর্কে জানবি না মানে... তরে কই দাড়া...' তারপর ওকে চেপে ধরে প্রায় ১ ঘন্টা আরবের ভূরাজনীতি বোঝালাম। মহানবী, খুলাফায়ে রাশেদীন, উমাইয়া খেলাফত, আব্বাসীয় খেলাফত, সৌদি আরব, ইরান, সিরিয়া, তুরস্ক, মিসর যখন ঘুরছিলাম, ফারুক তখন বলে- 'দোস্ত, আর না...' আমি আরো চেপে ধরে বলি- 'আর না মানে... তরে জানাই লাগবো...' পরে পাশের বেড থেকে হৃদয় আর শাকিল হাসাহাসি শুরু করে। বলে- 'আজকের মতো ওর ভূগোলের ডোজ কমপ্লিট দোস্ত, অরে ছাইড়া দে... আছরের আজান দেয়...' পরে অকে ছেড়ে দেয়া হয়।

একবার আমাদের ডিপার্টমেন্টে এক খান্ডাশী ম্যাডাম এসেছিলো। ৩৬, ৩৭, ৩৮ এর অনেকেই তাকে মনে করতে পারবে, তার নাম নুসরাত জাহান চৌধুরী। সে আগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগে ছিলো, আমাদের বিভাগে এক-দেড় বছর স্টপেজ দিয়ে পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যায়। এই এক-দেড় বছর সে ডিপার্টমেন্টে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। তার কিছু নিয়ম প্রাইমারি স্কুলের নিয়ম হওয়ারও যোগ্য ছিলো না। যেমন- ক্লাসে নিয়মিত আগের ক্লাসের পড়া ধরা, ক্লাসে প্রশ্ন করা যাবে না, ক্লাস শুরু হলে ক্লাসে ঢোকা এবং বের হওয়া যাবে না, ক্লাস শুরু হলে দরজা আটকে দেয়া ইত্যাদি। সে ক্লাসে এসেই প্রথম ১৫ মিনিট সময় নষ্ট করতো- তোমরা কিছু বোঝো না, তোমরা কিছু পারো না, তোমরা কিছু জানো না, গাধাদের পড়াইতে আসছি, তোমরা জীবনে কি করবা ইত্যাদি ইত্যাদি। তারপর সে তার পূর্বতন নোট করা ডায়েরিটা বের করতো, সেখানকার কিছু পয়েন্ট আলোচনা করতো। পরীক্ষায় আবার তার পয়েন্টের বাইরে কোনো পয়েন্ট দেয়া যেতো না। যারা তার পয়েন্টগুলো মুখস্থ দিতে পারতো তারাই তার কাছে ভালো ছাত্র ছিলো।

যাই হোক আমি আর শাকিল একবার ম্যাডামকে নিয়ে আলাপ করতে করতে হেটে গেরুয়া যাচ্ছিলাম। হঠাৎ কোন প্রসঙ্গে যেনো বললাম- 'নুসরাত জাহান চৌধুরী তো আমাদের ঘাড়ে পারা দিয়া পু*কি মারতেছে...' শাকিল বললো- 'হেই মিয়া... ঘাড়ে পারা দিয়া পু*কি কেমনে মারে... এইটা তো অসম্ভব... অসম্ভব কথা বলো মিয়া...' 'শারীরিকভাবে সম্ভব না হইলেও মানসিকভাবে সম্ভব...' তারপর আমরা হাটতে হাটতে গেরুয়ার ঢাল বাইলাম।

আরেকবার, বেনসনের দাম তখন মনে হয় ১০ টাকা। মাসের শেষ, আমাদের কারো হাতে তেমন টাকা নাই। সবার টাকাই বাসা থেকে আজকে আসবে, কালকে আসবে করছে। আমাদের সৈকত এমন সময় ক্লাসে চাদা তুললো। ১ টাকা, ২ টাকা করে চাদা তুলে ১০ টাকা করলো। তারপর টারজান পয়েন্ট থেকে ১টা বেনসন কিনে নিয়ে আসলো। ফ্যাকাল্টিতে আমাদের সিগারেট খাওয়ার আলাদা জায়গা ছিলো। সমাজবিজ্ঞান ভবনের ৫ তলায় উঠার সিড়ি। আমরা ৪ তলায় ক্লাস করতাম, ঐ সিড়ি খুব কাছে ছিলো। শুধু কাছে না, সেইফ এন্ড সিকিউর। আমরা ঐ জায়গার নাম দিয়েছিলাম 'গ্যাসচেম্বার'চেম্বারের জন্য আমাদের আলাদা 'নিখিল লোক প্রশাসন বায়ুসেবনকারী কমিটি' ছিলো। কমিটির স্থায়ী সদস্য ছিলাম আমি, শাকিল, প্লাবন, তিলন, সৈকত, হৃদয় আর চশমা তানভীর। শামীম, শুভ, সুষম আর আরেক তানভীর ছিলো গেস্ট মেম্বার। তো সৈকত সিগারেট কিনে চেম্বারে নিয়ে আসলো। একটা সিগারেট, অনেক ভোক্তা। সৈকত সিগারেটটার ফিল্টারের দিকে আগুন ধরালো। আমরা সৈকতের দিকে তাকিয়ে থাকলাম।

আমাদের মুন্না লাইব্রেরীতে পড়াশোনা করতো। তখন এরকম বিসিএসের পড়া পড়তো না লাইব্রেরিতে। অন্য অনেক কিছু পড়তো- তত্ত্ব, সাহিত্য, আউট বই। মুন্না একদিন হঠাৎ বলে উঠে- 'তিলন খালি রাজনীতিই কইরা গেলো, বোকা*দা...'বলে দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়লো। আবার তিলন একদিন কথা বলতে বলতে কি বিষয়ে যেনো বললো- 'এইযে মুন্না অরা বোকা*দার মতো খালি পইড়াই গেলো...'আমি এই দুই '' এর মাঝখানে পরে ছিলাম।

ফার্স্ট ইয়ারে তখন। একবার আমি মঈনউদ্দীন পাঠান ভাইকে খুজতে তার রুমে গিয়েছিলাম। সেখানে এক বড়ভাই বসে বসে পড়ালেখা করছিলেন। আমি বললাম- 'ভাই... মঈন ভাই আছে?' ভাই বললো- ' ও তো রুমে নাই। আপনে কে?' বললাম- 'ভাই... পুশকিন, লোক প্রশাসন, ৩৭...' ভাই বললো- 'আমি আব্দুল কুদ্দুস মাখন। এই নামে আরেক বিখ্যাত লোক আছে, চিনেন তারে?' আমি বললাম- 'জি ভাই... রাজনীতিবিদ ছিলো... ঠিক আছে ভাই যাই...' বটতলায় গিয়ে দেখি মঈন ভাই সেখানে বসে আছেন। ভাইকে বললাম- 'ভাই, আপনার রুমে গেছিলাম। আপনে এইখানে...' মঈন ভাই বললো- 'রুমে কে ছিলো?' বললাম- 'নাম বললো আব্দুল কুদ্দুস মাখন... ডিপার্টমেন্ট, ব্যাচ কিছু কয় নাই...' মঈন ভাই, শুভ ভাই, রোলান্ড দা আরো সবাই সে কি হাসি! মঈন ভাই বললো- 'নিশ্চয় অলক ভাই... সে ছাড়া এই কাজ কে করবো? রুমে একটা পোস্টার আছে মাখনের... দেখসস...?' আমি বললাম- 'না ভাই...' মঈন ভাই বলে- 'কি খেয়াল করস...?'

একটু পর রুমে গেলাম। রুমে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরই অলক ভাই হাজির। বললো- 'ভাই আমার ভুল হইয়া গেছে... আমি বুঝি নাই... আমার নাম, ব্যাচ বলা দরকার ছিলো...' আমিতো খুব বিব্রত। আবার ভয়ে আছি, মোস্ট সিনিয়র ব্যাচ। বললাম- 'ভাই আমি আপনার নাম-ব্যাচ জানি...' ভাই বললো- 'বলেনতো কি?' আমি বললাম- 'অলক... ৩১ ব্যাচ...' ভাই বললো- 'শুধু অলক?' আমি বললাম- 'সরি ভাই... অলক ভাই... ৩১ ব্যাচ।' ভাই বললো- 'ঠিকাছে পুশকিন... গেলাম।' আমি মনে মনে বললাম, আল্লাহ...

আরেকবার ক্লাস শেষে আমাদের ৩৬ ব্যাচের আকাশ ভাই আমাকে আর নাসিরকে র‍্যাগ দেয়ার জন্য সালাম-বরকত হলে নিয়ে গেলেন। হালকা কিছু র‍্যাগ-ফ্যাগ দিলেন। নাসির তখন খুব শক্ত। আকাশ ভাই যা বলে করে ফেলে। কাঠি দিয়ে রুম মাপা শেষ হলে আকাশ ভাই নাসিরকে বলেন- 'নাসির, বিড়ি খাস?' শক্ত নাসির তখন কেদে দিলো। 'না... ভাই... খাই না...' আকাশ ভাই অবাক হলেন, এতক্ষণ র‍্যাগ চললো কিছু করলো না, বিড়ির কথা জিজ্ঞাসা করতেই কেদে দিলো! আমার দিকে তাকালেন, আমি বললাম- 'আমি খাই ভাই...' ভাই বললেন- 'এ নাসির... বিড়ি না খাইলে কি কান্তে আছে? বিড়ি খাস না, খাস না... কান্দার কি হইলো... কান্দা থামা... পুশকিনরে সাথে নিয়া গিয়া ২টা বিড়ি নিয়া আয়...' আকাশ ভাই আমাকে ইশারা দিলেন, কান্দা থামা, কি একটা অবস্থা...

রাতে বটতলায় গান-বাজনা হতো। মঈন ভাই, রোলান্ড দা, কিশোর দা, শুভ ভাই, সেরু ভাই, রানা ভাই, মোমিন ভাই এরা থাকতো। রোলান্ড দা খোল বাজিয়ে গাইতো, সেরু ভাই টেবিলে তাল কাটতো, 'আর কি হবে এমন জনম বসবো রে সাধু মেলে...' রোলান্ড দা একবার আমাকে আর প্লাবনকে জিজ্ঞাসা করলেন- 'আচ্ছা, আমাদের হাত তো আমাদের অংশ। আমাদের হাত যদি কাটা পরে আর তাকে কবর দেয়া হয়, সেটা কি আর আমার থাকবে? এই 'আমি' আসলে কে...?' গভীর প্রশ্ন, আমরা ভাবতে বসে গেলাম। তার কিছুদিন পরেই দাদা হল ছেড়ে ইসলামনগর বাসা নিলেন। আমি এক বিকালে বটতলা থেকে হলে ঢুকতে গিয়ে দেখি দাদা রিক্সায় বিছানাপত্র তুলছেন। দাদার সাথে শুধু হিমেল দাঁড়ানো। আমি অনেক কষ্টে কান্না আটকালাম। আমি আর হিমেল, দাদাকে ইসলামনগর পর্যন্ত দিয়ে আসলাম।

আমাদের সময়ে কেবল রাজনৈতিক ঘটনা ঘটতো, তা না। স্মৃতিচারন করার মতো অনেক ঘটনা আছে, যেগুলো ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গল্প অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় জীবন, কেবল কয়েকটা গল্প; নাকি তার বেশি কিছু?



১০.


যাইহোক, জুবায়ের যেদিন মারা যায় সেদিন সকাল থেকেই শুরু হয়ে যায় সর্বাত্মক আন্দোলন। আন্দোলনের অংশ হিসেবে প্রথমেই রেজিস্টার ঘেরাও দেয়া হয়। আন্দোলনে সকলের অংশগ্রহণ অত্যন্ত স্বতঃস্ফুর্ত ছিলো। নেতৃত্বের জায়গায় প্রগতিশীল ছাত্রজোট বা সাংস্কৃতিক জোট থাকলেও ব্যাপক ছাত্রসমাগমকে লক্ষ্য করে গড়ে তোলা হয় একটি স্বতন্ত্র প্লাটফর্ম- ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর’।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় আন্দোলনের আঁতুড়ঘর। এখানে কোনো ধরনের নিপীড়ন, জুলুম-নির্যাতন, অন্যায় করে পার পাওয়া মুশকিল। এর আগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বহু নিপীড়নবিরোধী আন্দোলন সংগঠিত হয়েছে। নিপীড়ক শিক্ষক হোক আর উপাচার্য হোক, কোনো লাভ নাই। তাকে জবাবদিহিতার মুখোমুখীহতেই হয়। এর আগে এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিপীড়নের দায় মাথায় নিয়ে বাংলার মাস্টার মোস্তফা, নাটক ও নাট্যতত্ত্বের মাস্টার সানি বিদায় নিয়েছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কালচারটাই মারমুখী। এখানে কিছু মাস্টার বের হয় যারা কোনো জাতেরই না, পরে ছাত্রদের হাতে তাদের ঠিক হওয়া লাগে। সেদিন বটতলায় এক মাস্টার গাড়ি নিয়ে হাজির, সেতো পারলে দোকানের ভেতরেই গাড়ি পার্ক করে। এইটা নিয়ে কয়েকজন ছাত্র কথা বলতে গেলে তাদের আবার বহিষ্কারের ভয় দেখায়, আবার তাদের নামে লিখিত অভিযোগ দায়ের করে। আরে, এইখানে সেলিম আল দীন রিক্সায় করে ঘুরতো, খালি পায়ে হাটতো। এখানে আনু মুহাম্মদ এখনো খালেদা-হাসিনা দুই সরকারেরই মাইর খায়, এখানে রায়হান রাইন ট্রান্সপোর্ট এসে ছাত্রদের সাথে আলাপ করে, চা খায়। এখানে সৈয়দ নিজার আলম গাছের নিচে ছাত্রদের ক্লাস নেয়, হাইকোর্টে রিট করে কেনো ক্লাস বন্ধ করা অবৈধ হবে না?   জুবায়ের মারা যাওয়ার পর মূল আঙুল উঠে তৎকালীন ছাত্রলীগ আর উপাচার্যের দিকে। যদিও জুবায়ের অনেকটা ব্যক্তিগত কারণে মারা গিয়েছিলো, কিন্তু তারপরো কোনো ধরণের অপমৃত্যু আমরা সমর্থন করতে পারি না।

শাকিল আমাকে প্রায় ফিসফিস করে বললো- ‘প্লাবন ও নাকি ছিলো… জানো নাকি কিছু?’ আমি কিছু জানিনা এসম্পর্কে। তখন আমার সাথে হল এবং ডিপার্টমেন্টের অনেকের যোগাযোগই শুন্যের কোঠায় নেমে এসেছিলো। আস্তে আস্তে একটা একটা নাম প্রকাশিত হতে থাকে। প্লাবনের পর মাসুদের নাম আসে। একটা একটা নাম আসে আর ক্ষোভে ফেটে পরে রেজিস্টারের সামনে থাকা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর। নাম ধরে ধরে স্লোগান দেয়া হয়। খুনি প্লাবনের ফাঁসি চাই…খুনি মাসুদের ফাঁসি চাই…

আচ্ছা যে ধর্ষক, সে তো বছরের ৩৬৫ দিন, দিনের ২৪ ঘন্টাই আর ধর্ষন করে না। হয়তো কোনো এক দিন, কোনো এক মুহুর্তে সে এইরকম অনৈতিক কাজ করে বসে। কিন্তু খুন, ধর্ষন এগুলো এমন পর্যায়ের অপরাধ যে একবার করে ফেললেই হয়ে গেলো। সেখান থেকে পেছনে আসার আর কোনো উপায় নাই। কিন্তু এমনো তো হয় যে খুন করেনি, কিন্তু খুনি উপাধী নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনো উপায় ও নেই।

জুবায়েরকে মারা হবে এটা তৎকালীন প্রক্টর জানতো। জুবায়েরের ঐদিন ফোর্থ ইয়ারের শেষ ফাইনাল পরীক্ষা ছিলো। ঐ পরীক্ষার পর ৩-৪ দিনের গ্যাপ, তারপর ভাইভা। ছেলেপেলে ভাইভার আগেই ওকে মাইর দিতে চাইলো। ওদের ধারনা ছিলো ভাইভার পর জুবায়ের আর ক্যাম্পাসে আসবে না। তো নতুন কলার সামনে জুবায়ের ওর বান্ধবীর সাথে দাঁড়িয়ে ছিলো। সেখান থেকে দুই-তিনজন ওকে প্রায় জোর করে ধরে বিজ্ঞান কারখানার দিকে নিয়ে আসে। বিজ্ঞান কারখানাটা তখন যে জায়গায় ছিলো সেখানে এখন ওয়াজেদ মিয়া বিজ্ঞান গবেষণাগার। ঐদিন আমাদেরও ফাইনাল পরীক্ষা ছিলো।

তো জুবায়েরকে বিজ্ঞান কারখানার পেছনে নিয়ে গিয়ে রড দিয়ে মারে। জুবায়ের মাফ চায়, এরকম আর করবেনা বলে জানায়, ওকে ছেড়ে দিতে বলে, বাচাতে বলে। প্লাবন ঐ সময়ে সেখানে ছিলো। প্লাবন জুবায়েরের ঘটনায় ২২ দিন জেল ও খাটে। জেল থেকে জামিনে মুক্ত হয়ে ও আমার গেরুয়ার বাসায় এসেছিলো। ১ দিন থেকে পরে ওর গাইবান্ধার বাড়িতে গিয়েছিলো। জুবায়েরের ঘটনা আর জেলখানার ভেতরের কিছু বিষয় আমি ওর কাছে জানতে পারি।

প্লাবনের বক্তব্য সরাসরি কোট করা সম্ভব নয়। তবে মূল বক্তব্য ছিলো এইরকম, পরীক্ষা দিয়ে ও সমাজবিজ্ঞান থেকে হলের দিকে যাচ্ছিলো। পথিমধ্যে জুবায়েরকে কয়েকজন মিলে ফিজিক্স-কেমিস্ট্রির রাস্তাটা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলো। জুবায়ের ওকে দেখে ডাক দেয়। জুবায়ের ওদের হাত থেকে ওকে ছাড়িয়ে নিয়ে যেতে বলে। প্লাবন জুবায়েরকে নিয়ে যেতে নিষেধ করে। কিন্তু যারা নিয়ে যাচ্ছিলো তারা প্লাবনের কথা শুনে না। প্লাবন ওদের সাথে সাথে বিজ্ঞান কারখানা পর্যন্ত যায়। জুবায়ের প্লাবনকে প্রায় জোর করেই ওর সাথে নেয়। বিজ্ঞান কারখানার পেছনে আরো কয়েকজন আগে থেকেই মজুত ছিলো রড-লাঠিসোটা নিয়ে। তারা প্রথমে হাতে মারে, পরে রড-লাঠি দিয়ে মারে। এমনকি জুবায়েরকে হাত দিয়ে আগলাতে গিয়ে প্লাবন নিজেও দুইএকটা মাইর খায়। প্লাবনের ধারনা ছিলো দুইএকটা মাইর দিয়ে ছেড়ে দিবে।

মাসুদের বিষয়টা জিজ্ঞাসা করলাম, প্লাবন বললো- ‘মাসুদের বিষয়টাতো আরো লেইম। যেমন আমি কোনো পরিস্থিতির মধ্যে পরে গিয়েছিলাম। সেখানে না পারছিলাম থাকতে, না পারছিলাম বের হয়ে যেতে। তো সেখান থেকে বের করে নিয়ে আসতে আমি মাসুদকে ফোন দেই। প্রথমে ফোন দেই রিজনকে। রিজনের ফোন বন্ধ দেখায়। তারপর আমি মাসুদকে ফোন দিয়ে বলি বিজ্ঞান কারখানার পেছন থেকে যেন আমাকে এসে নিয়ে যায়। মাসুদ তখন হলে ছিলো। মাসুদ একটা রিক্সা নিয়ে আসে। রিক্সা রাস্তায় দাড়া করিয়েই বিজ্ঞান কারখানার পেছনে আসে, আমার হাত ধরে টেনে আমাকে সেখান থেকে বের করে নিয়ে রিক্সায় তোলে। আমরা হলে আসি। মাসুদ ঘটনাস্থলে ছিলো ১৫-২০ সেকেন্ড। এরপর জুবায়েরের বিষয়ে আমি আর কিছু জানি না।’

পরদিন সকালে ভিসির অফিসে প্লাবনসহ কয়েকজনকে ডাকা হয়। প্রত্যেকের সাথে আলাদা আলাদা কথা বলা হয়। প্লাবনের সাথে কথা বলে তৎকালীন প্রোভিসি ফরহাদ স্যার। প্লাবন যা যা ঘটেছে, দেখেছে সব বলে। প্লাবনকে বলা হয় তাহলে তুমি স্টেটমেন্ট দাও, সাক্ষী হয়। তোমার নিরাপত্তার বিষয়টা, তুমি যেনো না ফাসো সেটা ভার্সিটি দেখবে। প্লাবন ভার্সিটি কর্তৃপক্ষের কথামতো কাজ করে, কিন্তু যখন মামলার আসামী সাজানো হয় তখন প্লাবন-মাসুদের নাম সহ আসামীর কাগজ জমা দেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এখানে মূল রাজনীতিটা করে প্রশাসন।

প্রশাসনের রাজনীতি করার আরো বেশ কিছু নজির আছে। এই আন্দোলনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে উপাচার্য ছাত্রলীগকে দিয়ে সাংস্কৃতিক জোটের নেতাদের মার খাওয়ায়। মার খাওয়া নেতাদের আবার শিবির বলে হেনস্তা করারও চেষ্টা করে। এই পরিকল্পনাটা মনে হয় শরীফ এনামুল কবিরের নিজের। ওদের শিবির বললে ওরা নৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে যাবে, কারণ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃতি সবসময়ই শিবির বিরোধী। সমস্যা হয় বেশ কয়েকজন হিন্দুধর্মাবলম্বী এই সময়ে মার খায়। আর যারা মার দেয় তারা ভিসির খুব কাছের লোক বলে চিহ্নিত। এই মারামারির ফলে মূলত প্রশাসন আরো বিপাকে পরে। যাদের মারা হয় তাদের শিবির বলে কোনো প্রমান দিতে পারেনি আবার তারমধ্যে সাংস্কৃতিক জোটের নেতারাও ছিলো। ফলে আন্দোলন আরো বেগবান হয়।

এছাড়া কিভাবে যেনো আন্দোলনের খবরাখবর লিক হতে থাকে। আজকে আন্দোলনকারীরা কি করতে যাচ্ছে এটা আগে থেকেই প্রশাসন জেনে যাচ্ছিলো। আন্দোলনকারীদের জন্য এটা একটা খারাপ লক্ষণ। তখন আমার বেশিরভাগ সময় কাটতো বটতলায় বসে থেকে। সে সময়েই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে হয়ত সর্ব বৃহৎ মশাল মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। এতো বড় মশাল মিছিল করা কেবল ছাত্রজোট বা সাংস্কৃতিক জোটের পক্ষে করা সম্ভব না। সাধারণ ছাত্রদের ব্যাপক সমর্থন ছিলো এই আন্দোলনে। উপাচার্যের কর্মকাণ্ডের কারণে জুবায়েরের হত্যাকাণ্ডবিরোধী আন্দোলন রূপ নেয় ভিসিবিরোধী আন্দোলনে। শরীফ এনামুল কবির টিকে থাকার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন। কিন্তু ছাত্রদের অনড় অবস্থানের জন্য গদি থেকে সরে যেতে বাধ্য হন।


অসমাপ্ত... 

13 January 2020

আতুরঘরে মৃত্যু অথবা হিজলের লাল : পর্ব- ৭, ৮

৭.


তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শিক্ষা উপদেষ্টা ছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আলাউদ্দিন স্যার। আর তার নিকটস্থ বলে পরিচিত শরীফ এনামুল কবির হলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। প্রথম যখন তিনি উপাচার্য হন তখন তার ব্যাপারে সব ভালো ভালো কথা শুনি। পৃথিবীবিখ্যাত রসায়নবিদ, আন্তর্জাতিক জার্নালে রসায়ন বিষয়ে সবচেয়ে বেশি প্রবন্ধ ছাপানো বাংলাদেশী ইত্যাদি। কিন্তু রাজনীতির মাঠেও তিনি পরিপক্ক, অবশ্য এখনকার উপাচার্য ফারজানা ইসলামের তুলনায় উনার ক্রীড়ানৈপুন্য শিশুবৎ। শুধু উনি না, ঢাকায় রাজনীতির মাঠকাঁপানো ভিসি আনোয়ারও এখনকার ভিসির তুলনায় দুগ্ধপোষ্য শিশু।

জিতুদা একবার বলেছিলেন- ‘ছাত্রলীগে ৩-৪ টা গ্রুপ হওয়া খুবই স্বাভাবিক। গ্রুপ না থাকাই অস্বাভাবিক।’ তো সেই স্বাভাবিক নিয়মানুসারে হলে ছাত্রলীগের দুইটা গ্রুপ হয়ে গেলো। একগ্রুপে শাফিন ভাই আরেকগ্রুপে শামীম ভাই। শাফিন ভাই ছাত্রলীগের সেন্ট্রাল কমিটির সভাপতির সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে পেরেছিলেন। তখন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি ছিলো রিপন-রোটনের। আর শামীম ভাইয়ের সাথে ভালো সম্পর্ক ছিলো ক্যাম্পাসের উপাচার্যের। ৩৩ এর আসিফ ভাই, ৩৪ এর ফরহাদ ভাই, বাপ্পী ভাই এরা শাফিন ভাইয়ের সাথে যোগ দিলেন। আর এদিকে ৩৪ এর শরীফ ভাই, জিতুদা এরা শামীম ভাইয়ের গ্রুপে। যাই হোক এর প্রভাব আমাদের মধ্যেও পরেছিলো।

আমরা ৩৭ গ্রুপিং নিয়ে হলে মিটিং এ বসলাম। সব ব্যাচ এ গ্রুপিং হচ্ছে, ৩৭ এও হবে। কি করা যায়, তাই নিয়ে মিটিং। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম কে কোন গ্রুপে যাবে এটা নিয়ে হাত তোলা হবে। আমাদের মধ্যে গ্রুপিং হবে কিন্তু আমরা কোনোদিন নিজেরা নিজেদের সাথে মারামারি করবো না। যে গ্রুপ টিকে থাকবে তারা অপর বন্ধুদের ক্লাস-পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ করে দেবে। তারপর যখন আমরা সিনিয়র হয়ে যাবো তখন গ্রুপ তুলে দিয়ে একটা গ্রুপ হয়ে যাবো। আমি, প্লাবন, মাসুদ আর রিজন শামীম ভাইয়ের পক্ষে হাত তুললাম। আমাদের বন্ধু কালাম, সেতু, নাজমুলসহ আর যারা বাকি ছিলো সবাই শাফিন ভাইয়ের সাথে। তিলন মিটিং এ ছিলো না। ওকে ফোন দেয়া হলো- ‘তুই কোন গ্রুপে যাবি?’ তিলন বললো- ‘শামীম ভাইয়ের লগে...’ মিটিং শেষ করে আমরা হাত মেলাতে মেলাতে বের হলাম। যে যার বড় ভাইয়ের কাছে যাবো এখন। আমরা শরীফ ভাই আর জিতু ভাইয়ের কাছে গেলাম। ‘ভাই, আমরা আপনাদের গ্রুপে...’ ভাইরা হাসতে শুরু করলো- ‘মিটিং কইরা গ্রুপিং করছস...!’

শেষপর্যন্ত ৩৭ এর সুসম্পর্ক থাকেনি। ৩৭ মারাত্মক পলিটিকাল ব্যাচে পরিণত হয়। এর মধ্যে ক্যাম্পাসে ৩৮ আসে। আমাদের ইমিডিয়েট জুনিয়র, আমরা খুব খুশি, যাক এবার সিনিয়র হলাম। ৩৮ নিয়ে পরে আলাপ দিবো। কিছুদিন পরেই ছাত্রলীগের কমিটি দেয়। কমিটিতে বঙ্গবন্ধু হলের ৩২ শাফিন ভাই সভাপতি, কামালউদ্দিন হলের ৩৩ সাম্য ভাই সেক্রেটারি। ছোট একটা কমিটি দেয়া হয় প্রথমে, পরে বড় করা হবে। কমিটি দেয়ার কয়েকদিন পরে আমরা বটতলায় কাদের ভাইয়ের দোকানে বসে রাতের খাবার খাচ্ছিলাম। হঠাৎ হলের নিচে হৈচৈএর শব্দ। আমরা হাত ধুয়ে যেতে যেতে দেখি, হল থেকে দৌড়ে সবাই বটতলার দিকে আসছে। কাকে যেনো জিজ্ঞাসা করলাম- ‘কি হইছে হলে?’ ‘জিতু-শরীফরে মারতেছে’ ‘কে...?’ ‘শাফিন-সামি’। ততক্ষণে হলের সামনে প্রক্টর আর এ্যাম্বুলেন্স চলে এসেছে। আমরা কামালউদ্দিন সালাম-বরকত হলের সামনে দিয়ে হেঁটে মেডিকেল গেলাম। আমাদের মেডিকেল তাদের বেশিক্ষণ রাখা হবে না। ঢাকা মেডিকেলে পাঠিয়ে দেয়া হবে। শামীম ভাইকে আগেই ঢাকা মেডিকেল পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। জিতুদা আর শরীফ ভাইকে যে এ্যাম্বুলেন্সে তোলা হলো সেখানে আমি আর প্লাবন উঠলাম। আমাদের সাথে ছিলো ৩৪ এর ভাস্করদা। রাত ১ টার দিকে আমরা ঢাকা মেডিকেল পৌছালাম।

আমি কয়েকদিন বাসায় থাকলাম সেসময়। তারপর একদিন তিলন ফোন দিয়ে বললো- ‘ক্যাম্পাসে আয়। সালাম-বরকত হলে উঠবো আমরা...’ আমি আর প্লাবন সালাম-বরকত হলে উঠলাম। সালাম-বরকত হলের ৩৩ এর পারভেজ ভাই শাফিন ভাই থেকে দুরত্ব বজায় রাখতেন, শামীম ভাই আর ভিসির সাথে তার ভালো সম্পর্ক ছিলো। কমিটি বড় হবে এমন আলাপ শুনছিলাম। কিন্তু সেই কমিটিতে ভিসিলীগের জায়গা হবে না এমনো শুনেছি। শামীম ভাই, পারভেজ ভাই, শরীফ ভাই এরা ভিসিলীগ হিসেবে সেন্ট্রাল কমিটির কাছে চিহ্নিত হয়েছেন। একদিন ৩২ এর শামীম ভাই সালাম-বরকত হলে সবাইকে নিয়ে বসলেন। বললেন- ‘স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা কঠিন। ছাত্রলীগ কমিটি পাইছে... কিন্তু আমাদের ছাড়া এই কমিটি কি টিকাইতে পারবে? এই দুইচাইরজনের কমিটি তো আমরা মাইরা বাইর কইরা দিবো... তখন আমাদের সাথে নিয়ে কমিটি দেয়া লাগবে। ভিসিস্যার আমাদের সাথে আছেন...’

দুই গ্রুপই ক্যাম্পাসে একচ্ছত্র আধিপত্য চাচ্ছিলো। একদিকে বঙ্গবন্ধু আর কামালউদ্দিল হল। অপরদিকে সালাম-বরকত আর আল-বেরুনি হল। এইসময় ক্যাম্পাসে বেশ কয়েকটা মারামারির ঘটনা ঘটে। এমএইচ হল বনাম সালাম—বরকত হল একটা ধাওয়া-পালটা ধাওয়া হয়। এমএইচ হল বটতলা পর্যন্ত আসে। ডেইরী গেটে এমএইচ হলের ছাত্রলীগ আইডিকার্ড দেখে দেখে মারে। যার আইডি কার্ডে সালাম-বরকত হল সে মার খাবে। সালাম-বরকত হলও ডেইরী গেটে যায়, এমএইচের ছেলেদের সেন্ট্রাল ফিল্ডে, ক্যাফেটেরিয়ায়-মুক্তমঞ্চে দৌড়ানি দেয়।

আল বেরুনিতেও দুইটা গ্রুপ ছিলো। একটা সভাপতির পক্ষে, আরেকটা সেক্রেটারির পক্ষে এরকম এক সময়ে সকালে নাস্তা করার সময় দুই গ্রুপের নেতার মধ্যে হালকা কথা চালাচালি হয়, সেখান থেকে হাতাহাতি। তারপর নিয়ে গিয়ে এক গ্রুপের নেতা ৩৫ এর এমিলি ভাইকে আল-বেরুনি হলের ৪ তলা থেকে ফেলে দেয়া হয়। দুই গ্রুপ প্রচণ্ড মারামারি করে। সেখানে প্রক্টর আসে, পুলিশ আসে, থমথমে পরিবেশ। ৩৫ এর মাহি ভাই তখনি ভিসি শরীফ এনামুল কবিরকে বলেন- ‘কেমন ভিসি আপনি? আপনার সময়েই এমিলিকে চার তলা থেকে ফেলে দেয়া হইছে, এইটা মনে রাইখেন স্যার... আপনেরে আমরা দেইখা নিবো...’ এটা বলার পর মাহি ভাই বহিষ্কৃত হন। প্রগতিশীল ছাত্রজোট আর সাংস্কৃতিক জোট ভিসিবিরোধী আন্দোলনে নামে। কিন্তু আন্দোলন তখন সফল হয়নি, ভিসি মাহি ভাইয়ের বহিষ্কারাদেশ তুলে নেয়।

আমরা যখন শরীফ ভাই জিতুদার সাথে হলের বাইরে ছিলাম, আমাদের বন্ধুরা তখন হলের ভেতরেই ছিলো। তাদের সাথে ছিলো জুবায়ের। শরীফ ভাই জিতুদা হল থেকে বের হওয়ার আগ পর্যন্ত জুবায়ের ওর অবস্থান পরিষ্কার করেনি। মারামারির পর থেকে ও শাফিন ভাইয়ের গ্রুপে।

৮.


জুবায়েরের হাতে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে এমন তালিকা করতে গেলে তা বিশাল হবে। তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে আশিক আর ভাইস্তা রাজু। ভাইস্তা রাজু সবাইকে ভাইস্তা ডাকতো, আমরাও সবাই ওকে ভাইস্তা ডাকতাম। ওর সাথে জুবায়েরের আগেই কি একটা বিষয় নিয়ে কথা কাটাকাটি হয়েছিলো, অতি সামান্য কারণ। কিন্তু সেই সামান্য কারণে জুবায়ের মারাত্মক প্রতিক্রিয়া দেখায়। সেসময় যারা হলে ছিলো অনেকেই এই ঘটনা মনে করতে পারবে। রুমে মারলে সমস্যা হবে মনে করে, ভাইস্তা রাজুকে বঙ্গবন্ধু হলের ছাদে নিয়ে গিয়ে মারা হয়েছিলো। সে যেনো আওয়াজ করতে না পারে সেইজন্য মুখে আন্ডারওয়্যার গুজে দেয়া হয়েছিলো। হাত-পা বাঁধা হয়েছিলো, সারা শরীর উলঙ্গ করে মারা হয়েছিলো। আমরা অনেকেই মাঝেমাঝে গুঙিয়ে উঠা শুনে ভেবেছিলাম, হয়ত শিয়াল ডাকছে। আশিককেও এভাবে মারা হয়েছিলো। আশিকের আঙুলের ফাঁকে পেন্সিল রেখে চাপ দেয়া হয়েছিলো। জুবায়েরের রুম হয়ে গিয়েছিলো- ‘থার্ড ডিগ্রি সেন্টার’

সবচেয়ে অবাক হয়েছিলাম অভি আর সিনার সাথে ঘটা ঘটনায়। আশিক আর ভাইস্তা রাজুর সাথে তো নাহয় পূর্বতন ঝামেলা ছিলো। অভিতো ডিপার্টমেন্টের বন্ধু আর সিনা দীর্ঘদিনের রুমমেট। অভির সাথে একবার মুরাদ চত্ত্বরে দেখা। আমি ডাক দিলাম- ‘দাদা...’ দাদা সবসময় হাসিখুশি থাকে, কতো ঝড়ঝঞ্ঝা গিয়েছে, মুখ থেকে হাসি সরে নাই। দাদা আমাকে ডাকে সাধু পুশকিন! যাই হোক দাদার মুখ বেজার। জিজ্ঞাসা করলাম- ‘কি হইছে দাদা?’ দাদা আশপাশ তাকিয়ে বললো- ‘ডিপার্টমেন্টে জুবায়েরের পার্ট বাইরা গেছে...’ ‘এইটাতো স্বাভাবিক... দাদা...’ ‘অয় কি করছে জানো?’ ‘কি করছে...’ ‘চেয়ারম্যানের রুমের সোফার কাপড় ছিড়া ফেলছে...’ ‘তারপর...’ ‘তারপর চেয়ারম্যান জিগাইছে কে করছে এই কাম, জুবায়ের কইছে অভি করছে...’ ‘তোমার নাম নিছে কেন... ফাঁসানোর জন্য...’ ‘না তো কি... চেয়ারম্যান আমারে রুমে ডাইক্কা সেই ঝাড়ি... ডিপার্টমেন্ট থেইকা বাইর কইরা দিবো... পাশ কইরা বাইর হইতে পারুম না... কতো কথা... সর‍্যি কইছি... সর‍্যিও শুনে না...’

আর সিনা ছিলো জুবায়েরের রুমমেট। একদিন হলের বেশিরভাগ ৩৭ গেস্টরুমে মিটিং এ বসেছে। সেই মিটিংগুলোতে সাধারণত সিনা অংশ নিতো না। ও তখন গানবাজনা নিয়ে ব্যস্তগিটার কাঁধে ফেলে ঘুরে বেড়ায়। টিএসসি, অডিটরিয়াম, ট্রান্সপোর্ট, শুপারিতলা, মেডিকেল এসব জায়গায় গান গায়। সিনা এইরকম কোথাও থেকে আসছিলো। হলে ঢোকার সময় জুবায়ের ওকে ডাক দেয়। ‘সিনা শোন...’ ‘বন্ধু...’ ‘তর বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে...’ ‘কি অভিযোগ...’ ‘তুই জুনিয়রদের নেশা করা শিখাইতেছস...’ ‘কোন জুনিয়ররে শিখাইছি...’ ‘আছে এইরকম জুনিয়র... তরে এহন নাম কওয়া লাগবো...’ ‘অভিযোগ আসছে... নাম কওয়া লাগবো না...’ ‘নাম কইতে আমি বাধ্য না... আমার কাছে অভিযোগ আসছে... আজকে থেইকা তর এগুলা বন্ধ...’ ‘আচ্ছা... বন্ধ... আর কিছু...’ ‘না... যা...’ ‘কিন্তু আমাদের মধ্যে তো অনেকেই নেশা করে... তাদের কি হইবো...’ ‘এহন যা তো সিনা... এগুলা আর করিস না...’ সবাই সিনা আর জুবায়েরের দিকে তাকিয়ে ছিলো। সিনা বুঝতে পেরেছিলো জুবায়ের নিজেই নেশগ্রস্থ আছে, তাই আর কথা বাড়ালো না।

আর কিষাণ, আমাদের কিষাণ। ৩১ এর বিলাশদা একদিন কাকতালীয়ভাবে কিষাণের রুমে এলেন, সার্চ করার জন্য। যা সার্চ করছিলেন সেটা ডেস্কের শেলফের উপরেই পেয়ে গেলেন, একটা শিশি। কিষনকে জিজ্ঞাসা করলেন- ‘কি এডা?’ কিষাণ জানেও না কি এটা, ‘আমি তো জানিনা দাদা... কি এটা? এইখানে কেন...’ ‘জানস না... প্যাথেড্রিন নেস... আর জানস না এডা কি...’ আমিসহ আরো অনেকে সেই শিশির দিকে তাকিয়ে থাকলাম, আমরা জীবনে প্রথমবার প্যাথেড্রিন দেখছি। দাদা বললো- ‘রড নিয়া আয়’ বলামাত্র হাতের কাছে রড উঠে এলো বিলাশদার। মারতে শুরু করলেন কিষাণকে। কিষাণ চিৎকার করে বলতে থাকলো, দাদা আমি জানিনা এইটা কি, দাদা আমি চিনিনা এইটা কি। মারা শেষ করে বিলাশদা বললেন- ‘আজকেই হল ছাইরা দিবি...’ সেদিন বিকালেই কিষাণ ওর ট্রাংক নিয়ে হল ছেড়ে যায়এই পুরো সময়ে একজনের মুখেই হাসি ছিলো। একজনই বিলাশদাকে কিষাণের রুমে নিয়ে এসেছিলো, শেলফের উপরে প্যাথেড্রিনের শিশি আছে বলে। একজনই বিলাশদার হাতে রড তুলে দিয়েছিলো। পাঠকদের জন্য রহস্য হিসেবে থাকলো নামটা।



অসমাপ্ত... 

9 January 2020

আতুরঘরে মৃত্যু অথবা হিজলের লাল : পর্ব- ৫, ৬

৫.


আমি, শাকিল, তিলন আর প্লাবন বিকালে ক্যাম্পাসে আসলাম, কামালউদ্দিন হলের সামনে। সেখানে ছাত্রলীগের বড়ভাইদের জটলা। বড়ভাইরা হাসিমুখে রড হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। জিতুদার সাথে প্রথম সেইদিন পরিচিত হয়েছিলাম। তিলন নিয়ে গেলো- ‘দাদা... এরা আমার ডিপার্টমেন্টের বন্ধু... আপনার হলের ছোটোভাই...’ দাদা বললেন- ‘বিড়ি খাস?’ আমরা ঘাড় কাত করলাম, দাদা বললেন- ‘এখন চা-বিড়ি খা... হলে উইঠা পরে কথা হবেনে... ঠিক আছে...’ ভাসানী হল থেকে স্লোগান ভেসে আসছে, ‘জিয়ার সৈনিক এক হও, লড়াই করো... তারেক জিয়ার ভয় নাই, রাজপথ ছাড়ি নাই...’ পুকুরের এপাশ থেকে স্লোগান শোনা যাচ্ছে। স্লোগান শুনে জিতুদা, সামি ভাই এরা হাসছে। তিলনকে জিজ্ঞাসা করলাম কি ব্যাপার ভাইরা হাসে কেন? তিলন বললো- ‘ভাসানী হলের দলের সাথে মিটিং চলে... মিটিং সফল হইলে এরা ছাত্রলীগে যোগ দিবো’। প্রথমে বুঝি নাই বিষয়টা, বললাম- ‘অ...’।

সন্ধ্যার দিকে মিটিং সফল হলো। ভাসানী হলের ৩৩ ব্যাচের ছাত্রদলের নেতা আসগর ভাই তার কর্মীদের নিয়ে ছাত্রলীগে যোগ দিলেন। ছাত্রলীগে যোগ দিলেন এটা বোঝানোর জন্য ভাসানী হলে আবার মিছিল হলো। এবার মিছিল থেকে আওয়াজ আসলো- ‘ছাত্রলীগের মূলনীতি... শিক্ষা, শান্তি, প্রগতি... জয় বাংলা... জয় বঙ্গবন্ধু... শেখ হাসিনার ভয় নাই, রাজপথ ছাড়ি নাই...’ আমরা রড হাতে দাঁড়িয়ে আছি। বঙ্গবন্ধু হলকে ছাত্রদল মুক্ত করতে হবে। ছাত্রদল ক্যাম্পাসকে দোযখ বানিয়ে ফেলেছে। এরা বাকি খায়, ফাফড় দেয়, ছাত্রলীগকে মিছিল করতে দেয় না, হলে থাকতে দেয় না, লীগের নেতাদের ক্লাস করতে দেয় না, পরীক্ষা দিতে দেয় না। হল থেকে ছেলেদের জোর করে মিছিলে পাঠায়। ইচ্ছার বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে বাধ্য করা হয়। মিছিলে না গেলে হল থেকে বের করে দেয়া হবে বলে জানায়। হলের গেস্টরুমে ডেকে গালাগালি করে, গায়ে হাত তোলে।

আমি তখন ছাত্র ইউনিয়ন করি, প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক। যাই হোক, সে আলাপ পরে। সেসময় ক্যাম্পাসে ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি ছিলেন ৩২ এর এসএম শুভ ভাই, তিনি বঙ্গবন্ধু হলে থাকতেন। তিনি বলতেন- ‘দল আর লীগ কি আলাদা হইলো নাকি... একই ত... একই রকম আচার-আচরন... কয়দিন পর বুঝবি’সেই সময়ে ক্যাম্পাসে ছাত্র ইউনিয়ন ছাড়াও ছাত্রফ্রন্ট, ছাত্র ফেডারেশন আর ছাত্র মৈত্রী ছিলো। ফ্রন্টের প্রিন্স ভাই, ফেডারেশনের ইরান ভাই আর মৈত্রীর অনিন্দ্য আরিফ ভাই, এরা ছিলেন নেতা। এদের আর কাজ কি? কোথায় কী হলো শুধু মিছিল করা। শুভ ভাই ছাত্রদলের নেতাদের সাথে কথা বললেন। ‘ছাত্রলীগকে হলে উঠতে দেয়া হোক, ক্লাস পরীক্ষা দিতে দেয়া হোক।’ ছাত্রদল বললো- ‘কি... লীগপন্থী ইউনিয়ন!’ শুভ ভাই ছাত্রলীগের নেতাদের সাথে কথা বললেন। ‘ছাত্রদলকে যেনো হল থেকে বের না করে দেয়া হয়। এরা যেনো ক্লাস-পরীক্ষা চালিয়ে নিতে পারে।’ ছাত্রলীগ বললো- ‘কি... দলপন্থী ইউনিয়ন!’ শুভ ভাই বলে- ‘দেখ তো... কি অবস্থা...’

তো আমরা রাত ৯টা সাড়ে ৯টার দিকে হলে ঢুকলাম। শিক্ষক আর পুলিশ সাথে ছিলো, কিন্তু এরা হলের ভেতর ঢুকেনি। হলের গেট তালা মারা ছিলো। পুলিশ গিয়ে গেটের তালা ভাঙলো। ছাত্রলীগের সবাইকে ঢুকিয়ে দিয়ে হল গেট খুলে দিলো। হল গেটের দায়িত্ব নিলো ছাত্রলীগের ভাইরা। হলে ঢুকেই সামি ভায়ের চিৎকার। ‘খানকির পোলারা কই সব? সবগুলারে জবাই করবো, মাইরা ফেলবো... মাদারচোদেরা হলে ঢুকতে দেয় না... দেখ, হলে এখন আমরা...’ ছাত্রদলের ভাইয়েরা আগেই হল থেকে পালিয়ে গেছে। হলের পেছনে ডাইনিং-ক্যান্টিনের ছাদ থেকে দড়ি ঝোলানো। সেটা দিয়ে সবাই হল ত্যাগ করে সম্ভবত গেরুয়ার দিকে গিয়েছে। হলে শুধু ৩৬-৩৭ এর ছাত্ররা। ৩৬ আর ৩৭ আসলে তেমনভাবে রাজনীতি করার সুযোগ পায়নি। একে জুনিয়র ব্যাচ, তার উপর আবার বোঝানো হয়েছে বন্ধু আর ইন্টিমেসি। নেতাগোছের কাউকে না পেয়ে ছাত্রলীগের কারো কারো মাথা খারাপের মতো হয়ে গেলো। কাকে পিটাবে? কাকে হাড্ডি ভেঙে মনের ঝাল মেটাবে? সব রাগ গিয়ে পরলো- ৩৬ আর ৩৭ এর ছাত্রদের উপর। সামি ভাই রেগে গিয়ে বললো- ‘খুইজা বাইর কর, খানকির পোলাগো কার কার লগে ভালো সম্পর্ক আছিলো...’

হলে ঢুকে দেখি জুবায়ের চকোলেট কিনে নিয়ে বসে আছে। ছাত্রলীগের বড়ভাইদের কাউকে কাউকে ও চিনতো। এছাড়া তিলনের সাথেও ওর আলাপ দেয়া ছিলো। ছাত্রলীগ হলে উঠলে ও ছাত্রলীগ করবে। ও সবাইকে চকোলেট বিল্লাছে। আমরা অবাক হলাম। কারন ছাত্রদলের বড়ভাইদের সাথে ওর সম্পর্ক ভালো ছিলো। এখন চকোলেট হাতে নিয়ে ও সামি ভাইকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলো, ‘ভাই এতোদিন কোথায় ছিলেন... আমরা খুব কষ্টে ছিলাম...’ এইরকম ভোল পালটানো দেখে প্লাবন আমাকে ফিসফিসিয়ে বললো- ‘দেখ... কেমন পদের মাদারচোদ...’ ছাত্রলীগ হলের সবজায়গায় গার্ড বসিয়েছে। গেটে, ছাদে, হলের পেছনের দিকে ক্যান্টিন-ডাইনিং এ। আমরা যখন ডাইনিং এর দিকে ছিলাম তখন বিলাসদা আসলো। বললো- ‘এ জিতু কিডা... রাজু... অভি...’ তিলন দাদাকে বললো- ‘এরা তো ৩৭ দাদা।’ ‘এরা নাকি দল চোদাইছে...’ ‘না দাদা। ৩৭ এ কোনো দল নাই। এমনি বন্ধু-বান্ধব...’ ‘যাই হোক খুইজা বাইর কর। আছে নাকি পলাইছে...’ বড় নেতাদের ঝাল সব গিয়ে পরলো এদের উপর। ‘কই তগো বড়ভাইরা? সব পলাইছে... আর তগোরে রাইখা গেছে মাইর খাওয়ার লেইগা... আর দল চোদাবি...’

৩৭ এ কারা কারা ছাত্রদলের ভাইদের সাথে ভালো সম্পর্ক রাখতো এটা খুজে বের করার জন্য সবচেয়ে আগ্রহী ছিলো জুবায়ের। ও নিজে জিতুর আব্বাকে ফোন দিয়েছিলো। ওর আগ্রহে জিতুর উপর নেমে আসে অত্যাচার। আমি যখন জিতুকে দেখি ওর এক চোখ ফুলে গিয়েছিলো, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাটছিলো। ওর আব্বা ওকে নিতে এসেছিলো পরদিন সকালে। সেই যে জিতু হল ছাড়লো এরপর আর হলে থাকেনি। ওকে শারীরিকভাবে হেনস্তা করেও চলছিলো না। ওর আব্বার কাছে বিচার ও দেয়া হয়েছিলো, ছেলে রাজনীতি করে, নেশা করে ইত্যাদি। জিতুর আব্বা সেদিন কোনো কথা বলেন নাই, ছেলেকে নিয়ে হলগেট থেকে বিদায় নিয়েছিলেন। আমরা হলের গেটেই নির্বাক দাঁড়িয়ে ছিলাম।

জুবায়েরের রুম ছিলো আমার রুমের সামনেই। কেমন যেনো একটা গোঙানির আওয়াজ আসে জুবায়েরের রুম থেকে। রাতে বটতলায় খেতে গিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলাম- ‘কিরে তর রুমে কিসের আওয়াজ? কেমন যেনো গোঙানি মনে হইলো...’ জুবায়ের মনে হলো বিব্রত হলো। বললো- ‘ও কিছু না...’ এরমধ্যে ডিপার্টমেন্টের বান্ধবী সোমা আমাকে ফোন দিলো। বললো- ‘তোদের হলে রাজু আটকা পরছে... ওর ফোন বন্ধ... মিকি টেনশন করতেছে...’। আমি বললাম- ‘মিকি কে?’ সোমা বললো- ‘আমার হলের বান্ধবী। রাজুর গার্লফ্রেন্ড...’ আমি খোঁজ নিতেছি বলে ফোন রাখলাম। হলে গিয়ে দেখি, জুবায়েরের রুম খোলা। সেখানে আরো কয়েকজন ৩৭ ছিলো। রাজুও ছিলো। রাজুকে দেখে মনে হলো বিপর্যস্ত। রাজু আমার দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিলো। নিজেকে খুব অসহায় লাগছিলো তখন।

আমি জুবায়েরকে ডেকে রুমের বাহিরে আনলাম। বললাম- ‘রাজুরে আটকাইছস কেন? ছাইরা দে।’ ‘অর লগে আমার হিসাব নিকাশ আছে...’ ‘কি হিসাব নিকাশ?’ ‘অয় ছাত্রদল করতো...’ ‘অয় যে হিসাবে ছাত্রদল করতো, সেই হিসাবে তো তুই ও ছাত্রদল করতি... ওরে ছাইড়া দে।’ জুবায়ের আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললো- ‘ঠিক আছে... সকালে ছাড়মু...’ আমি তিলনকে ফোন দিলাম- ‘কি ব্যাপার? জুবায়ের রাজুরে আটকাইছে...’ তিলন বললো- ‘হ... অর নাকি কি কথা আছে...’ ‘জুবায়ের ত অরে মারছেও...’ ‘মারার ত কথা না... কথা বার্তা কইয়া ছাইড়া দেয়ার কথা...’ ফোন রেখে ৩৪ এর শরীফ ভাইয়ের কাছে গেলাম। ‘ভাই... জুবায়ের রাজুরে রুমে আটকায়া রাখছে...’ ‘এখনো আটকায়ে রাখছে কেন, ছাইড়া তো দেয়ার কথা...’ সকালবেলা যখন রাজু হল ছেড়ে যাচ্ছিলো ওর ও চোখ-মুখ ফোলা, খুঁড়িয়ে হাটছিলো। আমার কাঁধে ভর দিয়ে রাজু হলগেটে আসে। ওকে একটা রিক্সায় তুলে দেই। এছাড়া আর কিছুই করতে পারিনি সেদিন। আজকেও জিতু, রাজু এদের কথা মনে হলে, অপরাধবোধে ভুগি, মনটা খারাপ হয়।



.


আমাদের সময়ে ক্যাম্পাসে সাধারন ছাত্রদের স্বার্থ দেখে রাখতো প্রগতিশীল ছাত্রজোট আর সাংস্কৃতিক জোট। প্রগতিশীল ছাত্রজোটে ছিলো ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রফ্রন্ট, ছাত্র ফেডারেশন আর ছাত্র মৈত্রী। আর সাংস্কৃতিক জোট ছিলো ক্যাম্পাসের সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর একটি কমন প্লাটফর্ম; এখানে ২টা জাহাঙ্গীরনগর থিয়েটার, ধ্বনি, আনন্দন, জলসিড়ি, বিতর্ক সংগঠন- জুডো এবং জাডস, ইউনিয়ন-ফ্রন্টের কালচারাল উইং- জহির রায়হান চলচ্চিত্র সংসদ, চারণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র সহ আরো অনেক সংগঠন ছিলো।

আমাদের প্রথম বর্ষে ছাত্র ইউনিয়নের সম্মেলন হয়। সম্মেলনের আগে ছাত্র ইউনিয়নের আহ্বায়ক ছিলেন কল্লোল বণিক দা এবং যুগ্ম-আহবায়ক ছিলেন এসএম শুভ ভাই। সম্মেলনের পর শুভ ভাই সভাপতি হন। শুভ ভাইয়ের কমিটিতে মাসুদ ভাই সেক্রেটারি আর রাজিব কর্মকার সাংগঠনিক সম্পাদক। আমার ব্যাচে আমি ছাড়া ছিলো বন্ধু সিনা আর জয়দ্বীপ। ওরা সদস্য ছিলো। এরমধ্যেই আমি হল থেকে বের হয়ে গিয়ে আবার সেদিনই হলে উঠি। কয়েকদিন পর শুভ ভাই আমাকে দেকে পাঠানশুভ ভাই তখন বটতলায় বসে ছিলেন। যাওয়ার পর আমার হাতে একটা কারণদর্শানোর নোটিশ ধরিয়ে দেয়া হয়। শুভ ভাই আমাকে বলেন- ‘তুই কি ছাত্রলীগ করা শুরু করছস?’ আমি বললাম- ‘না, ভাই...’ ‘তাইলে ছাত্রলীগের সাথে তরে বেশি দেখা যায়?’ ‘আমি থাকি প্লাবনের সাথে বেশি... আর কই দেখা যায়?’ ‘জিতু-শরীফের সাথেও ভালো সম্পর্ক...’ ‘ঐটুক ভালো সম্পর্ক তো আরো অনেকের আছে? তারা কি কারণদর্শানোর নোটিশ পাইছে?’ ‘না... তারা পায় নাই। তুই লিখিতভাবে জমা দিস...’ ‘আচ্ছা ভাই...’ বলে আমি চলে আসি। আসার সময় খেয়াল করি পাশের টেবিলে বসে জয়দ্বীপ হাসছে।

এর কয়েকদিন পর ছাত্র ইউনিয়নের সম্মেলন। সম্মেলনের আগে আমি কারণ দর্শাই, সম্মেলনে প্রথম অধিবেশনে গিয়ে সবার সাথে দেখা করে বিদায় নিয়ে আসি। রাজিবদা সভাপতি হবে বোঝা যাচ্ছিলো। আমাকে জিজ্ঞাসা করা হলো সেক্রেটারি কে হলে ভালো হয়? আমি বলেছিলাম- মাহি মাহফুজ। পরবর্তীতে মাহি মাহফুজ ভাইকে সহসভাপতি করে মুনা আপুকে সেক্রেটারি করা হয়। সেক্রেটারি হওয়ার পরপরই মুনা আপু ছাত্র ইউনিয়নে কোনো কারনে নিষ্ক্রিয় হয়ে যান। তবে মাহি ভাই খুব দক্ষতার সাথে ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতি করতে থাকেন। সহসভাপতি পদ নিয়ে উনার মধ্যে কোনো ধরনের প্রতিক্রিয়া কখনো দেখিনি। মাহি ভাই থিয়েটারও করতেন। তৎকালীন উপাচার্য শরীফ এনামুল কবিরের বিরুদ্ধাচরন করে বহিষ্কারও হয়েছিলেন। রাজিব-মাহির কমিটিতে জয়দ্বীপ সাংগঠনিক সম্পাদক হয়েছিলো।

আমি সম্মেলন থেকে বের হয়ে এসেই জিতুদার কাছে যাই। দাদাকে বলি- ‘দাদা, আমি এতোদিন ছাত্র ইউনিয়ন করছি... এখন ছাত্রলীগ করতে কি কোনো অসুবিধা আছে?’ দাদা বলেন- ‘না... কিসের অসুবিধা? যাও... গিয়া বন্ধুবান্ধবরে সময় দাও।’


অসমাপ্ত... 

6 January 2020

আতুরঘরে মৃত্যু অথবা হিজলের লাল : পর্ব- ৩, ৪


৩.


গেরুয়ার ঢালে রিক্সা ছিলোনা বা আমাদের হাতে টাকা ছিলোনা। যাই হোক আমি আর শাকিল হেটেই রওনা দিলাম। বটটলা শুনশান, কবির সরণি পাড় হয়ে বামে ঘুরতেই চোখে পরলো রেজিস্টারের সামনে জটলা। কাছে যেতে যেতে বিক্ষিপ্ত স্লোগানগুলো স্পষ্ট হচ্ছে। 'জুবায়ের মরলো কেনো? প্রশাসন জবাব চাই!' প্রশাসনের কেউ তখনো জবাব দিতে আসেনি। ফলত রেজিস্টার অবরোধের মুখে পরলো। সবাই কেমন ক্ষিপ্ত, আতঙ্কিত! রেজিস্টারে তালা ঝুলিয়ে দেয়া হলো।

স্লোগানে সবচেয়ে বিশুদ্ধ কণ্ঠ ছিলো আমাদের তুবার। ও যখন বলতো- 'জ্বালো জ্বালো আগুন জ্বালো', তখন মনে হতো আসলেই গিয়ে আগুন লাগিয়ে দেই। ও যখন বলতো- 'প্রশাসনের গদিতে, আগুন জ্বালো একসাথে', তখন মনে হতো আসলেই প্রশাসনের গদিতে আগুন লেগে গেছে। অনেক দূর থেকে শোনা যেতো তুবার আওয়াজ।

তুবা আর তৃণা, আমাদের দুইজন বান্ধবী ছিলো। তুবা নাটকে পড়তো আর তৃণা বিতর্ক করতো। আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজের চক্ষুশূল ছিলো এই দুই নারী। আমার অনেক ব্যাচমেট এবং বড়ভাই ওদের নিয়ে খারাপ কথা বলেছে। বলতো- 'দেখ, মাগিগুলা মিছিল করে, স্লোগান দেয়, রাজনীতি চোদায়, প্যান্ট-শার্ট পরে...' তুবা আর তৃণা আগেরমতোই স্বাধীনচেতা আছে। কিন্তু মাঝখান থেকে ঐ মানুষগুলোর মুখোশ খুলে গিয়ে আসল চেহারা বের হয়ে আসতোআগে খারাপ লাগতো, এখন মজা লাগে।

আর একজন ছিলো আমাদের ফিট কুমারী ফিবা। যেকোনো জাতীয় দুর্যোগে ও ফিট খেতো। আমাদের ফার্স্ট ইয়ারে নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের নিপীড়ক মাস্টার সানির বিরুদ্ধে একটা জোড়দার আন্দোলন হয়েছিলো। আমরা যেতাম বড় আপুদের গান শুনতে। তারা রেজিস্টার ঘেরাও করে কি সুন্দর গান গাইতো! 'ভয় কি মরনে... রাখিতে সন্তানে... মাতঙ্গী বেজেছে আজ... সমরে রঙ্গে...' তদন্ত কমিটি বসলো। তদন্ত কমিটি সানি মাস্টারের দোষ খুজে পেলো না, তারপরো তাকে বাধ্যতামূলক কয়েক মাসের ছুটিতে পাঠালো। আর এরই মধ্যে ফিবা ফিট খেলো। মেডিকেলে জ্ঞান আসার পর তুবা ফিবার পাশে দাঁড়িয়ে কাদতে কাদতে জিজ্ঞাসা করলো- 'ফিট খাইলি কেন?' ফিবাও কাদতে কাদতে বললো- 'আন্দোলনের রেজাল্ট... আমাদের বিপক্ষে গেছে...' তুবা বললো- 'ফল বিপক্ষে গেলেই তুই ফিট খাবি...' তারপর দুইজনই কাদতে থাকলো। সে এক হৃদয় বিদারক দৃশ্য।

রেজিস্টার ঘেরাওয়ের সময়েও যথারীতি ফিট খেলো ফিবা। বন্ধু লেলিন ওর পাশেই দাঁড়ানো ছিলো। 'এএএ... ফিবা ফিট খায়...' বলতে বলতে ফিবা ফিট খেলো। আন্দোলনকারীরা দুইভাগে বিভক্ত হয়ে গেলো। একভাগ রেজিস্টার আটকে রাখবে, আরেকভাগ ফিবাকে নিয়ে মেডিকেলে দৌড়াদৌড়ি করবে। লেলিন একটা রিক্সা ডেকে ফিবাকে তুলে নিলো মেডিকেলে যাওয়ার জন্য। জ্ঞান ফেরার পর ফিবা আবার এসে রেজিস্টারের সামনে বসে৷

সবাই একে অপরকে প্রশ্ন করছে, কে খুন করেছে? কে কে খুন করেছে জুবায়েরকে? কয়েকটা নাম ভেসে এলো। আশিক, ভাইস্তা রাজু, অরূপ, জাহিদ, সোহান, আকরাম। আকরাম! জাহাঙ্গীরনগর থিয়েটার অডি করে আকরাম। কবিতা লেখে, ছবি আকে। বাকি আর সময় বন্ধুদের সাথে কোরাসে গান করে আকরাম। সদা হাসিমুখ, দেখা হলেই বলতো- 'দোস'এই আকরাম খুন করেছে? এই আকরাম, নাকি অন্য কেউ?

 ৪.


আমরা যে সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই সেসময় ছাত্রদলের দখলে ছিলো হলগুলো। আমরাতো ছাত্রদল, ছাত্রলীগ বুঝিনা। আমাদের বোঝানো হলো, সবার উপর 'হল' সত্য, তাহার উপর নাই... হল মানে সেটা বঙ্গবন্ধু হল। ক্যাম্পাসে আর কিছু রবেনা, শুধু বন্ধুরাই থাকবে। এসময় আমরা শিখলাম ইন্টিমেসি আর বোকাচোদা। নিজের বন্ধুদের সাথে গিয়ে ইন্টিমেসি বাড়াতে হবে আর বাকি সব হলের পোলাপান তো বোকাচোদা।

আমরা ফার্স্ট ইয়ার গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরি। সেন্ট্রাল ফিল্ডে বসে হাওয়া খাই। মেহেরে বসে চা-সিগারেট খাই। হলের সব ব্যাচমেট একসাথে ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করি, গলা ফাটিয়ে স্লোগান দেই, পৃথিবীতে কোনো হল আছেএএএ... মেয়েদের হলের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় এই আওয়াজ আরো তীব্র হতো। ৫-৭ জন গ্রুপ করে ট্রান্সপোর্ট যেতাম অতি সিনিয়র বড়ভাইদের সাথে পরিচিত হওয়ার জন্য।

তো আমরা ছাত্রদল বুঝি না, ছাত্রলীগ বুঝি না। আমরা বুঝি বঙ্গবন্ধু হল, নিজের বন্ধুবান্ধব, হলের সিনিয়র ব্যাচ, ডিপার্টমেন্ট ইত্যাদি। তখন মধ্যে দেশে সেনাশাসন চলে। সেনাশাসন আওয়ামী লীগের চাপের মুখে নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়। নির্বাচনে বিএনপির গরমগরম ভরাডুবি হয়। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার সাথে সাথে ক্যাম্পাসগুলোর ছাত্রলীগ চাঙ্গা হয়ে ওঠে। এতোদিন যা যা ছাত্রদল করেছে এখন তা তা ছাত্রলীগ করবে। ছাত্রদল কি করেছে? তারা ভিসিকে দেখেশুনে রেখেছে, ক্যাম্পাসের যাবতীয় খরচে নিজেদের ফেয়ার শেয়ার নিয়েছে, বিরোধী মতকে দমন করেছে, দোকানে বাকি খেয়েছে, ফাফড় দিয়েছে, গ্রুপিং করেছে, মারামারি করেছে, হলকে অস্ত্র ও মাদকের গুদাম বানিয়েছে। ছাত্রলীগ কি করেছে?

যাই হোক আমরা এগুলো বুঝি না। তিলন আমাদের আগেই হালকা বলে রেখেছিলো। ক্যাম্পাসে গণ্ডগোল হতে পারে। ছাত্রলীগের ভাইরা ক্যাম্পাসে ঢুকেছে, প্রশাসনের সাথে সিটিং-মিটিং শেষ। প্রশাসন নিজে এসে তাদের হলে তুলে দিবে। আর হলের ছাত্রদল হল থেকে পালিয়ে যাবে। বঙ্গবন্ধু আর ভাসানী হল ছাড়া ইতিমধ্যে পুরো ক্যাম্পাস ছাত্রলীগের দখলে। বঙ্গবন্ধু হলের পোলাপানের ইন্টিমেসি বেশি, তাই হল দখল করতে দেরী হচ্ছে। আমাদের হলের ছাত্রলীগ ইন এক্সাইল আছে কামালউদ্দিন হলে।

একদিন সকালে, দিন মনে নাই এখন আর, মারামারি শুরু হলো। বটটলা থেকে ইটপাটকেল আসছে। বঙ্গবন্ধু হলের ছেলেরাও তেড়ে তেড়ে যাচ্ছে। আমি ঘুমাচ্ছিলাম। ততদিনে আমরা রুম পেয়েছি নিচতলায়, ১২১ নং রুম। ১০ জন এক রুমে। আমাকে ডাক দিয়ে তোলে প্লাবন- 'মাদারচোদ... তাত্তারি উঠ। হল এটাক হইছে...' বলেই ও গোসল করতে চলে গেলো।

আমি আর শাকিল বসে আছি৷ ৩৬ ব্যাচের কোন এক বড়ভাই রুমে এসে নক করলেন। বললেন- 'রুমে কতজন আসস তোরা?' বললাম- 'ভাই ৩ জন...' বড়ভাই ৩ টা রড নিয়ে ২-৩ মিনিট পর আসলেন। বললেন- 'বাইঞ্চোদগুলা আইছে হল দহল করতে... এতো সুজা... বঙ্গবন্ধু হল হইলো দুর্গ... ফোর্ট... হল দিমুনা... লীগের পুলাপানের পু*কি দিয়া...' বলে আমাদের হাতে রডগুলো দিয়ে উনি আবার গেইটের দিকে দৌড়ে গেলেন। এখন বুঝতে পারি ওগুলো ছিলো মোটিভেশন, আর রডগুলো দেয়া হয়ছিলো আত্মরক্ষার্থে।

আমরা রড হাতে নিয়ে বিছানায় বসে আছি। প্লাবন গোসল শেষ করে এসে দেখে আমাদের হাতে রড। বললো- 'রড রাইখা রেডি হ তাড়াতাড়ি। বাইরাইতে হইবো...' আমরা অতিদ্রুত রেডি হলাম। হলগেট দিয়ে বের হয়ে দেখি হলের একটা ভাগ নিচুবট দিয়ে হৈ হৈ করতে করতে সামনে এগিয়ে গেছে। আরেকটা ভাগ হলের সামনের ছাদে, ঢেলানোর জন্য ইট তুলছে। আমি, প্লাবন আর শাকিল ডানে বামে তাকিয়ে, বরাবর ফিজিক্সের রাস্তা ধরলাম। শহীদ মিনার এসে সিদ্ধান্ত নিলাম তিলনের বাসায় যাবো, ওর বাসা সাভার। ওকে ফোন দিলো প্লাবন। আমরা থানা স্ট্যান্ডের উদ্দেশ্যে ডেইরি গেট থেকে বাসে উঠলাম।

থানা স্ট্যান্ড নেমে দেখলাম তিলন স্ট্যান্ডেই। তিলন খবর পেয়েছে মারামারির। বললো- ‘আজকেই তো হল দখল হইবো। আমি যামু এখন। হলের বড়ভাইরা সব কামালউদ্দিনে।’ ছাত্রলীগ করার অপরাধে এরা এতোদিন হলের বাইরে ছিলো৩১ ব্যাচের বিলাসদা, ৩২ ব্যাচের শামীম ভাই, সামি ভাই, ৩৩ ব্যাচের আসিফ ভাই, হিমেল ভাই, ৩৪ ব্যাচের জিতুদা, শরীফ ভাই। ৩৫, ৩৬ ব্যাচের কেউ ছিলোনা। ৩৭ ব্যাচের একই বিভাগের আমরা ৪ জন। আমাদের এখানে ব্যাচের হিসাব চলে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার যতো বয়স হয়, আমাদের নতুন ভর্তির ব্যাচ ও তাই হয়। আমাদের ব্যাচ ২০০৭ এ ভর্তি হয়, কিন্তু ক্লাস শুরু করে ২০০৮ এর মার্চের ১৬ তারিখে। আমরা হই ক্যাম্পাসের ৩৭ ব্যাচ।

হল থেকে বের হয়ে গিয়ে তো কূলকিনারা পাচ্ছিনা। এখন কি আর হলে যেতে পারবো? হলে তো ঢোকাই যাবে না। তিলনের নাহয় বাসা সাভার। প্লাবনের গাইবান্ধা, শাকিলের ময়মনসিংহ, আমার যাত্রাবাড়ি। তিলন বললো- ‘ধৈর্য ধইরা বিড়ি-চা খা। আজকে রাইতেই হলে উঠুম। হল হাতে পামু।’ প্লাবন বললো- ‘এতো সহজ! হল হাতে আইনা দিয়া যাইবো তর?’


 অসমাপ্ত...