25 February 2021

তুরস্কের ইতিহাস ও রাজনীতি। পর্ব ৩। বাইজেন্টাইন আনাতোলিয়া

 

সম্রাট কন্সট্যান্টিন দ্যা গ্রেট পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের একচ্ছত্র শাসক হওয়ার সময় থেকে আনাতোলিয়ার বাইজেন্টাইন কাল গণনা করা হয়। যদিও এর বহু আগে থেকেই গ্রীকরা এই অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেছে। আরো বিশদভাবে বলতে গেলে ৩৩০ সালে কন্সট্যান্টিনোপোল শহরের গোড়াপত্তনের সালকে ধরা হয় বাইজেন্টাইন যুগের শুরু।

সম্রাট কন্সট্যান্টিন দ্যা গ্রেট

সম্রাট কন্সট্যান্টিনের বংশধররা খুব বেশিদিন আনাতোলিয়া শাসন করতে পারেনি। ৩৬৩ সালে সম্রাট কন্সট্যান্টিনের বংশের পতন ঘটে। এরপর ভ্যালেনটিনিয়ানিক বংশ পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের শাসনে আসে ৩৬৩ সালে। ৩৭৯ সালে ভ্যালেনটিনিয়ানিক বংশের পতন ঘটে, ক্ষমতায় আসে থিওডোসিয়ান বংশ। ৪৫৭ সালে থিওডোসিয়ান বংশেরও পতন ঘটে, দৃশ্যপটে আসে লিওনিড বংশ। ৫১৮ সালে লিওনিডদের হটিয়ে ক্ষমতায় বসে জাস্টিনিয়ান বংশ।

জাস্টিনিয়ান বংশের সময়কালে পূর্ব রোমান সাম্রাজ্য তাদের সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছায়। ৫৫৫ সালে জাস্টিনিয়ান দ্যা গ্রেটের রাজত্বকালে পুর্ব রোমান সাম্রাজ্য আনাতোলিয়া থেকে এশিয়া, ইউরোপ এবং আফ্রিকার বিস্তির্ন এলাকা শাসন করতো। ৬১০ সালে হেরাক্লিয়ান বংশ সাম্রাজ্যের ক্ষমতায় আসে। ৭১১ সালে হেরাক্লিয়ানদের পতনের আগেই সাম্রাজ্যের আয়তন সংকুচিত হতে শুরু করে। দক্ষিণ দিক থেকে আসা মুসলিম সেনাপতিদের হাতে একের পর এক শহর হাতছাড়া হতে থাকে।

৪৭৬ খ্রিস্টাব্দে পূর্ব রোমান সাম্রাজ্য

৭০০ সালের পর পূর্ব রোমান সাম্রাজ্য জুড়ে দেখা দেয় অস্থিরতা, অনিরাপত্তা। যুদ্ধক্ষেত্রে পরাজয়ের প্রভাব পরতে থাকে সামাজিক জীবনে, অর্থনীতিতে, বাণিজ্যে, সর্বক্ষেত্রে। প্রতিবেশী রাজ্যগুলো বুঝতে পারে সাম্রাজ্য এখন দুর্বল অবস্থায় আছে। দূরের প্রদেশগুলোতে দেখা দেয় বিদ্রোহ, প্রাদেশিক শাসনকর্তারা স্বাধীনতা ঘোষণা করে সাম্রাজ্য থেকে আলাদা হয়ে যান।

বাইজেন্টাইন ধারা তখনো প্রবাহিত ছিলো। আনাতোলিয়া অঞ্চলে অল্প আয়তন ও জনসংখ্যা নিয়ে এরপরো কয়েক বছর বেশ কিছু বংশ শাসন করে গেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য- ইসাউরিয়ান বংশ (৭১৭-৮০২), নিকেফোরিয়ান বংশ (৮০২-৮১৩), আমোরিয়ান বংশ (৮২০-৮৬৭), মেসিদনিয় বংশ (৮৬৭-১০৫৭), দৌকা বংশ (১০৫৯-১০৮১), কোমনেনোস বংশ (১০৮১-১১৮৫), এঙ্গেলোস বংশ (১১৮৫-১২০৪), নিকেয়া সাম্রাজ্য (১২০৪-১২৬১), ল্যাটিন সাম্রাজ্য (১২০৪-১২৬১), ত্রেবিজোন্দ সাম্রাজ্য (১২০৪-১৪৬১) ইত্যাদি।

বাইজেন্টাইন পতাকা

পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের পূর্ব দিকের প্রতিবেশী এবং গুরুত্বপূর্ব প্রতিযোগী ছিলো পারস্য সাম্রাজ্য। পারস্যের সাথে সীমানা বিরোধ লেগেই থাকতো। সীমান্ত এলাকার করদ রাজ্যগুলোকে নিজেদের প্রভাবে রাখতে বেশ কয়েকবার সম্মুখযুদ্ধেও অবতীর্ন হয়েছে দুই প্রতিবেশী সাম্রাজ্য। কিন্তু দক্ষিণের নতুন খুলাফায়ে রাশেদিন আরবের উপদ্বীপ থেকে বের হয়ে রাজ্যবিস্তার শুরু করে। খুলাফায়ে রাশেদিনের মুসলিম সৈনিকরা আনাতোলিয়ায় প্রবেশ করা শুরু করে ৬৩৭ সালেই।

মুসলিম বিশ্বেও ক্ষমতার পালাবদল চলতে থাকে। সাথে বদলাতে থাকে মুসলিম অধিকৃত অঞ্চলগুলোর শাসনও। খুলাফায়ে রাশেদিনের পর উমাইয়া খেলাফত, তারপর আব্বাসিয় খেলাফত, ফাতিমিয় খেলাফত। ১০৭১ সালে মাঞ্জিকার্তের যুদ্ধের মাধ্যমে আনাতোলিয়ার মঞ্চে প্রবেশ করে সেলজুকরা। বদলাতে শুরু করে আনাতোলিয়ার ইতিহাসের প্রকৃতি।

 

তুরস্কের ইতিহাস ও রাজনীতি। পর্ব ২। আনাতোলিয়ার প্রাচীনকাল

 

পৃথিবীর ইতিহাসে আনাতোলিয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। প্রাচীনকালে আনাতোলিয়া এশিয়া মাইনর নামেও পরিচিত ছিলো। সুপ্রাচীনকাল থেকেই আনাতোলিয়াতে মানববসতির চিহ্ন পাওয়া যায়। সবচেয়ে প্রাচীন মানবসভ্যতা সুমেরিয় সভ্যতার একদম কাছাকাছি অবস্থান ছিলো আনাতোলিয়া। এছাড়া আনাতোলিয়া ভূরাজনৈতিকভাবেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। এশিয়া এবং ইউরোপের সংযোগস্থল হিসেবে আনাতোলিয়া সবসময়েই ক্ষমতার ইতিহাসের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলো।

গবেষকরা ধারণা করেন আনাতোলিয়ায় অবস্থিত গাতালহুইয়ুক পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন শহর। শহরের গড়ে উঠার সময়কাল খ্রিস্টপূর্ব প্রায় ৭৫০০ থেকে ৭০০০ সাল। অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় ৯০০০ বছর আগেই আনাতোলিয়ার জনগোষ্ঠী সভ্যতার ছোঁয়া পায়। মধ্য আনাতোলিয়ায় গড়ে উঠা সভ্যতার বাকী প্রাচীন শহরগুলো হচ্ছে- গায়ুনো, আসিকলি হুইয়ুক, গোবেকলি তেপে, মেরসিন, নেভালি চোরি, হাচিলার ইত্যাদি।

প্রথমে নগররাজ্য গড়ে উঠলেও খ্রিস্টপূর্ব ২৫০০ থেকে ২২০০ সালের মধ্যে হাত্তুশ শহরকে কেন্দ্র করে সাম্রাজ্য সম্প্রসারিত হতে থাকে। আনাতোলিয়ার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন অনুযায়ী হাত্তিন সাম্রাজ্য সবচেয়ে প্রাচীন, কিন্তু এর খুব কম ঐতিহাসিক দলিলই পাওয়া যায়। হাত্তিন সাম্রাজ্য সম্পর্কে তার প্রতিবেশী ব্যাবিলন সাম্রাজ্যের কিছু নিদর্শন পাওয়া যায়। পরবর্তী হিট্টাইট ও আক্কাদিয় সাম্রাজ্যের বর্ননায়ও হাত্তিন সাম্রাজ্যের প্রসঙ্গ আসে। হাত্তিন সাম্রাজ্য বেশিদিন টিকে থাকেনি। এর জায়গায় ক্ষমতার আসে হিট্টাইট সাম্রাজ্য

খ্রিস্টপূর্ব ১৪ শতকে মধ্যপ্রাচ্য ও আনাতোলিয়া 

হিট্টাইট সাম্রাজ্য আনাতোলিয়ায় প্রতিষ্ঠিত হয় ১৬৮০ খ্রিস্টপুর্বাব্দে। আনাতোলিয়া জুড়ে হিট্টাইট আমলের নিদর্শন পাওয়া গেছে। এছাড়া প্রতিবেশি আক্কদিয় সাম্রাজ্য এবং মিসরিয় সাম্রাজ্যের সাথে যুদ্ধ এবং চুক্তির প্রমানও পাওয়া গেছে। মিসরিয়রা হিট্টাইটদের কাছ থেকে ঘোড়ায় টানা রথ চালনা শেখে। বাইবেলেও হিট্টাইট সাম্রাজ্যের কথা এসেছে। হিট্টাইটদের সাথে পাশের রাজ্য ফিনিশিয়া এবং ক্রিট দ্বীপের নিয়মিত বাণিজ্যের বিবরণও পাওয়া গেছে। হিট্টাইট সাম্রাজ্যের পতন হয় ১১৭৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। পতনের পর হিট্টাইট সাম্রাজ্য সিরো-হিট্টাইট বিভিন্ন ছোটো ছোটো রাজ্যে ভাগ হয়ে যায়।

হিট্টাইটরা যখন সাম্রাজ্য বিস্তার করছে প্রতিবেশীরা গ্রীকরা তখনো নগররাষ্ট্র গড়ে তুলছে। গ্রীকরা তখন আইওনিয় দ্বীপপুঞ্জ থেকে ধীরে পূর্বে কলোনি বিস্তার করছে। আনাতোলিয়ার ভূমধ্যসাগর উপকূলে গ্রীকরা বেশ কিছু নগররাষ্ট্র গড়ে তোলে। আনাতোলিয়ার গ্রীক নগররাষ্ট্রগুলো ক্রমে শক্তিশালী হতে থাকে। হিট্টাইটদের পতনের পর পশ্চিম ও মধ্য আনাতোলিয়ায় বেশ কিছু গ্রীক নগররাষ্ট্র কেন্দ্রীক জোট ও রাজ্য গঠিত হয়।

পশ্চিম ও মধ্য আনাতোলিয়ার গ্রীক রাজ্যগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- ট্রয়, আয়োলিস, লিডিয়া, লিসিয়া, মাইসিয়া, কারিয়া, আয়োনিয়া এবং ফ্রিজিয়া। পূর্ব আনাতোলিয়ার কিছু অংশ দখল করে নেয় প্রতিবেশী আসিরিয় সাম্রাজ্য। এছাড়া আরো দুইটি রাজ্য গড়ে উঠে পূর্ব আনাতোলিয়ায়- সিমেরিয়া ও উরারতু।

আসিরিয় সাম্রাজ্যের যুগে আনাতোলিয়া ৮২৪-৬৭১ খ্রিস্টপূর্বাব্দ 

প্রাচীন আনাতোলিয়া তিনটি সভ্যতার মাঝখানে ছিলো। পশ্চিমপাশে গ্রীক সভ্যতা, দক্ষিন-পূর্ব পাশে সুমেরিয় সভ্যতা এবং দক্ষিন-পশ্চিম পাশে মিসরিয় সভ্যতা। এই তিন সভ্যতা থেকেই আনাতোলিয়া উপকৃত হতে থাকে। আবার সভ্যতাগুলোর সীমান্তে অবস্থিত হওয়ায় সবসময়েই ত্রিমুখী আক্রমন এবং ক্ষমতার পালাবদলের ভয়ে ভীত থাকতে হতো।

গ্রীকরাজ্যগুলোর মধ্যে আনাতোলিয়া অঞ্চলে সবচেয়ে শক্তিশালী হয়ে উঠে- লিডিয়া। লিডিয়া রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয় প্রায় ১২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। আর পতন হয় ৫৪৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। পতনের আগে লিডিয়া পুরো পশ্চিম ও মধ্য আনাতোলিয়া জুড়ে প্রভাববিস্তার করে। লিডিয়ার প্রতিবেশী ছিলো মধ্য ও পূর্ব আনাতোলিয়ার মেডিয়া রাজ্য ও সাইলেসিয়া রাজ্য।

৫৪৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পার্শ্ববর্তী আকামেনিয় সাম্রাজ্যের (পারস্য- বর্তমানে ইরান) সম্রাট সাইরাস দ্যা গ্রেট লিডিয়া দখল করে নেন এবং সাম্রাজ্যের প্রদেশ বানান। মেসিদনের রাজা ফিলিপের ছেলে আলেকজান্ডার দ্যা গ্রেট পারস্য দখলে নেয়ার আগপর্যন্ত লিডিয়া এবং সমস্ত আনাতোলিয়া আকামেনিয় সাম্রাজ্যের অধীনে থাকে। ৩৩৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আলেকজান্ডার দ্যা গ্রেট আনাতোলিয়ার পথে পারস্য আক্রমন করেন। কিন্তু তিনি বেশিদিন শাসন করতে পারেন নি। তার মৃত্যুর পর তার সাম্রাজ্য সেনাপতিদের মধ্যে ভাগাভাগি হয়ে যায়।

আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর তার সেনাপতিদের মধ্যে শুরু হয় রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ। প্রায় ৪০ বছর ধরে চলে এই যুদ্ধ (ডায়াডোখি- উত্তরাধিকারের যুদ্ধ)। আনাতোলিয়া অঞ্চলের ছোটো ছোটো রাজ্য সেনাপতিদের দখলে চলে যায়। গুপ্তহত্যা, ক্ষমতার পালাবদল ও আরেকজনকে নিয়ন্ত্রণে রাখার রাজনীতি শুরু হয়। ডায়াডোখি যুগে আনাতোলিয়া অঞ্চলের ক্ষমতাসীন সেনাপতিদের তালিকা হলো-

রাজ্য

সেনাপতি

হেলেসপন্টিন ফ্রিজিয়া

লিওননাটুস

লিডিয়া

মিনান্দার

কারিয়া

আসান্দার

ফ্রিজিয়া, লিসিয়া, পাম্ফিলিয়া

এন্টিগোনাস

কাপাডোশিয়া, পাফ্লাগোনিয়া

ইউমেনেস

সাইলেসিয়া

ফিলোটাস

আর্মেনিয়া

নিওটলেমাস

মাঝখানে কিছু বছরের জন্য আনাতোলিয়ায় এন্টিগোনাস শক্তিশালী হয়ে উঠেন। কিন্তু পারস্যের সেলুকাস, মিসরের টলেমি এবং থ্রেসের লাইসিমাকোসের চাপে থাকে থাকতে হয়। শেষ পর্যন্ত পারস্যের সেলুসিড সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত হয় আনাতোলিয়া। কিছু বছর পরেই আবার ছোটো ছোটো রাজ্যে ভাগ হয়ে যায়। সেলুসিড সাম্রাজ্য থেকে আলাদা হওয়া, আবার দখল হওয়া, আবার বিদ্রোহ করে স্বাধীন হওয়া এর মধ্যে দিয়েই এগিয়ে যাচ্ছিলো আনাতোলিয়ার ইতিহাস।

ডায়াডোখি- উত্তরাধিকারের যুদ্ধ, এন্টিগোনাসের আনাতোলিয়া
আনাতোলিয়ার উত্তরে কৃষ্ণসাগরের উপকূলের এরকম একটি ছোটো রাজ্য পন্টাস গড়ে উঠে ২৯১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। আনাতোলিয়ার ক্ষমতা যখন পন্টাসের রাজাদের হাতে যায় তখন ৮৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। ততোদিনে রোমানরাও সাম্রাজ্য বিস্তারে মনোযোগ দিয়েছে। খ্রিস্টপুর্ব ৩১ থেকে শুরু করে ৬ পর্যন্ত ধীরে ধীরে পুরো আনাতোলিয়া রোমান সাম্রাজ্যের প্রদেশে পরিণত হয়।

সুবিশাল রোমান সাম্রাজ্যে ভাঙন ধরে ২৭১ খ্রিস্টাব্দে। আনাতোলিয়া পরে পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের ভাগে। কিছুদিন পর রোমান সাম্রাজ্য আবার একীভূত হয়, আবার ভাঙন ধরে। ৩০৬ সালে পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের ক্ষমতায় আসেন সম্রাট কন্সট্যান্টিন দ্যা গ্রেট। ক্ষমতায় আসলেও সিংহাসন নিরঙ্কুশ করতে করতে ৩২৪ সাল হয় সম্রাট কন্সট্যান্টিনের। তার নতুন রোমান সাম্রাজ্যের জন্য একটি আলাদা রাজধানীর প্রয়োজন দেখা দেয়। এশিয়া ও ইউরোপের সংযোগস্থলে, মার্মারা সাগরের উপকূলে প্রাচীন গ্রীক নগর- বাইজেন্টিয়াম, এর উপরে তখনকার আধুনিক রোমান স্থাপত্যকলা প্রয়োগ করে ৩৩০ সালে গড়ে তোলা হয়, কন্সট্যান্টিনোপোল নগরী। কন্সট্যান্টিনোপোল নগরীই আজকের ইস্তানবুল।

সম্রাট কন্সট্যান্টিন দ্যা গ্রেট ইতিহাসে প্রসিদ্ধ ১ম খ্রিস্টিয়ান সম্রাট হিসেবে। তিনি খ্রিস্টিয়ান ধর্মকে রাজধর্ম ঘোষণা করেন। খ্রিস্টিয়ানদের বিখ্যাত কাউন্সিল অব নিকেয়া তার রাজত্বকালে অনুষ্ঠিত হয়। ফিলিস্তিনে অবস্থিত খ্রিস্টিয়ানদের পুরাকীর্তি তিনি সংস্কার করান। অর্থডক্স খ্রিস্টিয়ানরা সম্রাটকে এখনো সম্মান করে থাকে।

আনাতোলিয়া এই সময়ে পুরোপুরি গ্রীক অধ্যুষিত অঞ্চলে পরিণত হয়। অটোমান সাম্রাজ্যের কাছে পতনের আগ পর্যন্ত এই গ্রীক সংস্কৃতি বজায় থাকে। সম্রাট কন্সট্যান্টিনের বংশধররা ৩৬৩ সাল পর্যন্ত পূর্ব রোমান সাম্রাজ্য শাসন করেন। এর পরে বিভিন্ন গ্রীক রাজবংশ আনাতোলিয়া শাসন করে থাকেন। ৩২৪ থেকে ১৪৫৩ সালে অটোমানদের হাতে কন্সট্যান্টিনোপোল নগরীর পতন পর্যন্ত সময়কালকে বলে হয় বাইজেন্টাইন শাসনামল।

24 February 2021

তুরস্কের ইতিহাস ও রাজনীতি। পর্ব ১। তুর্কি শব্দের উৎপত্তি

 

বর্তমান মানচিত্রে কাজাকস্তান, মঙ্গোলিয়া, রাশিয়া আর চীন যে জায়গায় মিলেছে, সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এক বিস্তির্ন পার্বত্যঞ্চল- আলতাই। আলতাই পর্বতমালার দক্ষিণপূর্বে  গোবি মরুভূমি, আর চারপাশে মধ্য এশিয়ার বিস্তৃত স্তেপ। স্তেপের জনগোষ্ঠী পৃথিবীর ইতিহাসে বিখ্যাত তাদের যাযাবর জীবন আর পশুপালন নির্ভর অর্থনীতির জন্য। শুষ্ক আবহাওয়া আর পর্যাপ্ত পশুচারণভূমির অভাবে তারা এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ভ্রমণ করে বেড়ায়। খাবারের অভাব আর টিকে থাকার প্রতিযোগিতা তাদেরকে করেছে দক্ষ যোদ্ধা এবং সাহসী শিকারী।

ধারণা করা হয় তুর্কি জনগোষ্ঠী এই আলতাই পর্বতমালার অধিবাসী ছিলো। তুর্কদের কাছে আলতাই পবিত্র পাহাড়, আলতাই মানে তাদের পূর্বপুরুষের আবাস, স্বর্ণপাহাড়। তুর্কি ও মঙ্গোল ভাষায় আল মানে স্বর্ণ এবং তাই মানে পাহাড়। প্রায় ৪০০-৫০০ সালের দিকে চারণভূমির খোজে তারা চারপাশের স্তেপে ছড়িয়ে পরতে থাকে। ক্রমে এই যাযাবর যোদ্ধারা নিজেদের জন্য সংস্থান করে রাজ্যের, জড়িয়ে পরে রাজনীতিতে। রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হলেও তুর্কিরা যাযাবর জীবন ত্যাগ করেনি। ফলে তাদের রাজ্য তাদের তাবুর মতো চারপাশে ছড়িয়ে যায়।

প্রথমে বলে রাখা ভালো, তুরস্কের তুর্কি আর আলোচ্য তুর্কি মহাজনগোষ্ঠী এক বিষয় নয়। তুর্কি জনগোষ্ঠী এক বিশাল মহাজাতি। এই তুর্কি জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত জাতিগুলো হলো- তুর্কি, আজারবাইজানী, উজবেক, কাজাক, উইঘুর, তুর্কমেন, তাতার, কিরগিজ, বাশকির, চুভাশ, খোরাসানি তুর্ক, কাশকাই, কারাকালপাক, কুমিক, ক্রিমিয়ান তাতার, ইয়াকুত, কারাচাই ইত্যাদি।

আধুনিক রাষ্ট্র হিসাব করলে তুরস্ক ছাড়াও আজারবাইজান, উজবেকিস্তান, কাজাকস্তান, তুর্কমেনিস্তান, কিরগিজস্তান তুর্কি মহাজনগোষ্ঠী অধ্যুষিত রাষ্ট্র। এছাড়া চীন, রাশিয়া, মঙ্গোলিয়া, ইরান, আফগানিস্তান, তাজিকিস্তান, বুলগেরিয়া, ইউক্রেন ও মোলদাভিয়াতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ তুর্কিরা রয়েছে।

মানচিত্রে তুর্কি মহাগনগোষ্ঠী

যাযাবর শিকারী তুর্কিরা প্রাচীনকালে লিখিত ইতিহাস সংরক্ষণে খুব বেশি আগ্রহী ছিলো না। তাই তাদের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় প্রতিবেশী চীনা রাজ্যদের ঐতিহাসিক দলিলাদিতে। তুর্ক শব্দের উৎপত্তিস্থল হিসেবে প্রথম যে শব্দটিকে গবেষকরা চিহ্নিত করেন তা হলো- গোকতুর্ক, প্রাচীন প্রোটো-তুর্কি ভাষায় এর উচ্চারন ছিলো- কোকতুরুক। গোক শব্দের মানে অমর বা স্বর্গীয় আর তুর্ক শব্দের মানে শিরস্ত্রাণ। প্রাচীন তুর্কিদের শিরস্ত্রাণ তাই আলতাই পর্বতের মতো উপর দিকে চোখা।

৫৪৫ সালে পশ্চিমা ওয়েই রাজ্য আলতাই পর্বতের অভিজাতদের কাছে দূত পাঠান। সেই দূতগণ গোকতুর্ক অভিজাত হিসেবে আশিনা গোত্রের বুমিন এর সাথে দেখা করেছেন বলে উল্লেখ করেন। বুমিন পরবর্তীতে ৫৫১ সালে আলতাই পর্বতমালা ও পূর্বপাশের বিস্তির্ন মঙ্গোল স্তেপ দখল করে নিজেকে খাগান/খান ঘোষণা করেন। তার প্রতিষ্ঠিত রাজ্য ইতিহাসে প্রথম তুর্কি প্রতিষ্ঠিত রাজ্য। বুমিনের রাজ্যকে বলা হতো- গোকতুর্ক খানাতে

গোকতুর্ক খানাতে (৫৫১-৬০৩)

আলতাই পাহাড়ে তুর্কদের ধর্ম ছিলো তেংরি। প্রতিবেশী মঙ্গোলরাও একই ধর্ম পালন করতো। এই ধর্মে সৃষ্টিকর্তা হলেন আকাশদেবতা গোকতেংরি। গোকতেংরির ছেলে ওদতেংরি- সময়ের দেবতা, বোজতেংরি স্তেপভূমির দেবতা, উমায়- উর্বরতা ও কুমারীত্বের দেবী, কায়রা- আলো ও জীবনের দেবতা, উলগেন- ভালো কাজের দেবতা, মেরগেন- জ্ঞানের দেবতা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। তেংরিকে বলা হতো তুর্কদের দেবতা। ধর্ম হিসেবে তেংরি ছিলো সর্বেশ্বরবাদী এবং শামানবাদী ধর্ম।

পাশাপাশি তুর্করা পরিচিত হয় বৌদ্ধ ধর্মের সাথে। প্রতিবেশী চীন থেকে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা গোকতুর্ক খানাতেতে ধর্মপ্রচার করতে যায়। যাযাবর তুর্করা বৌদ্ধ ও তেংরি ধর্মের একটি মিশ্রধর্ম পালন করতে থাকে। পশ্চিমে তুর্করা প্রতিবেশী হিসেবে পরিচিত হয় মুসলিমদের সাথে। ধীরে ধীরে তুর্করা ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হতে থাকে। কারাখানিদ খানাতের রাজা সালতুক বুগরা খান তুর্কি রাজাদের মধ্যে প্রথম ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন ৯৩৪ সালে।

তেংরি ধর্মের প্রতীক

ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ তুর্কি সাম্রাজ্যগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- গোকতুর্ক সাম্রাজ্য (৫৫১-৬০৩), খাজার খানাতে (৬১৮-১০৪৮), উইঘুর খানাতে (৭৪৪-৮৪০), ওঘুজ ইয়াবগু খানাতে (৭৫০-১০৫৫), কারাখানিদ খানাতে (৮৪০-১২১২), গজনবী সাম্রাজ্য (৯৬৩-১১৮৬), সেলজুক সাম্রাজ্য (১০৩৭-১১৯৪) ইত্যাদি।

ওঘুজ তুর্কদের একটি শাখা কাস্পিয়ান সাগর আর আরল সাগরের মধ্যবর্তী স্থানে সাম্রাজ্য গড়ে তোলে এবং ক্রমে আরো পশ্চিমে সরে আসতে থাকে। সেলজুক সাম্রাজ্যের সময়কালে তারা পারস্য (বর্তমান ইরান) হয়ে আনাতোলিয়ায় (তৎকালীন বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য) প্রবেশ করে। সেলজুক সাম্রাজ্যের পতন হলে আনাতোলিয়ার তুর্করা গড়ে তোলে সেলজুক রুম সালতানাত। সেলজুক রুম সালতানাতের সময়ে তুর্করা তাদের উপজাতীয় বেইলিকের (গোত্রভিত্তিক বে শাসিত রাজ্য ব্যবস্থা) অধীনে শাসিত হতে থাকে। বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের সীমান্তে এরকম একটি বেইলিক ওসমানীয় বেইলিক পরবর্তীতে হয়ে উঠে একসময়কার পরাশক্তি অটোমান সাম্রাজ্য। কালের বিবর্তনে অটোমান সাম্রাজ্যের পতন হলে আনাতোলিয়া আর পূর্ব থ্রেস অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় তুরস্ক প্রজাতন্ত্র

 

*সংযুক্তি

তুর্কি জনগোষ্ঠীর তালিকা

জাতি

জনসংখ্যা

রাষ্ট্রে অবস্থান

ধর্ম

তুর্কি

৭ কোটি ৫৭ লক্ষ

তুরস্ক, তুর্কি সাইপ্রাস

সুন্নি ইসলাম, শিয়া ইসলাম

আজারবাইজানি

৩ কোটি ১৩ লক্ষ

আজারবাইজান, ইরান, রাশিয়া

সুন্নি ইসলাম, শিয়া ইসলাম

উজবেক

৩ কোটি ৭ লক্ষ

উজবেকিস্তান

সুন্নি ইসলাম

কাজাক

১ কোটি ৫১ লক্ষ

কাজাকস্তান, চীন, রাশিয়া

সুন্নি ইসলাম

উইঘুর

১ কোটি ১৯ লক্ষ

জিনজিয়াং উইঘুর (চীন)

সুন্নি ইসলাম

তুর্কমেন

৮০ লক্ষ

তুর্কমেনিস্তান

সুন্নি ইসলাম

তাতার

৬২ লক্ষ

তাতারস্তান (রাশিয়া)

সুন্নি ইসলাম, অর্থডক্স খ্রিস্টিয়ান

কিরগিজ

৬০ লক্ষ

কিরগিজস্তান, চীন

সুন্নি ইসলাম

বাশকির

১৭ লক্ষ

বাশকোরতোস্তান (রাশিয়া)

সুন্নি ইসলাম

চুভাশ

১৫ লক্ষ

চুভাশিয়া (রাশিয়া)

অর্থডক্স খ্রিস্টিয়ান, তেংরি

খোরাসানি তুর্ক

১০ লক্ষ

ইরান

শিয়া ইসলাম

কাশকাই

৯ লক্ষ ৫০ হাজার

ইরান

শিয়া ইসলাম

কারাকালপাক

৮ লক্ষ

কারাকালপাকস্তান (উজবেকিস্তান)

সুন্নি ইসলাম

কুমিক

৫ লক্ষ ২০ হাজার

দাগেস্তান (রাশিয়া)

সুন্নি ইসলাম

ইয়াকুত

৪ লক্ষ ৯০ হাজার

শাখা প্রজাতন্ত্র (রাশিয়া)

অর্থডক্স খ্রিস্টিয়ান, তেংরি

কারাচাই

৩ লক্ষ ৫০ হাজার

কারাচাই-চেরকেশিয়া (রাশিয়া)

সুন্নি ইসলাম

তুভা

২ লক্ষ ৮০ হাজার

তুভা প্রজাতন্ত্র (রাশিয়া)

বৌদ্ধ, তেংরি

গাগাউজ

১ লক্ষ ৩০ হাজার

গাগাউজিয়া (মোলদাভিয়া)

অর্থডক্স খ্রিস্টিয়ান

বালকার

১ লক্ষ ১২ হাজার

কাবার্দিনো-বালকারিয়া (রাশিয়া)

সুন্নি ইসলাম

নোগাই

১ লক্ষ ১০ হাজার

দাগেস্তান (রাশিয়া)

সুন্নি ইসলাম

সালার

১ লক্ষ ৫ হাজার

চীন

সুন্নি ইসলাম

অন্যান্য

৩ লক্ষ (প্রায়)

--

--

 

23 February 2021

বড় হয়ে আমি কি হতে চাই? পর্ব ৪


 

বড় হয়ে আমি লেখক হতে চাইতাম। কিন্তু লেখক কিভাবে হবো আমার জানা ছিলো না। আব্বাকে জিজ্ঞাসা করলাম- লেখকরা কি লেখে? আব্বা বললেন- লেখকরা বই লেখে। তখন থেকে আমার মনে হতে থাকলো আমাকেও বই লিখতে হবে, লেখক হতে হবে। বড় হয় যেনো আমরা বিসিএস পরীক্ষা দেই সেজন্য আব্বা কিছু সাধারণ জ্ঞানের বই এনে দিয়েছিলেন। বাসায় সেগুলো আমাকে পড়ে শোনাতেন। আমি সেই বই শুনে শুনে সিদ্ধান্ত নিলাম আমাকে সাধারণ জ্ঞানের বই লিখতে হবে।

আমার বয়স তখন ৬-৭ হবে, ক্লাস ২ এ পড়ি। সবকিছু এতো স্পষ্ট মনে নেই। কিন্তু যা মনে আছে, তাও কম না। আমাদের স্কুলে ক্লাস ৩ পর্যন্ত মেয়েদের সাথে শিফট, মানে সকাল ৭ টা থেকে দুপুর ১২ টা। একটা স্কুল ভ্যান আমাদের স্কুলে নিয়ে যেতো, নিয়ে আসতো। দুপুরে এসে আমি গোসল করতাম, খাবার খেয়ে ঘুমাতে যেতাম, বিকালে উঠে নিচে খেলতে যেতাম। বড়দের খেলা যেমন- ফুটবল, ক্রিকেটে আমাদের দুধভাত খেলোয়ার হিসেবে নেয়া হতো, আমরা তাই নিজেরা বরফপানি, সাতচারা এগুলো খেলতাম।

যেদিন প্রথম বই লিখলাম সেদিন এই রুটিনের ব্যতিক্রম হয়েছিলো। আমি এসেই একটা খালি খাতা, কাঁচি, আঠা, সাধারণ জ্ঞানের বই আর বেশ কিছুদিন ধরে জমানো স্টিকার নিয়ে বসে গেলাম। আমার ছোট দুই ভাই আমাকে ঘিরে বসলো। খাতার উপরে বড় বড় করে লিখলাম- সাধারণ জ্ঞান, তারপর নিজের পুরো নাম। তারপর এর আশপাশে কিছু ছোটো ছোটো স্টিকার লাগালাম- প্লেন, বাঘ, ডাইনোসর ইত্যাদির, ব্যাস বইয়ের মলাট তৈরী।

এবার ভেতরের লেখা তৈরীর পালা। ছোটো ভাইদের দায়িত্ব দিলাম সাধারণ জ্ঞানের বইগুলো থেকে ছবিগুলো কেটে আলাদা করে দিতে।  আমি সেগুলো খাতার ভেতরে আঠা দিয়ে লাগাতে লাগলাম। বইয়ের প্রথম চ্যাপ্টার- ডাইনোসর। ডাইনোসরের কিছু স্টিকার ছিলো- অর্ধেক পৃষ্ঠা সাইজের। সেগুলোর নিচে লিখলাম- ডাইনোসর। পরের চ্যাপ্টার- খেলাধুলা। সেখানে শচীন টেন্ডুলকারের ছবি লাগিয়ে নিচে নাম লিখে দিলাম। পশুপাখি বলে একটা চ্যাপ্টার করা হলো, সেখানে বাঘ, হরিণ, ইলিশ মাছ, দোয়েল পাখি ইত্যাদির ছবি বা স্টিকার লাগালাম।

সাধারণ জ্ঞানের বইগুলো থেকে ছবি কেটে আনলেও তখন রেফারেন্সিং বিষয়টা জানতাম না বিধায়, ফুটনোট দেয়া হয়নি। অন্তত তিনটা বই থেকে কাট-পেস্ট করা হলো। মৌলিক বলতে ছিলো শুধু জমানো স্টিকারগুলো।

এখন বুঝতে পারছি বইয়ের টাইটেল আসলে সাধারণ জ্ঞান না হয়ে হওয়া উচিত ছিলো- এনসাইক্লোপেডিয়া। সংগ্রহে থাকা সব স্টিকার আর ছবি সন্ধ্যার মধ্যে লাগানো হয়ে গেলো। এবার আব্বাকে বই দেখানোর পালা, আপনার ছেলে লেখক হয়ে গেছে।

বিকালে আমরা বাসায় থাকলে সাধারণত খুব চিল্লাপাল্লা করতাম, বারান্দায় পানি ঢেলে নদী-নদী খেলতাম, অথবা বালিশের উপরে চড়ে ঘোড়া-ঘোড়া খেলতাম। সেদিন কোনো চিল্লাপাল্লা নেই। আম্মা বিকালে এসে একবার দেখে গেলেন আমরা তিন ভাই মনোযোগ দিয়ে বই কাটছি আর খাতায় সেগুলোকে আঠা দিয়ে আটকাচ্ছি। আম্মা কিছু বললেন না।

সন্ধ্যায় আব্বা আসলে আমরা বই দেখালাম। আব্বা দেখে খুব খুশি হলেন-

সাধারণ জ্ঞানের বই লেখছো?

জ্বি আব্বা...

কয়টা বই নষ্ট করছো?

তিনটা আব্বা...

আচ্ছা... আবার নিয়া আসবো বই... এর পরের বই কি নিয়া লেখবা...

ডাকটিকেট নিয়া...

আব্বা বুঝতে পারলেন তার দীর্ঘদিনের জমানো ডাকটিকিটের ডায়েরী এখন বিপন্ন অবস্থায় আছে। এরপরের কিছুদিন আমরা আর ডাকটিকিটের ডায়েরীটা খুঁজে পেলাম না। অনেক বড় হওয়ার পর যখন হাইস্কুলে গেলাম তখন আব্বার বুকশেলফের ভেতরে সেটাকে পেলাম। কিন্তু তখন আর ডাকটিকিট নিয়ে বই লেখার আগ্রহ নেই।

সাধারণ জ্ঞান বইটি আমার লেখা একমাত্র এনসাইক্লোপেডিয়া, যেটার পাণ্ডুলিপি কালের বিবর্তনে হারিয়ে গেছে।