9 January 2020

আতুরঘরে মৃত্যু অথবা হিজলের লাল : পর্ব- ৫, ৬

৫.


আমি, শাকিল, তিলন আর প্লাবন বিকালে ক্যাম্পাসে আসলাম, কামালউদ্দিন হলের সামনে। সেখানে ছাত্রলীগের বড়ভাইদের জটলা। বড়ভাইরা হাসিমুখে রড হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। জিতুদার সাথে প্রথম সেইদিন পরিচিত হয়েছিলাম। তিলন নিয়ে গেলো- ‘দাদা... এরা আমার ডিপার্টমেন্টের বন্ধু... আপনার হলের ছোটোভাই...’ দাদা বললেন- ‘বিড়ি খাস?’ আমরা ঘাড় কাত করলাম, দাদা বললেন- ‘এখন চা-বিড়ি খা... হলে উইঠা পরে কথা হবেনে... ঠিক আছে...’ ভাসানী হল থেকে স্লোগান ভেসে আসছে, ‘জিয়ার সৈনিক এক হও, লড়াই করো... তারেক জিয়ার ভয় নাই, রাজপথ ছাড়ি নাই...’ পুকুরের এপাশ থেকে স্লোগান শোনা যাচ্ছে। স্লোগান শুনে জিতুদা, সামি ভাই এরা হাসছে। তিলনকে জিজ্ঞাসা করলাম কি ব্যাপার ভাইরা হাসে কেন? তিলন বললো- ‘ভাসানী হলের দলের সাথে মিটিং চলে... মিটিং সফল হইলে এরা ছাত্রলীগে যোগ দিবো’। প্রথমে বুঝি নাই বিষয়টা, বললাম- ‘অ...’।

সন্ধ্যার দিকে মিটিং সফল হলো। ভাসানী হলের ৩৩ ব্যাচের ছাত্রদলের নেতা আসগর ভাই তার কর্মীদের নিয়ে ছাত্রলীগে যোগ দিলেন। ছাত্রলীগে যোগ দিলেন এটা বোঝানোর জন্য ভাসানী হলে আবার মিছিল হলো। এবার মিছিল থেকে আওয়াজ আসলো- ‘ছাত্রলীগের মূলনীতি... শিক্ষা, শান্তি, প্রগতি... জয় বাংলা... জয় বঙ্গবন্ধু... শেখ হাসিনার ভয় নাই, রাজপথ ছাড়ি নাই...’ আমরা রড হাতে দাঁড়িয়ে আছি। বঙ্গবন্ধু হলকে ছাত্রদল মুক্ত করতে হবে। ছাত্রদল ক্যাম্পাসকে দোযখ বানিয়ে ফেলেছে। এরা বাকি খায়, ফাফড় দেয়, ছাত্রলীগকে মিছিল করতে দেয় না, হলে থাকতে দেয় না, লীগের নেতাদের ক্লাস করতে দেয় না, পরীক্ষা দিতে দেয় না। হল থেকে ছেলেদের জোর করে মিছিলে পাঠায়। ইচ্ছার বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে বাধ্য করা হয়। মিছিলে না গেলে হল থেকে বের করে দেয়া হবে বলে জানায়। হলের গেস্টরুমে ডেকে গালাগালি করে, গায়ে হাত তোলে।

আমি তখন ছাত্র ইউনিয়ন করি, প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক। যাই হোক, সে আলাপ পরে। সেসময় ক্যাম্পাসে ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি ছিলেন ৩২ এর এসএম শুভ ভাই, তিনি বঙ্গবন্ধু হলে থাকতেন। তিনি বলতেন- ‘দল আর লীগ কি আলাদা হইলো নাকি... একই ত... একই রকম আচার-আচরন... কয়দিন পর বুঝবি’সেই সময়ে ক্যাম্পাসে ছাত্র ইউনিয়ন ছাড়াও ছাত্রফ্রন্ট, ছাত্র ফেডারেশন আর ছাত্র মৈত্রী ছিলো। ফ্রন্টের প্রিন্স ভাই, ফেডারেশনের ইরান ভাই আর মৈত্রীর অনিন্দ্য আরিফ ভাই, এরা ছিলেন নেতা। এদের আর কাজ কি? কোথায় কী হলো শুধু মিছিল করা। শুভ ভাই ছাত্রদলের নেতাদের সাথে কথা বললেন। ‘ছাত্রলীগকে হলে উঠতে দেয়া হোক, ক্লাস পরীক্ষা দিতে দেয়া হোক।’ ছাত্রদল বললো- ‘কি... লীগপন্থী ইউনিয়ন!’ শুভ ভাই ছাত্রলীগের নেতাদের সাথে কথা বললেন। ‘ছাত্রদলকে যেনো হল থেকে বের না করে দেয়া হয়। এরা যেনো ক্লাস-পরীক্ষা চালিয়ে নিতে পারে।’ ছাত্রলীগ বললো- ‘কি... দলপন্থী ইউনিয়ন!’ শুভ ভাই বলে- ‘দেখ তো... কি অবস্থা...’

তো আমরা রাত ৯টা সাড়ে ৯টার দিকে হলে ঢুকলাম। শিক্ষক আর পুলিশ সাথে ছিলো, কিন্তু এরা হলের ভেতর ঢুকেনি। হলের গেট তালা মারা ছিলো। পুলিশ গিয়ে গেটের তালা ভাঙলো। ছাত্রলীগের সবাইকে ঢুকিয়ে দিয়ে হল গেট খুলে দিলো। হল গেটের দায়িত্ব নিলো ছাত্রলীগের ভাইরা। হলে ঢুকেই সামি ভায়ের চিৎকার। ‘খানকির পোলারা কই সব? সবগুলারে জবাই করবো, মাইরা ফেলবো... মাদারচোদেরা হলে ঢুকতে দেয় না... দেখ, হলে এখন আমরা...’ ছাত্রদলের ভাইয়েরা আগেই হল থেকে পালিয়ে গেছে। হলের পেছনে ডাইনিং-ক্যান্টিনের ছাদ থেকে দড়ি ঝোলানো। সেটা দিয়ে সবাই হল ত্যাগ করে সম্ভবত গেরুয়ার দিকে গিয়েছে। হলে শুধু ৩৬-৩৭ এর ছাত্ররা। ৩৬ আর ৩৭ আসলে তেমনভাবে রাজনীতি করার সুযোগ পায়নি। একে জুনিয়র ব্যাচ, তার উপর আবার বোঝানো হয়েছে বন্ধু আর ইন্টিমেসি। নেতাগোছের কাউকে না পেয়ে ছাত্রলীগের কারো কারো মাথা খারাপের মতো হয়ে গেলো। কাকে পিটাবে? কাকে হাড্ডি ভেঙে মনের ঝাল মেটাবে? সব রাগ গিয়ে পরলো- ৩৬ আর ৩৭ এর ছাত্রদের উপর। সামি ভাই রেগে গিয়ে বললো- ‘খুইজা বাইর কর, খানকির পোলাগো কার কার লগে ভালো সম্পর্ক আছিলো...’

হলে ঢুকে দেখি জুবায়ের চকোলেট কিনে নিয়ে বসে আছে। ছাত্রলীগের বড়ভাইদের কাউকে কাউকে ও চিনতো। এছাড়া তিলনের সাথেও ওর আলাপ দেয়া ছিলো। ছাত্রলীগ হলে উঠলে ও ছাত্রলীগ করবে। ও সবাইকে চকোলেট বিল্লাছে। আমরা অবাক হলাম। কারন ছাত্রদলের বড়ভাইদের সাথে ওর সম্পর্ক ভালো ছিলো। এখন চকোলেট হাতে নিয়ে ও সামি ভাইকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলো, ‘ভাই এতোদিন কোথায় ছিলেন... আমরা খুব কষ্টে ছিলাম...’ এইরকম ভোল পালটানো দেখে প্লাবন আমাকে ফিসফিসিয়ে বললো- ‘দেখ... কেমন পদের মাদারচোদ...’ ছাত্রলীগ হলের সবজায়গায় গার্ড বসিয়েছে। গেটে, ছাদে, হলের পেছনের দিকে ক্যান্টিন-ডাইনিং এ। আমরা যখন ডাইনিং এর দিকে ছিলাম তখন বিলাসদা আসলো। বললো- ‘এ জিতু কিডা... রাজু... অভি...’ তিলন দাদাকে বললো- ‘এরা তো ৩৭ দাদা।’ ‘এরা নাকি দল চোদাইছে...’ ‘না দাদা। ৩৭ এ কোনো দল নাই। এমনি বন্ধু-বান্ধব...’ ‘যাই হোক খুইজা বাইর কর। আছে নাকি পলাইছে...’ বড় নেতাদের ঝাল সব গিয়ে পরলো এদের উপর। ‘কই তগো বড়ভাইরা? সব পলাইছে... আর তগোরে রাইখা গেছে মাইর খাওয়ার লেইগা... আর দল চোদাবি...’

৩৭ এ কারা কারা ছাত্রদলের ভাইদের সাথে ভালো সম্পর্ক রাখতো এটা খুজে বের করার জন্য সবচেয়ে আগ্রহী ছিলো জুবায়ের। ও নিজে জিতুর আব্বাকে ফোন দিয়েছিলো। ওর আগ্রহে জিতুর উপর নেমে আসে অত্যাচার। আমি যখন জিতুকে দেখি ওর এক চোখ ফুলে গিয়েছিলো, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাটছিলো। ওর আব্বা ওকে নিতে এসেছিলো পরদিন সকালে। সেই যে জিতু হল ছাড়লো এরপর আর হলে থাকেনি। ওকে শারীরিকভাবে হেনস্তা করেও চলছিলো না। ওর আব্বার কাছে বিচার ও দেয়া হয়েছিলো, ছেলে রাজনীতি করে, নেশা করে ইত্যাদি। জিতুর আব্বা সেদিন কোনো কথা বলেন নাই, ছেলেকে নিয়ে হলগেট থেকে বিদায় নিয়েছিলেন। আমরা হলের গেটেই নির্বাক দাঁড়িয়ে ছিলাম।

জুবায়েরের রুম ছিলো আমার রুমের সামনেই। কেমন যেনো একটা গোঙানির আওয়াজ আসে জুবায়েরের রুম থেকে। রাতে বটতলায় খেতে গিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলাম- ‘কিরে তর রুমে কিসের আওয়াজ? কেমন যেনো গোঙানি মনে হইলো...’ জুবায়ের মনে হলো বিব্রত হলো। বললো- ‘ও কিছু না...’ এরমধ্যে ডিপার্টমেন্টের বান্ধবী সোমা আমাকে ফোন দিলো। বললো- ‘তোদের হলে রাজু আটকা পরছে... ওর ফোন বন্ধ... মিকি টেনশন করতেছে...’। আমি বললাম- ‘মিকি কে?’ সোমা বললো- ‘আমার হলের বান্ধবী। রাজুর গার্লফ্রেন্ড...’ আমি খোঁজ নিতেছি বলে ফোন রাখলাম। হলে গিয়ে দেখি, জুবায়েরের রুম খোলা। সেখানে আরো কয়েকজন ৩৭ ছিলো। রাজুও ছিলো। রাজুকে দেখে মনে হলো বিপর্যস্ত। রাজু আমার দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিলো। নিজেকে খুব অসহায় লাগছিলো তখন।

আমি জুবায়েরকে ডেকে রুমের বাহিরে আনলাম। বললাম- ‘রাজুরে আটকাইছস কেন? ছাইরা দে।’ ‘অর লগে আমার হিসাব নিকাশ আছে...’ ‘কি হিসাব নিকাশ?’ ‘অয় ছাত্রদল করতো...’ ‘অয় যে হিসাবে ছাত্রদল করতো, সেই হিসাবে তো তুই ও ছাত্রদল করতি... ওরে ছাইড়া দে।’ জুবায়ের আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললো- ‘ঠিক আছে... সকালে ছাড়মু...’ আমি তিলনকে ফোন দিলাম- ‘কি ব্যাপার? জুবায়ের রাজুরে আটকাইছে...’ তিলন বললো- ‘হ... অর নাকি কি কথা আছে...’ ‘জুবায়ের ত অরে মারছেও...’ ‘মারার ত কথা না... কথা বার্তা কইয়া ছাইড়া দেয়ার কথা...’ ফোন রেখে ৩৪ এর শরীফ ভাইয়ের কাছে গেলাম। ‘ভাই... জুবায়ের রাজুরে রুমে আটকায়া রাখছে...’ ‘এখনো আটকায়ে রাখছে কেন, ছাইড়া তো দেয়ার কথা...’ সকালবেলা যখন রাজু হল ছেড়ে যাচ্ছিলো ওর ও চোখ-মুখ ফোলা, খুঁড়িয়ে হাটছিলো। আমার কাঁধে ভর দিয়ে রাজু হলগেটে আসে। ওকে একটা রিক্সায় তুলে দেই। এছাড়া আর কিছুই করতে পারিনি সেদিন। আজকেও জিতু, রাজু এদের কথা মনে হলে, অপরাধবোধে ভুগি, মনটা খারাপ হয়।



.


আমাদের সময়ে ক্যাম্পাসে সাধারন ছাত্রদের স্বার্থ দেখে রাখতো প্রগতিশীল ছাত্রজোট আর সাংস্কৃতিক জোট। প্রগতিশীল ছাত্রজোটে ছিলো ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রফ্রন্ট, ছাত্র ফেডারেশন আর ছাত্র মৈত্রী। আর সাংস্কৃতিক জোট ছিলো ক্যাম্পাসের সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর একটি কমন প্লাটফর্ম; এখানে ২টা জাহাঙ্গীরনগর থিয়েটার, ধ্বনি, আনন্দন, জলসিড়ি, বিতর্ক সংগঠন- জুডো এবং জাডস, ইউনিয়ন-ফ্রন্টের কালচারাল উইং- জহির রায়হান চলচ্চিত্র সংসদ, চারণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র সহ আরো অনেক সংগঠন ছিলো।

আমাদের প্রথম বর্ষে ছাত্র ইউনিয়নের সম্মেলন হয়। সম্মেলনের আগে ছাত্র ইউনিয়নের আহ্বায়ক ছিলেন কল্লোল বণিক দা এবং যুগ্ম-আহবায়ক ছিলেন এসএম শুভ ভাই। সম্মেলনের পর শুভ ভাই সভাপতি হন। শুভ ভাইয়ের কমিটিতে মাসুদ ভাই সেক্রেটারি আর রাজিব কর্মকার সাংগঠনিক সম্পাদক। আমার ব্যাচে আমি ছাড়া ছিলো বন্ধু সিনা আর জয়দ্বীপ। ওরা সদস্য ছিলো। এরমধ্যেই আমি হল থেকে বের হয়ে গিয়ে আবার সেদিনই হলে উঠি। কয়েকদিন পর শুভ ভাই আমাকে দেকে পাঠানশুভ ভাই তখন বটতলায় বসে ছিলেন। যাওয়ার পর আমার হাতে একটা কারণদর্শানোর নোটিশ ধরিয়ে দেয়া হয়। শুভ ভাই আমাকে বলেন- ‘তুই কি ছাত্রলীগ করা শুরু করছস?’ আমি বললাম- ‘না, ভাই...’ ‘তাইলে ছাত্রলীগের সাথে তরে বেশি দেখা যায়?’ ‘আমি থাকি প্লাবনের সাথে বেশি... আর কই দেখা যায়?’ ‘জিতু-শরীফের সাথেও ভালো সম্পর্ক...’ ‘ঐটুক ভালো সম্পর্ক তো আরো অনেকের আছে? তারা কি কারণদর্শানোর নোটিশ পাইছে?’ ‘না... তারা পায় নাই। তুই লিখিতভাবে জমা দিস...’ ‘আচ্ছা ভাই...’ বলে আমি চলে আসি। আসার সময় খেয়াল করি পাশের টেবিলে বসে জয়দ্বীপ হাসছে।

এর কয়েকদিন পর ছাত্র ইউনিয়নের সম্মেলন। সম্মেলনের আগে আমি কারণ দর্শাই, সম্মেলনে প্রথম অধিবেশনে গিয়ে সবার সাথে দেখা করে বিদায় নিয়ে আসি। রাজিবদা সভাপতি হবে বোঝা যাচ্ছিলো। আমাকে জিজ্ঞাসা করা হলো সেক্রেটারি কে হলে ভালো হয়? আমি বলেছিলাম- মাহি মাহফুজ। পরবর্তীতে মাহি মাহফুজ ভাইকে সহসভাপতি করে মুনা আপুকে সেক্রেটারি করা হয়। সেক্রেটারি হওয়ার পরপরই মুনা আপু ছাত্র ইউনিয়নে কোনো কারনে নিষ্ক্রিয় হয়ে যান। তবে মাহি ভাই খুব দক্ষতার সাথে ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতি করতে থাকেন। সহসভাপতি পদ নিয়ে উনার মধ্যে কোনো ধরনের প্রতিক্রিয়া কখনো দেখিনি। মাহি ভাই থিয়েটারও করতেন। তৎকালীন উপাচার্য শরীফ এনামুল কবিরের বিরুদ্ধাচরন করে বহিষ্কারও হয়েছিলেন। রাজিব-মাহির কমিটিতে জয়দ্বীপ সাংগঠনিক সম্পাদক হয়েছিলো।

আমি সম্মেলন থেকে বের হয়ে এসেই জিতুদার কাছে যাই। দাদাকে বলি- ‘দাদা, আমি এতোদিন ছাত্র ইউনিয়ন করছি... এখন ছাত্রলীগ করতে কি কোনো অসুবিধা আছে?’ দাদা বলেন- ‘না... কিসের অসুবিধা? যাও... গিয়া বন্ধুবান্ধবরে সময় দাও।’


অসমাপ্ত... 

No comments:

Post a Comment