৯.
প্লাবনের একবার মনে
হলো কবিতা লিখবে। কিন্তু কবিতা কিভাবে লিখবে? কবিতা লেখার
প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে ও নীলক্ষেত থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গীতবিতান আর কাজী
নজরুল ইসলামের সঞ্চিতা কাব্যসংকলন কিনে নিয়ে আসলো। কবিতা লিখতে বসার আগে দুইটা বই
খুলে নিয়ে বসতো ও। তারপর দুইটা বই থেকেই কিছু কিছু পড়তো। এক-দুই পাতা পড়ার পর ওর কবিতা লেখার বেগ চাপতো। ওর প্রথম লেখা কবিতার প্রথম লাইন
এখনো মনে আছে আমাদের৷ 'বিষ ঢেলে দাও, বিষ ঢেলে দাও মম অন্তর মাঝে...' আমি, শাকিল,
পুইয়ান সবার রুমে রুমে গিয়ে বলে আসলাম এই ঘটনা, সবাই হাসতে হাসতে শেষ।
আমাদের আরেক বন্ধু
ছিলো পরিসংখ্যানের ফারুক। আমরা রুমমেট ছিলাম। একবার বিকালবেলা আমি, শাকিল,
প্লাবন, হৃদয় এবং সৈকত হালকা
ভেষজ দ্রব্যাদি সেবন করে রুমে আসলাম। রুমে এসে দেখি ফারুক পড়ছে। ও তখন তাবলীগ করা
শুরু করেছে। দুনিয়ার দুষ্ট ফারুক তাবলীগ শুরু করলেও দুষ্টামি ছাড়তে পারেনি। আমি
ওকে বললাম-
'আরবের ভূরাজনীতি বুঝস?' ও বললো' 'না...'
আমি ওকে চেপে ধরলাম- 'না মানে? তাবলীগ করবি আর আরব সম্পর্কে জানবি না মানে... তরে কই দাড়া...' তারপর ওকে চেপে ধরে প্রায় ১ ঘন্টা
আরবের ভূরাজনীতি বোঝালাম। মহানবী, খুলাফায়ে রাশেদীন, উমাইয়া খেলাফত, আব্বাসীয় খেলাফত, সৌদি আরব, ইরান, সিরিয়া, তুরস্ক, মিসর যখন ঘুরছিলাম, ফারুক তখন বলে- 'দোস্ত, আর না...'
আমি আরো চেপে ধরে বলি- 'আর না মানে... তরে জানাই লাগবো...' পরে পাশের বেড থেকে হৃদয় আর শাকিল
হাসাহাসি শুরু করে। বলে- 'আজকের মতো ওর ভূগোলের ডোজ কমপ্লিট
দোস্ত,
অরে ছাইড়া দে... আছরের আজান দেয়...' পরে অকে ছেড়ে দেয়া হয়।
একবার আমাদের
ডিপার্টমেন্টে এক খান্ডাশী ম্যাডাম এসেছিলো। ৩৬, ৩৭,
৩৮ এর অনেকেই তাকে মনে করতে পারবে, তার নাম নুসরাত জাহান চৌধুরী। সে আগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন
বিভাগে ছিলো, আমাদের বিভাগে এক-দেড় বছর স্টপেজ দিয়ে পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যায়। এই এক-দেড় বছর সে ডিপার্টমেন্টে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। তার কিছু নিয়ম প্রাইমারি
স্কুলের নিয়ম হওয়ারও যোগ্য ছিলো না। যেমন- ক্লাসে নিয়মিত
আগের ক্লাসের পড়া ধরা, ক্লাসে প্রশ্ন করা যাবে না, ক্লাস শুরু হলে ক্লাসে ঢোকা এবং বের হওয়া যাবে না, ক্লাস শুরু হলে দরজা আটকে দেয়া ইত্যাদি। সে ক্লাসে এসেই প্রথম ১৫ মিনিট সময়
নষ্ট করতো-
তোমরা কিছু বোঝো না, তোমরা কিছু
পারো না,
তোমরা কিছু জানো না, গাধাদের পড়াইতে
আসছি,
তোমরা জীবনে কি করবা ইত্যাদি ইত্যাদি। তারপর সে তার পূর্বতন
নোট করা ডায়েরিটা বের করতো, সেখানকার কিছু পয়েন্ট আলোচনা করতো। পরীক্ষায়
আবার তার পয়েন্টের বাইরে কোনো পয়েন্ট দেয়া যেতো না। যারা তার পয়েন্টগুলো মুখস্থ
দিতে পারতো তারাই তার কাছে ভালো ছাত্র ছিলো।
যাই হোক আমি আর শাকিল
একবার ম্যাডামকে নিয়ে আলাপ করতে করতে হেটে গেরুয়া যাচ্ছিলাম। হঠাৎ কোন প্রসঙ্গে
যেনো বললাম- 'নুসরাত জাহান চৌধুরী তো আমাদের
ঘাড়ে পারা দিয়া পু*কি মারতেছে...' শাকিল বললো- 'হেই মিয়া... ঘাড়ে পারা দিয়া পু*কি কেমনে মারে... এইটা তো অসম্ভব... অসম্ভব কথা বলো মিয়া...' 'শারীরিকভাবে সম্ভব না হইলেও মানসিকভাবে সম্ভব...' তারপর আমরা হাটতে হাটতে গেরুয়ার ঢাল বাইলাম।
আরেকবার, বেনসনের দাম তখন মনে হয় ১০ টাকা। মাসের শেষ, আমাদের কারো হাতে তেমন টাকা নাই। সবার টাকাই বাসা থেকে আজকে আসবে, কালকে আসবে করছে। আমাদের সৈকত এমন সময় ক্লাসে চাদা তুললো। ১ টাকা, ২ টাকা করে চাদা তুলে ১০ টাকা করলো। তারপর টারজান পয়েন্ট থেকে ১টা বেনসন কিনে
নিয়ে আসলো। ফ্যাকাল্টিতে আমাদের সিগারেট খাওয়ার আলাদা জায়গা ছিলো। সমাজবিজ্ঞান
ভবনের ৫ তলায় উঠার সিড়ি। আমরা ৪ তলায় ক্লাস করতাম, ঐ সিড়ি খুব কাছে ছিলো। শুধু কাছে না, সেইফ এন্ড
সিকিউর। আমরা ঐ জায়গার নাম দিয়েছিলাম 'গ্যাসচেম্বার'। চেম্বারের জন্য আমাদের আলাদা 'নিখিল
লোক প্রশাসন বায়ুসেবনকারী কমিটি' ছিলো। কমিটির স্থায়ী সদস্য ছিলাম আমি, শাকিল, প্লাবন, তিলন, সৈকত, হৃদয় আর চশমা তানভীর। শামীম, শুভ, সুষম আর আরেক তানভীর ছিলো গেস্ট মেম্বার। তো সৈকত সিগারেট কিনে চেম্বারে নিয়ে
আসলো। একটা সিগারেট, অনেক ভোক্তা। সৈকত সিগারেটটার ফিল্টারের দিকে
আগুন ধরালো। আমরা সৈকতের দিকে তাকিয়ে থাকলাম।
আমাদের মুন্না
লাইব্রেরীতে পড়াশোনা করতো। তখন এরকম বিসিএসের পড়া পড়তো না লাইব্রেরিতে। অন্য অনেক
কিছু পড়তো-
তত্ত্ব, সাহিত্য, আউট বই। মুন্না একদিন হঠাৎ বলে উঠে- 'তিলন খালি
রাজনীতিই কইরা গেলো, বোকা*দা...'। বলে দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়লো। আবার তিলন একদিন কথা
বলতে বলতে কি বিষয়ে যেনো বললো- 'এইযে মুন্না
অরা বোকা*দার মতো খালি পইড়াই গেলো...'। আমি এই দুই 'ব' এর মাঝখানে পরে
ছিলাম।
ফার্স্ট ইয়ারে তখন।
একবার আমি মঈনউদ্দীন পাঠান ভাইকে খুজতে তার রুমে গিয়েছিলাম। সেখানে এক বড়ভাই বসে বসে
পড়ালেখা করছিলেন। আমি বললাম- 'ভাই... মঈন ভাই আছে?' ভাই বললো- ' ও তো রুমে নাই। আপনে কে?' বললাম- 'ভাই...
পুশকিন, লোক প্রশাসন, ৩৭...'
ভাই বললো- 'আমি আব্দুল কুদ্দুস
মাখন। এই নামে আরেক বিখ্যাত লোক আছে, চিনেন তারে?' আমি বললাম- 'জি ভাই... রাজনীতিবিদ ছিলো... ঠিক আছে ভাই যাই...।'
বটতলায় গিয়ে দেখি মঈন ভাই সেখানে বসে আছেন। ভাইকে বললাম- 'ভাই, আপনার রুমে গেছিলাম। আপনে এইখানে...' মঈন ভাই বললো- 'রুমে কে ছিলো?'
বললাম- 'নাম বললো আব্দুল
কুদ্দুস মাখন... ডিপার্টমেন্ট, ব্যাচ কিছু কয় নাই...' মঈন ভাই, শুভ ভাই, রোলান্ড দা আরো সবাই সে কি হাসি! মঈন ভাই বললো- 'নিশ্চয় অলক ভাই... সে ছাড়া এই কাজ কে করবো? রুমে একটা পোস্টার আছে মাখনের... দেখসস...?' আমি বললাম- 'না ভাই...' মঈন ভাই বলে- 'কি খেয়াল করস...?'
একটু পর রুমে গেলাম।
রুমে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরই অলক ভাই হাজির। বললো- 'ভাই আমার ভুল
হইয়া গেছে...
আমি বুঝি নাই... আমার নাম, ব্যাচ বলা দরকার ছিলো...' আমিতো খুব বিব্রত। আবার ভয়ে আছি, মোস্ট সিনিয়র ব্যাচ। বললাম- 'ভাই আমি আপনার নাম-ব্যাচ জানি...' ভাই বললো- 'বলেনতো কি?' আমি বললাম- 'অলক...
৩১ ব্যাচ...' ভাই বললো- 'শুধু অলক?' আমি বললাম- 'সরি ভাই... অলক ভাই... ৩১ ব্যাচ।' ভাই বললো- 'ঠিকাছে পুশকিন... গেলাম।' আমি মনে মনে বললাম, আল্লাহ...
আরেকবার ক্লাস শেষে
আমাদের ৩৬ ব্যাচের আকাশ ভাই আমাকে আর নাসিরকে র্যাগ দেয়ার জন্য সালাম-বরকত হলে নিয়ে গেলেন। হালকা কিছু র্যাগ-ফ্যাগ দিলেন।
নাসির তখন খুব শক্ত। আকাশ ভাই যা বলে করে ফেলে। কাঠি দিয়ে রুম মাপা শেষ হলে আকাশ
ভাই নাসিরকে বলেন- 'নাসির, বিড়ি খাস?' শক্ত নাসির তখন কেদে দিলো। 'না...
ভাই... খাই না...' আকাশ ভাই অবাক হলেন, এতক্ষণ র্যাগ চললো কিছু করলো না, বিড়ির কথা জিজ্ঞাসা করতেই কেদে দিলো! আমার দিকে
তাকালেন,
আমি বললাম- 'আমি খাই ভাই...' ভাই বললেন- 'এ নাসির... বিড়ি না খাইলে কি কান্তে আছে? বিড়ি খাস না, খাস না... কান্দার কি হইলো... কান্দা থামা... পুশকিনরে সাথে নিয়া গিয়া ২টা বিড়ি
নিয়া আয়...'
আকাশ ভাই আমাকে ইশারা দিলেন, কান্দা থামা, কি একটা অবস্থা...
রাতে বটতলায় গান-বাজনা হতো। মঈন ভাই, রোলান্ড দা, কিশোর দা, শুভ ভাই, সেরু ভাই, রানা ভাই, মোমিন ভাই এরা থাকতো। রোলান্ড দা খোল বাজিয়ে
গাইতো,
সেরু ভাই টেবিলে তাল কাটতো, 'আর কি হবে এমন জনম বসবো রে সাধু মেলে...' রোলান্ড দা একবার আমাকে আর প্লাবনকে জিজ্ঞাসা করলেন- 'আচ্ছা,
আমাদের হাত তো আমাদের অংশ। আমাদের হাত যদি কাটা পরে আর তাকে
কবর দেয়া হয়, সেটা কি আর আমার থাকবে? এই 'আমি'
আসলে কে...?' গভীর প্রশ্ন, আমরা ভাবতে বসে গেলাম। তার কিছুদিন পরেই দাদা হল ছেড়ে ইসলামনগর বাসা নিলেন।
আমি এক বিকালে বটতলা থেকে হলে ঢুকতে গিয়ে দেখি দাদা রিক্সায় বিছানাপত্র তুলছেন।
দাদার সাথে শুধু হিমেল দাঁড়ানো। আমি অনেক কষ্টে কান্না আটকালাম। আমি আর হিমেল, দাদাকে ইসলামনগর পর্যন্ত দিয়ে আসলাম।
আমাদের সময়ে কেবল
রাজনৈতিক ঘটনা ঘটতো, তা না। স্মৃতিচারন করার মতো অনেক ঘটনা আছে, যেগুলো ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গল্প অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়
জীবন,
কেবল কয়েকটা গল্প; নাকি তার বেশি
কিছু?
১০.
যাইহোক, জুবায়ের
যেদিন মারা যায় সেদিন সকাল থেকেই শুরু হয়ে যায় সর্বাত্মক আন্দোলন। আন্দোলনের অংশ হিসেবে
প্রথমেই রেজিস্টার ঘেরাও দেয়া হয়। আন্দোলনে সকলের অংশগ্রহণ অত্যন্ত স্বতঃস্ফুর্ত ছিলো।
নেতৃত্বের জায়গায় প্রগতিশীল ছাত্রজোট বা সাংস্কৃতিক জোট থাকলেও ব্যাপক ছাত্রসমাগমকে
লক্ষ্য করে গড়ে তোলা হয় একটি স্বতন্ত্র প্লাটফর্ম- ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর’।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
আন্দোলনের আঁতুড়ঘর। এখানে কোনো ধরনের নিপীড়ন, জুলুম-নির্যাতন, অন্যায় করে পার পাওয়া
মুশকিল। এর আগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বহু নিপীড়নবিরোধী আন্দোলন সংগঠিত হয়েছে।
নিপীড়ক শিক্ষক হোক আর উপাচার্য হোক, কোনো লাভ নাই। তাকে জবাবদিহিতার মুখোমুখীহতেই হয়।
এর আগে এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিপীড়নের দায় মাথায় নিয়ে বাংলার মাস্টার মোস্তফা, নাটক
ও নাট্যতত্ত্বের মাস্টার সানি বিদায় নিয়েছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কালচারটাই
মারমুখী। এখানে কিছু মাস্টার বের হয় যারা কোনো জাতেরই না, পরে ছাত্রদের হাতে তাদের
ঠিক হওয়া লাগে। সেদিন বটতলায় এক মাস্টার গাড়ি নিয়ে হাজির, সেতো পারলে দোকানের ভেতরেই
গাড়ি পার্ক করে। এইটা নিয়ে কয়েকজন ছাত্র কথা বলতে গেলে তাদের আবার বহিষ্কারের ভয় দেখায়,
আবার তাদের নামে লিখিত অভিযোগ দায়ের করে। আরে, এইখানে সেলিম আল দীন রিক্সায় করে ঘুরতো,
খালি পায়ে হাটতো। এখানে আনু মুহাম্মদ এখনো খালেদা-হাসিনা দুই সরকারেরই মাইর খায়, এখানে
রায়হান রাইন ট্রান্সপোর্ট এসে ছাত্রদের সাথে আলাপ করে, চা খায়। এখানে সৈয়দ নিজার আলম
গাছের নিচে ছাত্রদের ক্লাস নেয়, হাইকোর্টে রিট করে কেনো ক্লাস বন্ধ করা অবৈধ হবে না? জুবায়ের
মারা যাওয়ার পর মূল আঙুল উঠে তৎকালীন ছাত্রলীগ আর উপাচার্যের দিকে। যদিও জুবায়ের অনেকটা
ব্যক্তিগত কারণে মারা গিয়েছিলো, কিন্তু তারপরো কোনো ধরণের অপমৃত্যু আমরা সমর্থন করতে
পারি না।
শাকিল আমাকে প্রায়
ফিসফিস করে বললো- ‘প্লাবন ও নাকি ছিলো… জানো নাকি কিছু?’ আমি কিছু জানিনা এসম্পর্কে।
তখন আমার সাথে হল এবং ডিপার্টমেন্টের অনেকের যোগাযোগই শুন্যের কোঠায় নেমে এসেছিলো।
আস্তে আস্তে একটা একটা নাম প্রকাশিত হতে থাকে। প্লাবনের পর মাসুদের নাম আসে। একটা একটা
নাম আসে আর ক্ষোভে ফেটে পরে রেজিস্টারের সামনে থাকা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর।
নাম ধরে ধরে স্লোগান দেয়া হয়। খুনি প্লাবনের ফাঁসি চাই…খুনি মাসুদের ফাঁসি চাই…
আচ্ছা যে ধর্ষক,
সে তো বছরের ৩৬৫ দিন, দিনের ২৪ ঘন্টাই আর ধর্ষন করে না। হয়তো কোনো এক দিন, কোনো এক
মুহুর্তে সে এইরকম অনৈতিক কাজ করে বসে। কিন্তু খুন, ধর্ষন এগুলো এমন পর্যায়ের অপরাধ
যে একবার করে ফেললেই হয়ে গেলো। সেখান থেকে পেছনে আসার আর কোনো উপায় নাই। কিন্তু এমনো
তো হয় যে খুন করেনি, কিন্তু খুনি উপাধী নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনো
উপায় ও নেই।
জুবায়েরকে মারা
হবে এটা তৎকালীন প্রক্টর জানতো। জুবায়েরের ঐদিন ফোর্থ ইয়ারের শেষ ফাইনাল পরীক্ষা ছিলো।
ঐ পরীক্ষার পর ৩-৪ দিনের গ্যাপ, তারপর ভাইভা। ছেলেপেলে ভাইভার আগেই ওকে মাইর দিতে চাইলো।
ওদের ধারনা ছিলো ভাইভার পর জুবায়ের আর ক্যাম্পাসে আসবে না। তো নতুন কলার সামনে জুবায়ের
ওর বান্ধবীর সাথে দাঁড়িয়ে ছিলো। সেখান থেকে দুই-তিনজন ওকে প্রায় জোর করে ধরে বিজ্ঞান
কারখানার দিকে নিয়ে আসে। বিজ্ঞান কারখানাটা তখন যে জায়গায় ছিলো সেখানে এখন ওয়াজেদ মিয়া
বিজ্ঞান গবেষণাগার। ঐদিন আমাদেরও ফাইনাল পরীক্ষা ছিলো।
তো জুবায়েরকে বিজ্ঞান
কারখানার পেছনে নিয়ে গিয়ে রড দিয়ে মারে। জুবায়ের মাফ চায়, এরকম আর করবেনা বলে জানায়,
ওকে ছেড়ে দিতে বলে, বাচাতে বলে। প্লাবন ঐ সময়ে সেখানে ছিলো। প্লাবন জুবায়েরের ঘটনায়
২২ দিন জেল ও খাটে। জেল থেকে জামিনে মুক্ত হয়ে ও আমার গেরুয়ার বাসায় এসেছিলো। ১ দিন
থেকে পরে ওর গাইবান্ধার বাড়িতে গিয়েছিলো। জুবায়েরের ঘটনা আর জেলখানার ভেতরের কিছু বিষয়
আমি ওর কাছে জানতে পারি।
প্লাবনের বক্তব্য
সরাসরি কোট করা সম্ভব নয়। তবে মূল বক্তব্য ছিলো এইরকম, পরীক্ষা দিয়ে ও সমাজবিজ্ঞান
থেকে হলের দিকে যাচ্ছিলো। পথিমধ্যে জুবায়েরকে কয়েকজন মিলে ফিজিক্স-কেমিস্ট্রির রাস্তাটা
দিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলো। জুবায়ের ওকে দেখে ডাক দেয়। জুবায়ের ওদের হাত থেকে ওকে ছাড়িয়ে নিয়ে
যেতে বলে। প্লাবন জুবায়েরকে নিয়ে যেতে নিষেধ করে। কিন্তু যারা নিয়ে যাচ্ছিলো তারা প্লাবনের
কথা শুনে না। প্লাবন ওদের সাথে সাথে বিজ্ঞান কারখানা পর্যন্ত যায়। জুবায়ের প্লাবনকে
প্রায় জোর করেই ওর সাথে নেয়। বিজ্ঞান কারখানার পেছনে আরো কয়েকজন আগে থেকেই মজুত ছিলো
রড-লাঠিসোটা নিয়ে। তারা প্রথমে হাতে মারে, পরে রড-লাঠি দিয়ে মারে। এমনকি জুবায়েরকে
হাত দিয়ে আগলাতে গিয়ে প্লাবন নিজেও দুইএকটা মাইর খায়। প্লাবনের ধারনা ছিলো দুইএকটা
মাইর দিয়ে ছেড়ে দিবে।
মাসুদের বিষয়টা
জিজ্ঞাসা করলাম, প্লাবন বললো- ‘মাসুদের বিষয়টাতো আরো লেইম। যেমন আমি কোনো পরিস্থিতির
মধ্যে পরে গিয়েছিলাম। সেখানে না পারছিলাম থাকতে, না পারছিলাম বের হয়ে যেতে। তো সেখান
থেকে বের করে নিয়ে আসতে আমি মাসুদকে ফোন দেই। প্রথমে ফোন দেই রিজনকে। রিজনের ফোন বন্ধ
দেখায়। তারপর আমি মাসুদকে ফোন দিয়ে বলি বিজ্ঞান কারখানার পেছন থেকে যেন আমাকে এসে নিয়ে
যায়। মাসুদ তখন হলে ছিলো। মাসুদ একটা রিক্সা নিয়ে আসে। রিক্সা রাস্তায় দাড়া করিয়েই
বিজ্ঞান কারখানার পেছনে আসে, আমার হাত ধরে টেনে আমাকে সেখান থেকে বের করে নিয়ে রিক্সায়
তোলে। আমরা হলে আসি। মাসুদ ঘটনাস্থলে ছিলো ১৫-২০ সেকেন্ড। এরপর জুবায়েরের বিষয়ে আমি
আর কিছু জানি না।’
পরদিন সকালে ভিসির
অফিসে প্লাবনসহ কয়েকজনকে ডাকা হয়। প্রত্যেকের সাথে আলাদা আলাদা কথা বলা হয়। প্লাবনের
সাথে কথা বলে তৎকালীন প্রোভিসি ফরহাদ স্যার। প্লাবন যা যা ঘটেছে, দেখেছে সব বলে। প্লাবনকে
বলা হয় তাহলে তুমি স্টেটমেন্ট দাও, সাক্ষী হয়। তোমার নিরাপত্তার বিষয়টা, তুমি যেনো
না ফাসো সেটা ভার্সিটি দেখবে। প্লাবন ভার্সিটি কর্তৃপক্ষের কথামতো কাজ করে, কিন্তু
যখন মামলার আসামী সাজানো হয় তখন প্লাবন-মাসুদের নাম সহ আসামীর কাগজ জমা দেয় বিশ্ববিদ্যালয়
প্রশাসন। এখানে মূল রাজনীতিটা করে প্রশাসন।
প্রশাসনের রাজনীতি
করার আরো বেশ কিছু নজির আছে। এই আন্দোলনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে উপাচার্য ছাত্রলীগকে দিয়ে
সাংস্কৃতিক জোটের নেতাদের মার খাওয়ায়। মার খাওয়া নেতাদের আবার শিবির বলে হেনস্তা করারও
চেষ্টা করে। এই পরিকল্পনাটা মনে হয় শরীফ এনামুল কবিরের নিজের। ওদের শিবির বললে ওরা
নৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে যাবে, কারণ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃতি সবসময়ই শিবির
বিরোধী। সমস্যা হয় বেশ কয়েকজন হিন্দুধর্মাবলম্বী এই সময়ে মার খায়। আর যারা মার দেয়
তারা ভিসির খুব কাছের লোক বলে চিহ্নিত। এই মারামারির ফলে মূলত প্রশাসন আরো বিপাকে পরে।
যাদের মারা হয় তাদের শিবির বলে কোনো প্রমান দিতে পারেনি আবার তারমধ্যে সাংস্কৃতিক জোটের
নেতারাও ছিলো। ফলে আন্দোলন আরো বেগবান হয়।
এছাড়া কিভাবে যেনো
আন্দোলনের খবরাখবর লিক হতে থাকে। আজকে আন্দোলনকারীরা কি করতে যাচ্ছে এটা আগে থেকেই
প্রশাসন জেনে যাচ্ছিলো। আন্দোলনকারীদের জন্য এটা একটা খারাপ লক্ষণ। তখন আমার বেশিরভাগ
সময় কাটতো বটতলায় বসে থেকে। সে সময়েই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে হয়ত সর্ব
বৃহৎ মশাল মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। এতো বড় মশাল মিছিল করা কেবল ছাত্রজোট বা সাংস্কৃতিক জোটের
পক্ষে করা সম্ভব না। সাধারণ ছাত্রদের ব্যাপক সমর্থন ছিলো এই আন্দোলনে। উপাচার্যের কর্মকাণ্ডের
কারণে জুবায়েরের হত্যাকাণ্ডবিরোধী আন্দোলন রূপ নেয় ভিসিবিরোধী আন্দোলনে। শরীফ এনামুল
কবির টিকে থাকার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন। কিন্তু ছাত্রদের অনড় অবস্থানের জন্য গদি থেকে
সরে যেতে বাধ্য হন।
অসমাপ্ত...
No comments:
Post a Comment