6 January 2020

আতুরঘরে মৃত্যু অথবা হিজলের লাল : পর্ব- ৩, ৪


৩.


গেরুয়ার ঢালে রিক্সা ছিলোনা বা আমাদের হাতে টাকা ছিলোনা। যাই হোক আমি আর শাকিল হেটেই রওনা দিলাম। বটটলা শুনশান, কবির সরণি পাড় হয়ে বামে ঘুরতেই চোখে পরলো রেজিস্টারের সামনে জটলা। কাছে যেতে যেতে বিক্ষিপ্ত স্লোগানগুলো স্পষ্ট হচ্ছে। 'জুবায়ের মরলো কেনো? প্রশাসন জবাব চাই!' প্রশাসনের কেউ তখনো জবাব দিতে আসেনি। ফলত রেজিস্টার অবরোধের মুখে পরলো। সবাই কেমন ক্ষিপ্ত, আতঙ্কিত! রেজিস্টারে তালা ঝুলিয়ে দেয়া হলো।

স্লোগানে সবচেয়ে বিশুদ্ধ কণ্ঠ ছিলো আমাদের তুবার। ও যখন বলতো- 'জ্বালো জ্বালো আগুন জ্বালো', তখন মনে হতো আসলেই গিয়ে আগুন লাগিয়ে দেই। ও যখন বলতো- 'প্রশাসনের গদিতে, আগুন জ্বালো একসাথে', তখন মনে হতো আসলেই প্রশাসনের গদিতে আগুন লেগে গেছে। অনেক দূর থেকে শোনা যেতো তুবার আওয়াজ।

তুবা আর তৃণা, আমাদের দুইজন বান্ধবী ছিলো। তুবা নাটকে পড়তো আর তৃণা বিতর্ক করতো। আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজের চক্ষুশূল ছিলো এই দুই নারী। আমার অনেক ব্যাচমেট এবং বড়ভাই ওদের নিয়ে খারাপ কথা বলেছে। বলতো- 'দেখ, মাগিগুলা মিছিল করে, স্লোগান দেয়, রাজনীতি চোদায়, প্যান্ট-শার্ট পরে...' তুবা আর তৃণা আগেরমতোই স্বাধীনচেতা আছে। কিন্তু মাঝখান থেকে ঐ মানুষগুলোর মুখোশ খুলে গিয়ে আসল চেহারা বের হয়ে আসতোআগে খারাপ লাগতো, এখন মজা লাগে।

আর একজন ছিলো আমাদের ফিট কুমারী ফিবা। যেকোনো জাতীয় দুর্যোগে ও ফিট খেতো। আমাদের ফার্স্ট ইয়ারে নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের নিপীড়ক মাস্টার সানির বিরুদ্ধে একটা জোড়দার আন্দোলন হয়েছিলো। আমরা যেতাম বড় আপুদের গান শুনতে। তারা রেজিস্টার ঘেরাও করে কি সুন্দর গান গাইতো! 'ভয় কি মরনে... রাখিতে সন্তানে... মাতঙ্গী বেজেছে আজ... সমরে রঙ্গে...' তদন্ত কমিটি বসলো। তদন্ত কমিটি সানি মাস্টারের দোষ খুজে পেলো না, তারপরো তাকে বাধ্যতামূলক কয়েক মাসের ছুটিতে পাঠালো। আর এরই মধ্যে ফিবা ফিট খেলো। মেডিকেলে জ্ঞান আসার পর তুবা ফিবার পাশে দাঁড়িয়ে কাদতে কাদতে জিজ্ঞাসা করলো- 'ফিট খাইলি কেন?' ফিবাও কাদতে কাদতে বললো- 'আন্দোলনের রেজাল্ট... আমাদের বিপক্ষে গেছে...' তুবা বললো- 'ফল বিপক্ষে গেলেই তুই ফিট খাবি...' তারপর দুইজনই কাদতে থাকলো। সে এক হৃদয় বিদারক দৃশ্য।

রেজিস্টার ঘেরাওয়ের সময়েও যথারীতি ফিট খেলো ফিবা। বন্ধু লেলিন ওর পাশেই দাঁড়ানো ছিলো। 'এএএ... ফিবা ফিট খায়...' বলতে বলতে ফিবা ফিট খেলো। আন্দোলনকারীরা দুইভাগে বিভক্ত হয়ে গেলো। একভাগ রেজিস্টার আটকে রাখবে, আরেকভাগ ফিবাকে নিয়ে মেডিকেলে দৌড়াদৌড়ি করবে। লেলিন একটা রিক্সা ডেকে ফিবাকে তুলে নিলো মেডিকেলে যাওয়ার জন্য। জ্ঞান ফেরার পর ফিবা আবার এসে রেজিস্টারের সামনে বসে৷

সবাই একে অপরকে প্রশ্ন করছে, কে খুন করেছে? কে কে খুন করেছে জুবায়েরকে? কয়েকটা নাম ভেসে এলো। আশিক, ভাইস্তা রাজু, অরূপ, জাহিদ, সোহান, আকরাম। আকরাম! জাহাঙ্গীরনগর থিয়েটার অডি করে আকরাম। কবিতা লেখে, ছবি আকে। বাকি আর সময় বন্ধুদের সাথে কোরাসে গান করে আকরাম। সদা হাসিমুখ, দেখা হলেই বলতো- 'দোস'এই আকরাম খুন করেছে? এই আকরাম, নাকি অন্য কেউ?

 ৪.


আমরা যে সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই সেসময় ছাত্রদলের দখলে ছিলো হলগুলো। আমরাতো ছাত্রদল, ছাত্রলীগ বুঝিনা। আমাদের বোঝানো হলো, সবার উপর 'হল' সত্য, তাহার উপর নাই... হল মানে সেটা বঙ্গবন্ধু হল। ক্যাম্পাসে আর কিছু রবেনা, শুধু বন্ধুরাই থাকবে। এসময় আমরা শিখলাম ইন্টিমেসি আর বোকাচোদা। নিজের বন্ধুদের সাথে গিয়ে ইন্টিমেসি বাড়াতে হবে আর বাকি সব হলের পোলাপান তো বোকাচোদা।

আমরা ফার্স্ট ইয়ার গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরি। সেন্ট্রাল ফিল্ডে বসে হাওয়া খাই। মেহেরে বসে চা-সিগারেট খাই। হলের সব ব্যাচমেট একসাথে ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করি, গলা ফাটিয়ে স্লোগান দেই, পৃথিবীতে কোনো হল আছেএএএ... মেয়েদের হলের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় এই আওয়াজ আরো তীব্র হতো। ৫-৭ জন গ্রুপ করে ট্রান্সপোর্ট যেতাম অতি সিনিয়র বড়ভাইদের সাথে পরিচিত হওয়ার জন্য।

তো আমরা ছাত্রদল বুঝি না, ছাত্রলীগ বুঝি না। আমরা বুঝি বঙ্গবন্ধু হল, নিজের বন্ধুবান্ধব, হলের সিনিয়র ব্যাচ, ডিপার্টমেন্ট ইত্যাদি। তখন মধ্যে দেশে সেনাশাসন চলে। সেনাশাসন আওয়ামী লীগের চাপের মুখে নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়। নির্বাচনে বিএনপির গরমগরম ভরাডুবি হয়। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার সাথে সাথে ক্যাম্পাসগুলোর ছাত্রলীগ চাঙ্গা হয়ে ওঠে। এতোদিন যা যা ছাত্রদল করেছে এখন তা তা ছাত্রলীগ করবে। ছাত্রদল কি করেছে? তারা ভিসিকে দেখেশুনে রেখেছে, ক্যাম্পাসের যাবতীয় খরচে নিজেদের ফেয়ার শেয়ার নিয়েছে, বিরোধী মতকে দমন করেছে, দোকানে বাকি খেয়েছে, ফাফড় দিয়েছে, গ্রুপিং করেছে, মারামারি করেছে, হলকে অস্ত্র ও মাদকের গুদাম বানিয়েছে। ছাত্রলীগ কি করেছে?

যাই হোক আমরা এগুলো বুঝি না। তিলন আমাদের আগেই হালকা বলে রেখেছিলো। ক্যাম্পাসে গণ্ডগোল হতে পারে। ছাত্রলীগের ভাইরা ক্যাম্পাসে ঢুকেছে, প্রশাসনের সাথে সিটিং-মিটিং শেষ। প্রশাসন নিজে এসে তাদের হলে তুলে দিবে। আর হলের ছাত্রদল হল থেকে পালিয়ে যাবে। বঙ্গবন্ধু আর ভাসানী হল ছাড়া ইতিমধ্যে পুরো ক্যাম্পাস ছাত্রলীগের দখলে। বঙ্গবন্ধু হলের পোলাপানের ইন্টিমেসি বেশি, তাই হল দখল করতে দেরী হচ্ছে। আমাদের হলের ছাত্রলীগ ইন এক্সাইল আছে কামালউদ্দিন হলে।

একদিন সকালে, দিন মনে নাই এখন আর, মারামারি শুরু হলো। বটটলা থেকে ইটপাটকেল আসছে। বঙ্গবন্ধু হলের ছেলেরাও তেড়ে তেড়ে যাচ্ছে। আমি ঘুমাচ্ছিলাম। ততদিনে আমরা রুম পেয়েছি নিচতলায়, ১২১ নং রুম। ১০ জন এক রুমে। আমাকে ডাক দিয়ে তোলে প্লাবন- 'মাদারচোদ... তাত্তারি উঠ। হল এটাক হইছে...' বলেই ও গোসল করতে চলে গেলো।

আমি আর শাকিল বসে আছি৷ ৩৬ ব্যাচের কোন এক বড়ভাই রুমে এসে নক করলেন। বললেন- 'রুমে কতজন আসস তোরা?' বললাম- 'ভাই ৩ জন...' বড়ভাই ৩ টা রড নিয়ে ২-৩ মিনিট পর আসলেন। বললেন- 'বাইঞ্চোদগুলা আইছে হল দহল করতে... এতো সুজা... বঙ্গবন্ধু হল হইলো দুর্গ... ফোর্ট... হল দিমুনা... লীগের পুলাপানের পু*কি দিয়া...' বলে আমাদের হাতে রডগুলো দিয়ে উনি আবার গেইটের দিকে দৌড়ে গেলেন। এখন বুঝতে পারি ওগুলো ছিলো মোটিভেশন, আর রডগুলো দেয়া হয়ছিলো আত্মরক্ষার্থে।

আমরা রড হাতে নিয়ে বিছানায় বসে আছি। প্লাবন গোসল শেষ করে এসে দেখে আমাদের হাতে রড। বললো- 'রড রাইখা রেডি হ তাড়াতাড়ি। বাইরাইতে হইবো...' আমরা অতিদ্রুত রেডি হলাম। হলগেট দিয়ে বের হয়ে দেখি হলের একটা ভাগ নিচুবট দিয়ে হৈ হৈ করতে করতে সামনে এগিয়ে গেছে। আরেকটা ভাগ হলের সামনের ছাদে, ঢেলানোর জন্য ইট তুলছে। আমি, প্লাবন আর শাকিল ডানে বামে তাকিয়ে, বরাবর ফিজিক্সের রাস্তা ধরলাম। শহীদ মিনার এসে সিদ্ধান্ত নিলাম তিলনের বাসায় যাবো, ওর বাসা সাভার। ওকে ফোন দিলো প্লাবন। আমরা থানা স্ট্যান্ডের উদ্দেশ্যে ডেইরি গেট থেকে বাসে উঠলাম।

থানা স্ট্যান্ড নেমে দেখলাম তিলন স্ট্যান্ডেই। তিলন খবর পেয়েছে মারামারির। বললো- ‘আজকেই তো হল দখল হইবো। আমি যামু এখন। হলের বড়ভাইরা সব কামালউদ্দিনে।’ ছাত্রলীগ করার অপরাধে এরা এতোদিন হলের বাইরে ছিলো৩১ ব্যাচের বিলাসদা, ৩২ ব্যাচের শামীম ভাই, সামি ভাই, ৩৩ ব্যাচের আসিফ ভাই, হিমেল ভাই, ৩৪ ব্যাচের জিতুদা, শরীফ ভাই। ৩৫, ৩৬ ব্যাচের কেউ ছিলোনা। ৩৭ ব্যাচের একই বিভাগের আমরা ৪ জন। আমাদের এখানে ব্যাচের হিসাব চলে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার যতো বয়স হয়, আমাদের নতুন ভর্তির ব্যাচ ও তাই হয়। আমাদের ব্যাচ ২০০৭ এ ভর্তি হয়, কিন্তু ক্লাস শুরু করে ২০০৮ এর মার্চের ১৬ তারিখে। আমরা হই ক্যাম্পাসের ৩৭ ব্যাচ।

হল থেকে বের হয়ে গিয়ে তো কূলকিনারা পাচ্ছিনা। এখন কি আর হলে যেতে পারবো? হলে তো ঢোকাই যাবে না। তিলনের নাহয় বাসা সাভার। প্লাবনের গাইবান্ধা, শাকিলের ময়মনসিংহ, আমার যাত্রাবাড়ি। তিলন বললো- ‘ধৈর্য ধইরা বিড়ি-চা খা। আজকে রাইতেই হলে উঠুম। হল হাতে পামু।’ প্লাবন বললো- ‘এতো সহজ! হল হাতে আইনা দিয়া যাইবো তর?’


 অসমাপ্ত... 

No comments:

Post a Comment