৭.
তখন প্রধানমন্ত্রী
শেখ হাসিনার শিক্ষা উপদেষ্টা ছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য
আলাউদ্দিন স্যার। আর তার নিকটস্থ বলে পরিচিত শরীফ এনামুল কবির হলেন জাহাঙ্গীরনগর
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। প্রথম যখন তিনি উপাচার্য হন তখন তার ব্যাপারে সব ভালো
ভালো কথা শুনি। পৃথিবীবিখ্যাত রসায়নবিদ, আন্তর্জাতিক জার্নালে রসায়ন বিষয়ে সবচেয়ে
বেশি প্রবন্ধ ছাপানো বাংলাদেশী ইত্যাদি। কিন্তু রাজনীতির মাঠেও তিনি পরিপক্ক,
অবশ্য এখনকার উপাচার্য ফারজানা ইসলামের তুলনায় উনার ক্রীড়ানৈপুন্য শিশুবৎ। শুধু
উনি না, ঢাকায় রাজনীতির মাঠকাঁপানো ভিসি আনোয়ারও এখনকার ভিসির তুলনায় দুগ্ধপোষ্য
শিশু।
জিতুদা একবার
বলেছিলেন- ‘ছাত্রলীগে ৩-৪ টা গ্রুপ হওয়া খুবই স্বাভাবিক। গ্রুপ না থাকাই
অস্বাভাবিক।’ তো সেই স্বাভাবিক নিয়মানুসারে হলে ছাত্রলীগের দুইটা গ্রুপ হয়ে গেলো।
একগ্রুপে শাফিন ভাই আরেকগ্রুপে শামীম ভাই। শাফিন ভাই ছাত্রলীগের সেন্ট্রাল কমিটির
সভাপতির সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে পেরেছিলেন। তখন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি ছিলো
রিপন-রোটনের। আর শামীম ভাইয়ের সাথে ভালো সম্পর্ক ছিলো ক্যাম্পাসের উপাচার্যের। ৩৩
এর আসিফ ভাই, ৩৪ এর ফরহাদ ভাই, বাপ্পী ভাই এরা শাফিন ভাইয়ের সাথে যোগ দিলেন। আর
এদিকে ৩৪ এর শরীফ ভাই, জিতুদা এরা শামীম ভাইয়ের গ্রুপে। যাই হোক এর প্রভাব আমাদের
মধ্যেও পরেছিলো।
আমরা ৩৭ গ্রুপিং নিয়ে
হলে মিটিং এ বসলাম। সব ব্যাচ এ গ্রুপিং হচ্ছে, ৩৭ এও হবে। কি করা যায়, তাই নিয়ে
মিটিং। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম কে কোন গ্রুপে যাবে এটা নিয়ে হাত তোলা হবে। আমাদের
মধ্যে গ্রুপিং হবে কিন্তু আমরা কোনোদিন নিজেরা নিজেদের সাথে মারামারি করবো না। যে
গ্রুপ টিকে থাকবে তারা অপর বন্ধুদের ক্লাস-পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ করে দেবে। তারপর
যখন আমরা সিনিয়র হয়ে যাবো তখন গ্রুপ তুলে দিয়ে একটা গ্রুপ হয়ে যাবো। আমি, প্লাবন, মাসুদ
আর রিজন শামীম ভাইয়ের পক্ষে হাত তুললাম। আমাদের বন্ধু কালাম, সেতু, নাজমুলসহ আর
যারা বাকি ছিলো সবাই শাফিন ভাইয়ের সাথে। তিলন মিটিং এ ছিলো না। ওকে ফোন দেয়া হলো-
‘তুই কোন গ্রুপে যাবি?’ তিলন বললো- ‘শামীম ভাইয়ের লগে...’ মিটিং শেষ করে আমরা হাত
মেলাতে মেলাতে বের হলাম। যে যার বড় ভাইয়ের কাছে যাবো এখন। আমরা শরীফ ভাই আর জিতু
ভাইয়ের কাছে গেলাম। ‘ভাই, আমরা আপনাদের গ্রুপে...’ ভাইরা হাসতে শুরু করলো- ‘মিটিং
কইরা গ্রুপিং করছস...!’
শেষপর্যন্ত ৩৭ এর
সুসম্পর্ক থাকেনি। ৩৭ মারাত্মক পলিটিকাল ব্যাচে পরিণত হয়। এর মধ্যে ক্যাম্পাসে ৩৮
আসে। আমাদের ইমিডিয়েট জুনিয়র, আমরা খুব খুশি, যাক এবার সিনিয়র হলাম। ৩৮ নিয়ে পরে
আলাপ দিবো। কিছুদিন পরেই ছাত্রলীগের কমিটি দেয়। কমিটিতে বঙ্গবন্ধু হলের ৩২ শাফিন
ভাই সভাপতি, কামালউদ্দিন হলের ৩৩ সাম্য ভাই সেক্রেটারি। ছোট একটা কমিটি দেয়া হয়
প্রথমে, পরে বড় করা হবে। কমিটি দেয়ার কয়েকদিন পরে আমরা বটতলায় কাদের ভাইয়ের দোকানে
বসে রাতের খাবার খাচ্ছিলাম। হঠাৎ হলের নিচে হৈচৈএর শব্দ। আমরা হাত ধুয়ে যেতে যেতে
দেখি, হল থেকে দৌড়ে সবাই বটতলার দিকে আসছে। কাকে যেনো জিজ্ঞাসা করলাম- ‘কি হইছে
হলে?’ ‘জিতু-শরীফরে মারতেছে’ ‘কে...?’ ‘শাফিন-সামি’। ততক্ষণে হলের সামনে প্রক্টর
আর এ্যাম্বুলেন্স চলে এসেছে। আমরা কামালউদ্দিন সালাম-বরকত হলের সামনে দিয়ে হেঁটে
মেডিকেল গেলাম। আমাদের মেডিকেল তাদের বেশিক্ষণ রাখা হবে না। ঢাকা মেডিকেলে পাঠিয়ে
দেয়া হবে। শামীম ভাইকে আগেই ঢাকা মেডিকেল পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। জিতুদা আর শরীফ ভাইকে
যে এ্যাম্বুলেন্সে তোলা হলো সেখানে আমি আর প্লাবন উঠলাম। আমাদের সাথে ছিলো ৩৪ এর
ভাস্করদা। রাত ১ টার দিকে আমরা ঢাকা মেডিকেল পৌছালাম।
আমি কয়েকদিন বাসায়
থাকলাম সেসময়। তারপর একদিন তিলন ফোন দিয়ে বললো- ‘ক্যাম্পাসে আয়। সালাম-বরকত হলে
উঠবো আমরা...’ আমি আর প্লাবন সালাম-বরকত হলে উঠলাম। সালাম-বরকত হলের ৩৩ এর পারভেজ
ভাই শাফিন ভাই থেকে দুরত্ব বজায় রাখতেন, শামীম ভাই আর ভিসির সাথে তার ভালো সম্পর্ক
ছিলো। কমিটি বড় হবে এমন আলাপ শুনছিলাম। কিন্তু সেই কমিটিতে ভিসিলীগের জায়গা হবে না
এমনো শুনেছি। শামীম ভাই, পারভেজ ভাই, শরীফ ভাই এরা ভিসিলীগ হিসেবে সেন্ট্রাল
কমিটির কাছে চিহ্নিত হয়েছেন। একদিন ৩২ এর শামীম ভাই সালাম-বরকত হলে সবাইকে নিয়ে
বসলেন। বললেন- ‘স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা কঠিন। ছাত্রলীগ কমিটি
পাইছে... কিন্তু আমাদের ছাড়া এই কমিটি কি টিকাইতে পারবে? এই দুইচাইরজনের কমিটি তো
আমরা মাইরা বাইর কইরা দিবো... তখন আমাদের সাথে নিয়ে কমিটি দেয়া লাগবে। ভিসিস্যার
আমাদের সাথে আছেন...’
দুই গ্রুপই
ক্যাম্পাসে একচ্ছত্র আধিপত্য চাচ্ছিলো। একদিকে বঙ্গবন্ধু আর কামালউদ্দিল হল।
অপরদিকে সালাম-বরকত আর আল-বেরুনি হল। এইসময় ক্যাম্পাসে বেশ কয়েকটা মারামারির ঘটনা
ঘটে। এমএইচ হল বনাম সালাম—বরকত হল একটা ধাওয়া-পালটা ধাওয়া হয়। এমএইচ হল বটতলা
পর্যন্ত আসে। ডেইরী গেটে এমএইচ হলের ছাত্রলীগ আইডিকার্ড দেখে দেখে মারে। যার আইডি
কার্ডে সালাম-বরকত হল সে মার খাবে। সালাম-বরকত হলও ডেইরী গেটে যায়, এমএইচের
ছেলেদের সেন্ট্রাল ফিল্ডে, ক্যাফেটেরিয়ায়-মুক্তমঞ্চে দৌড়ানি দেয়।
আল বেরুনিতেও দুইটা
গ্রুপ ছিলো। একটা সভাপতির পক্ষে, আরেকটা সেক্রেটারির পক্ষে। এরকম এক সময়ে সকালে নাস্তা
করার সময় দুই গ্রুপের নেতার মধ্যে হালকা কথা চালাচালি হয়, সেখান থেকে হাতাহাতি।
তারপর নিয়ে গিয়ে এক গ্রুপের নেতা ৩৫ এর এমিলি ভাইকে আল-বেরুনি হলের ৪ তলা থেকে
ফেলে দেয়া হয়। দুই গ্রুপ প্রচণ্ড মারামারি করে। সেখানে প্রক্টর আসে, পুলিশ আসে, থমথমে
পরিবেশ। ৩৫ এর মাহি ভাই তখনি ভিসি শরীফ এনামুল কবিরকে বলেন- ‘কেমন ভিসি আপনি?
আপনার সময়েই এমিলিকে চার তলা থেকে ফেলে দেয়া হইছে, এইটা মনে রাইখেন স্যার...
আপনেরে আমরা দেইখা নিবো...’ এটা বলার পর মাহি ভাই বহিষ্কৃত হন। প্রগতিশীল ছাত্রজোট
আর সাংস্কৃতিক জোট ভিসিবিরোধী আন্দোলনে নামে। কিন্তু আন্দোলন তখন সফল হয়নি, ভিসি
মাহি ভাইয়ের বহিষ্কারাদেশ তুলে নেয়।
আমরা যখন শরীফ ভাই
জিতুদার সাথে হলের বাইরে ছিলাম, আমাদের বন্ধুরা তখন হলের ভেতরেই ছিলো। তাদের সাথে
ছিলো জুবায়ের। শরীফ ভাই জিতুদা হল থেকে বের হওয়ার আগ পর্যন্ত জুবায়ের ওর অবস্থান
পরিষ্কার করেনি। মারামারির পর থেকে ও শাফিন ভাইয়ের গ্রুপে।
৮.
জুবায়েরের হাতে
ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে এমন তালিকা করতে গেলে তা বিশাল হবে। তবে সবচেয়ে বেশি
ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে আশিক আর ভাইস্তা রাজু। ভাইস্তা রাজু সবাইকে ভাইস্তা ডাকতো,
আমরাও সবাই ওকে ভাইস্তা ডাকতাম। ওর সাথে জুবায়েরের আগেই কি একটা বিষয় নিয়ে কথা
কাটাকাটি হয়েছিলো, অতি সামান্য কারণ। কিন্তু সেই সামান্য কারণে জুবায়ের মারাত্মক
প্রতিক্রিয়া দেখায়। সেসময় যারা হলে ছিলো অনেকেই এই ঘটনা মনে করতে পারবে। রুমে
মারলে সমস্যা হবে মনে করে, ভাইস্তা রাজুকে বঙ্গবন্ধু হলের ছাদে নিয়ে গিয়ে মারা
হয়েছিলো। সে যেনো আওয়াজ করতে না পারে সেইজন্য মুখে আন্ডারওয়্যার গুজে দেয়া
হয়েছিলো। হাত-পা বাঁধা হয়েছিলো, সারা শরীর উলঙ্গ করে মারা হয়েছিলো। আমরা অনেকেই
মাঝেমাঝে গুঙিয়ে উঠা শুনে ভেবেছিলাম, হয়ত শিয়াল ডাকছে। আশিককেও এভাবে মারা
হয়েছিলো। আশিকের আঙুলের ফাঁকে পেন্সিল রেখে চাপ দেয়া হয়েছিলো। জুবায়েরের রুম হয়ে
গিয়েছিলো- ‘থার্ড ডিগ্রি সেন্টার’।
সবচেয়ে অবাক হয়েছিলাম
অভি আর সিনার সাথে ঘটা ঘটনায়। আশিক আর ভাইস্তা রাজুর সাথে তো নাহয় পূর্বতন ঝামেলা
ছিলো। অভিতো ডিপার্টমেন্টের বন্ধু আর সিনা দীর্ঘদিনের রুমমেট। অভির সাথে একবার
মুরাদ চত্ত্বরে দেখা। আমি ডাক দিলাম- ‘দাদা...’ দাদা সবসময় হাসিখুশি থাকে, কতো
ঝড়ঝঞ্ঝা গিয়েছে, মুখ থেকে হাসি সরে নাই। দাদা আমাকে ডাকে সাধু পুশকিন! যাই হোক
দাদার মুখ বেজার। জিজ্ঞাসা করলাম- ‘কি হইছে দাদা?’ দাদা আশপাশ তাকিয়ে বললো- ‘ডিপার্টমেন্টে
জুবায়েরের পার্ট বাইরা গেছে...’ ‘এইটাতো স্বাভাবিক... দাদা...’ ‘অয় কি করছে জানো?’
‘কি করছে...’ ‘চেয়ারম্যানের রুমের সোফার কাপড় ছিড়া ফেলছে...’ ‘তারপর...’ ‘তারপর
চেয়ারম্যান জিগাইছে কে করছে এই কাম, জুবায়ের কইছে অভি করছে...’ ‘তোমার নাম নিছে
কেন... ফাঁসানোর জন্য...’ ‘না তো কি... চেয়ারম্যান আমারে রুমে ডাইক্কা সেই ঝাড়ি...
ডিপার্টমেন্ট থেইকা বাইর কইরা দিবো... পাশ কইরা বাইর হইতে পারুম না... কতো কথা...
সর্যি কইছি... সর্যিও শুনে না...’
আর সিনা ছিলো
জুবায়েরের রুমমেট। একদিন হলের বেশিরভাগ ৩৭ গেস্টরুমে মিটিং এ বসেছে। সেই
মিটিংগুলোতে সাধারণত সিনা অংশ নিতো না। ও তখন গানবাজনা নিয়ে ব্যস্ত। গিটার কাঁধে ফেলে
ঘুরে বেড়ায়। টিএসসি, অডিটরিয়াম, ট্রান্সপোর্ট, শুপারিতলা, মেডিকেল এসব জায়গায় গান
গায়। সিনা এইরকম কোথাও থেকে আসছিলো। হলে ঢোকার সময় জুবায়ের ওকে ডাক দেয়। ‘সিনা
শোন...’ ‘বন্ধু...’ ‘তর বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে...’ ‘কি অভিযোগ...’ ‘তুই জুনিয়রদের
নেশা করা শিখাইতেছস...’ ‘কোন জুনিয়ররে শিখাইছি...’ ‘আছে এইরকম জুনিয়র... তরে এহন
নাম কওয়া লাগবো...’ ‘অভিযোগ আসছে... নাম কওয়া লাগবো না...’ ‘নাম কইতে আমি বাধ্য
না... আমার কাছে অভিযোগ আসছে... আজকে থেইকা তর এগুলা বন্ধ...’ ‘আচ্ছা... বন্ধ...
আর কিছু...’ ‘না... যা...’ ‘কিন্তু আমাদের মধ্যে তো অনেকেই নেশা করে... তাদের কি
হইবো...’ ‘এহন যা তো সিনা... এগুলা আর করিস না...’ সবাই সিনা আর জুবায়েরের দিকে
তাকিয়ে ছিলো। সিনা বুঝতে পেরেছিলো জুবায়ের নিজেই নেশগ্রস্থ আছে, তাই আর কথা বাড়ালো
না।
আর কিষাণ, আমাদের
কিষাণ। ৩১ এর বিলাশদা একদিন কাকতালীয়ভাবে কিষাণের রুমে এলেন, সার্চ করার জন্য। যা
সার্চ করছিলেন সেটা ডেস্কের শেলফের উপরেই পেয়ে গেলেন, একটা শিশি। কিষনকে জিজ্ঞাসা
করলেন- ‘কি এডা?’ কিষাণ জানেও না কি এটা, ‘আমি তো জানিনা দাদা... কি এটা? এইখানে
কেন...’ ‘জানস না... প্যাথেড্রিন নেস... আর জানস না এডা কি...’ আমিসহ আরো অনেকে
সেই শিশির দিকে তাকিয়ে থাকলাম, আমরা জীবনে প্রথমবার প্যাথেড্রিন দেখছি। দাদা বললো-
‘রড নিয়া আয়’ বলামাত্র হাতের কাছে রড উঠে এলো বিলাশদার। মারতে শুরু করলেন কিষাণকে।
কিষাণ চিৎকার করে বলতে থাকলো, দাদা আমি জানিনা এইটা কি, দাদা আমি চিনিনা এইটা কি।
মারা শেষ করে বিলাশদা বললেন- ‘আজকেই হল ছাইরা দিবি...’ সেদিন বিকালেই কিষাণ ওর
ট্রাংক নিয়ে হল ছেড়ে যায়। এই পুরো সময়ে একজনের মুখেই হাসি ছিলো। একজনই বিলাশদাকে
কিষাণের রুমে নিয়ে এসেছিলো, শেলফের উপরে প্যাথেড্রিনের শিশি আছে বলে। একজনই
বিলাশদার হাতে রড তুলে দিয়েছিলো। পাঠকদের জন্য রহস্য হিসেবে থাকলো নামটা।
অসমাপ্ত...
No comments:
Post a Comment