১.
আমি তখন বঙ্গবন্ধু হল
ছেড়ে গেরুয়া বাসা নিয়েছি। সারা রাত তামিল ছবি দেখে সকালে আর ক্লাসে যেতে পারিনা।
বন্ধু শাকিলও গেরুয়া থাকে। ও তাই প্রতিদিন সকালে এসে ঘুম ভাঙিয়ে ক্লাসে নিয়ে যেতো।
বাসার রুমগুলো ছিলো ঢালাও, সবার জন্য একটাই ওয়াশরুম। আমার রুমের দরজা
ছিলো লোহার। নক করলে প্রচণ্ড আওয়াজ হতো। রাতে তাই দরজা লক না করেই ঘুমাতাম সকালে
শাকিল এসে আগে একটা সিগারেট ধরাতো। সিগারেটের গন্ধে আর শাকিলের ডাকাডাকিতে ঘুম
থেকে উঠতাম। রুমের দরজা খোলা থাকতো এটা অবশ্য শাকিল আর নিকটস্থ কয়েকজন ছাড়া আর কেউ
জানতোনা।
সেদিনও শাকিল রুমে এসে সিগারেট ধরিয়েছে।
আমাকে আস্তে করে ডাকছে। আমি উঠতেই দেখি শাকিলের চোখ-মুখ বিষণ্ণ। আমি উঠে জিজ্ঞাসা করলাম- 'কি হইছে?' শাকিল বলে- 'জুবায়ের মারা গেছে।'
'কি বলো? কেমনে?'
'তুমি জানো না... কালকে ওরে মারছে। আজকে ভোরে ও মারা গেছে। পোলাপান রেজিস্টার আটকাইছে।'
'শাকিল কয়টা বাজে?'
আমার রুমে ঘড়ি ছিলো না, শাকিলের হাতে ঘড়ি- 'এগারোটা।'
'কি বলো? কেমনে?'
'তুমি জানো না... কালকে ওরে মারছে। আজকে ভোরে ও মারা গেছে। পোলাপান রেজিস্টার আটকাইছে।'
'শাকিল কয়টা বাজে?'
আমার রুমে ঘড়ি ছিলো না, শাকিলের হাতে ঘড়ি- 'এগারোটা।'
'একটু বসো... আমি আসি...' বলে আমি মুখ ধুতে গেলাম। তাড়াহুড়া করতে গিয়ে দাত মাজতেও মনে নাই। মুখে কোনোরকমে পানি দিয়ে এসে রেডি হলাম। শীত ছিলো, গায়ে সোয়েটার পরে রওনা দিলাম রেজিস্টারের দিকে।
২.
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম
বর্ষ,
বঙ্গবন্ধু হলের গণরুম। গণরুম মানে যে রুমে প্রথম বর্ষের
ছেলেপুলেরা গাদাগাদি করে থাকে। বঙ্গবন্ধু হলের গণরুমটা ছিলো মূলত হলের রিডিংরুম।
বিশাল রুম,
প্রায় ১০০ জন একসাথে ছিলাম। আমি প্রথমে হলে উঠেছিলাম
ডিপার্টমেন্টের বন্ধু রুমির সাথে। ও পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে গেলেও আমি থেকে
গিয়েছিলাম হলেই বাকীদের সাথে। ডিপার্টমেন্ট আর হলে আস্তে আস্তে বন্ধুত্ব গাঢ় হতে
থাকে।
গণরুমে সবার আলাদা
বেডিং,
কিন্তু কে যে কোথায় ঘুমাচ্ছে কোনো হিসাব নেই। একরাতে আমি
রুমির পাশে শুই, ঘুম ভাঙলে দেখি আমার পাশে অভি। অভি আমাদের
ব্যাচের সকলের প্রিয় দাদা। ও আমাদের মধ্যে সবার আগে হলে উঠে। বড়ভাইদের ও খুব
পছন্দের ছিলো, বন্ধুদেরও। অভি আমাদের হলের দুর্গাপূজার
পুরোহিত,
আবার রোজায় সেহেরী খাওয়ার জন্য ও ই সবাইকে ঝাকিয়ে ঝাকিয়ে
তুলতো। অভি যেখানে থাকতো সেখানে কেউ মন খারাপ করে থাকতে পারতো না, এখনো অভি দাদা এইরকমই।
রিডিং রুমে বেশিরভাগই
আমরা রাত জাগতাম। কয়েকগ্রুপ তাস খেলতো, কয়েকগ্রুপ
বটটলায় চা খেতো, ক্যাম্পাস ঘুরতো, কয়েকজন বড়ভাইদের র্যাগ খেতে যেতো, আর যৎসামান্য
কিছু ভালো ছেলে রুমের কোনায় মশারি টানিয়ে ঘুমাতো। আমাদের মধ্যে প্লাবন প্রথম কয়েকদিন
মশারি টানিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করেছে। ওর বাড়ি গাইবান্ধা, আমরা ওর কাছ থেকে বেশ কয়েকটা নতুন শব্দ শিখলাম। ভোঙ্গা, মাঙ্গু, আসিয়েন ইত্যাদি।
বঙ্গবন্ধু হলের গণরুম
এতো বড় ছিলো যে বাকি হলের বন্ধুরাও থাকতে আসতো। যতো রাতই হোক, কেউ না কেউ জেগে থাকতোই। বন্ধু মুন্না রাত জেগে হুমায়ুন আজাদের কবিতার বই
পড়তো। বিশেষ বিশেষ লাইন আমাদের পাঠ করে শোনাতো। বন্ধু সিনা গান গাইতো, ওর একটা কালো রঙের গিটার ছিলো। বন্ধু আজাদ আর রিপন গালিগালাজে দিনদিন পারদর্শী
হয়ে উঠছিলো। বন্ধু জিতু আর রাজু বড়ভাইদের বেশি কাছে চলে যাচ্ছিলো। বন্ধু জয়দ্বীপ
প্রচুর কথা বলতো, এক খাবলা পড়তো আর ১০ খাবলা চাপাবাজি করতো।
বন্ধু যুবায়ের তখন হলেই ছিলো। কারো কারো সাথে বন্ধুত্ব ছিলো, একটা প্রেম করতো। সে বড় সুখের সময়।
রাতজেগে আমরা বটটলায়
বসে থাকতাম। এখনকার পাপড়বিক্রেতা আনিস ভাইয়ের তখন দোকান ছিলো উঁচু বটে। সে রাত ৪
টায় একটা ট্যালট্যালা খিচুড়ি রান্না করতো। গরম গরম পরিবেশন করতো এছাড়া এই খিচুড়ির
আর কোনো মাহাত্ম্য নাই, না ঝাল, না লবন, না আর কিছু! আর একটা সিঙ্গারা পাওয়া যেতো তার দোকানে। ঐ
সিঙ্গারাটা পাওয়া যেতো রাত ১২ টা থেকে ৪ টা পর্যন্ত। আনিস ভায়ের ঐ সিঙ্গারাটা ছিলো
পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট সিঙ্গারা, ১ টাকা দাম। আমরা
ঐটাকে ডাকতাম 'বালিকার সদ্য গজিয়ে ওঠা স্তনের ন্যায়
সিঙ্গারা'!
এছাড়া বটটলার রাতজাগা
পাখিদের মধ্যে ছিলো হাসু ভাই। সে বানাতো চা, পৃথিবীর সবচেয়ে
খারাপ চা। তার দুধচায়ে না থাকতো দুধ, না থাকতো চা।
চালধোয়া পানিও হাসু ভায়ের দুধ চায়ের চেয়ে গাঢ় হবে বলে আমরা বিশ্বাস করতাম। ঐদিনও
এক বড়ভাই হাসু ভায়ের দোকানে এসে বললেন- 'হাসু ভাই তুমি
কি আগের মতোই চা বানাও?' হাসু ভাই খুশি হয়ে গেলো- 'হ ভাই...
দিবো এক কাপ?' ভাই বললো- 'আগের মতো বানাইলে থাক। দেয়ার দরকার নাই...'
নির্মম নিষ্ঠুরতায়
হাসু ভাই অন্যদিকে মনোযোগ সরিয়ে নেয়। এখন হাসু ভাই কেমন চা বানায় কে জানে? হলের ভেতর একটা দোকান ছিলো। ঈমান আলীর দোকান। তার ঝোক ছিলো বডি বিল্ডিং এ।
সকালে রুটির সাথে ডিমপোচ দেয়ার আগে ও দুইটা বুকডন দিতো। বলতো- 'ভাই...
নিয়ত করছি ডিম দেয়ার আগে দুইটা কইরা বুকডন দিমু।'
শুধু কি ছাত্র আর
দোকানদারেরাই? না শিক্ষকও ছিলো। আমাদের অনেক সিনিয়র এক
বড়ভাই ঢোলঢোলা একটা প্যান্ট আর একটা শার্ট পরে বটটলায় খেতে যেতো। তার ব্যাচের
বেশিরভাগ ছাত্রই হল ছেড়ে দিয়েছে। উনি ছাড়েননি কারন উনি ভালো ছাত্র, যেকোনো দিন বিভাগে শিক্ষক হবেন। শিক্ষক হওয়ার পর উনার রাতারাতি চেঞ্জ। ইন করা
ছাড়া শার্ট পরেন না। উনি শিক্ষক হওয়ার আগে আমরা উনাকে ভাই ডাকতাম। শিক্ষক হওয়ার
পরও মাঝেমাঝে দেখা হয়, আমরা ভাই ডাকি, উনি বিব্রত হন। আমাদের বন্ধু তিলন বললো- 'ভায়ের ব্রত আছে, ভাইকে বিব্রত করো না।' তিলন ভাইয়ের জন্য একটা প্রকল্প হাতে নিলো।
ভাই যখন একলা থাকে, তখন তাকে স্যার ডাকে ও। লম্বা সালাম দিয়ে
তিলন ঘার কাত করে বলতো- 'স্যার ভালো আছেন?' আর যখন ভাই তার ছাত্রদের সাথে দাঁড়িয়ে থাকতো তখন তিলন জোরে ডাক দিতো- 'ভাইইই...'
ভাই কাম স্যার, তিলনের এই অত্যাচার বেশিদিন নিতে পারে নাই। ১ মাসের মাথায় তিলনকে ডেকে বলছে- 'তুমি আমাকে ভাই ই ডাইকো তিলন।'
শাকিলের সাথে আমার
প্রথম কথা হয়েছিলো মোটামুটি এরকম- 'তুমি কি বুদ্ধদেব বসু
পড়ছো?'
-'হুম্ম। তুমি কি অমিয় চক্রবর্তী পড়ছো? 'হুম্ম। তুমি কি আরজ আলী মাতুব্বর পড়ছো?' 'হুম্ম...' এই হুমহাম দিয়ে আমাদের কথা শুরু হয়েছিলো। তারপর কেবল সুখস্মৃতি। প্রত্যেক
ক্লাসটেস্টের আগে আমরা বাংলায় পয়েন্টগুলো বুঝে নিতাম। তারপর মনের মতো করে ইংরেজিতে
লিখতাম৷ বেশিরভাগ সময় আমাদের পয়েন্ট বুঝিয়ে দিতো সৈকত। আমি, শাকিল,
হৃদয়, প্লাবন, দুই তানভীর আলাপ আলোচনার মাধ্যমে পয়েন্ট সাজাতাম। আর ফাইনালে চলতো আমার আর শাকিলের
প্ল্যান। বসতাম গ্রুপ স্টাডির নিয়তে কিন্তু সেটা আর থাকতোনা। ফার্স্ট ইয়ারে
প্ল্যান করলাম আমি আর শাকিল একটা যৌথ বই লিখবো। বইয়ের নাম- 'ছোটোদের লোক প্রশাসন।' সেকেন্ড ইয়ারের প্ল্যান- 'ছোটোদের ম্যানেজমেন্ট।' থার্ড ইয়ারের প্ল্যান- 'সহজ ব্যবসায় নীতি ও প্রয়োগ।' কোন ইয়ারে যেনো
চ্যাপ্টারের নাম সহ প্ল্যানের আউটলাইনও গুছিয়ে ফেলেছিলাম। এখন আর মনে নাই, শাকিলের মনে থাকতে পারে৷
বিশ্ববিদ্যালয়! কি সুখের জীবন! আমরা ভাবতাম বেহেস্তে এসে পরেছি। বেহেস্তেও
কি এইরকম থাকবে? এইরকম কুয়াশা, এইরকম বৃষ্টি, ছাতিমের ঘ্রাণ; কৃষ্ণচুড়া, রাধাচূড়া, সোনালু, জারুলের ফুল পরে থাকা রঙিন রাস্তা! রাতভর
ক্যাম্পাসের রাস্তায় হাটাহাটি, সকালে গেরুয়ার দইচিড়া
খেয়ে গিয়ে ঘুমানো, সুইজারল্যান্ড, সিডনি,
বোটানি, এমএইচ থেকে টিএসসির
রাস্তা,
অডিটোরিয়াম, মুক্তমঞ্চ, ক্যাফেটেরিয়া, মেহের চত্ত্বর, চৌরঙ্গী থেকে বিশমাইলের রাস্তা, পুরান কলা, ট্রান্সপোর্ট।
সুখের জীবন কি থাকে
চিরকাল?
No comments:
Post a Comment